গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

সুদীপ কুমার দাস

খেয়া পারে তারা কয়েকজন


কৃষ্ণা কোন কিছুই দেখতে চাইছে না।বিছানার এক কোনে চুপচাপ বসে আছে কোন শব্দই যেন তার কানে  প্রবেশ না করে সেই চেষ্টাই সে চালিয়ে যাচ্ছে।তবুও শব্দগুলি তার কানে গরম সীসা হয়ে প্রবেশ করছে-ছিনাল মাগী,আর জায়গা পেলি না,পাঁচ বছরের ছোট ছেলের সাথেই ফষ্টিনষ্টি করা লাগলো।মুখে পাথরের   কাঠিন্য নিয়ে বসে থাকার চেষ্টা করে সে সহসাই তার দৃস্টি ছয় বছরের দীপ্তর মুখে আটকে যায়।দীপ্ত  ভীত সন্তস্ত্র চোখে পুরো ঘটনা দেখছে।এক হাতে সে তার মায়ের আঁচল ধরে আছে।দীপ্তর মা দীপ্তর বাবাকে থামানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু লাভ হচ্ছে না।দীপ্তর বাবা প্রচন্ড শক্তিতে মিহিরের মুখ লক্ষ্য করে ঘুঁষি মারে।মিহির সময় মত সরে দাঁড়ায়।লক্ষ্যভ্রষ্ট ঘুঁষি খাটের স্ট্যান্ডে লাগে।স্ট্যান্ড ভেঙ্গে যায়।এবার দীপ্তর মা প্রচন্ড ক্রোধে চিৎকার করে উঠে।
-থামবে তোমরা।তোমরা কেন এর মধ্যে নাক গলাচ্ছো?কে কাকে ভালোবাসবে এটি নিয়ে তোমরা কেন মাথা ঘামাচ্ছো?
বোনের চিৎকার শুনে দুর্লভ রঞ্জনকে ছেড়ে দেয়।রঞ্জন নাকে হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়ে।তার নাক দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়ছে।আচমকাই ঘরে নীরবতা নেমে আসে।কৃষ্ণা দীপ্তর মুখ মন্ডলে যে ভয়ের রেখা আঁকিবুঁকি করছে তা দেখতে থাকে।আর তা দেখতে দেখতে অসীম সাহস ভর করে তার উপর।
-এইটা আমার জীবন।আর আমার জীবন নিয়ে কথা বলার অধিকার  আপনাকে কে দিয়েছে অনীল বাবু?
দীপ্তর বাবার চোখে চোখ রেখে খুব ঠান্ডা গলায় কৃষ্ণা বলে।অনীল অসহায় দৃস্টিতে ঘরের চারপাশে তাকায়।
-আমি ভেবেছিলাম সব কিছুই মিহিরের কারসাজি।এতে হয়তো তোমার সায় নাই।
আমতা আমতা করে অনীল বলে।
-কে বলেছে আমার সায় নাই।সায় না থাকলে আমি ওর সাথে বিছানায় শুতে যাই?
ক্রোধের সাথে কৃষ্ণা কথাগুলি বলে।
চিৎকার চেঁচামেচিতে পাড়ার লোকও জড়ো হয়েছে।জানালার ওপারে কেউ একজন খিস্তি দেয়-এই সবাই উলু দে।বিধবা মাগীর মাংগে রসের জোয়ার এসেছে।উলু দে সব উলু দে।এষা দীপ্তর হাত ধরে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।অনীলও তার স্ত্রীর পথ ধরে। পরদিন কোর্টে গিয়ে  কৃষ্ণা আর রঞ্জন বিয়ে করে।বিকেলে জয়কালি বাড়িতে মালা বদল করে।
