গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৩

মৌ দাশগুপ্তা

 বালির ঘর

     বৃষ্টি আর মিষ্টি দুই বন্ধু নামে যেমন মিল, তেমনি বড় ভাব দুজনের এক্কেবারে মানিকজোড় যদিও দুজনের চেহারা-পত্তর, স্বভাব-চরিত্র, এমনকি পছন্দ-অপছন্দের অবধি কোন মিল নেই তবু বন্ধুত্বে কিন্তু কোন খাদ ছিলো না কি দিনই না গেছে একসময় ! যখন বৃষ্টি ছাড়া মিষ্টির একটা দিনও কাটতে চাইতনা জোড়া মানিকের মত ওরা থাকত সবসময়। ওরা একদম ছোট বেলার বন্ধু এক পাড়াতেই বাস। সেই স্কুল থেকে শুরু করে গোটা কলেজ লাইফটা ওরা একসাথে কাটিয়েছে একজনের জন্য আরেকজন ছিল প্রাণান্ত আর আজ চোখের দেখাটাও হয়না ঠিক মত !

     বৃষ্টির বাবা আচমকাই হার্ট এ্যটাকে মারা যাবার পর ওর চিররুগ্না মা একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ী চলে গেছিলেন বীরভূমের লাভপুরের বনেদী জমিদার বাড়ী আগের চেকনাই না থাকলেও জমিদারী মেজাজ, বনেদিয়ানা বা মধ্যযুগীয় নিয়ম কানুনের কোন কমতি ওবাড়িতে নেই বিশেষত কলকাতা শহরে বড় হয়ে ওঠা বাপমরা মেয়ের নিয়ম কানুন পালনে মামীমারা একটু বিশেষ দৃষ্টিই দিতেন ফলে একান্ত ইচ্ছা থাকলেও পারিপার্শ্বিক অবস্থার চাপে দুজনের যোগাযোগটা ছিন্ন হয়ে যায় অনেক চিঠি দিয়েছিল মিষ্টি, বৃষ্টি উত্তরও লিখেছিল, কিন্তু সে উত্তর যে কার অলিখিত নির্দেশে পোষ্টঅফিস অবধি পৌঁছায় নি তা কে জানে মোবাইল তো দুরঅস্ত বিশেষ প্রয়োজনে বিশেষ অনুমতি ছাড়া বাড়ীর মেয়েরা ল্যান্ডলাইন ফোনটা অবধি ব্যাবহার করতে পারত না তাই মিষ্টির লাগাতার ফোন আসলেও বৃষ্টি সময়মত সাড়া দিতে পারে নি সঠিক কারন জানতে না পেরে রাগে অভিমানে ফোন করাটাও ছেড়ে দিয়েছিল মিষ্টি ঘরবন্দী জীবনে কেমন পাগল পাগল লাগতো বৃষ্টির কিন্তু মাকে ফেলে পালানোর কোন উপায়ও তো ছিল না সে সময়ে ওর একমাত্র সঙ্গী ছিল বই ওর দাদুর নামে গ্রামে এটা লাইব্রেরী ছিল সেখান থেকে বই আনায় কোন বাধা ছিলনা খালি বাড়ী থেকে কাউকে সঙ্গী করে নিয়ে যেতে হত সাধারণত ওর মামাতো ভাই অলোকেশই সঙ্গী হত পুরানো নাম হলেও মানুষটি বিশেষ প্রবীন ছিল না সদ্য কিশোর ছেলেটিও সুন্দরী শহুরে দিদির সান্নি্ধ্য পছন্দই করত এই লাইব্রেরী গিয়েই আলাপ হয় ভাস্করের সাথে সুঠাম দোহারা চেহারার ছেলেটি গ্রামের ডাক্তারবাবুর ছেলে যাদবপুর থেকে ইলেকট্রনিক্সে বি টেক পড়ছে ছুটীছাটায় গ্রামে আসে আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত করে পরোপকার করে অলোকেশ ওরফে চিন্টুর কাছে সে একদম রিয়েল লাইফ হিরো সেই থেকেই আলাপ বৃষ্টির ছন্দহীন জীবনের এক দমকা মাতাল হাওয়া এক টুকরো বাড়তি আনন্দ জীবনটাও বেশ সহজ কথার মত বয়ে যাচ্ছিল একটানা জীবনের চেনা আর সরলরৈখিক ছন্দ একটু বেশিরকম সরলরৈখিক বলেই হয়ত একঘেঁয়েমি আর একাকীত্বে ভরা তার মাঝেই স্বপ্ন দেখতো ভাস্করকে নিয়ে কত রাত যে মনগড়া স্বপ্নের সাথে কেটেছে বৃষ্টির, তার হিসাব কে রাখে ভাস্কর কি আর বুঝতো না ? ওর পেলব ব্যাবহার, আলগা নরম চোখের চাউনি, ভাস্করের ওপর বৃষ্টির বিশেষ পক্ষপাতিত্ব চিন্টুও জানতো

