গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১২

অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

ধর্মাধিকরণের ষাঁড়

ধর্মাধিকরণের সম্মুখে এক বিশাল বটবৃক্ষ চিরকালীন ছবির ন্যায় ঘন সবুজ পত্রাদিতে শোভিত হইয়া দণ্ডায়মান। তাহার শাখায় বিশ্রাম করে বিহঙ্গকুল এবং সুশীতল ছায়ায় বিচারপ্রার্থী গ্রাম্য মানুষজন। ইহাকেই কেন্দ্র করিয়া ইতস্তত বিচরণ করেন কৃষ্ণবসনধারী শিকারিগণ। কিন্তু এই ছবিটিও সম্পূর্ণ নহে। ছবির মধ্যভাগে অবস্থান করে এক বিশালকায় ষণ্ড। তাহার গাত্রও এই দৃশ্যের উপযোগী ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। উকিল-মোক্তার-মুহুরি বাবুদের ন্যায় সেও ধর্মাধিকরণের চত্বর তথা বটবৃক্ষের ছায়ায় ছায়ায় ইতস্তত বিচরণ করে। সেও শিকারসন্ধানী। তবে তাহার লক্ষ্য মক্কেল নহে ধর্মাধিকরণের দেওয়াল হইতে খসিয়া পড়া পোস্টারের কাগজ,শুষ্ক বটপত্র এবং মওকা মিলিলে মক্কেলের হাতের স্ট্যাম্পের কাগজ, দলিল ইত্যাদি। এই ষণ্ডপুঙ্গবের চক্ষুদ্বয় ঘোরতর রক্তবর্ণ,শৃঙ্গদ্বয় অনতিদীর্ঘ কিন্তু ভয়ঙ্কর সূচালোদর্শনগ্রাম্য লোকেরা ইহাকে যৎপরোনাস্তি সমীহ করিয়া চলে। কিন্তু উকিল-মোক্তার-মুহুরিবাবুরা অভিজ্ঞতায় জানেন যে ইহা অতিশয় নিরীহ প্রাণী। কখনও কাহাকেও গুঁতাইবে এইরূপ সম্ভাবনা নাই বলিলেই চলেমক্কেলগণ আপন আপন পকেট,দলিলসমূহ এবং ডিক্রির কাগজ ইত্যাদি ঠিকমত সামলাইতে পারিলে ইহাকে ভয় পাইবার কোন হেতু নাই। কিন্তু তাঁহাদের এই গুহ্য ধারণাদি তাঁহারা মক্কেল সমক্ষে সবিশেষ প্রচারে আগ্রহী নহেন। কৃষ্ণবসনধারী আদালতচারীদের ঐ ষণ্ডপুঙ্গবও যেহেতু কৃষ্ণগাত্রসম্পন্ন,সুতরাং মক্কেলগণের সমীহভোগ্য। এইরূপে মক্কেলগণ সর্বদা তটস্থ থাকিলে তাঁহাদের ফীস্‌-প্রাপ্তি নির্বিঘ্ন হইয়া থাকে।

কালীপুর গ্রামের পয়জার আলির দ্বিতীয় পক্ষের পিতা আরাফত মিঞা দুর্দান্ত বজ্জাত লোক। পয়জারের মাতাকে নিকা করিয়াই সে তাহার কবরজাত পিতার সমুদয় সম্পত্তি দখল করিয়াছে এবং তাহাকে ভিটা হইতে উৎখাত করিয়াছে। পয়জার যতদিন যাবৎ নাবালক ছিল অনোন্যপায় হইয়া চুরিচামারি,ভিক্ষা ইত্যাদির দ্বারা নিজের ক্ষুন্নিবৃত্তি করিয়াছে। অবশেষে সাবালক হইয়া হাজীসাহেবের কৃপায় সে তাঁহার বাড়িতে আশ্রয় পায় এবং তাঁহার নধর গাভীগুলির পরিচর্যা করিতে থাকে। ইহা ছাড়া শয়নকালে হাজীর পদদ্বয়ে তৈলমর্দন ইত্যাদির দ্বারা সে তাঁহার স্নেহলাভে ধন্য হইতে থাকে। এইরূপে পাঁচ বৎসর কাল অতিক্রান্ত হইলে ঘটনাচক্রে বজ্জাত আরাফত স্ত্রীলোক ঘটিত ব্যাপারে হাজীর সহিত বিবাদে লিপ্ত হয়। অনন্তর হাজীসাহেব সেই বজ্জাতকে সমুচিত শাস্তি প্রদানে মনস্থ হন। পয়জারের কবরস্থ পিতার সম্পত্তি যাহাতে তাহার দশ আনা হক্ক,তাহা এযাবৎকাল সেই বজ্জাত জবরদখল ভোগ করিয়াছে এবম্বিধ ঘটনার গুনাহ্‌ দীর্ঘ দশ বৎসর কাল পরে সহসা তাহাকে কাতর করিয়া তোলে;এবং তাহা সহ্য করাও অনুরূপ গুনাহ্‌ - এইরূপ বিবেচনায় নিজেকে দোজখে নিমজ্জমান হইবার সম্ভাবনা হইতে রক্ষা করিবার নিমিত্ত তিনি আরাফতের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। গ্রামবাসীগণ তাঁহার সাধু সংকল্পে চমৎকৃত হইয়া হজের কী মাহাত্ব্য ইত্যাদি বলিতে থাকে এবং হাজীর জয়লাভের নিমিত্ত আল্লাতালার দোয়া মাঙ্গে।

