অদ্ভুতুড়ে
সম্প্রতি একটা কাজে ঢুকেছি। কাজটা অনেকটা এরকম - আমার কাছে
বাড়ির ঠিকানা থাকে, সেইমত আমি কালেকশন করে
বেড়াই। দিনের শেষে মালিককে সমস্ত হিসেব বুঝিয়ে নিজের পাওনা গণ্ডা বুঝে নিয়ে বাড়ি
ফিরি। এমন একটা কাজ; যে কাজের সুত্রে
বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় এবং নানা অদ্ভুত ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। এমন সব ঘটনা যে
সেগুলোতে হাসব না কাঁদব ঠিক করা মুস্কিল। প্রতিটি মানুষেরই কোন না কোন দুর্বলতা, বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে। আমরা হয়ত লক্ষ্য করি, হয়ত করি না।আর বেশি সাহিত্য কপচাবো না। গল্পটা বরং শুরু করা
যাক।
প্রথম বাড়িতে – সেদিনও
বেরিয়েছি টাকা আদায় করতে। দেখি এক বয়স্ক ভদ্রলোক চেয়ারে বসে আছেন। গিয়ে নিজের
পরিচয় দিয়ে টাকা চাইতে তিনি আমাকে বসতে বললেন। ভেতরে ঢুকে হেঁড়ে গলায় চা করতে
বললেন এবং ফিরে এসে লম্বা মাটির বারান্দায় আগা থেকে মাথা অবধি পেছনে হাত দিয়ে মাথা
নিচু করে পায়চারি শুরু করলেন। আমার সাথে কথা বলছিলেন এবং পায়চারি জারি ছিল। উনি
আমার সাথে কথা বললেও মাথাটা ছিল নিচু। মাথা নিচু করেই পায়চারি পর্ব ও আড্ডা পর্ব
চলছিল। আচম্বিতে দুম করে একটা জায়গায় বসে পড়লেন এবং একটা হতাশাসূচক শব্দ করেই
উঠোনের কোত্থেকে এক চিমটে কাদামাটি এনে বারান্দার ওই রহস্যময় জায়গায় লাগিয়ে দিয়ে
আঙ্গুল দিয়ে সমান করে দিলেন। আমি কিছু বোঝার আগেই উনি একগাল হেসে বীরত্বের সাথে
বর্ণনা করলেন – “হেহে... একটা ফুটো
ছিল।পিঁপড়ের গর্ত। বুজিয়ে দিলাম।“ আমি তো
হতবাক! এ ব্যাটা পাগল নয়ত? এখনও তো টাকা দেয়নি!
আমার শরীরের মধ্যেই তো গণ্ডাখানেক ফুটো আছে। ব্যাটা, মাটি নিয়ে আমার নাকে কানে হামলা না করে! কোনমতে চা গিলে টাকা
নিয়ে চম্পট দিলাম হরির নাম করে।
দ্বিতীয় বাড়িতে – নমস্কার পর্ব সেরে বাড়ির মালিককে বললাম টাকার কথা। বললেন “হবে হবে”। আমি একটু জল খেতে চাইলাম, উনি বললেন “হবে হবে
দাঁড়াও”। মনে মনে বললাম “বসতে চাইনি
রে হতভাগা”। যাই হোক, জল খেয়ে বললাম “ আমার একটু
তাড়া আছে দাদা, আরও বাড়ি যেতে হবে, একটু তাড়াতাড়ি করলে ভালো হয়”। উনি বললেন “হবে হবে”, বলেই ঘর
থেকে একটা হিসেবের খাতা বের করে কিসব হিসেব শুরু করলেন। আবার বললাম “দাদা একটু তাড়াতাড়ি!”। বরাবরের মত ক্যাসেট বাজল “হবে হবে”। মেজাজ খিঁচরে গেলো। বললাম “ আপনার বউয়ের দ্বিতীয় বিয়ে হয়নি বলেই তো শুনেছি” । খাতার ভেতর মাথা ঢুকিয়েই চটজলদি উত্তর “হবে হবে”। খ্যাঁক খ্যাঁক করে বিকট হাসার পর
