৪টি গল্প । লিখেছেন অর্ধেন্দু শেখর গোস্বামী, মৌ দাশগুপ্তা, দুপুর মিত্র এবং সায়ক চক্রবর্তী
গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।
শুক্রবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১২
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
ধর্মাধিকরণের ষাঁড়
ধর্মাধিকরণের সম্মুখে এক বিশাল বটবৃক্ষ চিরকালীন ছবির ন্যায়
ঘন সবুজ পত্রাদিতে শোভিত হইয়া দণ্ডায়মান। তাহার শাখায় বিশ্রাম করে বিহঙ্গকুল এবং সুশীতল
ছায়ায় বিচারপ্রার্থী গ্রাম্য মানুষজন। ইহাকেই কেন্দ্র করিয়া ইতস্তত বিচরণ করেন
কৃষ্ণবসনধারী শিকারিগণ। কিন্তু এই ছবিটিও সম্পূর্ণ নহে। ছবির মধ্যভাগে অবস্থান করে
এক বিশালকায় ষণ্ড। তাহার গাত্রও এই দৃশ্যের উপযোগী ঘোর কৃষ্ণবর্ণ।
উকিল-মোক্তার-মুহুরি বাবুদের ন্যায়
সেও ধর্মাধিকরণের চত্বর তথা বটবৃক্ষের ছায়ায় ছায়ায় ইতস্তত বিচরণ করে। সেও
শিকারসন্ধানী। তবে তাহার লক্ষ্য মক্কেল নহে – ধর্মাধিকরণের দেওয়াল হইতে খসিয়া পড়া পোস্টারের কাগজ,শুষ্ক বটপত্র এবং মওকা মিলিলে মক্কেলের হাতের স্ট্যাম্পের
কাগজ, দলিল ইত্যাদি। এই ষণ্ডপুঙ্গবের
চক্ষুদ্বয় ঘোরতর রক্তবর্ণ,শৃঙ্গদ্বয় অনতিদীর্ঘ
কিন্তু ভয়ঙ্কর সূচালোদর্শন। গ্রাম্য লোকেরা ইহাকে যৎপরোনাস্তি
সমীহ করিয়া চলে। কিন্তু উকিল-মোক্তার-মুহুরিবাবুরা
অভিজ্ঞতায় জানেন যে ইহা অতিশয় নিরীহ প্রাণী। কখনও কাহাকেও গুঁতাইবে – এইরূপ সম্ভাবনা নাই বলিলেই চলে। মক্কেলগণ আপন আপন পকেট,দলিলসমূহ এবং ডিক্রির কাগজ ইত্যাদি ঠিকমত সামলাইতে পারিলে
ইহাকে ভয় পাইবার কোন হেতু নাই। কিন্তু তাঁহাদের এই গুহ্য ধারণাদি তাঁহারা মক্কেল
সমক্ষে সবিশেষ প্রচারে আগ্রহী নহেন। কৃষ্ণবসনধারী আদালতচারীদের ঐ ষণ্ডপুঙ্গবও
যেহেতু কৃষ্ণগাত্রসম্পন্ন,সুতরাং মক্কেলগণের
সমীহভোগ্য। এইরূপে মক্কেলগণ সর্বদা তটস্থ থাকিলে তাঁহাদের ফীস্-প্রাপ্তি
নির্বিঘ্ন হইয়া থাকে।
ধর্মাধিকরণের সম্মুখে এক বিশাল বটবৃক্ষ চিরকালীন ছবির ন্যায়
ঘন সবুজ পত্রাদিতে শোভিত হইয়া দণ্ডায়মান। তাহার শাখায় বিশ্রাম করে বিহঙ্গকুল এবং সুশীতল
ছায়ায় বিচারপ্রার্থী গ্রাম্য মানুষজন। ইহাকেই কেন্দ্র করিয়া ইতস্তত বিচরণ করেন
কৃষ্ণবসনধারী শিকারিগণ। কিন্তু এই ছবিটিও সম্পূর্ণ নহে। ছবির মধ্যভাগে অবস্থান করে
এক বিশালকায় ষণ্ড। তাহার গাত্রও এই দৃশ্যের উপযোগী ঘোর কৃষ্ণবর্ণ।
উকিল-মোক্তার-মুহুরি বাবুদের ন্যায়
সেও ধর্মাধিকরণের চত্বর তথা বটবৃক্ষের ছায়ায় ছায়ায় ইতস্তত বিচরণ করে। সেও
শিকারসন্ধানী। তবে তাহার লক্ষ্য মক্কেল নহে – ধর্মাধিকরণের দেওয়াল হইতে খসিয়া পড়া পোস্টারের কাগজ,শুষ্ক বটপত্র এবং মওকা মিলিলে মক্কেলের হাতের স্ট্যাম্পের
কাগজ, দলিল ইত্যাদি। এই ষণ্ডপুঙ্গবের
চক্ষুদ্বয় ঘোরতর রক্তবর্ণ,শৃঙ্গদ্বয় অনতিদীর্ঘ
কিন্তু ভয়ঙ্কর সূচালোদর্শন। গ্রাম্য লোকেরা ইহাকে যৎপরোনাস্তি
সমীহ করিয়া চলে। কিন্তু উকিল-মোক্তার-মুহুরিবাবুরা
অভিজ্ঞতায় জানেন যে ইহা অতিশয় নিরীহ প্রাণী। কখনও কাহাকেও গুঁতাইবে – এইরূপ সম্ভাবনা নাই বলিলেই চলে। মক্কেলগণ আপন আপন পকেট,দলিলসমূহ এবং ডিক্রির কাগজ ইত্যাদি ঠিকমত সামলাইতে পারিলে
ইহাকে ভয় পাইবার কোন হেতু নাই। কিন্তু তাঁহাদের এই গুহ্য ধারণাদি তাঁহারা মক্কেল
সমক্ষে সবিশেষ প্রচারে আগ্রহী নহেন। কৃষ্ণবসনধারী আদালতচারীদের ঐ ষণ্ডপুঙ্গবও
যেহেতু কৃষ্ণগাত্রসম্পন্ন,সুতরাং মক্কেলগণের
সমীহভোগ্য। এইরূপে মক্কেলগণ সর্বদা তটস্থ থাকিলে তাঁহাদের ফীস্-প্রাপ্তি
