পুনর্জন্ম
শতদ্রু
গিয়ার বদলাল । এতক্ষণ খালি চড়াই এসেছে , হেয়ারপিন
টার্নিংটার পর রাস্তা খানিক সমান । দমচেপে বসেছিল হিয়া । অলটিচুডের হেরাফেরিতে ওর
কানে তালা লেগেগ্যাছে । পেছনে অখণ্ড নীরবতা , বুড়ো বুড়ি
প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে যথারীতি নেই কারণে ঝগড়া করেছে । আপাতত মুখে কুলুপ । একদিক
দিয়ে অবশ্য ভালই হয়েছে । গাড়িতে উঠেই বুড়ো এমন বকবকাচ্ছিল যে এরকম রাস্তায়
কন্সেনট্রেট করা মুশকিল । গল্প বলতে বুড়োর ঝুলিতে সাকুল্যে খান দশেক । সেই গল্প
সারাজীবনে কয়েককোটি বার শুনেছে হোলফ্যামিলি । অবশ্য প্রতিবার কথনে গল্পে খানিক মেদ
জমে বুড়োর । যারা আগে শুনেছে , তারা
মুখটিপে হাসে । কেউ কিন্তু ধরিয়ে দেয় না জনসমক্ষে । বোঝে বুড়োর জীবনে এখন এটুকুই
রোমাঞ্চ , সেই আনন্দটুকু কেড়ে নিয়ে কি লাভ !
সামনেই
হাঁটছে কয়েকটি স্কুলপড়ুয়া । নিনির বয়সীই হবে বা । কি কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ছে একে
অন্যের গায়ে । হাঁটুর ওপর স্কার্ট , ভি নেক ডিপ
কালারের পুলোভার , পায়ে জুতোমোজা , ফোলাফোলা টম্যাটোর মত গাল , সক্কলের
পিঠে স্কুলব্যাগ , কিন্তু কি অদ্ভুত, সকলেরই বই হাতে ধরা । ওরা কি শেষ পিরিয়ডে বইখাতা না
ঢুকিয়েই দৌড় মেরেছে নাকি, ভাবছিল
দিয়া । কিন্তু খানিক এগিয়ে ভুল ভাঙল । আরেকদল পোড়োকে দেখে বুঝল , এটাই এখন ইন থিং । সত্যি , সময়টা বড়
দ্রুত ছেড়ে যাচ্ছে হিয়াদের , আঙ্গুল
তুলে মস্করা করে বলছে , ‘ এক্কেবারে
বুড়ো হয়েগ্যাছ হে !’মেয়েও
আজকাল প্রায় ই বলে , ‘ তুমি
কিচ্ছু বোঝ না, মা ! ‘
মেয়ের কথা
মনে হতেই অন্যমনস্ক হয়ে যায় হিয়া । ভালোলাগে না একমাত্র মেয়েকে এতদূরে ফেলে রাখতে
। বাড়িটা হা হা করে যেন গিলতে আসে । কিন্তু শতদ্রুর ঐ এক জেদ । মেয়েকে কনভেন্ট
স্কুলে পড়াবে । নিজের বাংলা মিডিয়াম ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে ও বরাবরই কর্পোরেট মহলে
কুঁকড়ে থেকেছে । বলে , ‘ জানো তো , ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞেস করে কোন স্কুলে পড়েছ
। যদি শোনে তথাকথিত নামী স্কুল , প্রথমেই
একটা ইম্প্রেশন তৈরি হয়ে যায় । আমাদের সাথে পড়তো সুহাস , বেচারি দুর্দান্ত রেসাল্ট থাকা সত্বেও তেমন ভালো চাকরী
পায় নি , স্রেফ ইন্টারভিউ তে ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজি
বলতে পারতো না বলে । ‘ হয়তো সেই
হীনমন্যতা থেকেই মেয়ের ভবিষ্যৎ ভাবতে গিয়ে দিয়ার সেন্টিমেন্ট কে পাত্তা দিতে চায়
নি । মাসে একবার আসে ওরা এই পাহাড়ি শহরে মেয়েকে দেখতে । সেই যাত্রায় এবার সঙ্গী
হয়েছে মেয়ের ঠাকুমা ঠাকুর্দা ।
গাড়িটা
