[গত সংখ্যার পর]
“তুমি এলে মাটি কেঁপে ওঠে হাওয়ার
“তুমি এলে মাটি কেঁপে ওঠে হাওয়ার
আবির সামনে পেছনে মাঠ মাঠ
আর মাঠ মাঠের ওপারে নামে
সন্ধ্যা আর
সেঁজুতির
বারণ, তরাস
দুলে ওঠে ঘর বাড়ি
চোখের পাতায়
তমিস্ত্রা ভাঙার দারুণ আহ্বান
তুমি এলে শহর
সাজিয়ে রাখি রাত্রি হীনযান
তোমাকেই ছুঁয়ে বসে থাকি নিষ্পন্দ
শরীরে বরফের কুঁচি আকাশ আবার এক
অন্ধকার নিয়ে দ্রাঘিমায় লাফ দিল
আগুন বলয়ে কারা খুঁজেছিল নাভি,
প্রিয়তমা নারী ?
আমি তবু অন্ধকারে শব্দের কাণ্ডারী” !
সেঁজুতির
বারণ, তরাস
দুলে ওঠে ঘর বাড়ি
চোখের পাতায়
তমিস্ত্রা ভাঙার দারুণ আহ্বান
তুমি এলে শহর
সাজিয়ে রাখি রাত্রি হীনযান
তোমাকেই ছুঁয়ে বসে থাকি নিষ্পন্দ
শরীরে বরফের কুঁচি আকাশ আবার এক
অন্ধকার নিয়ে দ্রাঘিমায় লাফ দিল
আগুন বলয়ে কারা খুঁজেছিল নাভি,
প্রিয়তমা নারী ?
আমি তবু অন্ধকারে শব্দের কাণ্ডারী” !
বিদিশা সরকারের এই কবিতাটি পড়তে পড়তে
মনে হলো আজ যদি বৈদেহীকে দাঁড় করিয়ে বলি, প্রিয়তমা নারী ? আমি তবু অন্ধকারে
শব্দের কাণ্ডারী! বৈদেহী কি বুঝবে
আমার রাত জাগা চোখে ওর নিদারুণ উত্পাত । বুকের ভেতর সাহস সঞ্চয় করি । স্কুলের সামনে এসে
দাঁড়িয়ে আবার হাঁটছি আবার দাঁড়াছি আসলে কি
করবো বুঝতে পারছিন বুকের ভেতরটা শুকিয়ে
যাচ্ছে আসলে এই বয়সে এসে ভালোবাসি
কি বলা যায় এটা কি শোভন হবে ? স্কুলের বেলের চেয়ে বেশি আওয়াজ এখন
বুকের ভেতর। ঘুরে আবার হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে
দাঁড়িয়েছি স্কুল গেটের পাশে । 'আরে দাদা এখানে
প্রায়ই দেখছি ব্যাপারটা কি ? 'দারোয়ান এর কথায় ভড়কে গেলাম । কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে একটু গম্ভীর
হয়ে উত্তর দিলাম দিদিমনির সাথে একটু কথা আছে ।
দারোয়ানটা
আরো কিছু হয়ত বলতো তক্ষুনি কলাপাতা রঙের শাড়িতে বৈদেহী একপলক তাকিয়ে হেঁটে বেরিয়ে
গেলো । বৈদেহীর এই আচরণটা ঠিক মাথায় ঢুকলো না। মন বললো হয়ত দেখেনি কিন্তু চোখ বলছে
দেখেছে । এই যে দাদা সব দিদিমনি তো বেরিয়ে গেছে আপনি কাক বলুন তো? দারোয়ানের
কথায় ঘোর কাটে আসেনি বোধ হয় আজ বলেই আমি হাঁটতে থাকি । বৈদেহী এমন করলো কেন ? নিজের
সাথে নিজের প্রশ্ন উওরের খেলা খেলতে খেলতে স্কুল পেরিয়ে অনেকটা পথ এগিয়ে হাসপাতাল
মোড়ের কাছে এসে দেখি বৈদেহী ট্রাফিক পুলিশের ডান পাশে কমিনিউটি সেন্টারের নীচে
দাঁড়িয়ে আছে । পলকে মনে হলো এ প্রতীক্ষা আমার জন্য নয় । ইচ্ছে করেই একটু আড়াল করে