নির্বিঘ্ন হইয়া থাকে।
কালীপুর গ্রামের পয়জার আলির দ্বিতীয় পক্ষের পিতা আরাফত মিঞা
দুর্দান্ত বজ্জাত লোক। পয়জারের মাতাকে নিকা করিয়াই সে তাহার কবরজাত পিতার সমুদয়
সম্পত্তি দখল করিয়াছে এবং তাহাকে ভিটা হইতে উৎখাত করিয়াছে। পয়জার যতদিন যাবৎ
নাবালক ছিল অনোন্যপায় হইয়া চুরিচামারি,ভিক্ষা ইত্যাদির দ্বারা নিজের ক্ষুন্নিবৃত্তি করিয়াছে। অবশেষে
সাবালক হইয়া হাজীসাহেবের কৃপায় সে তাঁহার বাড়িতে আশ্রয় পায় এবং তাঁহার নধর
গাভীগুলির পরিচর্যা করিতে থাকে। ইহা ছাড়া শয়নকালে হাজীর পদদ্বয়ে তৈলমর্দন ইত্যাদির
দ্বারা সে তাঁহার স্নেহলাভে ধন্য হইতে থাকে। এইরূপে পাঁচ বৎসর কাল অতিক্রান্ত হইলে
ঘটনাচক্রে বজ্জাত আরাফত স্ত্রীলোক ঘটিত ব্যাপারে হাজীর সহিত বিবাদে লিপ্ত হয়।
অনন্তর হাজীসাহেব সেই বজ্জাতকে সমুচিত শাস্তি প্রদানে মনস্থ হন। পয়জারের কবরস্থ
পিতার সম্পত্তি –যাহাতে তাহার দশ আনা
হক্ক,তাহা এযাবৎকাল সেই বজ্জাত জবরদখল ভোগ
করিয়াছে –এবম্বিধ ঘটনার গুনাহ্ দীর্ঘ দশ বৎসর
কাল পরে সহসা তাহাকে কাতর করিয়া তোলে;এবং তাহা সহ্য করাও অনুরূপ গুনাহ্ - এইরূপ বিবেচনায় নিজেকে
দোজখে নিমজ্জমান হইবার সম্ভাবনা হইতে রক্ষা করিবার নিমিত্ত তিনি আরাফতের বিরুদ্ধে
জিহাদ ঘোষণা করেন। গ্রামবাসীগণ তাঁহার সাধু সংকল্পে চমৎকৃত হইয়া ‘ হজের কী মাহাত্ব্য ‘ইত্যাদি বলিতে থাকে এবং হাজীর জয়লাভের নিমিত্ত আল্লাতালার
দোয়া মাঙ্গে।
এইরূপে কৃতসংকল্প হইয়া হাজীসাহেব পয়জারকে সঙ্গে লইয়া তাহার
জমি উদ্ধারের উদ্দেশ্যে ধর্মাধিকরণের বটবৃক্ষের ছায়ায় অনবরত আসিতে থাকেন। পয়জারের
মাহিনার টাকা যাহা পাঁচ বৎসর যাবৎ হাজীর নিকট জমা আছে বলিয়া সে শুনিয়া আসিয়াছে
তাহা হাজীর শুভ্র বসনের কোটর হইতে কৃষ্ণ বস্ত্রাদির পকেটে চালান হইতে থাকে এবং
হাজীর কৃশকায় কাগজের ফর্দে তাহার আসা-যাওয়ার সিঁড়ি ক্রমশ দীর্ঘ হয়। হাজীর পিপীলিকা
সদৃশ সেই গনিত শাস্ত্র পয়জারের নিকট পড়িতে কিঞ্চিৎ জটিল হইলেও বুঝিতে বিন্দুমাত্র
অসুবিধা হয় না। সে আব্বাজানের জমি ফিরিয়া পাইবে – এইরূপ সুখে নিমগ্ন হয় কৃষ্ণকায় ষণ্ডটির মহিমময় বপুটি নিরীক্ষণ
করিয়া চমৎকৃত হইতে থাকে।
এইরূপে রায়দানের দিন নিকটবর্তী হইতে থাকিলে বজ্জাত আরাফতের
ধর্মবুদ্ধি কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ জাগ্রত হইতে থাকে এবং সেই বুদ্ধির দাহিকাশক্তি
ধিকিধিকি অনুতাপানল প্রজ্জ্বলিত করে। যেহেতু কথিত আছে যে অগ্নিতে অগ্নির বলবৃদ্ধি
হয়,সেহেতু হাজীর অগ্নিস্বরূপ ধর্মচেতনা কোরান হইতে অবতরণ করিয়া
আরাফতের অনুতাপানলকে আলিঙ্গন করে। অগ্নি অগ্নিতে দ্রব হইলে ছাই পড়িয়া থাকে –এই সব ধর্মবচন পয়জারের অজ্ঞাত থাকায় সে রায় আনিবার নিমিত্ত
হাজীকে তাগাদা দিতে থাকিলে তিনি কৃশকায় ফর্দ বাহির করিয়া আবিষ্কার করেন যে পয়জারের
যাবতীয় মাহিনাদি ইতিপূর্বেই উকিলবাবুদিগের পকেটস্থ হইয়াছে এবং রায়দানের দিবসে
তাঁহাদের পাওনাগন্ডাদি মিটাইবার কোনরূপ ব্যবস্থা তিনি দেখিতে পাইতেছেন না।
অগত্যা পয়জার বাসের ভাড়ার অভাবে পরদিবস দিনের আলো ফুটিতেই
পদব্রজে ধর্মাধিকরণের উদ্দেশে যাত্রা করে। তথায় সে কিঞ্চিৎ বিলম্বে উপস্থিত হইলেও
তাহাতে রায়দানে কোনরূপ বিঘ্ন ঘটে নাই জানিয়া সে আশ্বস্ত হয়। উকিলবাবুর মুখে ‘আমরাই জিতেছি হেঃ হেঃ – মুহুরির কাছে যাও,আজকের খরচা মেটাও ‘ শুনিয়া পয়জার ক্ষুধা বিস্মৃত হইয়া মুহুরিবাবুর নিকট দৌড়ায়।
তিনি ‘কে রে পয়জার নাকি,এত বিলম্ব কিসের – এই গেল গা ত'র ডিক্রির নকল আর এই
গেল গা ত’র আজগের খরচ ‘ ইত্যাদি বলিতে থাকেন। ডিক্রির নকল হাতে লইয়া পয়জার মনোযোগ
সহকারে তাহা পরীক্ষা করে। পিপীলিকার সারি যে স্থান হইতে যাত্রা শুরু করিয়াছে তাহার
অব্যবহিত পূর্বেই সিংহের মুখব্যাদান চিহ্নিত সরকারি কাগজখানি দেখিয়া সে পরম
পরিতৃপ্তি লাভ করে। কিন্তু সিংহ গুলিকে যথেষ্ট বলবান বোধ হইলেও উহারা কিরূপে
বজ্জাত আরাফতের নিকট হইতে জমি কাড়িয়া লইয়া তাহা পয়জারকে প্রদান করিবে – ইহাতে কিঞ্চিৎ সন্দিহান হইয়া সে মুহুরিবাবুকে অতঃপর সেই
প্রশ্ন উত্থাপন করে। তাহাতে মুহুরিবাবু ‘উকিলবাবু ৫০ টাকা – মুহুরি ২০ টাকা – আমলা ৩০ টাকা – বাজে খর্চা
২০ টাকা – সাকুল্যে ১২০ টাকা – দে টাকা দে – দে টাকা দে –‘বলিতে বলিতে পয়জারের জামায় হাত লাগান। মেলায় কেনা জামাটিতে
পকেট না থাকায় তিনি পয়জারের কোমরে লুঙ্গির অন্ধিসন্ধি সন্ধানে তৎপর হন এবং অবশেষে
স্বেদসিক্ত লুঙ্গির সরসতা ভিন্ন তাহার আঙ্গুল অন্য কিছুর স্পর্শ না পাওয়াতে ভয়ঙ্কর
রুষ্ট হইয়া রোষ কষায়িত দৃষ্টিতে পয়জারকে ভস্মীভূত করায় চেষ্টিত হন। ‘ শীগগিরই শোধ দিব ‘– ইত্যাকার সান্ত্বনা
বাক্যে তাহার ক্রোধ
প্রশমনের ইঙ্গিত না পাইয়া ডিক্রির নকল হাতে পয়জার উকিলবাবুর উদ্দেশে যাত্রা করে।
ঘুরিতে ঘুরিতে সে আরাফতকে দেখিতে পায়। সে ও বুঝি এইরূপ সিংহ
ছাপা কাগজ লাভের উদ্দেশ্যে আসিয়াছিল। কিন্তু তাহা হাকিমের আদেশে পয়জারের
হস্তগত হইয়াছে জানিয়া সবিশেষ বিমর্ষ হইয়া বটতলায় আসীন আছে। দুই একবার পয়জার বটতলা প্রদক্ষিণ করিতে
করিতে আরাফতের মুখভাব লক্ষ্য করিতে লাগিল। কিন্তু কাগজ দেখাইলেই জমি ছাড়িয়া দিবে
এমত বোধ হইল না। এইরূপকালে ধর্মাধিকরণের চত্বরে
উকিলবাবুকে দেখিতে পাইয়া পয়জার তাহার সম্মুখে
হাজির হইয়া অতঃপর কী কর্তব্য জিজ্ঞাসা
করিল যেহেতু বজ্জাত আরাফত ডিক্রির কাগজ দেখিয়া জমি ছাড়িবে না বলিয়াই বোধ হয় । ইহা
শুনিয়া উকিলবাবু ক্রোধান্বিত হইয়া ‘ছাড়বে না
মানে – ওর বাবা ছাড়বে, না ছাড়লে থানা-পুলিশ হবে, থানা-পুলিশ না এলে আদালত অবমাননার মামলা হবে’ ইত্যাদি অনর্গল বলিতে থাকিলেন। ‘কিন্তু বাবু, হাজিসাহেব
যে আমার উপরে নারাজ হছেন, তেনায় নারাজ হলে-‘ পয়জারের নিশ্বাসের সঙ্গে এইসব উচ্চারণ বহির্গত হইলে সহসা
উকিলবাবুর স্মরণ হয় যে পয়জার আজিকার খরচসমূহ পরিশোধ করে নাই। সুতরাং তিনি ‘হাজিসাহেব নারাজ হলে আমি কী জানি – আমি কী জানি’বলিয়া হনহন
করিয়া চলিয়া গেলেন।
হেনকালে ‘গেলো গেলো – খেলো খেলো ‘সমবেত রব
এবং তাহার হস্তধৃত ডিক্রির নকলে টান পড়িতেই পয়জার পিছন ফিরিয়া দেখিতে পায় যে
দৈত্যাকৃতি ষণ্ড ইতিমধ্যেই সিংহসমুহকে মুখগহ্বরে চালান করিয়া পিপীলিকার সারিকেও
ধীরে ধীরে টানিয়া লইতেছে। পয়জার হাত বাড়াইয়াও শেষ পর্যন্ত টানিয়া লইল। ষণ্ডটি যে
সিংহ অপেক্ষা শক্তিশালী ইহাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই। এইরূপে ষণ্ডটি পরম তৃপ্তিতে
ডিক্রির নকল চিবাইতে থাকিলে তাহার রক্তবর্ণ চক্ষুদ্বয় আরামে বুজিয়া আসিল এবং কষ
বাহিয়া শুভ্র ফেনা গড়াইতে লাগিল। এবং ডিক্রি চর্বণে সাদা ফেনা বাহির হয় জানিয়া
অদূরে দাঁড়াইয়া বজ্জাত আরাফত ‘ ষাঁড়ে খেয়েচে
- ষাঁড়ে খেয়েচে ‘ বলিয়া সোল্লাসে দুই হাত
তুলিয়া নৃত্য করিতে লাগিল।
-
মৌ দাশগুপ্তা

ভাইফোঁটা
সকাল থেকে উৎকন্ঠিতভাবে ঘর-বার করছিলো সোমা। কখন যে মেয়েটা
