তিন টেক্কা
ক্ষিতীশ
সরকারি অফিসের পিওন। মাইনে পায় শ-পাঁচেক টাকা। গ্রাম থেকে আট মাইল সাইকেল চালিয়ে রোজ
আপিসে যায়। বড়দা’র বাড়িতে খাওয়াদাওয়া।
মাসান্তে একশ’ টাকা ধরে দ্যায়। রোজগারি
ছেলে। মেয়ের বাবারা আসে, ফিরে যায়। দাদারা বলে, হক কথাই বলে, - বাড়ি করুক – বাড়ি না হলে বউ থাকবে কোথায়।
বাড়ি
না থাকলেও ক্ষিতীশের ভিটে আছে। এজমালি বিরাট কাঁচা-পাকা বাড়ি ভেঙে পৃথক হল তিন
ভাই। ভিটে তিন ভাগ হল। মধ্যিখানের ভাগ ক্ষিতীশের। বছর না ঘুরতেই দু-পাশে দুই বাড়ি
উঠে গেল। মধ্যিখানে ঘাস গজায়। ক্ষিতীশ ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারে না। আজীবনের এলোমেলো স্বভাব তার। পুরনো বাড়ির দরজা-জানলা,
টিন ক্ষিতীশের ভাগেও পড়েছিল। সেগুলো শুধুশুধু জল খায় দেখে বড়দা’ বলল,-- আমায় দিয়ে দে, নষ্ট হয় কেন মিছিমিছি,
তোর যখন ফুরসত হবে বাড়ি করার তখন না হয় দাম ধরে দেব।
কথায়
যুক্তি আছে। ক্ষিতীশ না করতে পারে না। তার দরজা-জানলা, টিন বড়দা’র বাড়ির গায়ে মাথায় উঠে যায়। হাজার খানেক টাকা জমিয়েছিল।
ওই নিয়েই বাড়ি শুরু করার মতলব ভাঁজছিল। শুনে মেজদা বলল, -- ও টাকায় ভিত খোঁড়াই সার
হবে। কাজ বন্ধ থাকলে টাকা দিয়ে খোঁড়া ভিত আপনা-আপনি বুজে যাবে। তারচে’ টাকাটা এখন আমায় দে, আমার বাড়ির কাজটা শেষ করে
ফেলি। তোর যখন বাড়ি করার পুরোপুরি রেস্ত হবে, আমায় বলিস – কাঠ যা লাগবে সব দায়িত্ব আমার। মেজদার
জঙ্গল-ব্যবসা; কাঠ না-হোক হাজার তিনেক টাকার লাগবে। সেটা যদি হাজারেই হয়ে যায় লাভ
কম করে দু-হাজার। ক্ষিতীশ মনে মনে উল্লসিত হয়; হাজার টাকা মেজদার হাতে তুলে দ্যায়।
কিন্তু বিপদ হল, বছরের পর বছর গড়ায়। বাড়ি করার রেস্ত আর জমেনা ক্ষিতীশের।
প্রথমদিকে আট-দশ হাজার টাকার এস্টিমেট ছিল। কিন্তু এখন কাঁচা-পাকা করতে হলেও
না-হোক বিশ হাজারের ধাক্কা! দু-পাঁচশো জমে, তাতে কাজ শুরু করা যায় না। আবার একদিন
হাতের ফাঁক দিয়ে গলেও যায়।
পুবে
বড়দা’র বাড়ি, পশ্চিমে মেজদার;
মাঝখানে ক্ষিতীশের ভিটেতে ঘাস গজায়। বড়দা’র রান্নাঘরের চালাটা বাড়তে বাড়তে ক্ষিতীশের ভিটের উপর দুটো ঠ্যাং
বাড়িয়ে দ্যায়। মেজদা বলে, -- গরু বেড়ে গেছে, গোয়ালটায় কুলোচ্ছে না। তোর জায়গাটায়
আপাতত একটা চালা তুলি – আশ্রয় পাক বেচারারা, তোর
বাড়ি হলে গোয়ালটা তোকেই দিয়ে দেব।
ন্যায্য কথা। ক্ষিতীশ আপত্তি করার কারণ খুঁজে
পায় না। পশ্চিম দিক থেকে চার ঠ্যাঙের উপর মেজদার গোয়ালচালা গুড়ি মেরে বসে। দুই
অগ্রজের মাঝখানে ক্ষিতীশের ভিটে একফালি
উঠোনের মতো চাঁদের আলো মেখে পড়ে থাকলে সে মাঝে মাঝে গভীর রাতে এসে তার উপর
দখিনমুখো বসে থাকে। দুই হাত দু-পাশে মেলে জোর পায় মনে। একদিন এইখানে তার বাড়ি হবে;
