গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৩

সাঈদা মিমি

বরই ফুল

- এটা দিয়ে আমরা ছেলেবেলায় নাকফুল বানাতাম ।
- সে কি বরই ফুলের নাকছাবি! নাকে বসাতে কিভাবে ?
- কেন নাকফুল যেখানে পড়ি । - অ্যাঁ কি বলছো ? ছেলেবেলায় নাক ফুঁড়িয়েছো ?
- হ্যাঁ, আমাদের গাঁও গেরামে ছোট বেলাতেই নাক ছ্যাদা করে দেয়া হয় ।

     রিনি আর সুস্মির কথোপকথন চলছিলো একটা বরই ফুলকে ঘিরে । সুস্মি নাইনে পড়ে, আজন্ম শহুরে । টি ভিতে দেখেটেখে গ্রাম চেনে । সে তার নাক হাত বুলিয়ে দেখছিলো । আরিব্বাস সে এই নাক ফোঁড়াবে না কখনই না । রিনি সুস্মির বড় খালার ননদের মেয়ে

     সুস্মিতা থেকে সুস্মি, তারপর সুশি । মেয়েটা খুব খেপে যায় এই নামে ডাকলে, “শেষতক আমাকে জাপানি খাবার বানিয়ে দিলে”!  লতা হেসে ফেলে,  নিপন অবশ্য বেশ একটা ভারিক্কি ভাব রেখে বলে, “খুবই ডেলিশাস খাবার মা মনি” ।  ওরা সুস্মির বাবা মা । বাবার এই কথাটায় মুখ ভেংচায় সে, “ইশ রে কাঁচা মাছ “! হ্যাঁ, কাঁচা কিন্তু ওটাকে এমন ভাবে কাটা হয় যেন একটা ধবধবে ফুল । তারপর হরেক সস আর সল্ট মাখিয়ে খাওয়া, আহা ! বাবা বোধহয় একটু উদাস হয়ে পড়েন, হয়তো তার জাপানে কাটানো প্রায় আঠারটা বছরের কথা মনে পড়ে যায় ।
সুস্মির বয়স পনের । অস্থির বয়স, এ বয়সে প্রকৃতির মত মনের রঙ বদলায় । ঐ পাশের চারতলায় যে ছেলেটা একমনে পড়ছে কিংবা পড়ার ভাণ করছে তাকে দেখতে ভালো লাগে সুস্মির । এমন নয় যে ব্যাপারটা একতরফা ঘটছে । ছেলেটাও লাজুক ভঙ্গিতে সুস্মিকে দেখে । এটা নিয়মিত রুটিনের মতই হয়ে দাঁড়িয়েছে । দু 'বছর আগেও তার মনোজগতে এরকম অনুভবের বালাই ছিলো না । একটা গল্পের বই সামনে খুলে গান ছাড়ে সুস্মিতা, তারপর ভাবনার লাগাম ছেড়ে দেয় । গতবছরও সে মায়ের সাথে অকপট ছিলো অথচ এখন অর্থহীন সব আড়াল । এরকম হওয়ার কথা ছিলো না । সুস্মি সব কথাই লতাকে বলে দিত । মা মেয়ের যুগলবন্দী । তারপরই ঘটনাটা ঘটলো ।

     ঘটনাটার মাঝে সুস্মির হাত ছিলো সামান্যই । পাশের বাসায় যে ছেলেটা থাকে, সুস্মিকে দেখলেই ইঁশারায় কিছু বলতো । একদিন কোন আকর্ষণী খেয়ালে সে ও হাত নাড়লো ছেলেটির উদ্দেশ্যে । ব্যাস, পরদিন এক প্রেমপত্র এলো বাসায়, কুৎসিত ভুল বানানে লেখা, ”লাব ইউ জানু, আমারে কল করো,  এই আমার নাম্বার, চুমা” । এই চিঠি পড়লো লতার হাতে । এহেন কথাবার্তা পড়ে ভয়ে হিম হয়ে  ডাকলো মেয়েকে । সুস্মি ভয়ে ভয়ে সবই বলে দিলো মা কে । অতঃপর মেয়ের ছাদে যাওয়া নিষিদ্ধ হলো ।

     সেই পর্যন্ত ঠিক ছিলো কিন্তু অতি ক্রোধে পাড়ার এক সিনিয়র নেতার কাছে নালিশ ঠুকে দিলো সে । প্রচণ্ড মার খেলো প্রেমিক প্রবর আর পাড়ায় রটে গেলো আরেক কেচ্ছা, বেশীর ভাগেরই মতামত, “মাইয়া ভালা না । হুদাহুদি পোলায় চিডি দিব ক্যান ! মাইয়া ছাদে উইঠ্ঠা রঙ্গ তামাশা করতো” । শেষতক এলাকা ছাড়তে হলো তাদের । এরপর থেকে মা কে ভয় পায় সুস্মি, সব কথা শেয়ার করে না তার সাথে । অবশ্য ফেলে আসা পৌষের দিনটার মত ভুলও করে না । তবু বয়সের বসন্ত তাকে কাঁপায় ।

     সুস্মিকে চোখে চোখে রাখে লতা । এটা ভারী অস্বস্তিকর তার জন্য । নিপন এমন নয় বরং অদ্ভুত এক উদাসীন মানুষ সে । কিন্তু অন্যরকম কিছু দিন প্রায়ই আসে, এই যখন তারা খালার বাসায় যায় কিংবা খালা এলে বেশ জমে । বিশেষ করে রিনি এলে । রিনি খালার বাসায় থেকে লেখাপড়া করে, বদরুন্নেসা কলেজে । রিনির সমবয়সিরা সবাই ছেলেপুলের মা হয়ে গেছে কিন্তু তার বিয়ে হয়নি । সে দেখতে ভালো নয় । পণ দিয়েও সম্পর্ক গড়া হয়নি, মন দেয়ার মত কেউ মেলেনি । রিনির কষ্ট সুস্মিকে স্পর্শ করে । টবে লাগানো বরই গাছটায় ফুল এসেছে । প্রতিবছরই আসে । হাতের তালুতে কারুকার্যময় ফুলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে রিনিকে দেখে সে । বরইফুল নাকছাবিতে মেয়েটাকে বড় সুন্দরী মনে হয় তার ।