আসবে। সন্ধ্যা নাগাদ মুখ কালো
করে ভগ্নদূতের মত শ্লথ পায়ে সৌমীর
ঘরে ফেরা দেখেই সোমা বুঝে গেল হাইকোর্টে ওরা গো-হারান হেরেছে। মেয়েটাকে একা ঘরে একটু কাঁদার সুযোগ করে দিতে বাইরের বারান্দাটায়
আসতেই দোতলা থেকে জোরে হাসি, চিৎকার,লাউডস্পীকার দিয়ে উদ্দাম গান বাজানোর আওয়াজটা যেন চাবুকের মত
কানে আছড়ে পড়ল। যুদ্ধজয়ের মহোৎসব। সোমা
ঘরের জানালা দরজাগুলো চেপে বন্ধ করে দু’হাতে সজোরে নিজের কান চেপে ধরলো।
“উফফ ভগবান ! এ তোমার কেমন বিচার!”
মায়ের পায়ের আওয়াজে জলেভেজা মুখ তুলে সৌমী বললো,
- মা, তোমার বিয়েতে দাদু
প্রচুর বরপণ দিয়েছিলেন ? বাবা নগদ টাকা,সোনা-দানা এসব নিয়ে তোমায় বিয়ে করেছিলো ? জানো, ওটার জন্যই এবাড়ীতে
তোমার কোন ভাগ নেই? বাবা পণ নিয়েছিল মা ?
সোমা বজ্রাহতের মত বসে থাকে। তথাকথিত পণ দেওয়ার আর নেওয়ার দু’জন লোকই তো আজ ধরাসীমার বাইরে।বাকি সব তো টাকার জোরে বানানো
কাগুজে বয়ান। সে দু’জনের একজনও যদি আজ
থাকতো তবে সোমার কি আর এই করুণদশা হতো ?
সোমা আর সুমন ভাইবোন । ওদের বাবা শক্তিপদবাবু ছিলেন সম্পন্ন
ব্যবসায়ী। রীতিমত খোঁজখবর করে ছোটবেলার বন্ধু, বিপত্নীক অনাদিচরণের একমাত্র ছেলে শান্তিচরণের সাথে মেয়ে
সোমার বিয়ে দিয়েছিলেন।চেনাজানার মধ্যে বিয়ে, দু’বাড়ীর পারিবারিক
অবস্থাও ভালো। দেনা পাওনার কোন কথাই ওঠে নি। তবে এটাও ঠিক,শক্তিপদবাবু সালঙ্কারা মেয়েকেই গোত্রান্তরিত করেছিলেন।কিন্তু
কে আর জানতো বাবা মারা যাবার শোক ভুলতে না ভুলতেই ভালোমানুষ শান্তিচরণের
কারখানাটাও বন্ধ হয়ে যাবে! মেয়ে বউ নিয়ে বেচারাকে উঞ্ছবৃত্তি করে সংসার চালাতে
হবে! তা সে উঞ্ছবৃত্তি করার অপমানটাও মানুষটা বেশীদিন সইতে পারলো না।
স্বামীর আত্মহত্যার পর একরত্তি মেয়েটার হাত ধরে সোমা যখন পাকাপাকি
ভাবে বাপের বাড়ী ফেরত এলো, তখন ওর বাবা মা দু’জনেই স্বর্গে। বাড়ীর কতৃ ভাইবৌ কাজল। কাজল প্রথম থেকেই
ব্যাপারটা সুনজরে দেখে নি। তিনতলা বাড়ীর একতলায় গারেজের পাশের কোণের একটা ঘর মা
মেয়েকে থাকার জন্য ছেড়ে দিলেও আদতে শুধু খাওয়া পড়া দিয়ে যেন ঘরের কাজের লোক হিসাবে
ওদের ঠাঁই দেওয়া হয়েছিল।এভাবেই অনাদর, অবহেলা, অপমান
কুড়িয়েও শুধু মেয়েটাকে মানুষ করার অদম্য তাগিদে সব নিশ্চুপে সয়ে যাচ্ছিল
সোমা।কিন্তু যেদিন অতিরিক্ত খরচের দোহাই দিয়ে সৌমীর কলেজের পড়াটাও কাজল বন্ধ করে
দিল, সেদিন আর উপায়ন্তর না দেখে মেয়ের নামে
রাখা, বাবার দেওয়া শেষ স্মৃতিচিহ্ন গলার হারটা বেচে বাড়ীর ভাগ চেয়ে কোর্টে মামলা
করেছিল সোমা।জেলা কোর্টে সোমার জিত হওয়ায় মামলা টানতে টানতে হাইকোর্ট অবধি নিয়ে
গেছিল সুমন-কাজল।সেখানে যে এভাবে হারতে হবে তা ভাবে নি সোমা।খালি হাতে ভাগ্যের ওপর, ভগবানের ওপর,ভরসা করে
বসেছিল।
দরজায় জোরে ধাক্কা পড়তে চমকে উঠলো সোমা। দরজা খুলতেই দেখে সুমন দাঁড়িয়ে। অল্প
অল্প টলছে।ওই অবস্থায় মামাকে দেখেই হয়তো পায়ে পায়ে উঠে এসে মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছিল
সৌমী। দিদিকে উপেক্ষা করে সৌমীর দিকে তাকিয়ে সুমন জড়ানো গলায় চেঁচিয়ে বললো,
- বড় আস্পদ্দা হয়েছ না? ভালমন্দ খেতি পরতি,সে আর পোষালো না! এখন মায়ে ঝিয়ে বেরোও আমার ঘর থেকে। দুর হও। আজ
রাতটা বাদে কাল সকালে যেন কারো মুখ না দেখতে হয় ! তাহলে কিন্তু চাকর ডেকে
ঘাড়ধাক্কা মেরে বাইরে বার করে দেব। আমার নামে মামলা করা? এই সুমন মুকুজ্জের নামে? এখন বোঝো, কত ধানে কত চাল!
