গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

নীহার চক্রবর্তী / দুটি গল্প

ফুরায় শুধু চোখে

বুড়ো হরলাল এখনো নিজেকে তার পাড়ার মাথা বলে মনে করে । সব ব্যাপারে আগে ছোটে । কান খাঁড়া করে সব শুনে নিজের মত জানায় । তার মতগুলো এ যুগের মতো নয় । আগের বিশ্বাস নাকি এ যুগ চলে না । তাই নাকচ হয়ে যায় তার সব কথা । হরলাল হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরে নিজের স্ত্রীকে বলে,সব মরুক গা । স্ত্রী মুখ-ভার করে বলে ওঠে,তোমার সম্মান বলে কিছু নেই ? যাও কেন ওদের মধ্যে,শুনি ?
হরলাল ফোকলা হেসে উত্তর দেয়,অতীত আর স্মৃতির কোন সম্মান আছে ? নেই বলেই তো কারো পিছু ছাড়ে না । আমি সেই অতীত আর স্মৃতির প্রতিনিধি । কেউ আমাকে থামাতে পারবে না ।
সেদিন জিতে গেলো হরলাল । তার পাড়ায় এক প্রবীণ মানুষ কেষ্ট দত্ত মধু ঢালীর মেয়ের উঁচু বুকে রাতের অন্ধকারে মোলায়েম করে হাত দিয়েছে । সে নিয়েই কথা হচ্ছিলো । হরলালের থেকে কেষ্ট দত্ত বছর পাঁচেকের ছোটো হবে । তাই সবাই মিলে হরলালকেই চেপে ধরল । রাগত-স্বরে তাকে বলা হল,’’আপনি কী বলেন এ ব্যাপারে ?
শুনে হরলাল একচোট হেসে বলে উঠলো,দোষ আমি কেষ্টর দেখছি না । মধু ঢালীর মেয়ের উঁচু বুক থেকে অতীত নড়ে উঠতেই পারে । এমনই সে । বিদেয় দিলেও আবার ফিরে আসে । এই আমার মতো । তার কথা শুনে তরুণ যুবক দিনেশ বলে,এর মানে কী ? আপনি কেষ্ট হারামির পক্ষে ?
হরলাল সহাস্যে জবাব দেয়,বিপক্ষে তো নয়ই । কীভাবে হওয়া যায় ? আমি পুরনো মানুষ । পুরনোদের নিয়েই চলতে ভালোবাসি । আমার অমন ইচ্ছে হবে কিনা বলতে পারছি না । এ যুগ যত অপমান করবে অতীতকে,ততই সে ফুঁসে উঠবে তার কথা বিলক্ষণ বুঝল হরলালের প্রতিবেশী রাখাল দাস । তাই সে উত্তর দিলো বলিষ্ঠ-কণ্ঠে,যুগ ভাগ কর না কেউ । অমৃত আর গরল বুঝতে সবাই একসাথে হও । নইলে কপালে সবার কষ্ট আছে । হরলালদাকে তোমরা তো মানুষ বলেই ভাবো না । দেখিনি বুঝি আমি ? তার কথা শুনে অনেকেই লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো ।
হরলাল রাখাল দাসের কাঁধে হাত দিয়ে বাড়ির দিকে আসতে আসতে বলল,বেশ বলেছ,ভাই । তবে আমি আর ওদের মধ্যে যাবো না । আমাকেই কোনোদিন কেষ্ট দত্তর লোক বুঝে পিটুনি দেবে । তার কথায় সহমত হয়ে রাখাল দাস বলল সখেদে,হ্যাঁ,দাদা । আর নয় । এখনো সম্মান বলে তো আপনার কিছু আছে