     সেদিন চিন্টু ফুটবল পিটাতে আগে বেরিয়ে গেছে মামাতো বোন অনিন্দিতা বারান্দা থেকে হাত নেড়ে বাইবলে দিল, লাইব্রেরী যাবেনা, গান শেখানোর দিদিমনি আসবেন রাঁধুনী অন্নদামাসীর জ্বর মা, মামীদের অনুমতি নিয়ে বৃষ্টি একাই লাইব্রেরী গেছে ফেরার পথে ঝুপ্পুস বৃষ্টি, স্কুল মোড়ে গিয়ে একা রিকশায় উঠে বাড়ী ফিরছে ; হঠাৎ ওকে চমকে দিয়ে কোত্থেকে লাফিয়ে উঠল ভাস্কর।
- একটু লিফট নিচ্ছি, অসুবিধা আছে ?
- আসলে কেউ দেখতে পেলে... না মানে মা যদি টের পায় তাহলে...
- আরে এটা কোন ব্যাপার হল ? দাঁড়াও প্লাস্টিকের পরদাটা এক্ষুনি টেনে দিচ্ছি !
- -আমি তো ..মানে এখানে এইভাবে..
- তোমার কি হল আবার ? একি তুমি কাঁপছ কেন ? আরে কী মুশকিল, পড়ে যাবে তো ! ঠিক আছে, ডানহাতে রিকশার হুডটা ধরো ঠিক করে, বাঁহাতে আমার হাতটা ধরো দেখি উফ, কী ঠাণ্ডা হাত, তুমি বোধহয় এনিমিক, জানো তো ?


     কিছুক্ষণের নীরবতা কাটিয়ে হাসপাতালের স্টাফ কোয়াটার্সের আগে নেমে যাবার মুখে গভীর স্বরে ভাস্কর বললো, বৃষ্টি শোনো, তোমার এত ভয় কিসের ? আমায় খুব খারাপ ভাবছো কি ? আসলে জ্বর গায়ে ভিজতে ইচ্ছে করছিল না আর স্ট্যান্ডে রিক্সাও মোটে একটাই ছিল ভাবছো তো ওয়েট করলাম না কেন ? আমায় আজই ফেরত যেতে হবে আধঘন্টা পরে ট্রেন। আরো একটা কথা, তুমি মেয়েটা না খুব ভালো

     ইতিমধ্যে মামারা বয়স্থা ভাগ্নীর আইবুড়ো বদনাম ঘোচাতে উঠে পড়ে লাগায় লজ্জার মাথা খেয়ে মাকে নিজের পছন্দের কথা খুলেই বলে বৃষ্টি একে তো গয়না শাড়ীতে জড়ভরত সেজে আলুপটলের মত লোকের সামনে দাড়িয়ে, বসে, ঘুরে-ফিরে যাচাই হতে আপত্তি, তার ওপর ভাস্কর ছাড়া অন্য কারো সাথে নিজেকে কল্পনা করতেও বিশ্রী লাগতো ওর ডাক্তার বাবুরা মুখোপাধ্যায় ব্রাহ্মণ বনেদীয়ানা বা বংশগৌরবে পিছানো থাকলেও ছেলে তার পরিবারের বাকি লক্ষণগুলো মায়েরও অপছন্দ না হওয়ায় হাওয়ায় তৈরী হতে লাগলো বৃষ্টির স্বপ্নের মায়ামহল

