গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৪ নভেম্বর, ২০১২

ওয়াসিকুজ্জামান অনি



শিশুতোষ গল্প

কুটুশ ও কচ্ছপ

সেদিন ছিল ছুটির দিন, স্কুলে চলছে গ্রীষ্মের বন্ধ তাই পড়া শোনাও নেই। কুটুশ মহা আনন্দে তাঁর গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এ গাছ থেকে ফল পাড়ছে না হলে প্রজাপতির পিছনে ছুটছে। রোদেলা ঝক ঝকে দিনে মন খুশীতে ভরে আছে। খেলতে খেলতে তাঁর এক সময় দেখা হয়ে গেল স্কুলের বন্ধু রিঙ্কুর সাথে। রিঙ্কু তখন তাঁর আরো এক বন্ধু পিটার কে নিয়ে হন হন করে হাটছিলো বনের দিকে। হঠাত কুটুসের সাথে দেখা হয়ে যাওয়ায় রিঙ্কু আর কুটুশ খুব খুশী হল।
কুটুশ রিঙ্কুকে শুধাল ‘কোথায় যাচ্ছ তোমরা’ ? রিঙ্কু  বলল ‘আমরা বনের ধারে লেকের পারে বনভোজন করব, সারাদিন লেকে ভেলায় চড়ব আর তীরে বসে রোদ পোহাব। তুমিও চলনা কুটুশ আমাদের সাথে, আমার কাছে যথেষ্ঠ খাবার আছে আর তিনজন হলে মজাও হবে খুব’ কুটুশ তখন বলল ‘আমাকে পাঁচ মিনিট সময় দাও আমি মা'কে বলে অনুমতি নিয়ে আসি’এই বলে সে এক দৌড়ে তাঁর বাসায় গিয়ে মা এর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসল। মা শুধু তাকে বলে দিলেন সন্ধ্যার আগেই যেন বাড়ী ফিরে আসে। আর তাঁদের তিনজনের জন্য স্যান্ডউইচ বানিয়ে দিলেন। তারপর তারা তিনজন মিলে গান গাইতে গাইতে চলল বনের পথে।

        বনে ঢুকে তারা জংলী ফুল তুলে তাঁর মধু খেল, বুনো কাঠাল ভেঙ্গে মজা করে খেল তারপর হেটে আর দৌড়ে নানা মজা করে তারা পৌঁছুল লেকের ধারে। সেখানে গিয়ে পিটার তাঁর ব্যাগ থেকে একটা চাঁদর বিছাল আর খাবার দাবার সাজাতে লাগল। আর রিঙ্কু তখন ব্যাস্ত হয়ে পড়ল রাবারের ভেলায় পাম্প করে বাতাস ভরতে। কুটুশ সাথে করে আনা বড় একটা বিচ ছাতা বসাতে লাগল বিছানো চাদরের পাশে। নির্জন লেকের তীর তিনবন্ধুর কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠল। তারা কিছুক্ষন লুকোচুরী খেললো বনের ধারে। গান গাইল গলা ছেড়ে। বাতাসে যেন আনন্দ ভেসে বেড়াচ্ছিল। তাঁদের কোলাহলে চমকে উঠে দু একটা হরীন তাকাল তাঁদের দিকে তারপর আবার মুচকি হেসে ঘাস খাওয়ায় মন দিল। একটা মস্ত ঢোড়া সাপ একটু পানি খেয়ে শব্দে ভয় পেয়ে সড়সড় করে ঢুকে পড়ল নলখাগড়ার ঝোপে। আর দু একটা বয়স্ক কাঁক বাচ্চাদের চ্যাচামেচিতে বিরক্ত হয়ে কা কা করতে করতে চলে গেল লেকের ওইপারে। দু একটা মাছও পানি থেকে উঁকি দিল কি চলছে তা দেখার জন্য।