ঘরের বাতাসে তীব্র মদের গন্ধ ছড়িয়ে সুমন দপদপ করে সিঁড়ি বেয়ে
ওপরে উঠে গেল।কাজলের জোর গলার টিটকারি, ব্যঙ্গের হাসি ছাপিয়ে ভেসে আসলো ঢাকের বাদ্যি,কান ফাটানো শব্দবাজী আর কোলাহল।দূরে কোথাও কালী প্রতিমা ভাসান
যাচ্ছে। হঠাৎই দু’চোখ জ্বালা করে জলে ভরে
এল সোমার।
আজ ভাইফোঁটা, না ?
দুপুর মিত্র
ভর দুপুরে মাঝ দরিয়ায়
নৌকা ভ্রমণ একেবারে নিজের মত করে মানে ঘটা করে নয়, হই হুল্লোড় করে নয়, নীরবে-নিভৃতে নৌকা ভ্রমণটা সাধারণত করা হয় না আমাদের। কিন্তু সেই করা না হওয়াটা আরাধ্য করতেই আমি আর বীথি আজ নদীর পাড়ে। শহর থেকে নদীর পাড়ে এসে পৌঁছতে দুপুর চলে এল। এই নদী মানুষ এ পার থেকে ওপারে যাতায়াতের জন্য খুব একটা ব্যবহার করে না। তাই বরাবরই লোকজন থাকে কম। আজ এই ভর দুপুরে যেন আরও কম।
বেদেদের নৌকাগুলো সারি সারি করে রাখা। কয়েকটি বেদে পরিবারের মানুষ জনকেও দেখা
যাচ্ছিল। তারা নৌকায় বসে রান্না করছে। ঘাটে এসে আমরা একটা নৌকা ভাড়া করলাম।
সারাদিনের জন্য ৫০০ টাকা। লোকটা খুব খুশি। এত টাকা দিয়ে নৌকা সাধারণত ভাড়া করে না
কেউ। এখানে যারা আসে, তাদের অধিকাংশই
প্রেমিক-প্রমিকা। ১ ঘণ্টার জন্য বা দুই ঘণ্টার জন্য নৌকা ভাড়া করে ঘোরে। তাতে ১
ঘণ্টার জন্য ৫০ টাকা করে দিতে হয়। কিন্তু আমি নৌকাটা একেবারে নিজের করে নিলাম।
মানে নৌকাটা আমি চালাব। মাঝি লাগবে না। নিজের মত করে চালাব। মাঝি একবার জিজ্ঞেস
করলেন- আপনি আগে কখনও নৌকা চালাইছেন? টাকার লোভে
পরে হয়ত আর কিছু বলেনি বা বলতে চায় নি। কেবল একবার বিড়বিড় করে বলল- ভরদুপুরে মাঝ
নদীতে যাবেন না স্যার। আমি অবশ্য নৌকা আগে চালিয়েছি। আমাদের বাড়িতেই বিশাল বড়
পুকুর রয়েছে । পুকুরের তত্ত্বাবধানের জন্য প্রায়ই
বাবা আমাকে পাঠাতেন। তখন নৌকা চালিয়ে চালিয়ে পুকুরের এপার থেকে ওপার ঘুরে বেড়াতাম।
বীথি একটু ভীতু টাইপের। নদী
এলাকার মানুষ হবার পরও সাঁতার শেখেনি। নদীর জল আমাকে যতটা না আবেগী করে তুলে, বীথিকে ঠিক ততটাই ভয়ার্ত করে তুলে। বীথির ধীরে ধীরে নৌকায় পা
পড়ল। একটু ভয়, একটু রোমাঞ্চ, একটু আবেগ নিয়ে বীথি নৌকার এক পাশে বসল। আমি ধীরে ধীরে নৌকা
চালানো শুরু করলাম। আমার নৌকা চালানো দেখে বীথি খুব খুশি। আমি নৌকা চালাতে পারি, এটা তার জন্য অনেক বড় ব্যাপার। মানে সকল পুরুষ মানুষের বোধহয়
নৌকা চালানোর অভিজ্ঞতা থাকতে হয়, তা না হলে
সে পুরুষ না। মানে সাহসী না, মানে নারীকে নিয়ে চলার মত না। মানে যে পুরুষ নৌকাই
চালাতে পারে না, সে কিভাবে একজন নারীকে
নিয়ে ঘর-সংসার করে। নৌকার বৈঠায় এক এক করে যখন ভর দিচ্ছিলাম, নদীর স্রোত, জলের শব্দ
আর বাতাসের আনাগোনায় একটা নিবিড় ছন্দের সৃষ্টি হয়েছিল। আমার গান গাইতে ইচ্ছে হল।
গান ধরলামও। ওরে সাম্পানের নাইয়া। বীথিও বেশ উল্লসিত। এতটাই উল্লসিত যে বীথি
আনন্দে এই থরথর নৌকায় নাচানাচি করবে এরকম পরিস্থিতি। কিন্তু নৌকা যখনই এদিক সেদিক
হেলে যায়, তখনই সে ভয়ে চুপ হয়ে যায়। বীথিও অবশ্য
আমার সঙ্গে গান ধরল।