দাঁড়ালাম । বৈদেহী ঘড়ি দেখছে আর রাস্তার এদিক ওদিক দৃষ্টি রেখে কাকে যেন খুঁজচ্ছে ।
আমার খুব কষ্ট লাগছে বুকটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।চোখটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে
এলো ।বৈদেহী এই জন্যই আজ আমায় দেখেও দেখেনি ? কার
জন্য আজ এতটা পথ হেঁটে এসেছে বৈদেহী ? কে সেই যুবক যার জন্য
বৈদেহীর চোখ প্রতীক্ষা করছে? আমার মনে তখন জীবনানন্দ দাশ
কথা বলে ওঠেন 'ফিরে এসো এই মাঠে,ঢেউয়ে, ফিরে
এসো হৃদয়ে আমার দূর থেকে দূরে-আরো দূরে যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর।'
বৈদেহী রাস্তা পার করে আমার দিকেই আসছে । আশপাশে বেশ কয়েকজন রয়েছে । এদের
কাউকেই কি এক্সপেক্ট করছিলো বৈদেহী । আমি ছাড়া আরো চারজন এখানে তার মধ্যে ব্ল্যাক
টি শার্টে চোখে রেবনের স্নানগ্লাস পরা ছেলেটাকে আমার বেশ লাগলো । ছেলেটা মাত্র এসে
দাঁড়ালো । মন বললো এই ছেলেটাই হবে। একটা অজানা কষ্টের মাঝেও আমার কেন জানিনা খুব
ভালো লাগা কাজ করছে। বৈদেহীর রুচির দাদ দিতে হবে। গুড চয়েস।একটু সরে গিয়ে ওয়ালের দিকে
মুখ করে দাঁড়ালাম। গীতামাসিকে এই ঘটনাটা বলতে হবে । না,বলা যাবে না । মামন
জেরা শুরু করবে । এতক্ষণে নিশ্চয় ওরা চলে গেছে । ঘাড়টা আলতো ঘুরিয়ে দেখলাম ছেলেটা
নেই । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়াতেই ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠলাম।
- আ..আপনি এখানে ?
- হুম।
- বাসায় যাননি এখনো ?
- না।
- কেন,কোনো সমস্যা ?
- না । আপনাকে আমার কিছু বলার ছিলো । আমার মনে বাহারী রঙের বেলুনের ওড়াউড়ি
। বৈদেহী কি আমার বলতে চাওয়া কথাটাই আমাকে বলতে চাইছে ?
- এখানে এভাবে কথা না বলে,কাল তো ছুটি আমরা
কোথাও মিট করি । নদীর পাড়ে বিকেলে । কিংবা অন্য কোথাও ।
-না।
- দেখুন বৈদেহী এখানে অনেকে দেখছে । কেউ কিছু ভাবতে পারে ।
-আপনি সেটা বোঝেন ? কথাটার মাঝে কেমন জানি একটা ঝাঁঝ ঝরে পড়লো ।
-শুনুন মিস্টার ।
-পু..পুরাণ । আমার নাম পুরাণ । আমি বুঝতে পারছি আপনি কি বলতে চান এখন
রাগের মাথায় ঐ কথাটা নাই বা বললেন ।
- আই এম সরি । মানছি আপনার সাথে
ঐভাবে কথা বলা উচিত হয়নি দুদিন । কিন্তু তাই বলে রোজ এভাবে বাচ্চা ছেলেদের মতো
আপনি স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন ? আজ দারোয়ান প্রশ্ন করেছে কাল
অন্য কেউ জানতে চাইবে । এটার মানে বোঝেন ?