বেলা দশটার দিকে একটা ছোট্ট বাড়ি কাম রেস্তরাঁর সামনে দাঁড় করাল শতদ্রু । ‘কি তোমরা সবাই চা টা খাবে তো ? আমার একটু রেস্ট দরকার । হাঁটু ব্যথা করছে ।‘ হিয়া পেছনে তাকাল । বাবা এক কথায় রাজী । চায়ের নেশা
পেয়েছে । বাড়িতে থাকলে এসময় এককাপ লিকার চা খায় । সেই সকাল সাতটায় এককাপ করে লিকার
চা আর দুটো ক্রিমক্রাকার খেয়ে রওনা দিয়েছে ওরা । অনেকক্ষণ ধরেই ছুঁচোতে ডন মারছে
পেটে । মায়ের ঝুলিতে কাজু , ঝুরিভাজা , খুরমা ছিল , সেও তো
কোনকালে শেষ । তাছাড়া একটা বিরতি বুড়ো বুড়ির ও দরকার । অনেকক্ষণ থম মেরে আছে ।
হাল্কা করা দরকার ।
নামেই
রেস্তোরাঁ । মোমো চাউমিন আর চা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না । সেখানে মোমোর অর্ডার
দিয়ে পাশের দোকান থেকে চিপস কিনে আনল হিয়া । বাবা চায়ের সাথে খাবে । মায়ের আবার
জর্দা পানের বটুয়া বেরিয়ে গেল এই ফাঁকে । এই এক নেশা , শত বলেও ছাড়াতে পারেনি কেউ । চা খেয়েই বাবা আবার ফর্মে , গাড়িতে উঠেই শুরু করলো, ‘বুঝলি হিয়া
, তখন আমি গ্যাংটকে পোস্টেড ... ।‘ মা চোখ পাকাল , ‘ এই আবার
শুরু হোল । চুপকরে গাড়িটা ভালোভাবে চালাতে দাও বরং ‘। বাবা
ক্ষুণ্ণস্বরে বলল , ‘ হু , আমি যেন আর গাড়ি চালাই নি কোনোদিন ! ‘,মা র ঠোঁট বেঁকে গেল, ‘সে আর আমি
জানি না, তুমি কেমন কি চালাও! বেশি বারফাট্টাই মেরো
না , দেব হাটে হাঁড়ি ভেঙে ‘। বাবা চুপ
করে গেল গম্ভীর মুখে ।
দূরথেকে
ফুটে উঠছে হিলটাউনের পেন্সিল স্কেচ । মেঘ জমে আছে মাথায় । ঝিরঝিরে বৃষ্টি আদর করছে
রাস্তা । খোলা জানালা দিয়ে হুটহাট মেঘ ঢুকে যাচ্ছে গাড়িতে । এত আরামেও চোখ বোজার
উপায় নেই । খালি মনেহয় , কি যেন মিস
হয়ে যাচ্ছে । তাছাড়া প্রতি টার্নিংএ একবার ডাইনে চেপে যাচ্ছে আরোহীরা , তো একবার বাঁয়ে । তাও ঝিমোচ্ছিল মা । বাবাও চোখ বুজে আছে
। জাগা না ঘুমন্ত বোঝা দায় । হঠাৎ একঝাঁক ছাগল আর
ভেড়া রাস্তা জুড়ে হেলেদুলে পেরনো শুরু করলো । ব্রেক কষল শতদ্রু । ‘ কি হোল , কি হোল ‘ বলে ধড়ফড় করে তন্দ্রা ভেঙে গেল বাবা মার । হলুদ গামবুট
পরে বিশাল রঙচঙে ছাতা মাথায় পশুদের মালিক কিম্বা রাখাল প্রাণপনে হুইসিল বাজিয়ে
ওদের লাইন করানোর চেষ্টা করছিলো । মিনিট ছয় সাত আটকে রইলো ওদের গাড়ি ।
পৌঁছেই চেনা সরদারজির হোটেলে গ্যারেজ করে
দিল বাবা মাকে । ওরা প্রতিমাসে একবার করে আসে বলে মোটামুটি ফিক্সড রুমই পায় ।
ডাবলবেড ডিলাক্স । দুটো পাশাপাশি ঘর হ’লনা । মা
বাবা একতলায় নিল । হাঁটু ব্যথা । সিঁড়ি ভাঙতে চায় না । বাবার ইচ্ছে ছিল দোতলায়
যাবার । বেটার ভিউ পাবে । মা বেঁকে বসলো । হিয়ারা নিজেদের ঘরে গিয়ে রুম সার্ভিসে
খাবার অর্ডার করে দিল । চাইনিজ ফ্রায়েড রাইস আর চিলি
চিকেন । বাবা মাটন পছন্দ করে , কিন্তু
হিলে মুরগীটাই চলে বেশী । মা অন্যকিছু খেতে ভয় পায় । পাছে পর্ক বা বিফ খাইয়ে দ্যায়
!