এইরূপে কৃতসংকল্প হইয়া হাজীসাহেব পয়জারকে সঙ্গে লইয়া তাহার জমি উদ্ধারের উদ্দেশ্যে ধর্মাধিকরণের বটবৃক্ষের ছায়ায় অনবরত আসিতে থাকেন। পয়জারের মাহিনার টাকা যাহা পাঁচ বৎসর যাবৎ হাজীর নিকট জমা আছে বলিয়া সে শুনিয়া আসিয়াছে তাহা হাজীর শুভ্র বসনের কোটর হইতে কৃষ্ণ বস্ত্রাদির পকেটে চালান হইতে থাকে এবং হাজীর কৃশকায় কাগজের ফর্দে তাহার আসা-যাওয়ার সিঁড়ি ক্রমশ দীর্ঘ হয়। হাজীর পিপীলিকা সদৃশ সেই গনিত শাস্ত্র পয়জারের নিকট পড়িতে কিঞ্চিৎ জটিল হইলেও বুঝিতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। সে আব্বাজানের জমি ফিরিয়া পাইবে এইরূপ সুখে নিমগ্ন হয় কৃষ্ণকায় ষণ্ডটির মহিমময় বপুটি নিরীক্ষণ করিয়া চমৎকৃত হইতে থাকে। 
 
এইরূপে রায়দানের দিন নিকটবর্তী হইতে থাকিলে বজ্জাত আরাফতের ধর্মবুদ্ধি কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ জাগ্রত হইতে থাকে এবং সেই বুদ্ধির দাহিকাশক্তি ধিকিধিকি অনুতাপানল প্রজ্জ্বলিত করে। যেহেতু কথিত আছে যে অগ্নিতে অগ্নির বলবৃদ্ধি হয়,সেহেতু হাজীর অগ্নিস্বরূপ ধর্মচেতনা কোরান হইতে অবতরণ করিয়া আরাফতের অনুতাপানলকে আলিঙ্গন করে। অগ্নি অগ্নিতে দ্রব হইলে ছাই পড়িয়া থাকে এই সব ধর্মবচন পয়জারের অজ্ঞাত থাকায় সে রায় আনিবার নিমিত্ত হাজীকে তাগাদা দিতে থাকিলে তিনি কৃশকায় ফর্দ বাহির করিয়া আবিষ্কার করেন যে পয়জারের যাবতীয় মাহিনাদি ইতিপূর্বেই উকিলবাবুদিগের পকেটস্থ হইয়াছে এবং রায়দানের দিবসে তাঁহাদের পাওনাগন্ডাদি মিটাইবার কোনরূপ ব্যবস্থা তিনি দেখিতে পাইতেছেন না।

অগত্যা পয়জার বাসের ভাড়ার অভাবে পরদিবস দিনের আলো ফুটিতেই পদব্রজে ধর্মাধিকরণের উদ্দেশে যাত্রা করে। তথায় সে কিঞ্চিৎ বিলম্বে উপস্থিত হইলেও তাহাতে রায়দানে কোনরূপ বিঘ্ন ঘটে নাই জানিয়া সে আশ্বস্ত হয়। উকিলবাবুর মুখে আমরাই জিতেছি হেঃ হেঃ মুহুরির কাছে যাও,আজকের খরচা মেটাও শুনিয়া পয়জার ক্ষুধা বিস্মৃত হইয়া মুহুরিবাবুর নিকট দৌড়ায়। তিনি কে রে পয়জার নাকি,এত বিলম্ব কিসের এই গেল গা  'র ডিক্রির নকল আর এই গেল গা তর আজগের খরচ ইত্যাদি বলিতে থাকেন। ডিক্রির নকল হাতে লইয়া পয়জার মনোযোগ সহকারে তাহা পরীক্ষা করে। পিপীলিকার সারি যে স্থান হইতে যাত্রা শুরু করিয়াছে তাহার অব্যবহিত পূর্বেই সিংহের মুখব্যাদান চিহ্নিত সরকারি কাগজখানি দেখিয়া সে পরম পরিতৃপ্তি লাভ করে। কিন্তু সিংহ গুলিকে যথেষ্ট বলবান বোধ হইলেও উহারা কিরূপে বজ্জাত আরাফতের নিকট হইতে জমি কাড়িয়া লইয়া তাহা পয়জারকে প্রদান করিবে ইহাতে কিঞ্চিৎ সন্দিহান হইয়া সে মুহুরিবাবুকে অতঃপর সেই প্রশ্ন উত্থাপন করে। তাহাতে মুহুরিবাবু উকিলবাবু ৫০ টাকা মুহুরি ২০ টাকা আমলা ৩০ টাকা বাজে খর্‌চা ২০ টাকা সাকুল্যে ১২০ টাকা দে টাকা দে দে টাকা দে –‘বলিতে বলিতে পয়জারের জামায় হাত লাগান। মেলায় কেনা জামাটিতে পকেট না থাকায় তিনি পয়জারের কোমরে লুঙ্গির অন্ধিসন্ধি সন্ধানে তৎপর হন এবং অবশেষে স্বেদসিক্ত লুঙ্গির সরসতা ভিন্ন তাহার আঙ্গুল অন্য কিছুর স্পর্শ না পাওয়াতে ভয়ঙ্কর রুষ্ট হইয়া রোষ কষায়িত দৃষ্টিতে পয়জারকে ভস্মীভূত করায় চেষ্টিত হন। শীগগিরই শোধ দিব ‘– ইত্যাকার সান্ত্বনা  বাক্যে  তাহার ক্রোধ প্রশমনের ইঙ্গিত না পাইয়া ডিক্রির নকল হাতে পয়জার উকিলবাবুর উদ্দেশে যাত্রা করে।

