গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৩

সুবীর সরকার

গানমাস্টার

গান গান করিয়া সর্বনাশ
 তবু না মেটে গানের হাউস

     খুব বেশি শীত খীব জাড় বাহে হাড়ের ভিতর সেঁধিয়ে যায় আলতাফ করাতী কুয়াশা দলা দলা অগুণতি পাখিরা কূয়াশাবাড়ীর দিকে । শূন্য সব মাঠে মাঠে শিশির-শব্দ । কোথাও কী যাওয়ার থাকে মানুসের ? পাখির ডানার নীচে হেঁটে যেতে যেতে স্মৃতিতাড়িত এক যাপনই সামনে এসে পড়ে বুঝি । শীতের রহস্যময় রাতগুলি যেন না ফুরতে চাওয়া কীসসাগাথা । অনেকানেক প্রান্তরের জেগে থাকা গানবাড়িগুলি তাকে প্ররোচিত করলেই আমোদিত হবার বহুবর্ণ উপাদান সমেত সম্পন্নতায় আশ্চর্য মিশে যায় কুয়াসা ঘেরা চাঁদের আলোর খদলে । এতএতোর ফাঁকে কখন দোতরা বাহিত ঢোল বাঁশি, সারিন্দা বাহিত জীবনযাপন নিয়েই কখন ধনী বাড়ীর খোলানে এসে দাঁড়ায় গানমাষ্টার ছায়াময় মায়াময় সব দোহার বাদকবৃন্দ সমেত

                                                
       ২

মাছ মারে মাছুয়া
দোলাবারিত হালুয়া

     চার পাঁচ কুড়ির মাঝামাঝি বয়সের গানমাস্টার ভুলে গেছে তার নিজনাম ৮/৯ বয়স থেকেই বাপের বাপ চন্দ্রকান্ত অধিকারির সঙ্গে  গানের দলে কেবল ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কখন যৌবন এসে গিয়েছিল, তারপর বাপ ধনকান্তর দলের মূল গিদাল হল সে । বাপের বাপ চন্দ্রকান্ত খুব ভালবাসতেন এই নাতিটিকে চন্দ্রকান্তই তার দীক্ষাগুরু, শিক্ষাগুরু চন্দ্রকান্ত তাকে জীবন শিখিয়েছেন । চিনিয়েছেন । গানের তত্ত্বতালাশ মনোশীখন শিখিয়েছেন ; বুঝতে শিখিয়েছেন-লোকগান হল সাধনা, জীবনবন্দনা । সেই থেকে দিনকাল পেরিয়ে দেশাচার লোকাচার গঞ্জ মানুষ নদী-দিঘি মেলা-মহোৎসব ছুঁয়ে ছুঁয়ে চন্দ্রকান্তর বড়ো বেটার বড়ো বেটা রতিকান্ত নাম হারিয়ে মাইল মাইল জঙ্গল, জনপ্‌ হাওড় হাওয়ার এক পৃথিবীর গান মাস্টার । যার গানে যার বাদ্য বাজনায় অতি প্রাকৃত পাখিরা , মানুষেরা চিরকালীন হয়ে যেতে থাকে

                                                    
        ৩

রসিয়া বসাইছে ফান্দ
বানিয়া বসাইছে ফান্দ

     সে কবেকার কথা । বৃটিশ আমল । চারদিকে কত কত জোতদার । পুবে জয়নাব মুন্সি খামারু জোতদার সরকারবাবু ফণিমোহন তো উত্তরে ঢোল দেওয়ানি খগেন বসুনিয়া হাতি জোতদার । নিজ চোখে কতবার দেখা হাতির পিঠেতে চড়ে জোতদারের গমনাগমন । ভবতারণ ধনির বাড়িতে রাসযাত্রা হত । পালোয়ানি কুস্তির লড়াই কুশান যাত্রা দোতারা পালার আসর, সে এক ধুন্ধুমার বেপার । একবার রানিরহাটের এক গানবাড়িতে সে দেখেছিল কোচবিহারের এক রানিকে । পাতলা খাওয়ার জঙ্গল থেকে চিতা বাঘ বেরিয়ে আসতো মাঝে মাঝে । ও ছিল কোচবিহার রাজার রিজার্ভ ফরেষ্ট । গান মাস্টার একবার রাজাদিঘির খেলার মাঠে পালা গাইতে গিয়েছিল । রাতভর পালা শেষ করে ফিরে আসার পথে দেখেছিল হাতির জুলুস আসছে । বাজনা বাজছে । পথের দু পাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে মানুসেরা । জানা গেল মহারাজা আসছেন শিকারক্যাম্পে । একঝলক দেখেওছিল বুঝি রাজাবাহাদুরকে !

     
         ৪

নিধুয়া পাথারে
ও কালা, যাইও না

     এইভাবে একপর্বে গানমাষ্টার কিংবদন্তির মত হয়ে ওঠে । হারাতে হয় নিজ নাম । তার গান, গায়নভঙ্গি কণ্ঠের জাদু তাকে লোকপ্রিয় করে তলে । উত্তীর্ণ হয় গানমাস্তারে । গৌরিপুরের রাজার বেটি নিহারবালার ডাকে সে ঘুরে বেড়ায় গৌরিপুর আভয়াপুরি গদাধরের ভূগোলে ভূগোলে । কত গান কত বাদক গিদাল লোক মানুষের উত্তাপ তাকে অঙ্গে মাখতে হয় । সে সব বড়ো যুদ্ধের সময়কালের । ঐ যেবার বোমা পড়ল । হিটলারের নাম প্রথম যেবার শুনল গানমাষ্টার । আর গরুর গাড়ির নিচে শীত রাতের লণ্ঠন দোলে ভয় ও ত্রাসে ।

            
            ৫

মানসীর বাড়িত মানসী নাই
সুকান দিঘিত পানি নাই

     এইভাবে একটানা আমাকে শুনে ফেলতে হয় আখোড়টি । গানমাস্টারের গল্পটি । ১৯৪৫ এর পৃথিবী ২০১৩ তে এসে থমকে দাড়ায় । তখন টাড়িবাড়ি বাতাস আকাশ রাজা জোতদার শিকার- টিকার, দোতরা সারিন্দার দীর্ঘ পরিভ্রমণ সাঙ্গ হতে না চাইলেও ইতিহাস পুরানকে নুতনভাবে জাগিয়ে তোলার প্রয়াস সচেতনভাবেই জারি থাকে । দূরের মাঠ নদী থেকে হাওয়া আসে ।
হাওয়ায় জাগে শত শেয়ালের ডাক । মাঘনিশিথের কোকিল । জিনপরিময় সময়-ক্রম । সব কিছু না সরিয়েও বুঝে নিতে পারি কোথাও বিনির্মিত হচ্ছে নিম্নবর্গীয়দের ইতিহাস, যার ভিতর বাদ্য বাজাতে বাজাতে হেঁটে আসছেন আমোদিত এক গানমাস্টার।