বাঁ হাতের রান্নাঘরে কাচের চুড়ির ঠিন্ ঠিন্ শব্দ বাজবে, ডান হাতের গোয়ালচালায়
দুধ দোয়া হবে – চিরিক-চাঁই। ঠিক তখনই দম
বন্ধ হয়ে আসে তার। বাতাস কম কম লাগে। তাড়াতাড়ি লাফ দিয়ে উঠে ট্রাফিক পুলিশের মতো
দুই হাত প্রসারিত করে থাবা মেলে দাঁড়ায় অগ্রজের দুই উদ্যত চালার দিকে।
২
ক্ষিতীশের
ডান হাতের তালুতে রাখা মাথা। ডান কনুই-এ ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে বাঁ হাত দিয়ে
অনাসক্তির সঙ্গে প্রথম তাসটা তুলল – চিড়িতনের বিবি। দ্বিতীয়টা ঝটিতি তুলেই সোজা হয়ে বসল – হরতনের সাহেব। তৃতীয়টা তুলে না দেখে আগের দুটোর
মাঝখানে রেখে জড়ো করে মেঝেতে নামিয়ে রাখল। মথুর তাস তুলেই একটা পঞ্চাশ পয়সা আলতো
করে ছুঁড়ে দিল বোর্ডে, সেটা গড়াতে গড়াতে ক্ষিতীশের ডান হাঁটুতে ঠোক্কর খেয়ে মেঝেতে
পড়ে থির্থির্ করে কাঁপতে লাগল। প্রত্যাশায় ক্ষিতীশের বুকে ঢিপিঢিপি আওয়াজ। সে
আধুলিটাকে ছুঁয়ে কপালে হাত ঠেকায়। তারপর মেঝে থেকে তাস তিনখানা তুলে ধীরে মেলে
ধরতে থাকে। পরপর দুজন তাস তুলেই ছুঁড়ে ফেলল তাসের গাদায়। সাহেব-বিবির মাঝখানে
টেক্কার প্রত্যাশায় কাঁপা হাতে সাহেবকে একটু ঠেলতেই ইস্কাপনের নওলা নির্লজ্জের মতো
বেরিয়ে পড়ল। ধুত্, বলে ক্ষিতীশ তাস ছুঁড়ে ফেলে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল।
বারো
মাসই প্রায় পাতা থাকে এই বিছানা। দাঁত বের করা মাদুরের উপর দুটো তেল চিটচিটে
কাঁথা। তাতে ছারপোকার শুকিয়ে-যাওয়া-রক্তের ছোপছাপ। পায়ের কাছে ভাঁজ করা শক্ত লেপ।
হাঁ-হয়ে-যাওয়া বালিশটা অল্প কিছু তুলো আর রাশিকৃত তুলোর বীজ নিয়ে ঘুণধরা কাঠের
আলমারির তলায় বছরখানেক ধরে পড়ে আছে। ক্ষিতীশের শিয়রে এখন বিমল মিত্রের উপন্যাস,
তার বালিশ।
মথুর
আর লেউলে লড়াই চলছে। পয়সার গাদায় ঠুংঠাং করে আধুলি পড়ছে। ক্ষিতীশের ঝিমুনি ধরে।
প্রায় একটা বাজে। বিড়ির ধোঁয়া পাক খেয়ে খেয়ে উপরে উঠছে। হ্যারিকেনের কালি-পড়া
কাঁচের ভেতর দিয়ে আসা অস্পষ্ট আলোয় টান-টান কয়েক জোড়া চোখ। উত্তেজিত আঙুলের ডগায়
বিড়ি নিভে যাচ্ছে। টান দিতে গিয়ে বিড়ির সুতো মথুরের জিভে জড়িয়ে যায়, ধোঁয়া আসে না।
বিরক্ত হয়ে থু-থু করে সুতো ফেলে আধপোড়া বিড়িটা যত্ন করে কোলের কাছে রেখে হাতের তাস
নামিয়ে লেউলকে বলে, -- শো। লেউল তার তাস দেখাতেই মথুর নিভে যায়, কালার। তার ছিল
টেক্কার পেয়ার। তড়িদ্গতিতে লেউল দু-হাত দিয়ে জমা-হওয়া টাকা-পয়সা নিজের কোলের কাছে
টানে। মথুর ততক্ষণে লেউলের কোমরে হাত দিয়েছে। বিড়ির বান্ডিল লেউলের লুঙ্গির কষি
খুলে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে। পয়সা সামলে লেউল খিস্তি করে উঠে, -- বাঞ্চোৎ, একটা বিড়ি
নিয়েছিস তো মুয়ে মুতে দেব।
একটা, শুধু একটা মাইরি – ম্যালা টাকা আমার জিতে নিলি!