ঘুরিতে ঘুরিতে সে আরাফতকে দেখিতে পায়। সে ও বুঝি এইরূপ সিংহ ছাপা কাগজ  লাভের উদ্দেশ্যে আসিয়াছিল। কিন্তু তাহা হাকিমের আদেশে পয়জারের হস্তগত হইয়াছে জানিয়া সবিশেষ বিমর্ষ  হইয়া বটতলায় আসীন আছে। দুই একবার পয়জার বটতলা প্রদক্ষিণ করিতে করিতে আরাফতের মুখভাব লক্ষ্য করিতে লাগিল। কিন্তু কাগজ দেখাইলেই জমি ছাড়িয়া দিবে এমত বোধ হইল না। এইরূপকালে ধর্মাধিকরণের  চত্বরে উকিলবাবুকে দেখিতে পাইয়া পয়জার তাহার সম্মুখে  হাজির হইয়া অতঃপর কী কর্তব্য  জিজ্ঞাসা করিল যেহেতু বজ্জাত আরাফত ডিক্রির কাগজ দেখিয়া জমি ছাড়িবে না বলিয়াই বোধ হয় । ইহা শুনিয়া উকিলবাবু ক্রোধান্বিত হইয়া ছাড়বে না মানে ওর বাবা ছাড়বে, না ছাড়লে থানা-পুলিশ হবে, থানা-পুলিশ না এলে আদালত অবমাননার মামলা হবেইত্যাদি অনর্গল বলিতে থাকিলেন। কিন্তু বাবু, হাজিসাহেব যে আমার উপরে নারাজ হছেন, তেনায় নারাজ হলে-পয়জারের নিশ্বাসের সঙ্গে এইসব উচ্চারণ বহির্গত হইলে সহসা উকিলবাবুর স্মরণ হয় যে পয়জার আজিকার খরচসমূহ পরিশোধ করে নাই। সুতরাং তিনি হাজিসাহেব নারাজ হলে আমি কী জানি আমি কী জানিবলিয়া হনহন করিয়া চলিয়া গেলেন।

হেনকালে গেলো গেলো খেলো খেলো সমবেত রব এবং তাহার হস্তধৃত ডিক্রির নকলে টান পড়িতেই পয়জার পিছন ফিরিয়া দেখিতে পায় যে দৈত্যাকৃতি ষণ্ড ইতিমধ্যেই সিংহসমুহকে মুখগহ্বরে চালান করিয়া পিপীলিকার সারিকেও ধীরে ধীরে টানিয়া লইতেছে। পয়জার হাত বাড়াইয়াও শেষ পর্যন্ত টানিয়া লইল। ষণ্ডটি যে সিংহ অপেক্ষা শক্তিশালী ইহাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই। এইরূপে ষণ্ডটি পরম তৃপ্তিতে ডিক্রির নকল চিবাইতে থাকিলে তাহার রক্তবর্ণ চক্ষুদ্বয় আরামে বুজিয়া আসিল এবং কষ বাহিয়া শুভ্র ফেনা গড়াইতে লাগিল। এবং ডিক্রি চর্বণে সাদা ফেনা বাহির হয় জানিয়া অদূরে দাঁড়াইয়া বজ্জাত আরাফত ষাঁড়ে খেয়েচে - ষাঁড়ে খেয়েচে বলিয়া সোল্লাসে দুই হাত তুলিয়া নৃত্য করিতে লাগিল।

               -