আমি কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না । বৈদেহীর দিকে তাকাতে পারছিলাম না
। বৈদেহী ক্ষাণিক দাঁড়িয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলো ।
- বৈদেহী কাল বিকালে আমি আপনার অপেক্ষায় থাকবো । আমি জানি কাল বিকাল
চারটায় আপনি আসবেন ব্রীজের কাছে । বৈদেহী ঘাড় ঘুরিয়ে একপলক তাকিয়ে এগিয়ে গিয়ে
রিক্সায় চেপে বসলো ।
আমার এত আত্মবিশ্বাসী কথাগুলো কি আমিই বলেছি ? আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো
না কিছুতেই। এই প্রথম আমার মনে হলো সময় খুব ধীরে চলছে অথচ কাল ও আমার মনে হতো সময়
খুব দ্রুত পালাচ্ছে আমার কাছ থেকে । অন্যসব ছুটির দিনের চেয়ে আজকের দিনটা আমার
জন্য অন্যরকম। আজ বিকেল চারটায় বৈদেহী আসবে তো?মন সায় দেয় । বৈদেহী
আসবে । সকালের রোদের মতো আমার চোখে মুখে আলো ।
বৈদেহীর কানে গতকাল থেকেই শুধু একটি কথা বাজছে 'আমি জানি আপনি আসেন টানে’, কোন
অলৌকিক শক্তি পেলে একটি সদ্য পরিচিত মানুষ এত আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে ? বৈদেহী
কোনভাবেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না । কাল সারা রাত তার চোখে ঘুম আসেনি । জীবনের
কোন সিদ্ধান্তই সে একা নেয়নি । তার মা ও দিদা
তার সিদ্ধান্তকে দৃঢ় করেছেন। আজ কি করবে বৈদেহী ।
মা কে বলবে ? কিন্তু কি বলবে ? তার
চোখে মুখে যে অস্থিরতা । মা কি কিছু বুঝতে পেরেছে?নিজেকে সহজ রাখার চেষ্টা
করে বৈদেহী ।সময় এত দ্রুতছুটছে।সময় যত যাচ্ছে বৈদেহীর অস্থিরতা তত বাড়ছে । মা কে
বললে মা কিভাবে নেবে বিষয়টা না । নিজের ওপর তার রাগ হয় । কি দরকার ছিলো দুদিনএভাবে
ইয়ার্কি মারার ? ইয়ার্কি মেরে ছিলো তো ছিলোই কাল এভাবে অপেক্ষা করে
কথা না বললে তো পারতো । বৈদেহীর কান্না পায় ।
আর মাত্র কয়েক ঘন্টা । তারপরই বৈদেহীর মুখোমুখি দাঁড়াবো আমি। ভাবতেই
কেমন শিহরণ জাগছে । মনে মনে আমি কথা সাজাই! বৈদেহীকে নিয়ে কোথায় বসবো ঠিক করি । বৈদেহীও
নিশ্চয় আমার মতোই কথা সাজাচ্ছে । নিজের সাথে নিজে বাজী রাখি । বৈদেহী আজ শাড়ী পড়বে
না সালোয়ার ? কি হবে তার রঙ ? ফেরার সময় কি বৃষ্টি হবে এক পশলা, একসাথে
ভিজে ফিরতে ফিরতে কি আপনি... নিজের ছেলেমানুষীতে নিজ । একা একা বোকার মতো হাসি।
মা’ র প্রশ্নে বৈদেহী নিরুত্তর । কি করবে বুঝতে পারেনা সে । মা কে
কিভাবে বলবে সে গত কয়েকদিন আগে ছাতা ফেরত দিতে গিয়ে সে দুইদিন একটা ছেলের সাথে
ইয়ার্কি মেরেছে, গতকাল তার নাম জেনেছে । আজ তার সাথে দেখা করতে বলছে
সেই ছেলে ।
না, এটা
মা কে বলা যাবে না । তবে কি বলবে পুরাণ নামের একটি ছেলে প্রতিদিন তার স্কুলের
সামনে
দাঁড়িয়ে থাকে । আজ একটু পরে গিয়ে তাকে কিছু বলতে যাবে সে । না, এটাও
বলা ঠিক হবেনা তবে হয়ত মা ই ছুটবে পুরাণকে কিছু বলতে । কি বলবে বৈদেহী তার মা কে ? কি
