গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০১৩

সুবীর সরকার

আদিতমারির বাঘ


তারপর সেই ডোরাকাটা বাঘ হাতিনালার জঙ্গল পেরিয়ে ৭/৮ নদি টপকে এক মোরগডাকা ভোরের অমলিনতায় গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে একসময় উঠেই এল আদিতমারির লাল সুরকির রাস্তায় । খুবই নিঃশব্দে ঘটনাটি ঘটলো,ঘটে গেল । একসময় আলো ছড়ালো আদিতমারির আকাশে । ১৮ হাতির হরিকান্ত দেওনিয়ার ঘুম ভাঙলো । শীত এখন মধ্যপর্বে।হরিকান্ত দেওনিয়া হরিকান্ত জোতদার কাল অধিক রাত পর্যন্ত বাউরা বাজারের কুশাণয়াত্রার আসরে ইয়ারবক্সি পরিবৃত হয়ে বেশ রসেবসে গাননাচ পানাহার আমোদে বেশ রসস্থ হয়ে প্রায় ভোররাতে বাড়ি ফিরেছিল । ঘুমটাও হল না সেইমত । আজ সারাদিন ছেঁড়াখোঁড়া টুলুং ভুলুং নাওয়ের মতন কাটবে । এদিকে বিকেল পেরোলে যেতে হবে হাতিবান্ধা কাছারিতে খাজনা আদায়ে । দেওনিয়া ঘুম ভাঙলেও পালঙ্ক ছাড়লো না । পুর্নবার পাশ ফিরে আবারো টেনে নিল মোলায়েম কাঁথাখানি । তন্দ্রার ভিতর দেওনিয়ার আবছায়া চোখের সামনে লক্ষীরাণী পুটিরাণীর চিক্কণ মুখগুলি।


কত পুরনো সব দিনকালপর্ব পেরিয়ে হাটবাজার গানবাজনার বর্ণময়তায় নিমজ্জিত হতে হতে ভেসে বেড়ানো স্মৃতিটুকরোর কোলাজে মহামহিম পুরাকালের ধ্বনিময়তাই বুঝি ফিরে আসতে থাকে । গল্পহীন মানুষেরাই বুঁনে চলেন একটানা গল্পের ভুবনমায়া । তখন সময়টাই কালপর্বটুকুই মুল গায়ক । মুখ্য চরিত্র হয়ে দেশাচার লোকলোত্তরে আবেষ্টিত হতে থাকে।হরিকান্ত দেওনিয়ার আদিপুরুষ ধনিকান্ত দেওনিয়ার কাকিন্যার রাজার পাটহাতির অকালমরণদৃশ্যে শোকগ্রস্থ হওয়ার দৃশ্যমুহূর্ত ফ্রেমবন্দি হয়ে পড়লেও সময়পর্বকে অতিবৃহৎ এক আবহমানতাই এনে দেয় বুঝি।তখন দুরেকাছের সব জোতজমি বনজঙ্গল ঝাড়ঝোপ যেন হামলে পড়ে লাটসাহেবের মোটরগাড়ি লালজিরাজার হাতি খানবাহাদুরের জোড়া ফিটন ছোটরানীর পালকি বিলকান্দির বিল তিস্তাচরের কাশিয়ার ফুল । সময়ের ভিতর তবে কি উদাসীনতাই এনে দেয় সময়।এতকিছুর ফাঁকে আজার বেটির গান ভেসে যায় গদাধরের পারে পারে_ নাল শাড়ি নে রে ময়না /নাল শাড়ি নে/মোটরগাড়ি চড়বে ময়না/নাল শাড়ী নে...


নিন্দের আলিসে দেওনিয়ার শরীরে কম্পন জাগে নাকের ফুটো দিয়ে আদ্ভুত শব্দ বেরোয়।দেওনিয়ার অর্ধচেতনে তখন মনোরম সব দৃশ্যখণ্ড নুড়িভাসা জলে যেন ভেসে যাওয়া। কমলারানী ফুলুরানি হরিমতি সবাই গতজন্মের ওপার থেকে হাওয়ার ডানায় ভর দিয়ে নেমে আসে বর্তমানের মরপৃথিবীতে।পদমতির চরে জোতদখলের সেই রক্তারক্তি লড়াই । দেওনিয়ার হাত মাখামাখি খলিল পাইকারের লাশের টাটকা রক্তে । জোতজমি জোতজমির মত নিস্পন্দ পড়ে থাকে । দেওনিয়া হাতির হাউদায় বসে বড়খুটার বনাঞ্চলে পাখিশিকারে যায় ।


এইভাবে কালখণ্ডের খোঁদলে ইতিহাসবাহিত হতে হতে দেওনিয়া জাগতে না চাওয়ার প্রাবল্যেই বুঝি বা আরো আরো ঘুমের আলিসায় ডুবে যেতে থাকে।আদিতমারির লাল সুরকির রাস্তায় গর্বিত ভঙ্গিতে তখন হাঁটতে থাকে হাতীনালার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা সেই ডোরাকাটা বাঘ।