ভদ্রলোক বুঝলেন বিদায় করলে সম্মান থাকবে। একটা গোপন কথা বলি, সম্মানের পাউভাজি হয়ে গেছিল সেই সপ্তাহেই আমাদের তাসের
আড্ডায়।
তৃতীয় বাড়িতে – বাড়ি ঢুকতেই
লক্ষ্য করলাম দরজার দুই পাশের মাটি লাল হয়ে আছে। ভদ্রলোক যে রসিক লোক তা সেটা রসাল
পানের পিকমিশ্রিত লাল মাটি দেখলেই টের পাওয়া যায়। দুমাস থেকে ঘুরছি, টাকা দেবার নাম নেই। যতবার ফোন করি বলে, টাকা নেই। এবার তাই সোজা বাড়িতে। যাই হোক, ভেতরে ঢুকলাম। ঢুকেই যা দেখলাম তাতে চক্ষু ছানাবড়া না হলেও
পানবড়া হবার জোগাড়। হোঁৎকা মতন এক লোক বেঞ্চে বসে বসে রেডিওতে গান শুনছেন আর
বেঞ্চের একপাশে একটা বড় থালায় সাজানো আছে খান পঁচিশেক পান। গোটা বাড়ি জর্দার গন্ধে
মম করছে। অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসার উপক্রম! টাকা চাইলাম। উনি মুখের পান ফেলে আর
একটা মুখে পুরলেন। আবার বললাম, আবার একটা
পান। এক মিনিটে একটা পান আস্ত রামছাগলের মত কচকচ করে কএকবার চিবিয়ে পুচ পুচ করে
কএকবার পিক ফেলেই আবার আর একটা। গত দশ মিনিটে আটটা পান মুখে ঢুকেছে এবং দুটো শব্দ মুখ থেকে বেরিয়েছে। “বস” আর “দিচ্ছি”। তাও সেটা অনেক কষ্টে মুখের ভেতর ওই
পানের বরজ থেকে বের হল। মাথা এত গরম হয়ে যাচ্ছিল যে বলার নেই, কিন্তু খরিদ্দার হলেন নারায়ণ ; অতএব চুপটি করতে সয়ে যাও! কিন্তু আমি একটু ট্যারা গোছের
বান্দা। যখন দেখলাম পনেরো মিনিট পার হয়ে গেলো অথচ না পান খাওয়ার বিরাম আছে আর না
ওই রেডিওর ঘ্যানঘ্যান বন্ধ হচ্ছে, তখন উঠোনের
পাশে বাঁধা ছাগলটাকে টেনে আনলাম বেঞ্চের পাশে। বেঞ্চের উপর উঠিয়ে থালা থেকে একটা
পান ছাগলের মুখে ঢুকিয়ে দিলাম (গেঁজিয়ে দিলাম) এবং ছাগলের দিকে তাকিয়ে বললাম “দাদা, একটু তাড়াতাড়ি করুন”। ভদ্রলোক এই দেখে মুখে জল দিলেন। ওনার হোঁৎকা শরীরের মধ্যে
আপেলের মত মুখটা তখন দেখার মত ছিল!
সারাদিন এই করার পর ঘড়িতে দেখি এগারোটা ছাপ্পান্ন বাজে। আমার
এবং ঘড়ির; এই দুইয়ের একসাথে বারোটা বাজার আগেই
আমার চেনা দোকানে গিয়ে বসলাম। এটা হরেনদার পানের দোকান। এখানে আমার নিত্য আড্ডা।
হরেনদাকে মাত্র বলেছি “মহাজ্বালা বুঝলে!...”, কানের পাশে ধ্বনিত হল “দাদ, হাজা, চুলকুনি যে কোন রকমের জ্বালা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয় আমাদের
এই অব্যর্থ জড়িবুটি...”
আগেরসংখ্যা- http://galpogucchho.blogspot.in/2012/11/blog-post_6468.html
আগেরসংখ্যা- http://galpogucchho.blogspot.in/2012/11/blog-post_6468.html