উত্তর দেবে সে মা কে তার অস্থিরতার কারণ হিসেবে ? নিজেকে
এতটা অসহায় এর আগে আর কখনো লাগেনি বৈদেহীর ।
ঘড়ির কাটায় এখন তিনটা বেজে পাঁচ মিনিট... আমার সময় আজ কাটছে না
কিছুতেই ।
দুপুরের
খাওয়া শেষ করে । ঘড়িতে চোখ রেখে দেখি তিনটা বেজে পাঁচ মিনিট । বেরিয়ে পড়া উচিত । ব্রীজের
দিকে যাবো নাকি বৈদেহীর বাসা হয়ে তারপর ব্রীজের দিকে যাবো ? ঠিক
করতে পারিনা। যদি ঐদিকে গেলে বৈদেহীর সাথে দেখা হয় একসাথে অন্তত ব্রীজের দিকে গেলে
কিছুটা সময় বেশী কাটানো যাবে । পরক্ষণেই মনে হয় ওর বাসার সামনে আমাকে দেখে যদি
বৈদেহী গতকালের মতো রেগে যায় ? থমকে দাঁড়াই । ফুলের দোকানের
দিকে তাকিয়ে মনে হলো কিছু
অর্কিড
কিনি যদিও বৈদেহীর প্রিয়ফুল কি আমি জানিনা । কিন্তু মাথায় যখন অর্কিডের কথা এলো
অর্কিডই নিলাম। সঙ্গে একবাক্স চকলেট আর কয়েক প্যাক চিপস আর হাফ লিটার কোল্ড ড্রিংক
নিয়ে ব্রীজের দিকে হাঁটতে লাগলাম । বৈদেহী যদি আমার আগে পৌঁচ্ছে যায় , একা
একা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়ত খারাপ লাগবে । মনে হতেই একটা রিক্সা ডেকে চেপে বসলাম ।
মা কে সত্যিটা বলতে পারেনি । বৈদেহী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বৈদেহীর অস্থিরতা
আরো বেড়ে গেলো । সাড়ে তিনটার কাটা ছুঁই ছুঁই করছে ঘড়িটা ।কি করবে বৈদেহী ? নিজেকে
শক্ত করার চেষ্টা করে বৈদেহী সিদ্ধান্ত নিতে । কয়েক মুহুর্ত চোখ বুঝে সিদ্ধান্ত
নেবার চেষ্টা করে বৈদেহী কিন্তু চোখ দুটো বন্ধ করতেই পুরাণের মুখটা ভেসে উঠে তার
বন্ধ চোখের অন্ধকারে । পলকেই আতংকিত চোখ খুলে বৈদেহী সিদ্ধান্ত নেয় । সে যাবে না ।
ঘরে এসে শুয়ে পড়ে । আবার উঠে বসে, মোবাইলটা হাতে নেয় কিন্তু তক্ষুনি
মনে পড়ে তার কাছে তো পুরাণের সেল নম্বর নেই । কি মনে হয় কে জানে বৈদেহী তার ব্যাগ
হাতড়ে একটি কয়েন বের করে ।
এই একটা কারণেই নিজেকে প্রেম ভালোবাসা থেকে এতদিন দূরে রেখেছি । অপেক্ষা
আমার বড্ড অপছন্দের
। স্কুল কলেজ লাইফে বন্ধুদের সাথে তাদের ডেটিং এ গিয়ে অপেক্ষা করার বেশ কিছু অভিজ্ঞতার
পর আমি বন্ধুদের ঘোষনা দিয়েছিলাম এ জীবনে প্রেম ভালোবাসায় আমি নেই । যদি কোন দিন কোনো
মেয়ে প্রোপজ করেও তবে ডেটিং এ আমি দেরীতে যাবো ।
ওদের
মতো বক সেজে দাঁড়িয়ে থাকবো না কোনোদিন । আজ সেই আমি বক সেজে তালগাছের মতো এক পায়ে
না হলেও দুপায়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি । নিজের এই হাল দেখে নিজের প্রতি নিজেই বিদ্রুপের
হাসি হাসলাম । ঘড়িতে এখন বিকাল চারটা বিশ..আমার আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা একটু একটু করে গলছে । গতকাল বিকাল থেকে আজ সারাদিনে এই
প্রথমবার আমার মনে হলো বৈদেহী আসবে না । না আসার যথার্থ কারণগুলো নিজেকে যত বোঝাবার চেষ্টা করছি।আমার ভেতরে ততটাই