বাড়িতে প্রচুর ভীড়।উঠোনে শিবনাথকে শুইয়ে রাখা আছে।দীপ্ত মায়ের আঁচল ছেড়ে ভীড়ের ফাঁক গলে শিবনাথের লাশের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।দীপ্তর মনে হতে থাকে শিবনাথ কাকু এখনই উঠে বসবে।আর বলবে-দীপ্ত সোনা এখনই টারজান শুরু হবে।দেখবে না?শিবনাথের বাম চোখ ঢোল হয়ে ফুলে আছে।চোখের উপরে নীলচে দাগ।দীপ্ত শুধু জেনেছিল শিবনাথ কাকু মটর সাইকেল চালাতে গিয়ে ইলেকট্রিক থাম্বার সাথে ধাক্কা খেয়েছে।এর দুইদিন পর আজ কাকুর লাশ উঠোনে।সে লাশের নিকট থেকে আবার মায়ের কাছে ফিরে আসে।মায়ের কাছে লিপি আর লিটন বসে আছে।লিটন ওরই বয়সী।লিপি ওদের চেয়ে বছর তিনেকের বড়।শুকনো মুখে লিপি ভীড় দেখছে।ভীড়ের মধ্যে গুঞ্জন উঠে-লাশ বেশীক্ষণ রাখা ঠিক হবেনা।এইবার লাশ বের করা হোক।কয়েজন মিলে লাশ খাটিয়ায় তোলে।বল হরি,হরি বল-শব্দগুলি জোড়ালো হওয়ার সাথে সাথে চারিদিকে কান্নার রোল ওঠে।কৃষ্ণা উঠোনে পড়ে হাঁউ মাউ করে কাঁদতে থাকে।দীপ্ত লক্ষ্য করে কৃষ্ণা কাকিমার সিঁদুর মুছে ফেলা হয়েছে। দীপ্তর মা উঠে গিয়ে কৃষ্ণাকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে।দীপ্ত আর লিটন চুপ করে বসে থাকে পাশাপাশি।মায়ের কান্না দেখছে ওরা।
-সুদের ব্যবসা করলে ঈশ্বর কঠিন পাপ দেয়।কিন্তু মানুষ তা বোঝেনা।
অনীল তার স্ত্রীকে বলে।
-দীপ্ত বাবা,তুমি কি জেগে আছো?
মায়ের কথায় কোন উত্তর দেয় না দীপ্ত।ভাবটা এমন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে।
-এত টাকা দিয়ে মানুষ কি করবে?
দীপা অনীলকে বলে।
-মানুষের চাহিদার কোন শেষ নেই।
স্ত্রীর কথার উত্তরে অনীল বলে।
-হঠাৎ মটর সাইকেল চালাতে গেলো কেন?
দীপা প্রশ্ন করে।
-ভেতরে অনেক রহস্য আছে।শিবনাথ যাদের কাছ হতে সব চাইতে বেশী টাকা পেতো তাদের দুইজন ওকে মটর সাইকেল চালানো শিখাচ্ছিল।কানাঘুঁষা হচ্ছে যে ব্রেকের স্কুরু খুলে রাখা হয়েছিল।
অনীল একটানা বলে যায়।
-আহারে।এই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কি হবে এখন?
দীপা বলে।বাবা-মায়ের গল্প শুনতে শুনতে দীপ্ত ঘুমিয়ে পড়ে।অনেক পড়ে বড় হয়ে দীপ্ত জেনেছিল ওইদিন শিবনাথ কাকুর মাথায় হেলমেট ছিল না।
শিবানাথ বসাক অনেক ধনাঢ্য এক ব্যক্তি।নীচাবাজারে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।সেখানে সব ধরণের খেলার সামগ্রী পাওয়া যায়।তবে এটা তার মূল ব্যবসা না।ওর মূল ব্যবসা সুদে টাকা ধার দেওয়া।সে লেখাপড়া শিখেনি।সব হিসাব মুখে মুখে করে এবং খুব নির্ভুল ভাবেই করে।তবে সুদ উসুলের সময় সে খুব নির্দয়কত মানুষকে  সর্বশান্ত করেছে তা সে নিজেই জানেনা।শিবনাথের দোতালা বাড়ি।নীচ  তলায় তিন ঘর ভাড়াটিয়া থাকে। বিধবা বোনসহ দোতালায় থাকে শিবনাথতবে ভাড়াটিয়াদের সাথে তার ব্যবহার ভালো।সবকিছু ফেলে মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে পরপারে পাড়ি দেয় শিবনাথ

