গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৪ নভেম্বর, ২০১২

নন্দিতা ভট্টাচার্য



বাসন্তী ও রেশন কার্ড


‘দিদি রেশন তুলতে যাব, পয়সা দাও’ - বলে বাইরের দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল বাসন্তী । আমার ফ্ল্যাটের সদর দরজা সব সময় খোলাই থাকে । দরজা আঁট করে সেঁটে রাখলে কেমন জানি অতি ছোট মন ছোট মন  মনে হয় । আমার উল্টো ফ্ল্যাটে থাকে এক কম বয়েসি দম্পতি । কেউ বেল টিপলে দরজা দুইঞ্চি ফাঁক করে সব কথা সেরে নেয় । চলে গেলেই ঠকাস করে প্রায় মুখের ওপর দরজা বন্ধ হয়ে যায় । আরে বাপু কলকাতা শহরে এত ঝুনঝুনওয়ালা , আগরওয়ালা থাকতে আমাদের বাড়িতে মরতে আসবে কে ! আর হয়েছে এই এক রেশন কার্ড । এটা ধরে রাখার জন্যে মাসে মাসে আবার এক খরচা । বাসন্তী প্রত্যেক মাসে সেই কাজটি করে দেয় নাহলে কখন আবার বে নাগরিক হয়ে যাব সেই ভয়ে । চিনি এবং কেরোসিন  ই নেয় । আমি চিনি রাখি উৎসবে অনুষ্ঠানে । সেদিন সঙ্গে নাতনিকে নিয়ে এসেছে বাসন্তী । চার  নম্বর মেয়েটি থাকে সুন্দরবন । শ্বশুর ঘর মোটামুটি খারাপ নয় । অল্প সল্প জমি আছে শ্বশুর চাষ করেন । ছেলে সাহায্য করে । কোনরকমে চলে আর কি । বরকে নিয়ে কলকাতা চলে আসতে  চাইছে । রিক্সা চালিয়ে হয়ত আরও একটু রোজগার হতে পারে । চাষের জমিতে তো সেরকম আয় নেই। মাঝে মাঝে মধু আনতে বনে ঢোকে, সে তো আরও বিপজ্জনক । বাসন্তীরও শ্বশুরবাড়ি সুন্দরবন । কিন্তু সে ঘর তো তাকে কবেই ছাড়তে হয়েছে  পাঁচটি ছেলে মেয়ে নিয়ে এসেছিল আজ থেকে পনের বছর আগে । সে দিনটি আজও হেঁটে হেঁটে চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় ।

         কাজের খোঁজে এসেছিল একটি পঁচিশ বছরের মেয়ে । সবাইকেই বলছিল ওর কথা । যা আমরা সবসময়ই শুনি, স্বামী আবার বিয়ে করেছে । সুতরাংওর নিশ্চিন্ত জীবন থেকে মুক্তি চেষ্টা করেছিল সতীনের সঙ্গে ঘর করবার । কিন্তু ওর মুখ ও তার সঙ্গে আর পাঁচটি মুখ তখন  স্বামীর কাছে বাড়তি । সে নতুন কচি বউকে নিয়ে আহ্লাদে আঁটখানা । তাই বাসন্তী গ্রামের দিদির পরামর্শে কলকাতার নেতাজী পল্লিতে । প্রথম বাচ্চাগুলোকে রেখে কাজ খুঁজতে এসেছিল । আমাদের এপার্টমেন্ট ওকে নিয়ে এসেছিল আর এক কাজের মাসি । এখানেই তিন ঘরে ওর কাজ জুটে যায় । বড় দুটো মেয়েকে দিনরাতের কাজে দিয়ে দেয় । তিনজনকে  নিয়ে চলে সকাল আটটা থেকে রাত আটটা  পর্যন্ত হাড় ভাঙা খাটুনি । কখন কখন আরও বেশি থাকতে হত  একটি বাড়িতে রাতের রুটি করার জন্যে  এক চাকরি করা দম্পতি, সারাদিনের পরিশ্রমের পর আর রুটি করার মত ধৈর্য থাকে না ।