ধীরে ধীরে আমাদের নৌকা একেবারে মাঝ নদীতে এসে পৌঁছাল। ভর দুপুরে মাঝ নদীর দৃশ্য আসলেই অন্যরকম। চারপাশে তাকালে কিছুই দেখা যায় না। কেবল জল আর জল ছাড়া। কেবল জল আর জল ছাড়া। রোদ-জল আর বাতাসের যাচ্ছেতাই খেলাটা কেবল ভরদুপুরে মাঝ নদীতে আসলেই দেখা যায়। দুপুরের এই সময়টায় নদীতে জোয়ার চলছিল। এতে কেমন আরও উন্মত্ত, প্রাণোচ্ছল মনে হচ্ছিল নদীকে। আমি একবার নদীর দিকে তাকালাম, আরেকবার বীথির দিকে। এইভাবে কয়েকবার। এই মাত্র মনে হল এত উন্মত্ত নদী আগে কখনই দেখিনি। নদীটি কি যেন চাইছে। আমি হাত বাড়িয়ে নদীর জল ছুঁয়ে দেখলাম। বীথিও আমার মত নদীর জল ছুঁয়ে দেখতে চাইল। ও সাঁতার জানে না তাতে কি, ও যদি নদীতে পড়ে মরে তাতে কি, নদী যদি আজকে ওকে নিয়ে যেতে চায় তাতে ! ও জল ছূঁয়ে দেখুক। নদীর জল কেমন। আমি বারণ করলাম না। বীথি একেবারেই শিশুদের মত করে এক হাতে নৌকার একটা অংশ শক্ত করে ধরে নদীর জল ছুঁল। একবার সাহস পাবার পর সে যেন একটা খেলা পেয়ে গেল। যেন সে আগে কখনই জল ছোঁয় নি। সে বারবার নদীর জল ছুতে শুরু করল। নৌকাটা একটু নাড়িয়ে দিলেই বীথি পড়ে যাবে। ও যখন হেলান দিয়ে নদীর জল ছোঁয়ার চেষ্টা করল তখন একবার মনে হল নৌকাটা একটু নাড়িয়ে বীথিকে ফেলে দেই। এই ভরদুপুরে নদীর স্রোত আর বীথি! আমি একবার নৌকাটা নাড়ালাম। বীথি চিৎকার করে ওঠল। খবরদার। নৌকা নাড়াবে না। বীথি কি টের পেল আমি ওকে ফেলে দিতে চাচ্ছি। নদী ওকে চাইছে !
হঠাৎ খেয়াল করলাম- মাঝ নদীতেই আমাদের থেকে অল্প দূরে আরেকটি নৌকায় একজন বেদেনি আমাদের দেখে হাসছে। আমি এতক্ষণ ভেবেছিলাম মাঝ নদীতে কেবল আমরা দুজনই। বেদেনি চিৎকার করে বলছে, ও স্যার, মাঝ নদীতে এসে গেছ। ভরদুপুরে কেউ মাঝনদীতে আসে না। আমি বুঝতে না পারলেও সন্দেহটা হল বীথির। বীথি আমাকে এবার তাগাদা দেওয়া শুরু করল। এই চল, চল। নদীর পাড়ে চলে যাই। আমি আস্তে আস্তে নদীর পাড়ে দিকে নৌকা ভেড়াতে শুরু করলাম। তখনই মনে পড়ল আমি কিন্তু বীথিকে নদীতে ফেলে দিতে চেয়েছিলাম। আমার ভিতরে কেন এমনটা হল। আমি কেন বীথিকে নদীতে ফেলে দিতে চাইলাম! - এরকম ভাবতে যে মাঝির কাছে থেকে প্রথমে নৌকাটি ভাড়া করে এনেছি, তার বিড়বিড় করে বলা কথা মনে পড়ল; ভরদুপুরে মাঝ নদীতে যাবেন না স্যার।
ধীরে ধীরে আমাদের নৌকা একেবারে মাঝ নদীতে এসে পৌঁছাল। ভর দুপুরে মাঝ নদীর দৃশ্য আসলেই অন্যরকম। চারপাশে তাকালে কিছুই দেখা যায় না। কেবল জল আর জল ছাড়া। কেবল জল আর জল ছাড়া। রোদ-জল আর বাতাসের যাচ্ছেতাই খেলাটা কেবল ভরদুপুরে মাঝ নদীতে আসলেই দেখা যায়। দুপুরের এই সময়টায় নদীতে জোয়ার চলছিল। এতে কেমন আরও উন্মত্ত, প্রাণোচ্ছল মনে হচ্ছিল নদীকে। আমি একবার নদীর দিকে তাকালাম, আরেকবার বীথির দিকে। এইভাবে কয়েকবার। এই মাত্র মনে হল এত উন্মত্ত নদী আগে কখনই দেখিনি। নদীটি কি যেন চাইছে। আমি হাত বাড়িয়ে নদীর জল ছুঁয়ে দেখলাম। বীথিও আমার মত নদীর জল ছুঁয়ে দেখতে চাইল। ও সাঁতার জানে না তাতে কি, ও যদি নদীতে পড়ে মরে তাতে কি, নদী যদি আজকে ওকে নিয়ে যেতে চায় তাতে ! ও জল ছূঁয়ে দেখুক। নদীর জল কেমন। আমি বারণ করলাম না। বীথি একেবারেই শিশুদের মত করে এক হাতে নৌকার একটা অংশ শক্ত করে ধরে নদীর জল ছুঁল। একবার সাহস পাবার পর সে যেন একটা খেলা পেয়ে গেল। যেন সে আগে কখনই জল ছোঁয় নি। সে বারবার নদীর জল ছুতে শুরু করল। নৌকাটা একটু নাড়িয়ে দিলেই বীথি পড়ে যাবে। ও যখন হেলান দিয়ে নদীর জল ছোঁয়ার চেষ্টা করল তখন একবার মনে হল নৌকাটা একটু নাড়িয়ে বীথিকে ফেলে দেই। এই ভরদুপুরে নদীর স্রোত আর বীথি! আমি একবার নৌকাটা নাড়ালাম। বীথি চিৎকার করে ওঠল। খবরদার। নৌকা নাড়াবে না। বীথি কি টের পেল আমি ওকে ফেলে দিতে চাচ্ছি। নদী ওকে চাইছে !