অচিন-জননী

শিবেন মিত্তির গলি মানেই পতিতাদের গলি । একটু বেলা বাড়া থেকে সন্ধে পর্যন্ত মেয়েরা গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেজে-গুজে । ওদের মাঝে এক বুড়ী মতো মহিলাকেও দেখা যায় । অসিত অফিসে আসতে-যেতে তাকে দেখে । কখনো দেখা যায় সে হাসি-খুশি । কখনো বা খুব বিষণ্ণ । অসিত দেখে খুব অবাক হয় । তার ব্যাপারে ওর উৎসাহ খুব বেশী । কিন্তু অত মেয়ের মাঝে তার কাছে যেতে ও সাহস পায় না ।
কিন্তু অসিতের আগ্রহ দিনের পর দিন বাড়তে থাকে । মার কাছে এসে বলে সেই বুড়ীর কথা । ওর মা শুনে হাসে । অসিতকে বলে,একদিন বুড়ী-মার সঙ্গে কথা বলতেই পারিস । তুই তো আর... কিন্তু মার কথায় কোনোরকম বুকে বল পায় না ও । আমতা আমতা করে বলে,বোঝোই তো সব । অনেক চেনা মানুষ ও পথ দিয়ে যায় । মা বুঝে এক-মুখ হেসে বলে,তবে দূর থেকে তাকে প্রণাম জানাস । তোর দিদিমা-ঠাকুমার মতো হবে না ?’’ মার কথা শুনে অসিত খুব খুশী হয়ে বলে,সে হবে,মা । খুব প্রণাম করতে ইচ্ছে হয় বুড়ী-মাকে । তুমি তো দেখোনি তাকে । কেমন করে বসে থাকে যে ।
একথার পর বেশ কয়েকদিন অসিত আর বুড়ী-মাকে গলির মোড়ে দেখল না । খুব বিস্মিত হল । মনে খুব আঘাত পেলো ও । তবু প্রতিদিনের মতো মাথায় আঙুল ঠেকাতে ভুলল না । একদিন ওর মাথায় আঙুল ঠেকানো দেখে এক মেয়ে পথে উঠে এলো । অসিতের মুখোমুখি হয়ে স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করলো,কাকে রোজ ভক্তি দেখাও ? আমরা নিশ্চয় কেউ নই ? কোনোদিক দিক থেকেই আমরা নই । না বয়সে,না সম্মানে । তাহলে কে গো ? বল না একবারটি ।
অসিত পথের পাশে উঠে এলো তারপর । মেয়েটাও এলো ওর সঙ্গে । এরপর চারদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে অসিত বলল মেয়েটাকে,সেই বুড়ী-মা কোথায় ? কদিন থেকে দেখি না যে । খুব ভালো লাগতো তাকে । বিশ্বাস কর আমাকে । আমার ঠাকুমার মতো বেশ খানিকটা । কোথায় সে ? অসিতের কথা শুনে মেয়েটার দুচোখ জলে ভরে গেলো । তার গাল বেয়ে টপটপ করে জল পড়তে থাকলো । দেখে অসিত প্রমাদ গুণতে শুরু করলো । বুঝল নির্ঘাত বুড়ী-মা আর নেই ।
তিনি তো কদিন আগেই মারা গেছেন । সে আপনি কী করে জানবেন ? আমাদের খুব ভালবাসতেন তিনি । হ্যাঁ,আপনার কথাও বলেছেন কয়েকবার । বলতেন দেখেই বোঝা যায় খুব ভদ্র ঘরের ছেলে হবে । তার জন্য আমরাও আপনাকে চিনে ফেলেছিলাম । নিজেদের মধ্যে আপনাকে দাদাই বলতাম । বিশ্বাস করুন ।
মেয়েটা একনাগাড়ে কথা বলার পর রুমাল দিয়ে তার চোখ মুছল । মুখে তার কষ্টের হাসি । অসিত কি বলবে আর কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না । হঠাৎ ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,ওনার কাজ হয়ে গেছে ? আমি কিছু সাহায্য করতে পারি ? সাথে-সাথে মেয়েটা বলে উঠলো বেশ বলিষ্ঠ কণ্ঠে,আমরা এখানে শরীর বেচে পয়সা নিই । তুমি তো সে ধরণের মানুষ নও । আসি ।
মেয়েটা খুব দ্রুত তার জায়গায় আবার ফিরে গেলো । তারপর রঙ-তামাশা শুরু করলো সঙ্গিনীদের সাথে । আর হাতছানি দিক-দিগন্তরে । অনেকক্ষণ হাঁ করে সেদিকে চেয়ে অসিত হাতের ঘড়ি দেখল । অফিসের সময় পেরিয়ে গেছে ওর । এবার তাই ঘরেই ফিরে যেতে হবে ওকে । আর এরপরেও অফিসে গেলে বুঝি ওর সবকিছুই মিথ্যা হয়ে যাবে ঈশ্বরের কাছে ।