বরই ফুল
- এটা
দিয়ে আমরা ছেলেবেলায় নাকফুল বানাতাম ।
- সে কি
বরই ফুলের নাকছাবি! নাকে বসাতে কিভাবে ?
- কেন
নাকফুল যেখানে পড়ি । - অ্যাঁ কি বলছো ? ছেলেবেলায় নাক ফুঁড়িয়েছো ?
- হ্যাঁ,
আমাদের গাঁও গেরামে
ছোট বেলাতেই নাক ছ্যাদা করে দেয়া হয় ।
রিনি আর
সুস্মির কথোপকথন চলছিলো একটা বরই ফুলকে ঘিরে । সুস্মি নাইনে পড়ে, আজন্ম শহুরে । টি ভিতে দেখেটেখে গ্রাম
চেনে । সে তার নাক হাত বুলিয়ে দেখছিলো । আরিব্বাস সে এই নাক ফোঁড়াবে না কখনই না ।
রিনি সুস্মির বড় খালার ননদের মেয়ে ।
সুস্মিতা
থেকে সুস্মি, তারপর
সুশি । মেয়েটা খুব খেপে যায় এই নামে ডাকলে, “শেষতক আমাকে জাপানি খাবার বানিয়ে দিলে”! লতা হেসে ফেলে, নিপন
অবশ্য বেশ একটা ভারিক্কি ভাব রেখে বলে, “খুবই ডেলিশাস খাবার মা মনি” । ওরা সুস্মির বাবা মা । বাবার এই কথাটায়
মুখ ভেংচায় সে, “ইশ রে
কাঁচা মাছ “! হ্যাঁ, কাঁচা
কিন্তু ওটাকে এমন ভাবে কাটা হয় যেন একটা ধবধবে ফুল । তারপর হরেক সস আর সল্ট মাখিয়ে
খাওয়া, আহা ! বাবা বোধহয়
একটু উদাস হয়ে পড়েন, হয়তো
তার জাপানে কাটানো প্রায় আঠারটা বছরের কথা মনে পড়ে যায় ।
সুস্মির
বয়স পনের । অস্থির বয়স, এ বয়সে
প্রকৃতির মত মনের রঙ বদলায় । ঐ পাশের চারতলায় যে ছেলেটা একমনে পড়ছে কিংবা পড়ার ভাণ
করছে তাকে দেখতে ভালো লাগে সুস্মির । এমন নয় যে ব্যাপারটা একতরফা ঘটছে । ছেলেটাও
লাজুক ভঙ্গিতে সুস্মিকে দেখে । এটা নিয়মিত রুটিনের মতই হয়ে দাঁড়িয়েছে । দু 'বছর আগেও তার মনোজগতে এরকম অনুভবের বালাই
ছিলো না । একটা গল্পের বই সামনে খুলে গান ছাড়ে সুস্মিতা, তারপর ভাবনার লাগাম ছেড়ে দেয় । গতবছরও সে
মায়ের সাথে অকপট ছিলো অথচ এখন অর্থহীন সব আড়াল । এরকম হওয়ার কথা ছিলো না । সুস্মি
সব কথাই লতাকে বলে দিত । মা মেয়ের যুগলবন্দী । তারপরই ঘটনাটা ঘটলো ।
ঘটনাটার
মাঝে সুস্মির হাত ছিলো সামান্যই । পাশের বাসায় যে ছেলেটা থাকে, সুস্মিকে দেখলেই ইঁশারায় কিছু বলতো ।
একদিন কোন আকর্ষণী খেয়ালে সে ও হাত নাড়লো ছেলেটির উদ্দেশ্যে । ব্যাস, পরদিন এক প্রেমপত্র এলো বাসায়, কুৎসিত ভুল বানানে লেখা, ”লাব ইউ জানু, আমারে কল করো, এই
আমার নাম্বার, চুমা” । এই চিঠি পড়লো লতার
হাতে । এহেন কথাবার্তা পড়ে ভয়ে হিম হয়ে ডাকলো মেয়েকে । সুস্মি ভয়ে ভয়ে সবই বলে দিলো মা কে । অতঃপর মেয়ের ছাদে
যাওয়া নিষিদ্ধ হলো ।
সেই
পর্যন্ত ঠিক ছিলো কিন্তু অতি ক্রোধে পাড়ার এক সিনিয়র নেতার কাছে নালিশ ঠুকে দিলো
সে । প্রচণ্ড মার খেলো প্রেমিক প্রবর আর পাড়ায় রটে গেলো আরেক কেচ্ছা, বেশীর ভাগেরই মতামত, “মাইয়া ভালা না । হুদাহুদি পোলায় চিডি দিব
ক্যান ! মাইয়া ছাদে উইঠ্ঠা রঙ্গ তামাশা করতো” । শেষতক এলাকা ছাড়তে হলো তাদের ।
এরপর থেকে মা কে ভয় পায় সুস্মি, সব কথা শেয়ার করে না তার সাথে । অবশ্য ফেলে আসা পৌষের দিনটার মত ভুলও
করে না । তবু বয়সের বসন্ত তাকে কাঁপায় ।
সুস্মিকে
চোখে চোখে রাখে লতা । এটা ভারী অস্বস্তিকর তার জন্য । নিপন এমন নয় বরং অদ্ভুত এক
উদাসীন মানুষ সে । কিন্তু অন্যরকম কিছু দিন প্রায়ই আসে, এই যখন তারা খালার বাসায় যায় কিংবা খালা
এলে বেশ জমে । বিশেষ করে রিনি এলে । রিনি খালার বাসায় থেকে লেখাপড়া করে, বদরুন্নেসা কলেজে । রিনির সমবয়সিরা সবাই
ছেলেপুলের মা হয়ে গেছে কিন্তু তার বিয়ে হয়নি । সে দেখতে ভালো নয় । পণ দিয়েও
সম্পর্ক গড়া হয়নি, মন
দেয়ার মত কেউ মেলেনি । রিনির কষ্ট সুস্মিকে স্পর্শ করে । টবে লাগানো বরই গাছটায়
ফুল এসেছে । প্রতিবছরই আসে । হাতের তালুতে কারুকার্যময় ফুলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে
করতে রিনিকে দেখে সে । বরইফুল নাকছাবিতে মেয়েটাকে বড় সুন্দরী মনে হয় তার ।