         বেশ  ঢল ঢল চেহারা বাসন্তীর । চোখগুলো খুব বড় বড় । এত  কষ্টের মধ্যেও স্বাস্থ্যটি ওর অটুট কোন যাদুবলে কে জানে । দুপুরের ভাত খায় রায় গিন্নির বাড়িতে । সন্ধেবেলা চা-রুটি আমার বাড়ি । ছেলেটিকে স্কুলে দিয়েছে । দুই মেয়েও ঠিকে কাজের জন্যে তৈরি হচ্ছে । ছেলেটিকে নিয়ে মহা সমস্যা । তার পড়াশোনায় কোন মন নেই । কাছেই অবৈতনিক প্রাইমারী স্কুলে পড়ে সে । মা  বেরিয়ে এলেই মহা আনন্দে খেলে বেড়ায় ।  মায়ের তো সময় নেই ওর পেছনে ঘুর ঘুর করার । দিদিদের সে মোটে পাত্তা দেয় না । বাসন্তী আবার পুত্র স্নহে অন্ধ । রোজ ই বোঝাই–  মেয়েগুলোকেও স্কুলে দিয়ে দে। তোর মত জীবন হবে ওদের । দুটোকে তো বাইরে দিয়েছিস । এদুটো অন্ততপক্ষে ; বলে , জান কত টাকা লাগবে ? আমি বলি , কেন  স্কুলগুলো তো বিনে পয়সায় পড়ায় । ঐ শুনতেই বিনে পয়সায়। বই আছে , স্কুলের জামা আছে । আরও কতকিছু লাগে জান । তখনও সর্বশিক্ষার ঢেউ আসেনি। দুপুরে পেট পুরে খাওয়ার ধুমধাম শুরু হয়নি । স্কুল ছুট দের ধরে ধরে আনা শুরু হয়নি । যদিও খুব একটা এদিক ওদিক সর্বশিক্ষায়ও করতে পারেনি । তাই আর মেয়েদের কোথায় পাঠান হল!  ওরাও মার রুজি বাড়াতে লেগে গেল কাজে। 

         মায়ের সঙ্গ ধরে আসতো ঝিমা সে চার নম্বর । দেড় , দুবছরের বছরের তফাতে সবগুলোর জন্ম। বড়টির বয়েস এই বার , তের ছিল তখন ।। তিন নম্বর রিমা ঘরে থেকে ভাইকে সামলাত । ভাইকে  নাওয়ানো খাওয়ানো ঘুম পাড়ানো । ভাই ও নিজের জন্যে রান্না করা । রাতে বাসন্তী বাজার করে চাল ডাল সবজি নিয়ে গেলে রাতে রান্না হত । ভাতে জল দিয়ে রেখে সকালে ভাই বোনে তাই খেত । এই ভাবে চার পাচ বছর কেটে গেল । বার বার ই বদলাচ্ছে ওদের কাজ কর্ম ।  মোটামুটি খাওয়াদাওয়া জুটছে মেয়ে তিনটেকেই থাকা খাওয়ার জায়গায় দিয়ে দিয়েছে । বাসন্তীও যা রোজগার করছে একটু থিতু হয়েছে মনে হয় । মুখে চোখে একটু চকচকে ভাব । এর মধ্যে এসে , দিদি একটু দেশে যাব । দেখে আসি ওদের মন কেমন করছে । আমি বলি , কার জন্যে বরের জন্যে ? ধন্যি বাপু তোদের প্রেম । তা যাচ্ছ যাও পেটে করে কিছু নিয়ে এস না যেন । আমি সতর্ক করি । ওকে কি কোন ভরসা  আছে ? মন ভুলে যায় পট করে । ফেরার সময় দেখি বাড়ির পান নিয়ে এসেছে । সুপুরি নিয়ে এসেছে । আমি বলি , কি রে খুব আদর যত্ন পেয়েছিস মনে হচ্ছে । এক গাল হাসি । কোথায় শুলি রাতে ? লজ্জায় একেবারে মাথা নুয়ে গেল । মাথাটা গেল গরম হয়ে । বললাম জানিস তোর আদর কেন বেড়েছে ? তুই বাচ্চা কাচ্চা মিলে টাকা পাচ্ছিস তো তাই । তোর একবারও কি মনে হল না , যারা তোর খবর করেনি গত পাঁচ সাত বছরে তারা আবার যোগাযোগ করছে কেন?

         — না গো দিদি , ওখানে তেমন আয় পত্তর নেই তাই এখানে আসতে চায় । শহরে তো রোজগারের অনেক রাস্তা আছে ।  আমি বলি অ । তা তোর সতীন আছে না গেছে । আছে গো , শরিল একদম শুকিয়ে গেছে । শ্বশুর মারা গেইছে । সে খাটতে পারত খুব । জমিজমা আর বেশি নেই । কি মজাতেই না আছে এই লোকগুলো । পিত্তি জ্বলে যায়। আদিখ্যেতা ! নিজের মনে গজ গজ করতে থাকি । পরের সপ্তাহে বাসন্তী দু তিন দিন কামাই করল । চিন্তায় থাকি , কি জানি আবার অসুখ বাঁধাল কি না । আসলে জিজ্ঞেস করি , কি রে কামাই করলি যে । শরীর খারাপ হয়েছিল? কোন উত্তর দেয় না । কি রে বল ?