সিকি ফ্যাল, বিড়ি পাবি।
একটা বিড়ি এক সিকি!
তোকে সাধছি?
দশ পয়সা দিচ্ছি, মাইরি একটা –
বল্লাম তো হবে না।
মথুর অগত্যা ‘শালা চামার’ বলে নিজের আধপোড়া বিড়িটা ধরায়।
ছোট্ট
ঘর। আট হাত বাই আট হাত। এককালে খুব ঘটা করে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ক্ষিতীশও
ছিল একজন উৎসাহী উদ্যোক্তা। সেই সুবাদে সে রাত্রিটা লাইব্রেরিতে কাটাত। বারোয়ারি
ঘর। আপত্তি ওঠেনি কোন। পাঁচ-ছ-বছর পরে বই পড়ার উৎসাহ চলে গেল সকলেরই। অধিকাংশ বই
গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে ছড়িয়ে আছে। ঘুণধরা আলমারিতে এখনও কয়েকটা ফাল্গুনী, নীহার
পড়ে আছে। দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথ ঝুলছেন। তাঁর পিছনে উঁকি মারছে ভলিবলের ছেঁড়া নেট।
সিলিং জুড়ে মাকড়সার জাল ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় কালচে মেরে গেছে। দরজার কোণে স্তূপিকৃত
বিড়ির টুকরো। এই লাইব্রেরি-ঘরই এখন
ক্ষিতীশের কায়েমি আস্তানা। রোজ রাতে দাদার বাড়িতে খাওয়াদাওয়া সেরে হ্যারিকেন নিয়ে
চলে আসে। গত একবছর ধরে বিমল মিত্রের বইটা পড়ছে সে। এখনও শেষ করে উঠতে পারেনি।
ঘুমোনোর আগে বইটা পড়ে। ঘুম এসে গেলেই ওটা মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়ে। পরদিন কতটা পড়েছে
আর মনে থাকে না। গোড়ার থেকে আবার আরম্ভ করতে হয়। বিমল মিত্রের বইয়ের ভেতরে আর একটা
নিষিদ্ধ চব্বিশ পাতার বই আছে। কেউ টের পায় না। যেদিন ঘুম আসতে চায় না সেদিন বিমল
মিত্র না পড়ে সেটা পড়ে। পড়তে পড়তে নিজেকে হাল্কা করে নেয়। তারপর ক্লান্ত শরীরে
শুয়ে পড়লে বিমল মিত্র জায়গা নেন শিয়রে।
তবে
সবগুলো রাত নিরঙ্কুশ যায় না। আলুর লোকেরা আসে। ফড়ে মথুর ও লেউল, আড়তদার শ্যামা আর
অনা। প্রথম প্রথম ভারী বিরক্ত হত ক্ষিতীশ। কিন্তু তার আপত্তি করার হক নেই। এ ঘরে
সকলের সমান অধিকার। ক্ষিতীশ আগে তাসই চিনত না। কিন্তু সারারাত ওরা পয়সা ঝন্ঝন্
করে খেলতে থাকলে নিরুপায় ক্ষিতীশ তাস চিনল। তারপরই নেশা লেগে গেল তার। এখন তেতাসের
সে নিয়মিত খেলোয়াড়। পঞ্চাশ পয়সা বোর্ড। ধরানি নীচে পঞ্চাশ পয়সা, উপরে দশ টাকা।
বোর্ডে তিনশো টাকা জমা হয়ে গেলে হাত দেখানো বাধ্যতামূলক।
ক্ষিতীশ
তার পাতা বিছানার উপরেই বসে। ওরা চারজন চটের থলে পেতে মেঝেতে। আরও দু-তিন দান খেলা
