গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৩

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

খুন
     রবিবারের সকালটা পল্টুর বেশ খোশমেজাজে কাটে । অন্যদিনের চেয়ে একটু বেলায় ওঠা, ধীরে-সুস্থে চায়ে চুমুক দেওয়া, তারপর মায়ের ঘরে গিয়ে এটা-সেটা ,আবার খানিক বোনের সঙ্গে খুনসুটি করে বাজারে যায় ও। সপ্তাহে এই একটা দিন সংসারের বাজারের দায়িত্ব তার নিজের। বাকি দিনিগুলো বাবাই কোণমতে চালিয়ে নেন। কি করেই বা সে যাবে! রোজই তো সকাল নটার সময় অফিসে যাবার তাড়া। এখান থেকে প্রায় মাইল দশেক দূরে তার কারখানা। নটার বেরোলে সাড়ে নটার সময় সে ঠিক পৌঁছে যায় অফিসে। লিলি, তার ছোট বোন সেও যায় তার একটু পরেই। লিলি তার চেয়ে ঠিক চার বছরের ছোট । মাত্র কয়েকমাস হল এখানেই একটা মিশনারী স্কুলে পড়াতে ঢুকেছে। ছোট মফস্বল শহর। জায়গাটা বিহার-বাংলার মাঝামাঝি। একসময় প্রচুর মিশনারীদের প্রভাব ছিল। এখন অনেক কমে গেছে, কিন্তু স্কুল, কলেজগুলো রয়ে গেছে। সেইরকমই একটা মিশনারীদের স্কুলে লিলি কাজ পেয়েছে। ভালো ছাত্রী ছিল, রেজাল্টও ভাল, চাকরী পেতে কোন অসুবিধে হয় নি। অসুবিধে হয়েছিল পল্টুর। পাটনা থেকে এখানে আসতে কত যে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল, সেই জানে। প্রথম প্রথম খুব রাগ হত। দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে এখানে কেন যে বাবা রিটায়ার করে বাড়ি করতে গেলেন, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না পল্টু। এখন সয়ে গেছে। বলতে গেলে মাত্র ছয়/সাত বছর তারা এখানে এলেও জায়গাটা আর খারাপ লাগে না। সব চেনা হয়ে গেছে। ছোট শহর, সবাই সবাইকে চেনে, বিপদে-আপদে ছুটে আসে, ভালই লাগে। যে কোন খবর কাউকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখ, সবাই জানে। কি জানি, হয় তো কার বাড়িতে কি রান্না হয় তাও জানে! ভেবে মনে মনেই হাসল একটু পল্টু। দাড়িটা কামিয়ে বাজারে যাবে নাকি ফিরে এসে কাটবে এটা ভেবে একবার মুখে হাত বুলিয়ে নিল। লিলি তার ঘরে বিছানা ঝাড়ছিল, দেখে বললে, ‘ তোকে দেখতে ভালই দাদা, অত বারবার মুখ না দেখলেও চলবে।‘ 


     ত্যারছা চোখে লিলির দিকে একবার তাকিয়েই বিছানার চাদরের অপর হামলে পড়ল পল্টু। লিলি হাঁ হাঁ করে চীৎকার করে উঠল...মা, দাদাকে বারণ কর, আজ কিন্তু আমার সময় নেই...এই, ভাগ, যা, বাজারে যা ...ওসব আদিখ্যেতা আমার কাছে আর দেখাস না দাদা, যার কাছে দেখাবি তাকে এবার নিয়ে আয়...যা  --কেন, তোকে যে খাইয়ে, পরিয়ে রেখেছি, তার বেলা ? তুই, তুই আমায়...তবে রে, বলে কিছু একটা ছুঁড়বে বলে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বড় পাশ বালিশটা হাতে তুলে নিল লিলি। পল্টু হাতটা ধরে ফেলল----রাখ রাখ, এটা তোর চেয়ে ওজনে ভারী, কেন শুধু শুধু এখুনি টাল সামলে উলটে পড়বি ...। বলেই জোরে হাঁক দিল...মা, তোমার অসুরদলনী কে সামলাও । বাইরে এসে বারান্দায় টাঙ্গানো দুটো বড় বাজারের থলি টেনে নিয়ে স্কুটারের দিকে এগিয়ে গেল । লিলি বিছানা ঝাড়া বন্ধ রেখে এসে চেঁচিয়ে বলল...আজ দুরকম মাছ আনিস , দাদা...।‘ পল্টু একবার ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে গেল বাড়িরি বাইরে ।
     