        কিছুক্ষণ খেলার পর তিনবন্ধু মিলে স্যান্ডউইচ খেয়ে ভেলায় চড়ে লেকে ঘুরতে লাগল আপন মনে। তারা কখন লেকের মাঝে কখন লেকের ওইপারে ইচ্ছেমত ঘরতে লাগল। ঘন্টা খানেক ঘুরবার পর লেকের ঐপারে তারা ভেলা ভিড়াল একটু জিরিয়ে নেবে বলে। তারা তীরে গাছের ছায়ায় বসে নানা গল্প করছে এমন সময় অস্পষ্ট একটা চিতাকার শুনল তাঁরা। পিটার শুধাল তোমরা কি কিছু শুনেছ? তিনজনই কান খাড়া করে চেষ্টা করল শুনবার। তখন যেন তাঁরা শুনল একটু ভিতরের জঙ্গলে কেউ যেন চিৎকার করছে- ‘আমাকে বাঁচাও, কেউ কি শুনছ, আমাকে সাহায্য কর’ তিনবন্ধুই চিৎকার শুনে ঘাবড়ে গেল, না জানি কি বিপদ আছে।
তখন রিঙ্কু বলল ‘চল চলে যাই এখান থেকে, আমরাও না জানি কোন বিপদে পড়ব’ কিন্তু পিটার আর কুটুশের মনে হল চিৎকারটা কিসের তা দেখা উচিৎ। রিঙ্কুর সাথে এ নিয়ে কথা বার্তা বলে শেষ পর্যন্ত কৌতুহলেরই জয় হলো। তাঁরা তিনজন মিলে আস্তে আস্তে নলখাগড়ার ঝোপ ঠেলে ঢুকতে লাগল বনের দিকে। কিছু দুর গিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় তাঁরা দেখল একটা কচ্ছপ শিকারীদের পাতা ফাঁদে আটকে গেছে আর ফাঁদ থেকে মুক্তি পাবার জন্য প্রাণপণ চিৎকার করছে।

        কুটুশ তাকে সুধাল ‘তুমি ফাঁদে পড়লে কিভাবে ? কচ্ছপ বলল, ‘ঘরে আমার তিন বাচ্চা তাঁদের জন্য একটু বেশী খাবার জোগাড় করতে ঢুকেছিলাম বনে। ফাঁদের ভেতরের এই আপেলটা দেখে যেই ধরতে গিয়েছি তখনি দেখি আমি ফাঁদে বন্দী কোনভাবে বেরুবার পথ পেলাম না। হয়ত কিছুক্ষন পরে শিকারীরা এসে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে, দয়া করে আমাকে সাহায্য কর তোমরা’

        রিঙ্কুটা ছিল ভিতুর ডিম, সে সাথে সাথে কুটুশ আর পিটারকে বলল ‘চল চল এখানে থেকে আর কাজ নেই নাহলে হঠাত শিকারীরা আসলে আমরাও বিপদে পড়ব’ একথা শুনে পিটার একটু ইতস্তত করছিল আর কচ্ছপটা আকুল হয়ে বলল ‘দেখ ঘরে আমার তিনটা বাচ্চা আছে, আমি যদি না যাই তবে তাঁরা না খেয়ে মারা যাবে নতুবা জলের অন্য কোন হিংস্র প্রানী তাঁদের খেয়ে ফেলবে, দয়া করে আমাকে সাহায্য কর’ কুটুশ কিন্তু তখন কিছু না বলে ফাঁদটা দেখছিল, তাঁর পর সে তাঁর বন্ধুদের বলল , ‘একে ফাঁদ থেকে মুক্ত করা সম্ভব, ঐ দেখ ফাঁদের কিনারগুলো দড়ি দিয়ে বাঁধা আছে, আমরা যদি ঐ দড়ি কেটে দেই তবে ফাঁদের একধার খুলে যাবে আর কচ্ছপ মুক্তি পাবে’ 

        রিঙ্কু তখন বলল ‘কাজ নেই এ উপকার করবার বরং চল আমরা তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাই এখান থেকে নাহলে আমরাও বিপদে পড়ব’ তখন পিটার বলল, ‘কুটুশ ঠিকই বলেছে , আমাদের আছে তীক্ষ্ণ দাঁত যা দিয়ে ঐ দড়ি কেটে আমরা কচ্ছপকে মুক্ত করতে পারব’ সাথে সাথে কুটুশ বলল ‘তা ছাড়া বিপদে পড়া কাউকে সাহায্য করা আমাদের দায়িত্ব’ তাঁদের এমন ভাবনায় রিঙ্কু খুব লজ্জা পেয়ে বলল ‘তোমরা ঠিকই বলেছো। চল আমরা কাজে লেগে পড়ি’ এই বলে তাঁরা তিনবন্ধু মিলে কুট কুট করে দাঁত দিয়ে কাটতে লাগল দড়িটা। দড়িটা শক্ত আর মোটা হলে কি হবে তা কি আর ইদুর ছানাদের দাঁতের জোরের সাথে পারে। দশ মিনিটের মাথায় তাঁরা দড়ি কেটে ফাঁদের বাক্সটার এক ধার খুলে কচ্ছপকে মুক্ত করে দিল। 

