গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১২

দুপুর মিত্র


ভর দুপুরে মাঝ দরিয়ায়        
        
নৌকা ভ্রমণ একেবারে নিজের মত করে মানে ঘটা করে নয়, হই হুল্লোড় করে নয়, নীরবে-নিভৃতে নৌকা ভ্রমণটা সাধারণত করা হয় না আমাদের। কিন্তু সেই করা না হওয়াটা আরাধ্য করতেই আমি আর বীথি আজ নদীর পাড়ে। শহর থেকে নদীর পাড়ে এসে পৌঁছতে দুপুর চলে এল। এই নদী মানুষ এ পার থেকে ওপারে যাতায়াতের জন্য খুব একটা ব্যবহার করে না। তাই বরাবরই লোকজন থাকে কম। আজ এই ভর দুপুরে যেন আরও কম।
         
         বেদেদের নৌকাগুলো সারি সারি করে রাখা। কয়েকটি বেদে পরিবারের মানুষ জনকেও দেখা যাচ্ছিল। তারা নৌকায় বসে রান্না করছে। ঘাটে এসে আমরা একটা নৌকা ভাড়া করলাম। সারাদিনের জন্য ৫০০ টাকা। লোকটা খুব খুশি। এত টাকা দিয়ে নৌকা সাধারণত ভাড়া করে না কেউ। এখানে যারা আসে, তাদের অধিকাংশই প্রেমিক-প্রমিকা। ১ ঘণ্টার জন্য বা দুই ঘণ্টার জন্য নৌকা ভাড়া করে ঘোরে। তাতে ১ ঘণ্টার জন্য ৫০ টাকা করে দিতে হয়। কিন্তু আমি নৌকাটা একেবারে নিজের করে নিলাম। মানে নৌকাটা আমি চালাব। মাঝি লাগবে না। নিজের মত করে চালাব। মাঝি একবার জিজ্ঞেস করলেন- আপনি আগে কখনও নৌকা চালাইছেন? টাকার লোভে পরে হয়ত আর কিছু বলেনি বা বলতে চায় নি। কেবল একবার বিড়বিড় করে বলল- ভরদুপুরে মাঝ নদীতে যাবেন না স্যার। আমি অবশ্য নৌকা আগে চালিয়েছি। আমাদের বাড়িতেই বিশাল বড় পুকুর রয়েছে পুকুরের তত্ত্বাবধানের জন্য প্রায়ই বাবা আমাকে পাঠাতেন। তখন নৌকা চালিয়ে চালিয়ে পুকুরের এপার থেকে ওপার ঘুরে বেড়াতাম। 

        বীথি একটু ভীতু টাইপের। নদী এলাকার মানুষ হবার পরও সাঁতার শেখেনি। নদীর জল আমাকে যতটা না আবেগী করে তুলে, বীথিকে ঠিক ততটাই ভয়ার্ত করে তুলে। বীথির ধীরে ধীরে নৌকায় পা পড়ল। একটু ভয়, একটু রোমাঞ্চ, একটু আবেগ নিয়ে বীথি নৌকার এক পাশে বসল। আমি ধীরে ধীরে নৌকা চালানো শুরু করলাম। আমার নৌকা চালানো দেখে বীথি খুব খুশি। আমি নৌকা চালাতে পারি, এটা তার জন্য অনেক বড় ব্যাপার। মানে সকল পুরুষ মানুষের বোধহয় নৌকা চালানোর অভিজ্ঞতা থাকতে হয়, তা না হলে সে পুরুষ না। মানে সাহসী না, মানে নারীকে নিয়ে চলার মত না। মানে যে পুরুষ নৌকাই চালাতে পারে না, সে কিভাবে একজন নারীকে নিয়ে ঘর-সংসার করে। নৌকার বৈঠায় এক এক করে যখন ভর দিচ্ছিলাম, নদীর স্রোত, জলের শব্দ আর বাতাসের আনাগোনায় একটা নিবিড় ছন্দের সৃষ্টি হয়েছিল। আমার গান গাইতে ইচ্ছে হল। গান ধরলামও। ওরে সাম্পানের নাইয়া। বীথিও বেশ উল্লসিত। এতটাই উল্লসিত যে বীথি আনন্দে এই থরথর নৌকায় নাচানাচি করবে এরকম পরিস্থিতি। কিন্তু নৌকা যখনই এদিক সেদিক হেলে যায়, তখনই সে ভয়ে চুপ হয়ে যায়। বীথিও অবশ্য আমার সঙ্গে গান ধরল।