মনখারাপের অন্ধকার নেমে আসচ্ছে।দূরে
তাকিয়ে হাতের অর্কিড আর অন্যসব কিছুর দিকে তাকিয়ে মনে হলো চশমাটা ঝাপস চারটা বেজে
তেতত্রিশ... আমার বুকের ভেতরটায় অচেনা আজানা এক শূন্যতা এতটা ফাঁকা
আগে কোনোদিন লাগেনি । এমন কি গতকাল বিকালেও না । গত বিকালের কথা মনে পড়তেই মনে পড়লো বৈদেহীকে
তো আমি ব্রীজের এদিকে না ঐদিকে কিছু
বলিনি। এমনো তো হতে পারে বৈদেহী আমার জন্য ব্রীজের ঐদিকটায় অপেক্ষা করছে কিংবা অপেক্ষা করে এখন ফিরে আসচ্ছে ! পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে ব্রীজের ঐদিকটায় এলাম।নেই
। বৈদেহী কোত্থাও নেই । পাঁচটা বেজে পাঁচ... নীল ঝকঝকে আকাশটার ঈশান কোণে কখন মেঘ
জমেছে খেয়াল করিনি। ছেঁড়া ছেঁড়া কালো মেঘে পশ্চিমের কুসুমরঙা আকাশ অদ্ভুত এক রঙে
সেজেছে । ব্রীজটার ঐদিক থেকে এদিকে আসতে আসতে দেখছি সোনা আকাশটা পলকে পলকে কালো
হয়ে আসছে ।
আমি বুঝে পাইনা । এখন আমার কি করা উচিত ? ফিরে
যাওয়া নাকি আরেকটু অপেক্ষা! ধীরে ধীরে আমি ব্রীজ পেরিয়ে আগে যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, আমার
যে মন একটু আগেও বলছিলো বৈদেহী আসবে, সেই মনটাই এখন আকাশের মত রঙ পাল্টে
বলছে বৈদেহী আসবে না ।
কি করবো
বুঝতে পারি না। যেখানে বৈদেহীকে নিয়ে বসবো ভেবেছিলাম পাশের সেই রাস্তাটা দিয়ে আমি
নীচে নামতে থাক কাশ ফুলের ঝুপটার কাছে এসে মনে হলো।হাতের অর্কিড আর বাকীসব এখানে
ফেলে দেয়াটাই ভালো । সবকিছু ঝোপটার কাছে ফেলে রেখে আমি কাশফুলের ঝোপটা পেছনে রেখে
এগিয়ে যাই নদীর দিকে ।
বৈদেহী যা কোনদিন করেনি আজ সে সেটা করলো। মা কে মিথ্যা একটি জরুরী
কাজের কথা বলে সে বেরিয়ে পড়লো । মনে মনে তার দেখা স্বপ্নটা যেন সত্যি না হয় সেই প্রার্থনা
করতে করতে সে রিক্সায় চেপে বসে।তার চোখে মুখে অস্থিরতা। আকাশে মেঘ জমছে । পুরাণ যদি
এতক্ষণে ফিরে গিয়ে থাকে? কিংবা সে যেটা স্বপ্নে দেখেছে তা য কি করবে বৈদেহী ? তার
কান্না পায় । ব্রীজের কাছে এসে নামে বৈদেহী । কোথাও পুরাণ কে দেখতে পায়না সে ।
ঘড়ির
কাটায় পাঁচটা পনের। বৈদেহীর অস্থিরতা আরো বাড়ে,কি করবে কিছু বুঝতে
পারেনা সে । পুরাণ কি তবে ফিরে গেলো । কাশবনের দিকে আছে কি পুরাণ ? আলো
কমে এসেছে । কিছু একটা ভাবে বৈদেহী, তারপর নিচের দিকে নামতে থাকে ।
কাশফুলের ঝোপের কাছে এসে সে থমকে দাঁড়ায় । কনে দেখা আলোয় সে অর্কিড,চকলেট,টিপস আর কোল্ড ড্রিংকসের
বোতল পড়ে থাকতে দেখে । এদিকে সেদিকে তাকায় বৈদেহী । কোথাও পুরাণ নেই। সে ডাকে
পুরাণ..পুরাণ..পুরাণ সাড়া না পাওয়া বৈদেহী কেঁদে ওঠে । পাখিরা দল বেঁধে ঘরে ফিরে
যাচ্ছে। আকাশ কালো কালো মেঘে ছেয়ে গেছে । সন্ধ্যার অনেক আগেই তাই অন্ধকার নেমে
এসেছে । বৈদেহী বুঝতে পারে না কি করবে সে। এভাবে ফিরে যাবে ? এই