         এদিকে মুক্তির আনন্দে কচ্ছপটার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল, সে তখন তিনবন্ধুকে বলল, ‘তোমাদের কাছে আমি আর আমার বাচ্চারা চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব’ তখন পিটার বলল ‘চল আর এখানে থেকে কাজ নেই শিকারীরা আসার আগেই আমরা পালিয়ে যাই’ সাথে সাথে সবাই বলল ঠিক ঠিক। তাতে মনে হয় গাছের খোড়লে থাকা টিকটিকিও সায় দিল ঠিক ঠিক বলে। তাঁরা সবাই মিলে চলল আবার লেকের পারে। কচ্ছপ আরেকবার তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে লেকের জলে ডুব দিল আর তাঁরা তিনবন্ধু ভেলা নিয়ে ফিরে আসল লেকের এই পারে তারপর খাওয়া দাওয়া করে বিকেল হতেই ফিরতে লাগল তাঁদের গ্রামের দিকে। তিনজনেরই মনে একটা ভাল কাজ করার আনন্দ। সন্ধ্যার আগেই তাঁরা তাঁদের যার যার বাসায় ফিরে গেল। কুটুশ ফিরে এসে তাঁর বাবা মা কে পুরো দিনের সব ঘটনা বলল। সবকথা শুনে তাঁর বাবা মা আর ভাইবোনেরা খুব খুশী হল।

        কুটুশের মা বললেন- তোমরা খুব ভালো কাজ করেছ কচ্ছপকে বাঁচিয়ে, তা নাহলে তাঁর বাচ্চারা অনাহারে মারাই যেত। এর পর গ্রীষ্মের ছুটি কেটে স্কুল আবার খুলে গেল। যথারীতি নিয়মে সব কিছু চলতে লাগল। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল এক বছর। পরেরবছর গ্রীষ্মের ছুটিতে কুটুশ, রিঙ্কু আর পিটার মিলে ঠিক করল তাঁরা আবার যাবে ঐ বনের ধারে লেকে বনভোজন করতে। এবার তাঁদের সাথে তাঁদের আরেক বন্ধু রীনা যোগ হল। চার বন্ধু মিলে একদিন খুব আনন্দ নিয়ে আগেরবারের মত খেলতে খেলতে আর বুনোফুলের মধু খেতে খেতে পৌছে গেল বনের ভিতরের সেই লেকের পারে। আগেরবারে মত কেউ টঙ্গাল ছাতা, কেউ বসার চাঁদর, কেউ খাবার সাজাল আবার কেউ ভেলাতে বাতাস ভরল। কিছুক্ষণ বনে লুকোচুরি খেলে তাঁরা ভেলায় চড়ল লেকের জলে ভেসে বেড়াবে বলে। লেকের স্বচ্ছ জলে একেবারে তল দেখা যায়। নানা রঙের মাছ খেলে বেড়াচ্ছিল। আবার জলে ভেলার নড়াচড়া দেখে দু একটা গলদা চিংড়ী আর কাকড়া ভয় পেয়ে দুড়দাড় করে প্রবালের নিচে গিয়ে লুকোচ্ছিল। রঙ বেরঙের প্রবালে যেন অন্য একটা জগত। তাঁরা এক মনে ভেলার ধার থেকে তাকিয়ে ছিল জলের দিকে। এদিকে ভাসতে ভাসতে তাঁদের ভেলা এসে পড়েছে একেবারে লেকের মাঝখানে।  তাঁরা তন্ময় হয়ে জলের দিকে তাকাতে থাকায় কেউ খেয়াল করেনি, হঠাত করে চারদিক থম মেরে গিয়েছে। ইশান কোণে পাগলা মেঘেরা আড়মোড় ভাংছে। একটা ঝড় এল বলে, চারদিক আধার হয়ে আসছে। 

