গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১২

মৌ দাশগুপ্তা


ভাইফোঁটা

সকাল থেকে উৎকন্ঠিতভাবে ঘর-বার করছিলো সোমা। কখন যে মেয়েটা আসবে। সন্ধ্যা নাগাদ মুখ কালো করে ভগ্নদূতের মত শ্লথ পায়ে সৌমীর ঘরে ফেরা দেখেই সোমা বুঝে গেল হাইকোর্টে ওরা গো-হারান হেরেছে। মেয়েটাকে একা ঘরে একটু কাঁদার সুযোগ করে দিতে বাইরের বারান্দাটায় আসতেই দোতলা থেকে জোরে হাসি, চিৎকার,লাউডস্পীকার দিয়ে উদ্দাম গান বাজানোর আওয়াজটা যেন চাবুকের মত কানে আছড়ে পড়ল। যুদ্ধজয়ের মহোৎসব। সোমা ঘরের জানালা দরজাগুলো চেপে বন্ধ করে দুহাতে সজোরে নিজের কান চেপে ধরলো।
উফফ ভগবান ! এ তোমার কেমন বিচার!
মায়ের পায়ের আওয়াজে জলেভেজা মুখ তুলে সৌমী বললো,
- মা, তোমার বিয়েতে দাদু প্রচুর বরপণ দিয়েছিলেন ? বাবা নগদ টাকা,সোনা-দানা এসব নিয়ে তোমায় বিয়ে করেছিলো ? জানো, ওটার জন্যই এবাড়ীতে তোমার কোন ভাগ নেই? বাবা পণ নিয়েছিল মা ?

সোমা বজ্রাহতের মত বসে থাকে। তথাকথিত পণ দেওয়ার আর নেওয়ার দুজন লোকই তো আজ ধরাসীমার বাইরে।বাকি সব তো টাকার জোরে বানানো কাগুজে বয়ান। সে দুজনের একজনও যদি আজ থাকতো তবে সোমার কি আর এই করুণদশা হতো ?

সোমা আর সুমন ভাইবোন । ওদের বাবা শক্তিপদবাবু ছিলেন সম্পন্ন ব্যবসায়ী। রীতিমত খোঁজখবর করে ছোটবেলার বন্ধু, বিপত্নীক অনাদিচরণের একমাত্র ছেলে শান্তিচরণের সাথে মেয়ে সোমার বিয়ে দিয়েছিলেন।চেনাজানার মধ্যে বিয়ে, দুবাড়ীর পারিবারিক অবস্থাও ভালো। দেনা পাওনার কোন কথাই ওঠে নি। তবে এটাও ঠিক,শক্তিপদবাবু সালঙ্কারা মেয়েকেই গোত্রান্তরিত করেছিলেন।কিন্তু কে আর জানতো বাবা মারা যাবার শোক ভুলতে না ভুলতেই ভালোমানুষ শান্তিচরণের কারখানাটাও বন্ধ হয়ে যাবে! মেয়ে বউ নিয়ে বেচারাকে উঞ্ছবৃত্তি করে সংসার চালাতে হবে! তা সে উঞ্ছবৃত্তি করার অপমানটাও মানুষটা বেশীদিন সইতে পারলো না।

স্বামীর আত্মহত্যার পর একরত্তি মেয়েটার হাত ধরে সোমা যখন পাকাপাকি ভাবে বাপের বাড়ী ফেরত এলো, তখন ওর বাবা মা দুজনেই স্বর্গে। বাড়ীর কতৃ ভাইবৌ কাজল। কাজল প্রথম থেকেই ব্যাপারটা সুনজরে দেখে নি। তিনতলা বাড়ীর একতলায় গারেজের পাশের কোণের একটা ঘর মা মেয়েকে থাকার জন্য ছেড়ে দিলেও আদতে শুধু খাওয়া পড়া দিয়ে যেন ঘরের কাজের লোক হিসাবে ওদের ঠাঁই দেওয়া হয়েছিল।এভাবেই অনাদর, অবহেলা, অপমান কুড়িয়েও শুধু মেয়েটাকে মানুষ করার অদম্য তাগিদে সব নিশ্চুপে সয়ে যাচ্ছিল সোমা।কিন্তু যেদিন অতিরিক্ত খরচের দোহাই দিয়ে সৌমীর কলেজের পড়াটাও কাজল বন্ধ করে দিল, সেদিন আর উপায়ন্তর না দেখে মেয়ের নামে রাখা, বাবার দেওয়া শেষ স্মৃতিচিহ্ন গলার হারটা বেচে বাড়ীর ভাগ চেয়ে কোর্টে মামলা করেছিল সোমা।জেলা কোর্টে সোমার জিত হওয়ায় মামলা টানতে টানতে হাইকোর্ট অবধি নিয়ে গেছিল সুমন-কাজল।সেখানে যে এভাবে হারতে হবে তা ভাবে নি সোমা।খালি হাতে ভাগ্যের ওপর, ভগবানের ওপর,ভরসা করে বসেছিল।

দরজায় জোরে ধাক্কা পড়তে চমকে উঠলো সোমা। দরজা খুলতেই দেখে সুমন দাঁড়িয়ে। অল্প অল্প টলছে।ওই অবস্থায় মামাকে দেখেই হয়তো পায়ে পায়ে উঠে এসে মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছিল সৌমী। দিদিকে উপেক্ষা করে সৌমীর দিকে তাকিয়ে সুমন জড়ানো গলায় চেঁচিয়ে বললো,
- বড় আস্পদ্দা হয়েছ না? ভালমন্দ খেতি পরতি,সে আর পোষালো না! এখন মায়ে ঝিয়ে বেরোও আমার ঘর থেকে। দুর হও। আজ রাতটা বাদে কাল সকালে যেন কারো মুখ না দেখতে হয় ! তাহলে কিন্তু চাকর ডেকে ঘাড়ধাক্কা মেরে বাইরে বার করে দেব। আমার নামে মামলা করা? এই সুমন মুকুজ্জের নামে?  এখন বোঝো, কত ধানে কত চাল!

ঘরের বাতাসে তীব্র মদের গন্ধ ছড়িয়ে সুমন দপদপ করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল।কাজলের জোর গলার টিটকারি, ব্যঙ্গের হাসি ছাপিয়ে ভেসে আসলো ঢাকের বাদ্যি,কান ফাটানো শব্দবাজী আর কোলাহল।দূরে কোথাও কালী প্রতিমা ভাসান যাচ্ছে। হঠাৎই দুচোখ জ্বালা করে জলে ভরে এল সোমার।

আজ ভাইফোঁটা, না ?