হয়ে গেল। ক্ষিতীশের হাতে কিছুই আসছে না। দরজা জানালা বন্ধ। পাঁচজনের বিড়ির ধোঁয়ায়
ঘরের বাতাস জমাট। ঝিমুনি ধরে ক্ষিতীশের। বোর্ডে পয়সা দিয়ে দিয়েই দশবারো টাকা হারছে
সে। খুচরো টাকা পয়সা প্রায় শেষ। জামার গোটানো হাতায় দুটো পঞ্চাশ টাকার নোট লুকোনো
আছে। সে বোর্ডে পঞ্চাশ পয়সা ছুঁড়ে দিয়ে মনে মনে ঠিক করল, এটাই শেষ। এবার শুয়ে
পড়বে। কিন্তু সেবারেই গোলামের পেয়ারে সাত-আট টাকার একটা ছোট দান জিতে গেল সে।
অগত্যা ঝিমুনি কাটাতে লুঙির ট্যাঁক থেকে শেষ বিড়িটা বের করে ধরায়। তারপর তাস
বিলোয়। লেউল তাস না তুলে ব্লাইন্ড মারল পঞ্চাশ পয়সা। মথুর ব্লাইন্ড মারতে গিয়েও
মারল না। আজ বেশ হেরেছে সে, কল্জের জোর কম। তাসগুলো তুলে চকাস্ করে চুমু খেল,
তারপর সেগুলো মেলে ধরেই বিকৃতমুখে ছুঁড়ে দিল। অনা তাস দেখে এক টাকা ধরল। শ্যামা ব্লাইন্ড
মারল। ক্ষিতীশও ভাবছিল একবার ব্লাইন্ড দেবে কিনা। কিন্তু তার খুচরোর স্টক কম।
বেহিসেবি না হওয়াই ভালো ভেবে প্রথমেই ইস্কাপনের টেক্কা তোলে। পরেরটাও টেক্কা!
হরতনের। তৃতীয়টা তুলতে গা ছম্ছম্ তার। হা ঈশ্বর! এক ঝটকায় মাথায় রক্ত উঠে যায়।
আঙুলগুলো কাঁপতে থাকে। এটাও টেক্কা! তিন টেক্কা! ঝটিতি তাসগুলো জড়ো করে ফেলে।
বিশ্বাস হয় না যেন। নতুন করে এক একটা তাস মেলে দেখতে থাকে। ক্ষিতীশের মুখের দিকে
তাকিয়ে লেউল আর শ্যামা চকিতে চতুর দৃষ্টি বিনিময় করে। ক্ষিতীশ খেয়াল করে না। সে
কাঁপা হাতে এক টাকার কয়েন ছুঁড়ে দ্যায়। চারটে হাত এখনও খেলছে। দুটো ব্লাইন্ড।
ভগবান করুন ওদের হাতে যেন ভালো তাস জমে। একটা বড়ো দান আসুক ক্ষিতীশের হাতে। লেউল
আবার ব্লাইন্ড মারল। অনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত উঠিয়ে নিল। শ্যামা ব্লাইন্ড চালিয়ে
যেতে লাগল। টানটান হয়ে বসেছে ক্ষিতীশ। খেলুক শালারা ব্লাইন্ড যত পারে! বোর্ডে যত
পয়সা পড়বে – সব তার – তারই! মুখের ভাব নির্বিকার রাখার চেষ্টা করতে
লাগল সে। শালারা যেন বুঝতে না পারে কী মাল নিয়ে বসে আছে সে। কিন্তু খুচরো টাকা শেষ
হতেই হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ল সে। জামার হাতা থেকে পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে বোর্ডে
ছুঁড়ে দিয়ে বলল, -- দশ মরা।
লেউল তার মুখের দিকে তাকাল, যেন জরিপ করতে চাইল।
তারপর জিজ্ঞেস করল, -- দশ টাকা ধল্লি?