        অল্পকিছুক্ষনের মধ্যেই মেঘ চলে এল তাঁদের উপরে, কিন্তু তাঁরা তখন তন্ময় মাছ দেখায়। এমন সময় কড় কড় কড়াত করে বনের ধারে বাজ পড়ল আর শুরু হল ঝড়। সেকি তাঁর গর্জন আর প্রচন্ড বাতাস। তাঁরা কিছু বুঝার আগেই পড়ে গেল ঝড়ের মুখে। বাতাসের এক ঝপাটায় তাঁদের বৈঠা আর খাবার দাবার উড়ে গেল কোনদিকে। ভেলাটা ফুসে ওঠা ঢেউ এর মাথায় চড়ে নাচতে লাগল। কিছু বুঝবার আগেই যেন এক মহা প্রলয় শুরু হল। চার বন্ধু তখন একে অপরকে জড়িয়ে প্রান ভয়ে কাঁদতে লাগল। প্রচন্ড বাতাস আর ঢেউ এ তাঁদের ভেলাট একবার লাফিয়ে উঠছিল উপরে আর একবার ধপ্পাস করে পরছিল। ভেলার উপরে যেন টিকে থাকাই দায়। একসময় বাতাসের একটা ঝাপটা ভেলেটাকে দিল উল্টে আর চারবন্ধুই পড়ে গেল জলে। জলে পড়ে তাঁরা হাবুডুবু খেতে লাগল। তাঁরা কেউই সাঁতার জানতনা তাই জল খেতে খেতে আস্তে আস্তে তাঁরা ডুবতে লাগল। তাঁরা অনেক চিৎকার করল, কিন্তু নির্জন বনে বাতাসের শব্দে তাঁদের চিৎকার, সাহায্যের আবেদন সব চাপা পরে গেল। 
ঠিক এমন সময় হঠাত কুটুশ অনুভব করল সে ভেসে উঠছে। তাঁর নিচে একটা শক্ত কিছু তাকে ঠেলে তুলছে জলের উপর। সে ভাবল হয়ত সৃষ্টিকর্তা তাঁর ডাক শুনেছেন। ভেসে উঠবার পর সে বুঝতে পারল সে একটা কচ্ছপের খোলে শুয়ে আছে। চারদিকে তাকিয়ে দেখল রিনা, রিঙ্কু আর পিটারও একই ভাবে আরো তিনটা কচ্ছপের খলে বসে আছে। চারটা কচ্ছপ মিলে দ্রুত সাঁতরে তাঁদের পৌছে দিলে লেকের পারে। ডাঙ্গায় উঠে চার বন্ধুই যেন হাপ ছেড়ে বাচল এই প্রবল বিপদ থেকে। ইতিমধ্য ঝড়ের প্রকোপ কমে গেছে।

        তাঁরা একটু সাভাবিক হয়ে চার কচ্ছপকে অনেক  ধন্যবাদ জানাল তাঁদের উদ্ধার করবার জন্য। তখন সবথেকে বড় কচ্ছপটা বলল- ‘ধন্যবাদ দেবার দরকার নেই, তোমাদের বাঁচান আমার কর্তব্য ছিল, মনে আছে একদিন তোমরা আমাকে শিকারীর ফাঁদ থেকে বাচিয়েছিলে। আর সে কারণেই আমি আমার বাচ্চাদের কাছে ফিরে যেতে পেরেছিলাম। আমার সাথের এই তিনজনই আমার সেই তিন বাচ্চা। তাই আজকে যখন তোমরা বিপদে পড়েছ আমরা সবাই মিলে তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে এলাম। বিপদ গ্রস্তকে সাহায্য করতে হয়, না হলে সমাজে টিকে থাকা খুব কঠিন’

        রীনা বাদে বাকি তিনবন্ধুর সাথে সাথে একবছর আগের সেই ঘটনা মনে পড়ল। এবং তাঁরা কচ্ছপদের পেয়ে খুব খুশী হল। ইতিমধ্যে ঝড় থামায় কচ্ছপেরা বিদায় নিয়ে ফিরে গেল জলে আর চার বন্ধু মিলে ফিরে চলল তাঁদের গ্রামের দিকে। পরে সেই কচ্ছপদের সাথে কুটুশ আর তাঁর বন্ধুদের অনেক খাতির হয়ে গিয়েছিল। যখনি তাঁরা ছুটি পেত বনের ধারে লেকের পারে যেত আর কচ্ছপ পরিবারের সাথে গল্প করত আর খেলত।