     রাতটা গভীর আর অন্ধকার আসলে শুক্লপক্ষের ফ্যাটফেটে জোৎস্না ঢাকা পড়েছে পুঞ্জীভূত মেঘের আড়ালে   আজ সেই কালো শহরের বুকে অতন্দ্র প্রহরীর মত জেগে আছে এক আলোর মালায়, ফুলে, রঙীন বেলুনে সাজানো বিয়েবাড়ীর দোতলার একটি ঘর বউভাতের নহবতের সানাই থেমে গেছে অনেক আগে নিমন্ত্রিত অতিথিরাও ফেরত গেছেন যে যার আপন গন্তব্যে চার পাশটা ঘুমের আবেশে মগ্ন কারো কোন সাড়া নেই কোথাও চরম নিস্তব্ধতার মাঝে মাঝে পথ কুকুরের কান্না কিংবা পাহারাদারের বাঁশীর শব্দ, দু একটা গাড়ীর যান্ত্রিক আওয়াজ তুলে ছুটে যাওয়া ,পরিবেশকে আরও নিদ্রালু আর একাকী করে তুলছে রাস্তা থেকে কেউ যদি দোতলার একটা ঘরটার দিকে তাকায়, কিছুটা অবাক কি হবেনা? ঘরের বাতি একবার জ্বলছে, একবার নিভছে বেড সুইচ অন-অফের অনবরত শব্দ টিকটক,টিকটক নিশ্চুপ রাতটার মতই নিস্তব্ধ হয়ে খাটের একপাশে বসে আছে নববধু লাল বেনারসী, সোনার গয়না, ফুলের সাজ বেড সুইচটা তার হাতেই আলো-অন্ধকারের এই খেলাটা সে একা একাই খেলছে নিজের মনে আলো জ্বললেই হীরের কুচির মত ঝিকিয়ে উঠছে অশ্রুর ফোঁটা একহাতে সুইচ আরেক হাতে দলামোচড়ানো এক টুকরো কাগজ সদ্য বিবাহিত স্বামীর না ভুলতে পারা প্রথম প্রেমিকার চিঠি যে চিঠিতে এক সম্পর্ক চিরদিনের মত ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত থাকলেও যা আজকে গড়ে উঠতে চলা নতুন সম্পর্কটার ভিতটাই টলিয়ে দিয়েছে অর্ক পরিস্কার বলে দিয়েছে বাড়ীর লোকেদের, বিশেষত ওর মায়ের, চাপে পড়ে বিয়ে করলেও কোনদিনই ওর প্রথম প্রেম বা প্রেমিকাকে ভুলতে পারবে না আর যতদিন না সেটা পারবে ততদিন অন্য কাউকে স্ত্রী বলে মানতেও পারবে না তা সে যতই ওর সাথে সাতপাকে ঘুরুক না কেন

খুব বেশি কথা আমার কাছে জমা নেই অর্ক কিংবা আছে, সেসব তোমার জন্য নয় দীর্ঘদিন রইলাম তোমার হয়ে, তোমায় ভালবেসে, অভ্যাসে অনভ্যাসে, সুখে দুঃখে অথচ দেখ, তোমায় ছেড়ে যেতে একটুও কষ্ট হচ্ছেনা আমার এত ভালবাসলে আমায়, আমি কি একটুও বাসিনি তবে ? খুব বেসেছি। কিন্তু আমার ওপর তোমার অধিকার বোধ, তোমার মালিকানা, তোমার নিজস্ব পছন্দ অপছন্দগুলোকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া, আমার আলাদা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রাটাই মানতে না চাওয়াটা মনে মনে হাঁপিয়ে তুলত আমায়, হাঁপিয়ে তুলছিল আমি মুক্তি চাইছিলাম, চাইছিলাম একমুঠো আকাশ, একটু বাতাসের দমকা স্পর্শ, একটুকরো স্বাধীনতা আর আজ যে তোমায় শুধু সেইকারণেই সেভাবে ভালোবাসিনা, ভালোবাসতে পারছিনা, একথা তোমাকে জানাতে খুব খারাপ লাগছে কি ? হয়ত হ্যাঁ, আবার, হয়ত না ভাবছো তো তোমাকে বহুদিন ধরে ঠকিয়েছি ! সেজন্য সত্যি বড় কষ্ট হয়েছে বুকের ভিতর ! বার বার বলতে চেয়েছি, যে, আমি আর এই মিথ্যে সম্পর্কটাকে বিশ্বাসহীনতার চোরাবালির ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে পারছিনা, অথচ যতবার এসব বলতে গিয়ে তোমার মুখের দিকে তাকিয়েছি, ভেসে গেছি তোমার ভালোবাসার উচ্ছ্বাসে, মাদকতায়, সমর্পনে। আমার মনের মানুষটিকে তোমার চেনার কথা নয় তোমার চোখের আড়ালে ওর সাথে আমার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সেও তো কম দিন হলনা আজ আর এসব কথার কোন অর্থ নেই দুই পরিবারের সম্মতিতেই আমরা বিয়ে করে নিয়েছি অর্ক খুব নরম মনের ভালো মানুষ বিশ্বাস কর, খুব সুখে থাকব আমি ওর সাথে আমায় নিয়ে আর না ভেবে নিজের খেয়াল রেখো ওটাই বাস্তব একা থেক না আর প্রেম প্রেম খেলার রিস্কও নিও না পারলে খুব তাড়াতাড়ি একটা বিয়ে করে নিও  

মিষ্টি

চিঠির সাথে খামের ভেতরে একটা ফটোগ্রাফও ছিল, আপাতত বৃষ্টির কোলের ওপরই পড়ে আছে সেটা বিয়ের পোশাকে হাসিমুখে এক নবদম্পতি, খুব চেনা, খুব কাছের দুটি মানুষ মিষ্টি আর ভাস্কর