শিবনাথের মৃত্যুর এক বছরের মাথায় রঞ্জন ঝন্টুর কাপড়ের দোকানে কাজ নেয়।থাকা-খাওয়া ফ্রি আর তিন হাজার টাকা মাসিক বেতনে চাকরি হয় তার।অনীল বাবুর পাশের তিন ঘর নিয়ে ঝন্টু ভাড়া থাকে।প্রথম যেদিন পঁচিশ বছরের টগবগে সুদর্শন রঞ্জন ঝন্টুর ঘরে ওঠে।সেদিন বাড়ির বউদের মধ্যে বেশ গুঞ্জন উঠে।কি সুন্দর দেখতে ছেলেটা!রঞ্জন মিহিরের আত্মীয়।তবে অনেক দূর-সম্পর্কের।আর মিহির কৃষ্ণার মেসো।শিবনাথ মারা যাওয়ার পর রোজ একবার সন্ধ্যায় বাড়িতে আসে।কৃষ্ণা আর তার সন্তানদের খোঁজ নেয়।

অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই রঞ্জন বাড়ির সবার সাথে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলে।তবে দীপ্ত রঞ্জনকে ঠিক পছন্দ করতে পারেনা।তার কাছে মনে হয়-কাকুটা কেমন যেন অন্যরকম।একদিন দীপ্ত তার মামা দুর্লভকে বলে-মামা,রঞ্জন কাকুর চুল সজারুর কাঁটার মত না?ভাগ্নের কথা শুনে দুর্লভ হো হো করে হেসে উঠে।

রঞ্জন সবার সাথে মিশলেও কৃষ্ণার সাথে ঠিক তার জমছিল না।কৃষ্ণা সব সময় একটা দূরত্ব বজায় রাখে।রঞ্জন ভালো করে খোঁজ নিয়ে জেনেছে-শিবনাথ বসাকের সকল সম্পত্তি কৃষ্ণার নামে।রঞ্জন স্বপ্ন দেখা শুরু করে।দারিদ্র্যতা ওর ভালো লাগে না।কৃষ্ণা যদিও ওর চেয়ে একটু বড় আর তিন ছেলে-মেয়ের মা, তবুও সমস্যা নেই।টাকা থাকলে সব পাওয়া সম্ভব।সে ঠিক করে কৃষ্ণাকে বরশীতে গেঁথে ফেলতে হবে।সে মনে মনে ছক কষে।

-আপনি দেখতে এত সুন্দর,একটু তো সাজগোজ করতে পারেন।
রঞ্জনের কথায় কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না কৃষ্ণা।
-কত মেয়েই তো বিধবা হয় আবার বিয়েও করে।

রঞ্জন ছিপ ফেলতে ফেলতে বলে।কৃষ্ণা ঘাটে বাসন ধুয়ে নিচ্ছিলরঞ্জন দিঘীতে বরশী ফেলেছে।বাসন মাজা শেষ হলে কৃষ্ণা কোন কথা না বলে চলে যায়।সেদিন সন্ধ্যায় কৃষ্ণা আয়নাতে নিজেকে দেখে।বিশাল ঘন চুল ওর।তেমন আর যত্ম নেওয়া হয়না।চিরুনী তুলে নেয় হাতে।

সিঁড়ি দিয়ে কৃষ্ণা নামছিল।দীপা নীচ থেকে কৃষ্ণাকে দেখতে পায়কৃষ্ণার পরনে রঙ্গীন শাড়ি।দীপা খুব অবাক হয়।

কৃষ্ণা আর রঞ্জনের বিয়ের পর একে একে সব ভাড়াটিয়া বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।দীপ্তরা ওই বাড়ি ছেড়ে বেশ কিছুদূর এসে অন্য বাসা ভাড়া নেয়।পাড়ায় বেশ কিছুদিন মুখরোচক আলোচনা চলে।তারপর ধীরে ধীরে সব আলোচনা ঝিমিয়ে যায়।রঞ্জন তার গ্রামের বাড়িতে বাবা-মাকে পাকা বাড়ি করে দেয়
দীপ্ত যখন পঞ্চম শ্রেণীতে ওঠে তখন লিটনরা ভারতে চলে যায়।ততদিনে অবশ্য লিটনদের আর একটি ভাই হয়েছে।লিটনরা রঞ্জনকে বাবা বলতো না।বলতো ড্যাডি।এর কিছুদিন পর দীপ্ত জানতে পারে ভারতে লিটনের ড্যাডি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে।