গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০১৩

ইন্দ্রাণী সরকার

দ্বন্দ্ব

রুমেলা যখন ক্লাস এইটে উঠল তখন থেকে সে লক্ষ্য করত পাড়ার ছেলেরা তার দিকে একটু যেন বেশি বেশি নজর দিচ্ছে | স্কুলটা বাড়ি থেকে হাঁটাপথেই ছিল | একটি ছেলে ওকে একটু বেশিই লক্ষ্য করত | প্রথম প্রথম রুমেলা অতো পাত্তা দিত না, কিন্তু ক্রমে ক্রমে লক্ষ্য করল যে রোজই ফেরার পথে ছেলেটি একটু দুরত্ব রেখে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় | ছেলেটির বাড়ি ওদের বাড়ির কাছেই ছিল, কিন্তু পূর্বপুরুষদের মধ্যে কোনো একটা মনোমালিন্যের জন্য দুই পরিবারের মধ্যে একটু বিবাদেরই সম্পর্ক ছিল | ছেলেটির নাম কুণাল | রুমেলার মত একই ক্লাসে পড়ত কিন্তু অন্য একটি স্কুলে | ক্রমে রুমেলার মনে ওর জন্য একটা মায়া পড়ে যেতে লাগল | ওর সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হলে "কেমন আছো", "পড়াশুনো কেমন চলছে" ইত্যাদি সৌজন্যমূলক কয়েকটি কথার আদান প্রদান হত | ওদের বাড়ির পাশে প্রত্যেক বছর রথের মেলা বসত | সময়ে রুমেলা ওর বান্ধবীদের নিয়ে খুব হৈ হৈ করত | স্কুল থেকে এসে খাওয়া দাওয়া সেরে, তারপর হোমওয়ার্ক শেষ করে সন্ধ্যেবেলায় মেলাতে বেড়াতে যেত | সময় ওকে বাড়ি থেকে অপার স্বাধীনতা দেওয়া হত |
এবারে মেলাতে প্রথম ইলেকট্রিক নাগরদোলা এল | সবাই খুব উৎসাহিত চড়ার জন্য | অনেক উঁচু প্রায় পাঁচতলা বাড়ির সমান | রুমেলার একটু ভয়ভয় করলেও বন্ধুদের দেখাদেখি চড়ে বসল | হঠাৎ মনে হল ওর মাথাটা কেমন ঘুরে যাচ্ছে | ভয়ে চোখ বুজে ফেলল | ওর পাশে বসে থাকা মেয়েটির হাত শক্ত করে ধরে রইল | মেয়েটি ওকে ভরসা দিয়ে বলল যে চিন্তা নেই এখুনি থেমে যাবে | রুমেলার মনে হল যেন অন্তহীন এক প্রতীক্ষা | যখন নাগরদোলা থামল তখন অর্ধমূর্ছিত | মাটিতে ধপ করে বসে পড়ল | পাশের লোকজন ছুটে এল | কেউ কেউ বলল, "চোখে মুখে জল দাও, মাথা ঘুরে গেছে খুব |" একটু পরে যখন চোখ খুলল, দেখল ওর বান্ধবীরা আর কুণাল ওর দিকে চিন্তান্বিতভাবে তাকিয়ে আছে | একজন বলল, "কি রে ? এখন একটু ভালো বোধ করছিস্ ?" রুমেলা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল | তারপর বলল, "মনে হচ্ছে হেঁটে বাড়ি যেতে পারব না |" তখন কুণাল বলল, "চিন্তা নেই, আমি একটা রিকশা ডেকে দিচ্ছি, তোমার কোনো বান্ধবীর সঙ্গে বাড়ি চলে যাও | আর ভাড়াটা খুবই যৎসামান্য তাই নিয়ে কোন চিন্তা করার নেই |" এই বলে একটা রিকশা ডেকে ওদের চড়িয়ে দিল | রুমেলার মন কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল | তারপর থেকে ওরা যেন কোন অদৃশ্য বন্ধনে জড়িয়ে গেল | স্কুল শেষ হবার পর রুমেলা ওর বাবা মায়ের সাথে মামার বাড়ি বিহারে পাটনায় বেড়াতে গেল | সেখানে মামাতো ভাই বোনদের সাথে সারা দিন হৈ হুল্লোড় করে সময় কাটতে লাগল |