     রাস্তায় বেরিয়ে কোনদিকে আগে যাবে ভাবছিল। বাজার করে বাড়িতে রেখে ওপাড়ায় যাবে নাকি আগেই ঘুরে আসবে ঠিক করতে পারছিল না। অফিস ফেরতা শুনেছে বটে কি একটা হয়েছে ওদিকে, বেশি কিছু জানে না। একবার খবর নেবার কথা মনে হয়েছিল কিন্তু নিজে যাওয়াই ভাল, এই ভেবে আর কাউকে জিজ্ঞাসা করে নি। কি করবে বুঝতে না পেরে বাঁদিকে বাজারের রাস্তা ধরেও আবার পিছিয়ে এসে কলেজ রোডের রাস্তাই ধরল পল্টু। একবার ঘুরে আসাই ভাল, কেমন যেন একটা চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। করবীর কথাই ভাবছিল পল্টু। এদিকে নাকি কাল কিছু বড় রকমের গোলমাল হয়েছে, পুলিশ এসেছিল, একজনকে ধরে নিয়ে গেছে, তাও শুনেছে । নাঃ, একবার ঘুরে আসাই যাক ।
                                             (২)

     কলেজ রোডে করবীদের বাড়িতে এসে একবারেই মুখোমুখি হয়ে গেল করবীর বাবার । বিভূতিবাবু বাগানে মাটি , সার এসব নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। একবার মুখ তুলে দেখলেন পল্টুকে । কিছু বললেন না। পল্টু এড়াতে চাইছিল ভদ্রলোককে। কেমন যেন ভাল লাগে না এই লোকটিকে তার। এর জন্যই আজ ওদের সংসারে এত অশান্তি। রিটায়ার করার পর থেকে শুধু বাগান নিয়ে পড়ে আছেন। ঘরে একটা রুগ্না মেয়ে, বিশ্ববখাটে একটা ছেলে, কোনদিকে হুঁশ নেই। করবীর মা একসময় একটা বাচ্চাদের স্কুলে পড়াতেন, এখনও কয়েকটি বাড়িতে টিউশনি করেন। করবী নিজেও কয়েকটা বাচ্চাকে পড়ায় বাড়িতে। তার একটা পা ছোট । ছেলেবেলা থেকেই ওর এইরকম। স্কুলে। কলেজে যখন পড়ত উঁচু গোড়ালির জুতো পরতে হত একপায়ে। চামড়ার বেল্ট দিয়ে হাঁটূর সঙ্গে আটকানো থাকত। বাড়িতে পরে না । একটা পা হাত দিয়ে ধরে পা টেনে টেনে হাঁটে। দেখলে খারাপ লাগে। আগে পল্টু নিজেও তা জানত না। অনেক পরে জেনেছে। লিলির চেয়ে এক ক্লাস ওপরে পড়ত করবী । স্কুলবাসে যাতায়াত করার সময় দেখেছে মিষ্টি মুখখানি বাসের জানালা দিয়ে বাইরে বার করে বসে থাকতে । শ্যামলা মেয়েও যে এত সুন্দর দেখতে হতে পারে, করবী কে দেখেই জেনেছিল পল্টু। আজ তার কাছে সুন্দরী মেয়ের সংজ্ঞা অনেকটাই আলাদা। তাছাড়া করবী মনের দিক দিয়েও ভাল মেয়ে, স্বভাব ভাল, কথাবার্তা সুন্দর । আবার দুষ্টুমিও করতে পারে তাল বুঝে। কিন্তু ভাইটা একেবারে বিশ্ব-বখাটে । এমন মেয়ের যে কি করে একটা এই ধরনের ভাই থাকে সে বুঝতে পারে না। কোন রকমে টেনেটুনে বিএস সি পাশ করেছে। একটা কাছাকাছি কারখানায় মেকানিকের কাজে ঢুকেছিল, কিন্তু ছেড়েছুড়ে দিয়ে এখন যে কি করে কে জানে! বিরক্ত বোধ করল পল্টু । বিভূতিবাবুকে কোন রকমে পাশ কাটিয়ে বারান্দায় উঠে এল । সামনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল । সরমা ভিতরের বারান্দায় ভেজা জামাকাপড় মেলে দিচ্ছিলেন । হয়ত সবে চান করে এসেছেন। পল্টূকে দেখে ভেজা জামাকাপড় তারে ফেলে দিয়ে পল্টূর হাতদুটো জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। অবাক পল্টু ! “কি হয়েছে কাকিমা, কাঁদছেন কেন”?


     সরমা হাত দিয়ে চোখে শাড়ীর কোনা চেপে ধরে কান্না জড়ানো গলায় যা বললেন তার অর্থ হল করবীর ভাইকে কাল পুলিশে তুলে নিয়ে গেছে। আকাশ থেকে পড়ল পল্টু। সে কি ! কি করেছে, বাবলা ! “জানি না বাবা। থানার দারোগা তো বলে গেল—খুন । আমার বিশ্বাস হয় না বাবা । কোন ভদ্র ঘরের ছেলে এ কাজ করতে পারে, বল” বিচলিত বোধ করল পল্টু । কি উত্তত্র দেবে সে ! যে ছেলেদের সঙ্গে বাবলা মিশছিল, তাতে যে ওর ভাল কিছু হচ্ছে না, সেটা সবাই জানত। কিন্তু তাই বলে খুন! “আচ্ছা, দেখি করবীর সঙ্গে একবার কথা বলে”, ভিতরে ঢোকার জন্য পা বাড়াল সে । সরমা চলে গেলেন ।