       - সে এসেছেল, মাথা নিচু করে  এই মরেছে । আমি বলি, কে কে কে ? তোমাদের জামাই গো দিদি। দিদির মেজাজ ওর ভালই জানা আছে । আর দিদি যে এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশ বিরক্ত তাই কাচুমাচু মুখ । নিকুচি করেছে জামাইয়ের । এখানেও এসে হাজির হয়েছে !!    যাক গে আমার আর কি ! যার আম তার আঁটি , সে ই বুঝবে । চুপ করে থাকি । ভাবি এতদিন শহরে থেকে নিশ্চয়ই বুদ্ধি বেড়েছে
কিন্তু না , দিন পেরলো না । পরের মাসে দেখি মুখ শুকনো করে রাত নটায় কাজ সেরে যাওয়ার পথে হাজির হয়েছে । দিদি , এ মাসে হইনিক । কি বলিস মুখপুড়ি ! আঁতকে উঠি । এখন ? ভ্যাক করে কেঁদে পড়ল । কি করি এখন। মুখ দেখে কি যে মায়া হল । এই ভয় ই তো পাচ্ছিলাম । বলি, এখন কি করতে চাস ? রাখবি ? না
না গো দিদি , কোথায় রাখব ? তুমি ত সব জান সত্যি তো আমার থেকে বেশি ওর দিনগুলো আর কে দেখেছে !

        –বলি , ঠিক আছে আমায় একটু ভাবতে দে । পরদিনই ফোন করলাম আমার এক ডাক্তার বান্ধবীকে । দিনখন ঠিক হল । চিরদিনের মত শঙ্কা মুক্ত করালাম । যাক আর ভয় নেই । নিশ্চিন্ত হয় । এবার একটু শান্তিতে থাকবে । সে ও আর যাওয়া আসা করছে না। কিন্তু বাসন্তী মাঝে মধ্যে যাতায়াত করতে লাগল । ওখানে তার আদর যত্ন হচ্ছে বুঝলাম । টাকা পয়সাও হয়ত দেয় । আমাকে বলে না । আমি বার বার বলি মেয়েদের জন্যে যে খাতা খুলে দিয়েছি ব্যাঙ্কে প্রত্যেক মাসে সেখানে টাকা রাখিস কিন্তু । চারনম্বর এখন বাড়ি থাকে ভাইকে দেখে । তিন নম্বর আমাদের ওখানেই একটি বাড়িতে ঠিকে ঢুকেছে । সকাল থেকে রাত পর্যন্ত থাকে । রাতে মার সঙ্গে বাড়ি ফিরে যায় । যে বাড়িতে খাওয়া পরার কাজে দিয়েছিল  সে বাড়ির বাবুটির বেশি আদরযত্নের ফলে ওকে কাছে এনে রাখতে হয়েছে ।  চোখের সামনে থাকবে । দেখতে ও ই সবচেয়ে ভাল । ফর্সা রঙ । স্বাস্থ্য ও ভাল । নাক চোখ কাটা কাটা । সে আর বাঁচে ?

        হটাত একদিন কেঁদে পড়ল বাসন্তী, মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছে  না । কদিন থেকেই ওর হাব ভাব আমার কেমন কেমন ঠেকছিল । এত সাজগোজ বেড়েছে । কোথা থেকেই বা এত পয়সা পায় । আমি ভাবি দরকার কি সব ব্যাপারে নাক গলানোর । মেয়েরা বড় হয়েছে । ওরাই বুঝবে । আবার দু তিন দিন খবর নেই । আসে তিন দিন পর । আমি হা করে দাঁড়িয়ে । কি জানি কি শুনব ? আবার একগাল হাসি ।
- দিদি মেয়ে জামাইকে ঘরেই তুলে ফেললাম গো । ছেলেটি মন্দ নয় । বিগবাজারে চা বিক্রি করে । ছেলের মা ঘরে তোলেনি । পন ছাড়া বিয়ে । তায় আবার নিজে পছন্দ করে । আমার কাছেই আছে । কয়েকদিন পর নিজে এক কামরা দেখে বাড়ি ভাড়া নেবে । কিন্তু এক কামরা আর ভাড়া  নেওয়া হয় না ।  সাত মাসের পোয়াতি রেখে সে উধাও হয়েছে ……
 [সৌজন্য – ইন্দিরা মুখার্জি সম্পাদিত ওয়েব পত্রিকা ‘সোনার তরী’]