        ধীরে ধীরে আমাদের নৌকা একেবারে মাঝ নদীতে এসে পৌঁছাল। ভর দুপুরে মাঝ নদীর দৃশ্য আসলেই অন্যরকম। চারপাশে তাকালে কিছুই দেখা যায় না। কেবল জল আর জল ছাড়া। কেবল জল আর জল ছাড়া। রোদ-জল আর বাতাসের যাচ্ছেতাই খেলাটা কেবল ভরদুপুরে মাঝ নদীতে আসলেই দেখা যায়। দুপুরের এই সময়টায় নদীতে জোয়ার চলছিল। এতে কেমন আরও উন্মত্ত, প্রাণোচ্ছল মনে হচ্ছিল নদীকে। আমি একবার নদীর দিকে তাকালাম, আরেকবার বীথির দিকে। এইভাবে কয়েকবার। এই মাত্র মনে হল এত উন্মত্ত নদী আগে কখনই দেখিনি। নদীটি কি যেন চাইছে। আমি হাত বাড়িয়ে নদীর জল ছুঁয়ে দেখলাম। বীথিও আমার মত নদীর জল ছুঁয়ে দেখতে চাইল। ও সাঁতার জানে না তাতে কি, ও যদি নদীতে পড়ে মরে তাতে কি, নদী যদি আজকে ওকে নিয়ে যেতে চায় তাতে ! ও জল ছূঁয়ে দেখুক। নদীর জল কেমন। আমি বারণ করলাম না। বীথি একেবারেই শিশুদের মত করে এক হাতে নৌকার একটা অংশ শক্ত করে ধরে নদীর জল ছুঁলএকবার সাহস পাবার পর সে যেন একটা খেলা পেয়ে গেল। যেন সে আগে কখনই জল ছোঁয় নি। সে বারবার নদীর জল ছুতে শুরু করল। নৌকাটা একটু নাড়িয়ে দিলেই বীথি পড়ে যাবে। ও যখন হেলান দিয়ে নদীর জল ছোঁয়ার চেষ্টা করল তখন একবার মনে হল নৌকাটা একটু নাড়িয়ে বীথিকে ফেলে দেই। এই ভরদুপুরে নদীর স্রোত আর বীথি! আমি একবার নৌকাটা নাড়ালাম। বীথি চিৎকার করে ওঠল। খবরদার। নৌকা নাড়াবে না। বীথি কি টের পেল আমি ওকে ফেলে দিতে চাচ্ছি। নদী ওকে চাইছে !

         হঠাৎ খেয়াল করলাম- মাঝ নদীতেই আমাদের থেকে অল্প দূরে আরেকটি নৌকায় একজন বেদেনি আমাদের দেখে হাসছে। আমি এতক্ষণ ভেবেছিলাম মাঝ নদীতে কেবল আমরা দুজনই। বেদেনি চিৎকার করে বলছে, ও স্যার, মাঝ নদীতে এসে গেছ। ভরদুপুরে কেউ মাঝনদীতে আসে না। আমি বুঝতে না পারলেও সন্দেহটা হল বীথির। বীথি আমাকে এবার তাগাদা দেওয়া শুরু করল। এই চল, চল। নদীর পাড়ে চলে যাই। আমি আস্তে আস্তে নদীর পাড়ে দিকে নৌকা ভেড়াতে শুরু করলাম। তখনই মনে পড়ল আমি কিন্তু বীথিকে নদীতে ফেলে দিতে চেয়েছিলাম। আমার ভিতরে কেন এমনটা হল। আমি কেন বীথিকে নদীতে ফেলে দিতে চাইলাম! - এরকম ভাবতে যে মাঝির কাছে থেকে প্রথমে নৌকাটি ভাড়া করে এনেছি, তার বিড়বিড় করে বলা কথা মনে পড়ল; ভরদুপুরে মাঝ নদীতে যাবেন না স্যার।