অর্কিড আর চকলেটগুলো কি পুরাণই নিয়ে এসেছিলো ? কাঁদতে
কাঁদতে আবার বৈদেহী কান্না কান্না গলায় আবার
ডাকে
পুরাণ..পুরাণ..প্লীজ সাড়া দাও পুরাণ বলেই আরো জোরে কেঁদে ওঠে ।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসচ্ছে । বহতা জলের দিকে একমনে
তাকিয়ে থাকলে নাকি জল নিজের দিকে টানে। আমিও এতক্ষণ তাকানোর পর সেই টান অনুভব
করছি। যদি ডুবে যাই জগত সংসারের এমন কিছু হবে না।বৈদেহীও জানবে না হয়ত কয়েকদিন
দেখবে আমি স্কুলের সামনে নেই, গীতামাসির বাড়ীতে নেই। তারপর একসময় ভুলে যাবে। গীতামাসি,বাবা মা আর বন্ধুরা
হয়ত
কাঁদবে ।
আমার জীবনানন্দ দাশের কথা মনে পড়ে ট্রামের নীচে নিজেকে সঁপে দেবার আগে উনার কি
আমার মতোই মনে পড়েছিলো সবার কথা,নাকি কোনো কবিতার কথা ভেবেছিলেন তিনি সেই দিনের কুক্ষণে !
আলো কমে আসচ্ছে । বৈদেহী বুঝতে
পারেনা সে কি করবে । আবার কান্না চোখে
সে এদিক ওদিক তাকায় । কোথাও কেউ নেই।এমন শুনশান জায়গায় দাঁড়ানোটা তার উচিত মনে
হয়না, কিন্তু পা যেন চলছে না তার। অর্কিডগুলো তুলে নিয়ে আবার ফেলে দিয়ে সে এগিয়ে
গিয়ে আবার ফিরে এসে অর্কিডগুলো তুলে নিয়ে আরো নিজেকে তার খুনী মনে হয়। আত্মবিশ্বাসী
একটা মানুষকে সে নিজের খামখেয়ালীতে মেরে ফেলেছে মনে হতে সে জোরে চিত্কার করে ওঠে
পুরা..ণ । আমি ভরা নদীটার দিকে তাকিয়ে নিজেকে তৈরী
করতে থাকি । একটা লাইন আমার মাথায় ঘুরপাক খায় 'নিজেকে লিখতে গিয়ে
দেখি শব্দ নিরুত্তর-'
এই
নিরুত্তর শব্দটা কি বৈদেহী ? আমি বুঝতে পারিনা । আমার আজ
মৃত্যু হলেও তো কেউ জানবে না আমি আত্নহত্যা করেছি । জানলেও কেউ জানবে না বৈদেহীর
আজ আসার কথা ছিলো এইখানে । হয়ত বৈদেহীও আমার মৃত্যুর কারণ বুঝবে না। সবার মতো সেও
হয়ত প্রশ্নের গভীর অন্ধকারে থেকে যাবে সারাজীবন! প্রেম করে কেন মানুষ মরে যায় এটা
এতদিন আমার কাছে খুব হাস্যকর মনে হতো ! এখন আমার মন যেন তা বুঝতে পারছে । প্রত্যাখান, আশাভঙ্গের
বেদনা মানুষকে একা করে দেয় এখন আমি বুঝতে পারছি । ইলশে গুড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু
করেছে । চারপাশে আবছায়া আলো । কাশফুলের শুভ্রতা বদলে গিয়ে ধুসর । নদীর টলটলে জলে
গুটি বসন্তের মতো কালশিটে দাগ ।
মেয়ে কন্ঠে ‘পুরাণ’ ডাকটা কানে বাজলো । আমার খুব হাসি পেলো । মৃত্যু
ভাবনার সাথে ইলুউশান এভাবে মিলেমিশে থাকে তা জানা ছিল । আবার ডাকটা কানে এলো বেশ জোরে । এবার একটু
ঘাবড়ে গেলাম মৃত্যু কি আমায় ডাকছে ? নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে
দাঁড়ালাম । নদী কি আমাকে তার বুকে টেনে নিতে এভাবে করুণ কন্ঠে ডাকছে ? বৈদেহী যদি
একবার এভাবে ডাকতো ! আমি নদীর জলের খুব কাছাকাছি । নীরবতা বাড়ছে । এখন আর কোনো ডাক
শুনতে পাইনা । তবে কি এতক্ষণ এই ডাকটা আমার ভ্রম ছিলো ?