হঠাৎ খেয়াল করলাম- মাঝ নদীতেই আমাদের থেকে অল্প দূরে আরেকটি নৌকায় একজন বেদেনি আমাদের দেখে হাসছে। আমি এতক্ষণ ভেবেছিলাম মাঝ নদীতে কেবল আমরা দুজনই। বেদেনি চিৎকার করে বলছে, ও স্যার, মাঝ নদীতে এসে গেছ। ভরদুপুরে কেউ মাঝনদীতে আসে না। আমি বুঝতে না পারলেও সন্দেহটা হল বীথির। বীথি আমাকে এবার তাগাদা দেওয়া শুরু করল। এই চল, চল। নদীর পাড়ে চলে যাই। আমি আস্তে আস্তে নদীর পাড়ে দিকে নৌকা ভেড়াতে শুরু করলাম। তখনই মনে পড়ল আমি কিন্তু বীথিকে নদীতে ফেলে দিতে চেয়েছিলাম। আমার ভিতরে কেন এমনটা হল। আমি কেন বীথিকে নদীতে ফেলে দিতে চাইলাম! - এরকম ভাবতে যে মাঝির কাছে থেকে প্রথমে নৌকাটি ভাড়া করে এনেছি, তার বিড়বিড় করে বলা কথা মনে পড়ল; ভরদুপুরে মাঝ নদীতে যাবেন না স্যার।
সায়ক চক্রবর্তী
অদ্ভুতুড়ে
সম্প্রতি একটা কাজে ঢুকেছি। কাজটা অনেকটা এরকম - আমার কাছে
বাড়ির ঠিকানা থাকে, সেইমত আমি কালেকশন করে
বেড়াই। দিনের শেষে মালিককে সমস্ত হিসেব বুঝিয়ে নিজের পাওনা গণ্ডা বুঝে নিয়ে বাড়ি
ফিরি। এমন একটা কাজ; যে কাজের সুত্রে
বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় এবং নানা অদ্ভুত ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। এমন সব ঘটনা যে
সেগুলোতে হাসব না কাঁদব ঠিক করা মুস্কিল। প্রতিটি মানুষেরই কোন না কোন দুর্বলতা, বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে। আমরা হয়ত লক্ষ্য করি, হয়ত করি না।আর বেশি সাহিত্য কপচাবো না। গল্পটা বরং শুরু করা
যাক।
সম্প্রতি একটা কাজে ঢুকেছি। কাজটা অনেকটা এরকম - আমার কাছে
বাড়ির ঠিকানা থাকে, সেইমত আমি কালেকশন করে
বেড়াই। দিনের শেষে মালিককে সমস্ত হিসেব বুঝিয়ে নিজের পাওনা গণ্ডা বুঝে নিয়ে বাড়ি
ফিরি। এমন একটা কাজ; যে কাজের সুত্রে
বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় এবং নানা অদ্ভুত ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। এমন সব ঘটনা যে
সেগুলোতে হাসব না কাঁদব ঠিক করা মুস্কিল। প্রতিটি মানুষেরই কোন না কোন দুর্বলতা, বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে। আমরা হয়ত লক্ষ্য করি, হয়ত করি না।আর বেশি সাহিত্য কপচাবো না। গল্পটা বরং শুরু করা
যাক।
প্রথম বাড়িতে – সেদিনও
বেরিয়েছি টাকা আদায় করতে। দেখি এক বয়স্ক ভদ্রলোক চেয়ারে বসে আছেন। গিয়ে নিজের
পরিচয় দিয়ে টাকা চাইতে তিনি আমাকে বসতে বললেন। ভেতরে ঢুকে হেঁড়ে গলায় চা করতে
বললেন এবং ফিরে এসে লম্বা মাটির বারান্দায় আগা থেকে মাথা অবধি পেছনে হাত দিয়ে মাথা
নিচু করে পায়চারি শুরু করলেন। আমার সাথে কথা বলছিলেন এবং পায়চারি জারি ছিল। উনি
আমার সাথে কথা বললেও মাথাটা ছিল নিচু। মাথা নিচু করেই পায়চারি পর্ব ও আড্ডা পর্ব
চলছিল। আচম্বিতে দুম করে একটা জায়গায় বসে পড়লেন এবং একটা হতাশাসূচক শব্দ করেই
উঠোনের কোত্থেকে এক চিমটে কাদামাটি এনে বারান্দার ওই রহস্যময় জায়গায় লাগিয়ে দিয়ে
আঙ্গুল দিয়ে সমান করে দিলেন। আমি কিছু বোঝার আগেই উনি একগাল হেসে বীরত্বের সাথে
বর্ণনা করলেন – “হেহে... একটা ফুটো
ছিল।পিঁপড়ের গর্ত। বুজিয়ে দিলাম।“ আমি তো
হতবাক! এ ব্যাটা পাগল নয়ত? এখনও তো টাকা দেয়নি!