ক্ষিতীশ ঘাড় নাড়তেই একটু ইতস্তত করে সে নিজের
তাস দেখল এবং দেখার সঙ্গে সঙ্গেই দশ টাকার নোট দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে দিল বোর্ডে। মথুর
বলল, -- জমেছে মাইরি! শ্যামা নির্বিকারভাবে পাঁচ টাকা করে ব্লাইন্ড দিয়ে যেতে
থাকল। ক্ষিতীশের দ্বিতীয় নোটটায় যখন আর কুড়ি টাকা মোটে জ্যান্ত তখনই হঠাৎ নার্ভাস
বোধ করে সে। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শিরশিরানি উঠে আসে। বোর্ডে নোটের স্তূপ। সব তারই
তো? নিজের তাস আর একবার ভালো করে দ্যাখে সে। ভুল নেই, তিন টেক্কা। তার উপরে কেউ
নেই। মথুর এবং অনাও টানটান হয়ে বসেছে।
বিস্ফারিত চোখে তিনজনের মুখ ও বোর্ডের দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। শ্যামা আর লেউলের
মুখ কঠিন। ক্ষিতীশ ‘চল্লিশ মরা’ বলেই লেউলকে একটা সিকি ছুঁড়ে দিয়ে বলে, -- বিড়ি
দে।
লেউল ধীরেসুস্থে তার কোমর থেকে বিড়ির বান্ডিল বের করে ক্ষিতীশকে
একটা দ্যায়। সে বিড়ি জ্বালিয়ে বুক ভরে একটা টান দিতেই মথুর ভীতসম্ভ্রমের গলায় বলে,
-- শেষটা এক টান দিবি ক্ষিতীশ।
শ্যামা
এবার ধীরে ধীরে তার তাস তোলে। সময় নিয়ে দ্যাখে। ক্ষিতীশ প্রবল প্রত্যাশায় তার দিকে
তাকায়। তার গলা শুকনো। এই বারেই তার টাকা ফুরিয়ে যাবে। শ্যামা যদি আবার ধরে!
বোর্ডে কি তিনশো হয়েছে? মনে মনে হিসেব করে সে। লেউল নব্বই, শ্যামা পঞ্চান্ন, গোড়ার
দিকে সাত-আট – বোর্ড নিয়ে দশ ধরলে – না, এখনও বাকি। তার মাথা ঝাঁঝাঁ করে। শ্যামা দশ
টাকার নোট পকেট থেকে বের করে একটু ভাবে, তারপর বোর্ডে ছুঁড়ে দ্যায়। ক্ষিতীশ তার
দ্বিতীয় পঞ্চাশটা বোর্ডের দিকে ঠেলে দ্যায়, বলতে চায়, ‘সই’; কিন্তু গলা দিয়ে একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরোয় শুধু। মথুরের দিকে অনুনয়
ভরে তাকায়, হাতের বিড়িটা তার দিকে বাড়িয়ে দ্যায়; তারপর কেশে গলা পরিষ্কার করে
বলে,-- গোটা পঞ্চাশ হবে
? মথুর
তার হাত থেকে বিড়িটা নেয়; নিভে গেছে দেখে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে ধরায়। তারপর
ট্যাঁক থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে একটু হাসার চেষ্টা করে; বলে, -- কালীর
দিব্যি – আমার কাছে আর একটা পয়সাও
নাই।
অনাকে কিছু বলার আগেই সে উঠে দাঁড়িয়ে লুঙি খুলে
আন্ডারপ্যান্ট দেখিয়ে দ্যায়। শ্যামা আর লেউলের চোয়ালে চোয়াল, চাপা ঠোঁট দেখে আর
কিছু বলে না ক্ষিতীশ। নিজের হাতে ধরা তিনটে তাসের দিকে তাকায়; দ্যাখে, জ্যোৎস্নায়
মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে তার একফালি ভিটে – তার অধিকারের মাটি, কারুর নয় ষোল আনা তারই। তবু তার আয়তন কমে আসে
দিনে দিনে। অগ্রজের দুই উদ্যত চালা গুড়ি মেরে এগিয়ে আসে। চুড়ির ঠিন্ঠিনে মিঠে
আওয়াজ মিলিয়ে যায়।
সে একটা চাপা নিশ্বাসের সঙ্গে টাকার স্তূপের উপর তিনটে টেক্কা
ছড়িয়ে দ্যায়। তারপর শেষ-না-হওয়া বিমল মিত্রের উপর মাথা রেখে চোখ বোজে।