    করবী চুপ করে জানালার কাছে একটা চেয়ারে বসে ছিল, পল্টুর আসার শব্দ পায়নি । এখন ওর নাম ধরে ডাকায় ঘাড় ফেরাল। “কি হয়েছে বাবলার । কাকিমা কিসব বলে গেলেন। কি, ব্যাপার কি বলত ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না” করবীর মুখের দিকে তাকিয়ে বল পল্টু । “মা যা বলেছেন সেটাও ঠিক আর বাবলা যা করেছে, সেটাও ঠিক” । নিষ্পৃহ মুখে বলে গেল করবী
-- তুমি কি করে জানলে” ?
- লিলি খুব খারাপ কাজ করে এলে যেভাবে তুমি জানতে পারবে কিম্বা তুমি করে এলে লিলি । আচ্ছা, তোমরা একটা কথা কেন মানতে চাইছ না...বাবলা তো ভাল ছেলে ছিল না । তোমাদের অসুবিধে টা কোথায়, যা ঘটেছে সেটাকে অস্বীকার করা নাকি বাবলা কে তোমরা চেন, জান, তোমাদের নিজের লোক বলে ভাবতে অসুবিধে হওয়া ? ঠিক করে বল তো ?

     অবাক মুখে করবীর দিকে তাকিয়ে রইল পল্টু । অন্যকথা ভাবছিল সে। একে করবীর একটা পা ছোট, বাড়িতে তাই নিয়ে আপত্তি উঠবেই, অশান্তিও কম হবে না । তার ওপর বাবলার কথা কানে গেলে...যাবেই, এত ছোট জায়গায় এসব কথা চাপা থাকে না । তাহলে তো কোনমতেই আর কিছু করা যাবে না । বিরক্ত বোধ করছিল পল্টু । রাগ, বিরক্তি চাপা থাকল না মুখের চেহারায়, গলার স্বরেও । খুনখারাপির কথা শুনে পল্টু ভয়ানক বিরক্ত হয়েছে । বাড়ি বটে একখানা !  একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল
- তাহলে, কি করবে এখন ?
- আমি তো পারব না বাইরে গিয়ে ছোটাছুটি করতে । তাছাড়া মাকে একা রেখে এখন বাইরে যাওয়াও যাবে না । আমি গুপ্ত কাকাকে একবার আসতে বলেছি । দেখি, কতটা কি করা যায়...”।  - গুপ্ত কাকা মানে, আমাদের রমেনের বাবা, যিনি চার্চ রোডে থাকেন, উনি তো ?
- হুঁ, দেখি একবার ওনার সঙ্গে কথা বলে...অন্যমনস্ক ভাবে উত্তর দিল করবী । 
- উনি কি পারবেন একজন খুনীর আসামীকে ছাড়াতে...মানে,
- না, ছাড়ানোর চেষ্টা তো করিনি । ও যাতে শাস্তি পায়, আমি সেটাই তো চাইছি । জেলে ওকে যেতেই হবে । এতবড় কাজ করে জেলে যাবে না তো কি ! আমি যাতে ওর জেল হয় সেই চেষ্টাই করব । খুব করা আর খুনের জন্য সাহায্য করা, আমার কাছে এক । আমি সেটাই দেখছি...

     হতবাক একবারে পল্টু । ভাইকে ছাড়াবার চেষ্টা না করে জেলে যাবার জন্য কেউ আবার উকিল লাগায় নাকি ! তার জন্য আবার উকিল লাগানোর কি দরকার ? বিরক্ত মুখে বলল “তুমি কি করে সামলাবে ? এত সব...একা, এভাবে” গলার স্বর আরো নেমে গেল পল্টুর । “তোমার এই ব্যাপারে আমি তো কিছু করতেও পারবো বলে মনে হয় না...এত ব্যস্ত হয়ে আছি”...

শান্ত অবিচলিত স্বরে জবাব দিল করবী । “একা একাই তো বড় হয়েছি পল্লব দা । স্কুল, কলেজ এভাবেই তো পেরিয়েছি। বাইরে তবু তো জুতো পরি । বাড়িতে পা টেনে টেনে হাঁটি । কেউ তো সাহায্য করে না ! আমাদের মত মেয়েরা এভাবেই বড় হয়, আমাদের এভাবেই সব করতে হয়, পল্লব দা । আমাদের সাহায্য করার দরকার হয় না । এতদিন পেরেছি বাকি দিনগুলোও পারব...। আপনি আসুন, আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে, ছুটির দিনের বাজার, সময় লাগবে”। 


মাথা নীচু করে বেরিয়ে এল পল্টু । করবী কি মনের কথা পড়তে পারে !