একদিন ওর মামা বললেন যে এখানের স্থানীয় জমিদারবাবু তাঁর স্ত্রী ছেলের সঙ্গে সামনের সপ্তাহে দেখা করতে আসবেন | রুমেলার মামাতো বোন জয়িতা খুব উৎসাহ নিয়ে বলল, "জানো দিদি, ওনারা খুব ভাল, একদম অহংকার নেই | আর সায়ন দা কি ভীষণ হ্যান্ডসাম !" যথাসময়ে ওঁরা তিনজন ওদের বাড়িতে এলেন | মামা মাইমা ওঁদের নিয়ে খুব শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন | রুমেলার সঙ্গে সবাইকে পরিচয় করে দেওয়া হল | জমিদার বাবু তাঁর স্ত্রী খুব আন্তরিকভাবে রুমেলার সঙ্গে কথোপকথন করতে লাগলেন, কিন্তু সায়ন একদম চুপচাপই রইল | খাওয়া দাওয়া শেষে জমিদারবাবু অনেক করে ওদের সবাইকে ওনার বাড়ি যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে গেলেন | যথারীতি একদিন সবাই মিলে জমিদারবাবুর বাড়িতে গেলেন | ছোটরা অবাক হয়ে ঘুরে ঘুরে চারিদিক দেখতে লাগল | জমিদারবাবু সায়নকে বললেন ওদের নিয়ে চারিদিক দেখাতে | এবার সায়ন খুব স্বচ্ছন্দভাবে রুমেলার সাথে বাক্যালাপ শুরু করল | রুমেলা সব পুরোনো পুরোনো পোর্ট্রেটগুলো দেখে তাঁদের পরিচয় জানার জন্য প্রশ্ন করাতে সায়ন খুব ধৈর্য্যসহকারে সব কিছু বুঝিয়ে দিতে লাগল | মাঝে মাঝে রুমেলাকে ওর পড়াশুনা ইত্যাদি ব্যাপারে প্রশ্ন করতে লাগল | তারপর সায়ন বলল যে এবার একটা খুব সারপ্রাইজ দেওয়া হবে | ছোটরা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল | রুমেলার মামাতো ভাই দীপ বলে উঠল, "আমি জানি কি !" এই কথা শুনে রুমেলা আর জয়িতা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল | দীপ মিটিমিটি হাসতে লাগল | সায়ন তখন ওদের একটা মস্ত ঘরে নিয়ে গেল | সেখানে চারিদিকে শুধু পেন্টিং আর পেন্টিং | দীপ বলে উঠল, "এই সব পেন্টিং সায়নদার আঁকা |" রুমেলা অবাক হয়ে সায়নের দিকে তাকিয়ে রইল | এবার সায়ন একটা ঢাকা দেওয়া পেন্টিং দেখিয়ে বলল, "এবার দেখো সারপ্রাইজ |" এই বলে ঢাকাটা সরাতেই সবাই ভীষণভাবে অবাক হয়ে দেখল সামনে জলজ্যান্ত রুমেলার ছবি ! রুমেলা অবাক হয়ে একটা মস্ত হাঁ করে তাকিয়ে রইল | দীপ বলে উঠল, "দিদি মুখ বন্ধ করো, মুখে পোকা ঢুকে যাবে, হিহি |" রুমেলা তখন বলে উঠল, "মোটেও মুখ বন্ধ করব না | তুই না বললি একটু আগে যে তুই জানিস কি সারপ্রাইজ, এবার বুঝেছি তোর দুষ্টুমি !" দীপ হি হি করে হেসে উঠে বলল, "কি করব ! সায়ন দা যে সে দিন অনেক করে বলল তোমার একটা ছবি দিতে তোমার পোর্ট্রেট আঁকার জন্য |" এই শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল আর রুমেলা রাগে মুখ লাল করে রইল | বাড়ি ফেরার পর রুমেলা জানতে পারল যে সব কিছুই অনেক আগে থেকেই ঠিক করা ছিল | রুমেলার একটি পুরোনো ছবি দেখে জমিদার বাবু তাঁর স্ত্রী ভীষণ মুগ্ধ হয়ে ওর সাথে তাঁদের একমাত্র ছেলের বিয়ে দেবার মনস্থ করেন | তাই রুমেলার বাবা মা ওকে এইখানে নিয়ে এসে ওদের পরিচয় করানোর জন্য এই প্ল্যান করেন | রুমেলা একদিন কুনালকে সব কথা খুলে বলল | কুণাল ভীষণ খুশি হয়ে বলল, " তো দারুন খবর! আমার প্রিয় বান্ধবী হবে কি না জমিদার বাড়ির বউ !" রুমেলা অবাক হয়ে ভাবল তাহলে কি এতদিন কুণাল ওকে সত্যি সত্যি নিজের করে পেতে চায় নি, না কি মনে কষ্ট পাবে বলে ব্যাপারটাকে এইভাবে চাপা দিল !