বিবেকানন্দ রোডের পুরাতন বাড়ি ছেড়ে যাদবপুরে এসে
হাজির হল কূজন। পাঁচতলার ফ্ল্যাটের ছোট্ট ঘরটা যেন সারাদিনের যুদ্ধের শেষে বিশ্রাম
নেওয়ার তাঁবু। এ কটা দিন এত ঝড় গেছে কুজন আর কাকলির ওপর দিয়ে যে যাদবপুরের এই মাঝারিমাপের দুটো ঘর,
ডাইনিংরুম, রান্নাঘর আর একচিলতে বারান্দাটাই যেন
তাদের কাছে ভাগ্যবিজেতা হওয়ার লাকি টিকিট । সত্যি এত কিছুর পরও যে শান্তি আছে তা এই ঘরে
এসেই মনে হচ্ছে । কদিন কানের কাছে যা বেজেছে তারপর এই ঘরের
নিঃস্তব্ধতায় কুজন স্পষ্ট অনুভব করছিল তার সাত বছরে সেই চঞ্চল প্রেমিকা কাকলির নিঃশ্বাসের
শব্দ, ক্রমশঃ
বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া হৃদস্পন্দন।
বিয়ের
পর পর দুজনের ওপর দিয়ে এমন ঝড় বইল যে মাত্র দেড় বছরেই তারা ভুলতে বসেছিল
তাদের সেই একে অপরকে প্রথম অনুভব করার মুহূর্তগুলো। উস্কোখুস্কো চুলে
আলতো হাত বুলিয়ে দিয়ে কূজন বলল , “তোমার ওপর অনেক অত্যাচার হয়েছে, জানি, সে আমার ব্যর্থতা”। কাকলি সহসা স্থির, একপলক দুপলক, হঠাৎ বলল, “অত্যাচার? কিন্তু তুমিতো করনি।
তবে ব্যর্থতা কিসের?
আর যদি সেটা না হত
তবে কি আজ আমরা এত কাছাকাছি আসতে পারতাম”? ছোট্ট এই ফ্ল্যাটবাড়িকে সুন্দর করে সাজানোর
স্বপ্ন কাকলিকে এত বেশি ভাবিয়ে তুলেছিল যে সে তার পুরাতন স্মৃতিকে আর ভাবার জায়গায়
আনতে পারছিলনা। সারা গায়ের জায়গায় জায়গায় ক্ষতগুলো যেন ভাঙাচোরা দেওয়ালের ওপর নতুন
চাপানো রঙের স্বাদ পাচ্ছিল। গাঢ় বাদামী দুই চোখে তখন রামধনু রঙ স্বপ্ন। আর সেই
স্বপ্ন যেন এসে স্পর্শ করছিল কূজনের হৃদয়কে। ছন্দপতন হওয়া সত্ত্বেও যেন নতুন
ছন্দের স্বাদ পাচ্ছিল তারা। “নাহ্, ঘরগুলো
সব সাজিয়ে ফেলি”, বলেই
আঁচলের খুঁটটা কোমরে বেঁধে চুলগুলো আলতো করে ঠিক করে হঠাৎ গান গেয়ে উঠল কাকলি, আমার গানের......”