ফ্রেশ হয়ে
সেন্টার টেবিলটা আর রিক্লাইনার নিয়ে খাটের উল্টোদিকে সেট করে নিল হিয়া । শতদ্রু
সিগারেট আর অ্যাশট্রে নিয়ে পাশে এসে বসলো । সেখান থেকে বিরাট কাঁচের দেয়ালজোড়া
পর্দা সরালেই ধূমায়িত শৃঙ্গ । খেয়ে মা বাবা একটু গড়াবে । মেয়ের কাছে যেতে যেতে
তিনটে বেজে যাবে । ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছিল হিয়া । সময় আর কাটতে চাইছেনা যেন
। উঠেগিয়ে নিজেদের বড় ট্রাভেল ব্যাগ খুলে মেয়ের জন্য আনা দিম্মার হাতে
বোনা সোয়েটার আর মাফলার বের করলো । বড় এক শিশি আচারও পাঠিয়েছে দিম্মা । হিয়া মাকে
বারণ করে অনেক । এই বয়সে এত বোনাবুনির কি দরকার ? চোখটা যাবে
শেষ হয়ে । তা বুড়ি কথা শুনলে তো ! বলে , ‘ যতদিন পারি
, না করিস না । আর কি , সময় তো হয়ে
এলো ‘। হিয়ার গলার কাছে অস্বস্তি হোল , কথাটা মনে করে । সমবয়সীদের পরপর মৃত্যু মাকে দার্শনিক করে
দিয়েছে । এখন যেন খালি গুছিয়ে রেখে যাচ্ছে যতটা পারা যায় । হাত বোলাল মায়া ভরে ।
মায়ের স্নেহাশিষ লেগে আছে এতে ।
‘শোন, চলো না, আমরা
বেড়িয়ে পরি, নিনি কে নিয়ে চলে আসি । মা বাবা বরং কাল
সকালে যাবে ওর স্কুল দেখতে, এখন
বিশ্রাম করছে করুক, আমরা ফিরে
এসে একসাথে বেরবো ‘, হিয়ার গলায়
ব্যাগ্রতা কান এড়াল না শতদ্রুর । রাজী হয়ে গেল । দুজনে পোর্টিকো থেকে গাড়ী বের করে
রওনা দিল ।
একটু একটু
করে ঠাণ্ডা বাড়ছে । মেঘ কাটে নি । বৃষ্টি নামবে মনেহচ্ছে খানিকক্ষণের মধ্যেই ।
হিয়ার তখন এসব খেয়াল নেই । ওর মন পড়ে আছে মেয়ের কাছে । খানিক এগোনোর পর মেঘটা যেন
কালো চাদরে মুড়ে ফেললো চারদিক । ফগলাইট জ্বেলেও কিচ্ছু দ্যাখা যাচ্ছে না । শতদ্রু
ভয় পেয়ে গেল । পারবে না আর এভাবে গাড়ি চালাতে , খুব পাকা
ড্রাইভারও পারবে কিনা সন্দেহ । উল্টোদিক থেকে বেশ খানিকক্ষণ কোন গাড়ি আসে নি ।
বুঝতে পারছে না কি করা
উচিৎ । হিয়ারও হুঁশ ফিরেছে ততক্ষণে । কয়েকবার আড়চোখে তাকিয়েছে শতদ্রুর দিকে । ওর
কপালেও গভীর ভাঁজ । শতদ্রু খুব রাফ অ্যান্ড টাফ । সহজে ভয় পাবে না । সেই শতদ্রুর
অবস্থা দেখে হিয়া কাঠ হয়ে গ্যাছে ভয়ে । শতদ্রুর থাইয়ের ওপর শক্ত হয়ে চেপে বসেছে ওর
আঙুল । দেখতে দেখতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল । পাহাড়ে বৃষ্টি ওরা প্রথম দেখছে না ।
কিন্তু এমন বৃষ্টি এই প্রথম । মনে হচ্ছে জগতসংসার ভেঙ্গে পড়েছে । গুমগুম শব্দ শোনা
যাচ্ছে , কোথাও পাথর নামছে গড়িয়ে । ওদের মাথার ওপর
নয়তো ? ঠিকঠাক কিচ্ছু ভাবার অবস্থায় নেই শতদ্রু । মেয়েটা
নিরাপদ আছে তো ? হা ভগবান ! মা বাবা যে কি করছে ! মোবাইলটার