আমার শরীরের মধ্যেই তো গণ্ডাখানেক ফুটো আছে। ব্যাটা, মাটি নিয়ে আমার নাকে কানে হামলা না করে! কোনমতে চা গিলে টাকা
নিয়ে চম্পট দিলাম হরির নাম করে।
দ্বিতীয় বাড়িতে – নমস্কার পর্ব সেরে বাড়ির মালিককে বললাম টাকার কথা। বললেন “হবে হবে”। আমি একটু জল খেতে চাইলাম, উনি বললেন “হবে হবে
দাঁড়াও”। মনে মনে বললাম “বসতে চাইনি
রে হতভাগা”। যাই হোক, জল খেয়ে বললাম “ আমার একটু
তাড়া আছে দাদা, আরও বাড়ি যেতে হবে, একটু তাড়াতাড়ি করলে ভালো হয়”। উনি বললেন “হবে হবে”, বলেই ঘর
থেকে একটা হিসেবের খাতা বের করে কিসব হিসেব শুরু করলেন। আবার বললাম “দাদা একটু তাড়াতাড়ি!”। বরাবরের মত ক্যাসেট বাজল “হবে হবে”। মেজাজ খিঁচরে গেলো। বললাম “ আপনার বউয়ের দ্বিতীয় বিয়ে হয়নি বলেই তো শুনেছি” । খাতার ভেতর মাথা ঢুকিয়েই চটজলদি উত্তর “হবে হবে”। খ্যাঁক খ্যাঁক করে বিকট হাসার পর
ভদ্রলোক বুঝলেন বিদায় করলে সম্মান থাকবে। একটা গোপন কথা বলি, সম্মানের পাউভাজি হয়ে গেছিল সেই সপ্তাহেই আমাদের তাসের
আড্ডায়।
তৃতীয় বাড়িতে – বাড়ি ঢুকতেই
লক্ষ্য করলাম দরজার দুই পাশের মাটি লাল হয়ে আছে। ভদ্রলোক যে রসিক লোক তা সেটা রসাল
পানের পিকমিশ্রিত লাল মাটি দেখলেই টের পাওয়া যায়। দুমাস থেকে ঘুরছি, টাকা দেবার নাম নেই। যতবার ফোন করি বলে, টাকা নেই। এবার তাই সোজা বাড়িতে। যাই হোক, ভেতরে ঢুকলাম। ঢুকেই যা দেখলাম তাতে চক্ষু ছানাবড়া না হলেও
পানবড়া হবার জোগাড়। হোঁৎকা মতন এক লোক বেঞ্চে বসে বসে রেডিওতে গান শুনছেন আর
বেঞ্চের একপাশে একটা বড় থালায় সাজানো আছে খান পঁচিশেক পান। গোটা বাড়ি জর্দার গন্ধে
মম করছে। অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসার উপক্রম! টাকা চাইলাম। উনি মুখের পান ফেলে আর
একটা মুখে পুরলেন। আবার বললাম, আবার একটা
পান। এক মিনিটে একটা পান আস্ত রামছাগলের মত কচকচ করে কএকবার চিবিয়ে পুচ পুচ করে
কএকবার পিক ফেলেই আবার আর একটা। গত দশ মিনিটে আটটা পান মুখে ঢুকেছে এবং দুটো শব্দ মুখ থেকে বেরিয়েছে। “বস” আর “দিচ্ছি”। তাও সেটা অনেক কষ্টে মুখের ভেতর ওই
পানের বরজ থেকে বের হল। মাথা এত গরম হয়ে যাচ্ছিল যে বলার নেই, কিন্তু খরিদ্দার হলেন নারায়ণ ; অতএব চুপটি করতে সয়ে যাও! কিন্তু আমি একটু ট্যারা গোছের
বান্দা। যখন দেখলাম পনেরো মিনিট পার হয়ে গেলো অথচ না পান খাওয়ার বিরাম আছে আর না
ওই রেডিওর ঘ্যানঘ্যান বন্ধ হচ্ছে, তখন উঠোনের
পাশে বাঁধা ছাগলটাকে টেনে আনলাম বেঞ্চের পাশে। বেঞ্চের উপর উঠিয়ে থালা থেকে একটা
পান ছাগলের মুখে ঢুকিয়ে দিলাম (গেঁজিয়ে দিলাম) এবং ছাগলের দিকে তাকিয়ে বললাম “দাদা, একটু তাড়াতাড়ি করুন”। ভদ্রলোক এই দেখে মুখে জল দিলেন। ওনার হোঁৎকা শরীরের মধ্যে
আপেলের মত মুখটা তখন দেখার মত ছিল!
সারাদিন এই করার পর ঘড়িতে দেখি এগারোটা ছাপ্পান্ন বাজে। আমার
এবং ঘড়ির; এই দুইয়ের একসাথে বারোটা বাজার আগেই
আমার চেনা দোকানে গিয়ে বসলাম। এটা হরেনদার পানের দোকান। এখানে আমার নিত্য আড্ডা।
হরেনদাকে মাত্র বলেছি “মহাজ্বালা বুঝলে!...”, কানের পাশে ধ্বনিত হল “দাদ, হাজা, চুলকুনি যে কোন রকমের জ্বালা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয় আমাদের
এই অব্যর্থ জড়িবুটি...”
আগেরসংখ্যা- http://galpogucchho.blogspot.in/2012/11/blog-post_6468.html
আগেরসংখ্যা- http://galpogucchho.blogspot.in/2012/11/blog-post_6468.html
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যসমূহ (Atom)