কাকলির গান যেন বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া কোনো মুল্যবান রত্ন । কাকলির গান শুনে প্রদ্বীপ্ত বলেছিল, “একটা হ্যাবক মাল পেয়েছিস কূজন।” কথাটার প্রকৃত অর্থ ভালো না খারাপ টা বোঝেনি আর বোঝার প্রয়োজনও বোধ করেনি। শুধু এটুকু বুঝেছিল যে এরা তার প্রকৃত বন্ধু নয়। ইতিমধ্যে কাকলি জিনিসপত্রগুলো সব ঠিকঠাক করে স্নান করতে চলে গেছে। কূজন তখনও সেইসব পুরনো স্মৃতিগুলোর ভালো দিকগুলো কুরিয়ে নিজের হৃদয়ে ভরছে। হাতের সিগারেটটা কখন যে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সেদিকে খেয়াল নেই তার, জ্ঞান হল কাকলির চুলের জলের ঝাপটায়। গামছা দিয়ে চুল ঝাড়ছে কাকলি। তারই ছিটে ফোঁটা লাগছে কুজনের গায়ে, গালে, ঠোঁটে, কপালে। যেন তারা বিন্দু বিন্দু হয়ে আকর্ষণ করছে উত্থান সিন্ধুতে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য। মাথার জল কপালের ভেজা সিঁদুর ছুঁয়ে লজ্জায় লাল হয়ে ফর্সা গাল বেয়ে চুয়ে পড়ছে, ব্লাউজ ভিজিয়ে , খুঁজে চলেছে কোনো এক পার্থিব সুখ। কূজনের সুপ্ত ইচ্ছা মনের বাসনাকে তপ্ত করল, ছুঁয়ে দেখতে চাইল তার দুটো হাত। কুজনের সব ইচ্ছাই কাকলি বুঝতে পারত আর কূজনও মাঝে মাঝে এ ব্যাপারটা বুঝতে পারত না। এই ইচ্ছাটাও কাকলির মনে সাড়া জাগালো। হারিয়ে যাওয়া দুষ্টু হাসি হেসে বলল, “উঁহু.. এখন নয়,স্নান সার তাড়াতাড়ি, খুব খিদে পেয়েছে।”
আসার
সময়ই তারা খাবার কিনে এনেছিল। আর এখন দুদিন খাবার কিনেই যে খেতে হবে সেটাও
বুঝেছিল। খেয়ে নিয়ে বাকি জিনিসগুলো গোছাতে কাকলির সাহায্য করতে লাগল কূজন। সব কিছুই
ভীষণ হাল্কা লাগছিল কূজনের। জীবনের এবড়ো-খেবড়ো পথ খালি পায়ে হাঁটার পর কেউ যেন আদর
করে মলম লাগিয়ে যাচ্ছিল। সে খুশি কাকলির
জন্য। কাকলি, যাকে সে যেন হারাতে
বসেছিল। কাকলির বাবা এক বাঙালি ফার্মে চাকরি করতেন। তাতে তার আয় এত বেশি ছিল না যে
তিনি তিন তিনটে মেয়েকে মানুষ করবেন। মাআ সংসার না ধরলে কবেই তলিয়ে যেত তারা। কাকলি
মেজ, দিদি ভারতনাট্যম শিখে
আজ বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। সে গানটাকেই বেছে নিয়েছিল। বিয়ের পর এই গানটাই যেন জীবন
থেকে হারিয়ে যেতে বসেছিল তার, অথচ এই গানই টেনেছিল কূজনকে। মা অনেক কষ্ট করে পড়াশোনার পাশাপাশি
তাদের এ সব শিখিয়েছিলেন কিন্তু এখন.........
“কিগো শুয়ে আছো যে? শরীর ভালো নেই নাকি?” কাকলির ছোঁয়ায় চমকে উঠে বসল কূজন। আস্তে
করে কাকলিকে কাছে টেনে বলল, “তোমার সব শখ সাধ আমার জন্য নষ্ট হয়ে গেছে গো..। আমি কিভাবে যে এর
ক্ষতিপূরণ করি ? তোমার
অনেক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ছিল যা আমার জন্যই নষ্ট হল।” কাকলি যেন কিছুই হয়নি বা ঘটেনি এমন ভাব
করে বলে ফেলল, “তোমার
জন্য আমার ক্ষতি? কিসের ?”
দেড়
বছর ধরে এত অকথ্য অত্যাচার সহ্য করে যে কাকলি বেঁচে আছে সে যে আগুনে পুড়ে সোনার মত
হয়ে গেছে আজ। কূজন যেন অনুভব করছিল মেয়েদের সহ্য ক্ষমতা কতটা আসীম। হঠাৎ যেন
কূজনের ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছা করছিলো। কাকলিকে চেপে ধরে ভেসে গেল বানের জলে ।