টাওয়ার চলে গ্যাছে । হিয়ার ঠোঁট কাঁপছে । ওর সামনে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না , শতদ্রু হিয়ার মাথাটা বুকে টেনে নিল । হু হু করে কেঁদে
উঠলো হিয়া । শতদ্রু অভাগা , কাঁদতেও
পারছে না । গাড়িটা একটা খেলনার মতো রাস্তার পাশে দাঁড় করানো । ভয় হচ্ছে , যে কোন মুহূর্তে ওপর থেকে ধ্বস নেমে আসবে । খুব কাছেই
রাস্তা বসে গ্যাছে । বন্যার স্রোতের মত জল যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে । গাড়ির কাঁচ তোলা ।
ময়েসচার জমছে । দৃষ্টি ঘষা ঘষা । অস্পষ্ট লাগছে বাইরের তাণ্ডব । ‘ গুরুদেবকে ডাকো হিয়া ‘, শতদ্রু
এটুকু উচ্চারণ করতে পারলো অনেক কষ্টে । ও কিছু দেখবে না , যা হয় হোক । চোখ বুজে ফেললো শতদ্রু । কতক্ষণ হোল কে জানে ! মনে
হচ্ছে আজই বুঝি পৃথিবীর শেষ । যদি মরেই যায় আজ ওরা দুজন এইভাবে রাস্তার ওপর , ওদের বডিও বোধহয় খুঁজে পাবে না কেউ কোনোদিন । মা বাবাকে
বলেও আসা হয় নি । খুব চিন্তা করবে । ওদের যেন কোন ক্ষতি না হয় । মা বাবা যেন
নিনিকে নিয়ে নিরাপদে থাকে ! নাস্তিক শতদ্রু হঠাৎ ফিল করলো , আস্তিকরা কত ভাগ্যবান , তারা
নির্ভর করার মত , দোষারোপ করার মত একটা অবলম্বন তো পায় অন্তত
!
হোটেলের
ঘরে ঘুম থেকে উঠেই ভ্রু কুঁচকে গ্যাছে বাবার । মায়ের ঘুম তখনো ভাঙ্গেনি । মোবাইলটা
একটা প্রস্তরযুগের ভোঁতা অস্ত্রের মত অচল হয়ে পড়েআছে । বাবা ওপরে গিয়ে দ্যাখে ছেলে
বৌমার ঘরে তালা , রিসেপশান থেকে জানালো ওরা অনেকক্ষণ আগেই
বেরিয়েছে , গাড়িটাও নেই । কপাল কুঁচকে গেলো বাবার ।
সর্দারজী নেই । একটা বাঙালী ছেলে ম্যানেজারি করছে । ও বল্ল , পাহাড়ে অসময়ের বৃষ্টি এটা । লক্ষণ ভালো না । ঘড়ির কাঁটা
ছটা ছুঁতে চলেছে । কোন খবর নেই । নাতনির স্কুলের কি খবর কে জানে । হিয়ারা কি
ওখানেই আটকে আছে ? কদিন আগেই উত্তরাখণ্ডের খবরে নড়ে গ্যাছে
দেশ । মানুষের লোভে মানুষ মরছে । কেদারনাথ মন্দিরে থরে থরে পড়েছিল মৃতদেহ আর টাকার
বান্ডিল । রামওয়ারা গ্রামটার কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় নি । পেপারে ছবি দিত ।
ডুলি শুদ্ধ ভেসে গ্যাছে তীর্থযাত্রী । পায়ে নাইকের
স্নিকার , গায়ে উডল্যান্ড জ্যাকেট , নিষ্প্রাণ দেহ , মুখ থুবড়ে
পড়ে আছে পাথরের ওপর । খানিক আগেও যেখানে থরে থরে দোকানপাট গমগম করছিলো ক্রেতা
বিক্রেতার ভিড়ে জাস্ট ভোজবাজির মতো উবে গ্যাছে । মাথা কাজ করছে না , সামনে চায়ের কাপ জুড়িয়ে জল । ঘরে যেতে সাহস হচ্ছে না , শতদ্রুর মাকে ফেস করার ক্ষমতা নেই , হাঁটুতে জোর নেই উঠে দাঁড়ানোর । নিশ্চল বসে আছে বাবা , মোমের আলোয় ভুতের মতো । কারেন্ট নেই বিকেল থেকেই ।