বৈদেহী অর্কিডগুলো বুকে চেপে ধরে আর চিত্কার করে হাউমাউ করে কাঁদতে
থাকে । বৈদেহীর মনে হয় এই শাস্তিটাই তার প্রাপ্য ছিলো হয়ত ! সারাটা জীবন তাকে এই
বৃষ্টির মতোই
কাঁদতে
হবে, কাউকে বলা যাবে না । পুরাণের মৃত্যুর জন্য তার খামখেয়ালীপনা দায়ী । এত
আত্মবিশ্বাস নিয়ে যে বলতে পারে সে একটু ধৈর্য্য ধরতে পারলো না । বৈদেহীর খুব রাগ
হয় পুরাণের উপর, তারপরই নিজের উপর রাগ হয়, গতকাল না বললেই তো পারতো
সে পুরাণ
কে, যে
আমি আসবো না পুরাণ ।
ডাকটা আবার কানে আসে । আওয়াজটা তো নদী থেকে নয় মনে হয় পেছন থেকে কেউ
ডাকছে । আবছায়া অন্ধকারে ধুসর কাশ ছাড়া আর কিছু দেখতে পাইনা। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে
বৃষ্টি মেখে হাঁটতে কিছুটা এগিয়ে একটা ছায়া চোখে পড়লো ফাঁকে । এটাও কি আমার
ইলিউশান ? আমার ভেতরে বৈদেহী এতটা জায়গাটা করলো অবসরে ? নাকি
গভীর আত্নবিশ্বাসে আঘাত পেলে মানুষ এমন ইলিউশনে ঢুকে যায় ? ছায়াটা
নড়ছে । আমি কি সন্ধ্যায় ভূত দেখছি ! ছায়ার মতো কিছু
একটা যে
হাঁটছে আমি বুঝতে পারছি । ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম । পিছন থেকে জড়িয়ে ধরা কি ঠিক হবে ?
বৈদেহী কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে যাচ্ছে । হঠাত্ তার মনে হলো কেউ পেছন পেছন
আসছে । সে থামলে পেছনের আওয়াজটা থেমে যায় । হাঁটলে আওয়াজটা আবার কানে আসে । কোন বদ
মতলবে কোন বদলোক তার পিছন নেয়নি তো ? তার অস্থিরতা আর কান্না আরো
বেড়ে যায়।
কি করবে
বৈদেহী ভাবতে ভাবতে চমকে আর তার হাতের ব্যাগটা দিয়ে জোরে জোরে এলোপাথারি ।
- আরে মারছো কেন ?
- আপনি আমার পিছু নিয়েছেন কেন ? কন্ঠটা
শুনে আমার বৈদেহীর মতো লাগলো কিন্তু এই সন্ধ্যায় বৈদেহী এখানে আসবে কিভাবে ? ইলিউশন,আবার ইলিউশন! চকিতে বৈদেহীর মনে হয় পুরাণ নয়ত ? না
।
- তুমি কাঁদচ্ছো কেন ? ভয় পেয়েছো ? এই
সন্ধ্যায় এখানে কেন একা একা।
- মরতে।
- আজব। মরতে চাইছো কেন!
- আমার ইচ্ছা । আপনি যেখানে যাচ্ছেন যান তো ।
- এভাবে একটা মেয়েকে রেখে কি করে যাই ? যদি মরে যাও তখন কি হবে?
- প্লীজ যান তো ।
- তোমার সমস্যাটা আমায় বলো আমি সমাধান করে দিচ্ছি।
- আপনি যাবেন ?
- আচ্ছা তুমি যে মরতে এলে তোমার কি ইলিউশন হচ্ছে !
- মানে!
- যেমন আমি বারবার শুনছি নারী কন্ঠে কে যেন ডাকছে পুরাণ ।
আমাকে চমকে দিয়ে ছায়াটা আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে, ‘পুরাণ
তুমি কোথায় ছিলে আমাকে কাঁদিয়ে...’
(শেষ)