গান গান করিয়া
সর্বনাশ
তবু না মেটে গানের হাউস
খুব বেশি শীত । খীব জাড় বাহে । হাড়ের ভিতর সেঁধিয়ে
যায় আলতাফ করাতী । কুয়াশা দলা দলা । অগুণতি পাখিরা
কূয়াশাবাড়ীর দিকে । শূন্য সব মাঠে মাঠে শিশির-শব্দ । কোথাও কী
যাওয়ার থাকে মানুসের ? পাখির ডানার নীচে হেঁটে যেতে যেতে
স্মৃতিতাড়িত এক যাপনই সামনে এসে পড়ে বুঝি । শীতের রহস্যময় রাতগুলি যেন না ফুরতে
চাওয়া কীসসাগাথা । অনেকানেক প্রান্তরের
জেগে থাকা গানবাড়িগুলি তাকে প্ররোচিত করলেই আমোদিত হবার বহুবর্ণ উপাদান সমেত
সম্পন্নতায় আশ্চর্য মিশে যায় কুয়াসা ঘেরা চাঁদের আলোর
খদলে । এতএতো’র ফাঁকে কখন দোতরা বাহিত ঢোল বাঁশি, সারিন্দা বাহিত
জীবনযাপন নিয়েই কখন ধনী বাড়ীর খোলানে এসে দাঁড়ায় গানমাষ্টার ছায়াময় মায়াময় সব
দোহার বাদকবৃন্দ সমেত ।
২
মাছ মারে মাছুয়া
দোলাবারিত হালুয়া
দোলাবারিত হালুয়া
চার পাঁচ কুড়ির মাঝামাঝি বয়সের গানমাস্টার
ভুলে গেছে তার নিজনাম । ৮/৯ বয়স থেকেই বাপের বাপ চন্দ্রকান্ত অধিকারির
সঙ্গে গানের দলে কেবল ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে
কখন যৌবন এসে গিয়েছিল, তারপর বাপ ধনকান্তর দলের মূল গিদাল হল সে ।
বাপের বাপ চন্দ্রকান্ত খুব ভালবাসতেন এই নাতিটিকে । চন্দ্রকান্তই তার
দীক্ষাগুরু, শিক্ষাগুরু । চন্দ্রকান্ত তাকে জীবন শিখিয়েছেন । চিনিয়েছেন । গানের
তত্ত্বতালাশ মনোশীখন শিখিয়েছেন ; বুঝতে শিখিয়েছেন-লোকগান
হল সাধনা, জীবনবন্দনা । সেই থেকে দিনকাল পেরিয়ে দেশাচার
লোকাচার গঞ্জ মানুষ নদী-দিঘি মেলা-মহোৎসব ছুঁয়ে ছুঁয়ে চন্দ্রকান্তর বড়ো বেটার বড়ো বেটা রতিকান্ত নাম হারিয়ে মাইল মাইল
জঙ্গল, জনপ্ হাওড় হাওয়ার এক পৃথিবীর গান মাস্টার । যার গানে যার বাদ্য বাজনায় অতি প্রাকৃত পাখিরা , মানুষেরা চিরকালীন হয়ে যেতে থাকে ।
৩
রসিয়া বসাইছে ফান্দ
বানিয়া বসাইছে ফান্দ
বানিয়া বসাইছে ফান্দ
সে কবেকার কথা । বৃটিশ আমল । চারদিকে কত
কত জোতদার । পুবে জয়নাব মুন্সি খামারু জোতদার সরকারবাবু ফণিমোহন তো উত্তরে ঢোল
দেওয়ানি খগেন বসুনিয়া হাতি জোতদার । নিজ চোখে কতবার দেখা হাতির পিঠেতে চড়ে
জোতদারের গমনাগমন । ভবতারণ ধনির বাড়িতে রাসযাত্রা হত । পালোয়ানি কুস্তির লড়াই
কুশান যাত্রা দোতারা পালার আসর, সে এক ধুন্ধুমার
বেপার । একবার রানিরহাটের এক গানবাড়িতে সে দেখেছিল কোচবিহারের এক রানিকে । পাতলা খাওয়ার
জঙ্গল থেকে চিতা বাঘ বেরিয়ে আসতো মাঝে মাঝে । ও ছিল কোচবিহার রাজার রিজার্ভ ফরেষ্ট
। গান মাস্টার একবার রাজাদিঘির খেলার মাঠে পালা গাইতে গিয়েছিল । রাতভর পালা শেষ
করে ফিরে আসার পথে দেখেছিল হাতির জুলুস আসছে । বাজনা বাজছে । পথের দু পাশে সার
বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে মানুসেরা । জানা গেল মহারাজা আসছেন শিকারক্যাম্পে । একঝলক
দেখেওছিল বুঝি রাজাবাহাদুরকে !
৪
নিধুয়া পাথারে
ও কালা, যাইও না
ও কালা, যাইও না
এইভাবে একপর্বে গানমাষ্টার কিংবদন্তির মত
হয়ে ওঠে । হারাতে হয় নিজ নাম । তার গান, গায়নভঙ্গি কণ্ঠের
জাদু তাকে লোকপ্রিয় করে তলে । উত্তীর্ণ হয় গানমাস্তারে । গৌরিপুরের রাজার বেটি
নিহারবালার ডাকে সে ঘুরে বেড়ায় গৌরিপুর আভয়াপুরি গদাধরের ভূগোলে ভূগোলে । কত গান
কত বাদক গিদাল লোক মানুষের উত্তাপ তাকে অঙ্গে মাখতে হয় । সে সব বড়ো যুদ্ধের
সময়কালের । ঐ যেবার বোমা পড়ল । হিটলারের নাম প্রথম যেবার শুনল গানমাষ্টার । আর
গরুর গাড়ির নিচে শীত রাতের লণ্ঠন দোলে ভয় ও ত্রাসে ।
৫
মানসীর বাড়িত মানসী
নাই
সুকান দিঘিত পানি নাই
সুকান দিঘিত পানি নাই
এইভাবে একটানা আমাকে শুনে ফেলতে হয় আখোড়টি
। গানমাস্টারের গল্পটি । ১৯৪৫ এর পৃথিবী ২০১৩ তে এসে থমকে দাড়ায় । তখন টাড়িবাড়ি বাতাস
আকাশ রাজা জোতদার শিকার- টিকার, দোতরা সারিন্দার দীর্ঘ পরিভ্রমণ সাঙ্গ হতে না
চাইলেও ইতিহাস পুরানকে নুতনভাবে জাগিয়ে তোলার প্রয়াস সচেতনভাবেই জারি থাকে । দূরের
মাঠ নদী থেকে হাওয়া আসে ।
হাওয়ায় জাগে শত শেয়ালের ডাক । মাঘনিশিথের কোকিল
। জিনপরিময় সময়-ক্রম । সব কিছু না সরিয়েও বুঝে নিতে পারি কোথাও বিনির্মিত হচ্ছে
নিম্নবর্গীয়দের ইতিহাস, যার ভিতর বাদ্য বাজাতে বাজাতে হেঁটে
আসছেন আমোদিত এক গানমাস্টার।