জেনারেটার খরচ করতে চাইছে না মালিক । এই দুর্যোগ কতক্ষণ থাকবে কে জানে ।
নিনিদের মিশনস্কুলটা একটা পাহাড়ের মাথায়
চ্যাপ্তা থালার মত জমির ওপর । আসেপাশে উঁচু ভূমিরূপ নেই । ফলে ওপর থেকে বড়পাথর
গড়িয়ে নামার ভয় নেই । তবে পাহাড় বড় খামখেয়ালী । কে বলতে পারে ধ্বস নেমে গোটা
স্কুলবিল্ডিংটাই হুরমুরিয়ে নেমে আসবে না ! সিস্টার সিরিল সব বাচ্চাদের প্রেয়াররুমে
জড় করেছেন । যিশুবাবার সামনে কাঁপাকাঁপা মোমের আলোয় ওরা দেখতে পাচ্ছে , হাঁটু মুড়ে বসে চোখ বুজে প্রার্থনা করছেন সিস্টার । গোটা
হলে পিনড্রপ সাইলেন্স । সিস্টারের দুই গালে জলের ধারা । একদম বাচ্চারা এক কোণে
জড়সড় হয়ে আছে । অন্য সিস্টাররা দু হাত দিয়ে ওদের বুকে আগলে রেখেছেন । যেমন করে
পাখির ছানাদের ডানা মেলে আগলায় পাখির মা বাবা । ফোঁপাচ্ছে কেউ কেউ । হাতে ধরা সফট
টয় বা খেলনা গাড়ি । নিনি পারছে না প্রার্থনায় মন দিতে । মা ফোন করেছিল সকালে । বলল
, ‘ আসছি , সারপ্রাইজ
আছে ‘। মা রা কোথায় এখন ? ওহ গড ! গলার কাছে পাথর চাপিয়ে দিয়েছে কেউ । খেয়াল করে নি
কখন পাশে এসে বসেছে শিম্বা । ওদের কথা বন্ধ আজ দিন সাতেক । ফালতু ক্যাচাল করে
শিম্বা ওকে সেদিন বকা খাইয়েছিল । একবারও স্যরি বলে নি । থাক , নিনিও দেখবে , কদিন পারে
কথা না বলে থাকতে । হুহ , এই নাকি
বেস্ট ফ্রেন্ডের নমুনা ! নেহাত মা বাবা নেই বলে শিম্বাকে এত বেশিবেশি পাত্তা দিত
এতদিন । সেই শিম্বা নিনির গা ঘেঁষে বসে আছে । নিনির হাত অজান্তেই আঁকড়ে ধরল
শিম্বার বরফ ঠাণ্ডা হাত । শিম্বা আরেক হাতে চাপ দিল ওর হাতে , চকচকে চোখে অনেক
অভিব্যক্তি , যেন বলছে , ‘ এভ্রিথিং
উইল বি ওকে ‘।
সর্দারজী
ঝিমোতে ঝিমোতে সোফা থেকে প্রায় গড়িয়ে পড়ার মুখে বাবা ধরে ফেলল । সারারাত ঘুম হয় নি
কারো । গোটা হোটেলের বোর্ডাররা রিসেপশানে এসে বসে আছে । উৎকণ্ঠায় , ভয়ে যে যার মাতৃভাষায় সারারাত আরাধ্যকে স্মরণ করে গ্যাছে । তবে তারা একদিক থেকে বাবার
চেয়ে লাকি । তাদের ছেলে বউমা নাতনি এই ভাবে দুর্যোগের মধ্যে বাইরে পড়ে নেই । তারা
সপরিবারে আছে এক ছাদের তলায় , একসাথে ভাগ
করে নিচ্ছে উৎকণ্ঠার প্রহর । যা হবে , সকলের
একসঙ্গে হবে । এককালের দুঁদে প্রশাসনিক অফিসার , সারাজীবন
লোক চরিয়ে খাওয়া বাবা হঠাৎ বুঝতে পারলো হোটেলের ঐ বয়টার সাথে বাবার কোন তফাৎ নেই
আদপেই । যতই ছড়ি থাকনা কেন হাতে , যতই লম্বা
ল্যাজ থাক না কেন , এই
মুহূর্তে কারুর কিস্যু করার নেই , বসে বসে
দ্যাখা ছাড়া !
তখন ফ্যাকাসে আলো ফুটতে শুরু করেছে ।
বৃষ্টি ধরেছে সবে । বাবা বেড়িয়ে এলো হোটেল থেকে । ‘দাঁড়ান
বোসবাবু , আমিও যাবো আপনার সাথে ‘, বলে পাণ্ডেসাহেব এগিয়ে এলেন । পেছনপেছন আরও অনেকে ।
একরাত্তিরে কে যেন এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছে গোটা ভারতবর্ষ । হোটেলথেকে কেউ কেউ চেয়ে
এনেছে বেলচা , শাবল । কি কাজে লাগবে কে জানে । মাকে
নাড়ানো যায় নি । সেই যে ধ্যানে বসে আছে তো আছেই । মায়ের পাশেও একটা মোবাইল রেখে
এসেছে বাবা । ওটা এয়ারটেলের । কে জানে কোন নেটওয়ার্ক আগে প্রাণ ফিরে পাবে । নিনির
স্কুলের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে দলটা । প্রায় মাইলদুয়েক যেতে হবে খাড়াই । বাবার
হাঁপ ধরছে কয়েকপা হাঁটলেই । মনেহচ্ছে কলজে ফেটে যাবে । হাঁ করে শ্বাস টানছিল ।
প্যাটেল বলল , ‘ ট্রাই টু
কিপ ইওর মাউথ সাট , আঙ্কেল , আদারওয়াইস উ উইল গেট টায়ার্ড সুন ‘। ছেলেটা শতদ্রুর বয়সীই হবে হয়তো । বাবার বুকের ভেতরটা
হিম হয়ে উঠলো । ‘ বাবা ‘ ডাকটা আর কোনোদিন শুনতে পাবে তো ? একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল বাবা , সম্বিৎ ফিরল কার যেন সোল্লাশ চিৎকারে । এখানে মোবাইলের
টাওয়ার দেখা যাচ্ছে বি এস এন এল এর । সবাই যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে লাগলো লোকাল
পুলিশফাঁড়িতে । কেউ কেউ সাজেশান দিল প্রশাসনিক ভবনে ফোন করার । তবেই সঠিক তথ্য
জানা যাবে । কি অবস্থা শহরের । পথঘাট কি কনডিশানে আছে । কোথায় কোথায় ধ্বস নামলো ।
ক্যাসুয়ালটি হলে তা কত । রেস্কিউ টিম কতদূরে । একেকজনের একেকরকম জিজ্ঞাসা ।
দুএকজন শতদ্রুদের ফোন নাম্বার চেয়ে নিল । ট্রাই করবে । সর্দারজি ডিরেক্টরি ঘেঁটে
নিনির স্কুলের ফোন নাম্বারটা
নিয়ে এসেছিলেন । তিনি সেখানে ফোন করে জানালেন , নিরাপদেই
আছে বাচ্চারা । তবে শতদ্রু কিম্বা হিয়া ওখানে নেই । পায়ের
নীচে মনেহল ভুমিকম্প হচ্ছে বাবার । কেউ একজন ধরে ফেলল পড়ার আগেই। ফ্লাস্ক খুলে ব্রাণ্ডি বাড়িয়ে দিলেন নেন্নে সাহেব । মুখে চোখে জল
দিলো কেউ একজন । রাস্তার ধারে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল বাবাকে । তখনি
বুক পকেটে বাবার মোবাইল বেজে উঠলো । ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন মোবাইলটা বের করে আনল
বাবার পকেট থেকে । নীল টেলিফোনের সিম্বল ভেসে উঠেছে পর্দায় , ‘ হিয়া কলিং ... ‘।