গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

বাবুল ডি নকরেক

একটি মিথ্যে গল্প

এক

শোভন আমার প্রিয় ছাত্রদের একজন। তাদের গ্রামের বাড়ি জামালপুরের স্বপ্নবাড়ি গ্রামে। সেখানে এত ভাল কলেজ থাকতে কেন বংশাই নদীর পাড়ের 'মধুপুর কলেজ'-এ পড়তে আসল, আমি ভেবেই পাই না। তার ছোট বোনও আমাদের কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। দু'জনেই অসম্ভব মেধাবী। কিন্তু এত এত বিনয়ী, নম্র, ভদ্র, সবকিছুতে এত এত পরিশীলিত এবং পরিমার্জিত যে বর্ণনা করা যায় না।
ওরা কলেজের পর সপ্তাহে ৩ দিন আমার বাসায় পড়তে আসে। তাদের বাবা একজন শিক্ষিত, সজ্জন, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। যেদিন থেকে জানি ওরা মুক্তিযোদ্ধার ছেলে-মেয়ে, সেদিন থেকে তাদের প্রাইভেট পড়ার টাকা নেই না। ওতে যেন আমিও তাদের পরিবারে একটা আলাদা মর্যাদার আসন পেলাম। তাদের বাবা-মাসহ পরিবারের সকলেই আমাকে স্যারবলে ডাকা শুরু করে দিলেন। সাথে ওদের গ্রামের ছোট বড় অনেকেই আমাকে অহেতুক 'স্যার' ডাকতে শুরু করে দিলেন।
আমি প্রতি মাসে স্বপ্নবাড়িতে যাই। সেখানে শোভন, শোভা আর একুশ'র বিনে পয়সার পাঠশালাতে ৩-ঘন্টা স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের বান-কি মুন, ড আতিউর রহমান, মাদার তেরেসা, আইন্সটাইন, টমাস আল্ভা এডিসনদের গল্প শোনাই। মাঝে মাঝে ইংরেজি পড়াই। চড়ুই পাখির গল্প, নো ফ্রি লাঞ্চ, জীবন দর্শন নিয়ে ছোট ছোট গল্প বলে তাদের উৎসাহিত করি।
আমি তাদের কলিন পাওয়েল এর ফিলোসফি শেখাই, "There are no secrets to success. It is the result of preparation, hard work, and learning from failure."
এভাবে এক সময় স্বপ্নবাড়ি'র উঠানের বিনে পয়সার পাঠশালাটা খুব আপন হয়ে উঠে, আপন হয়ে উঠে চারিপাশের মানুষ-জন।
একদিন শোভনের বাবাকে বললাম, “স্যার, আপনি যখন আমাকে স্যার ডাকেন, আমার খুব খারাপলাগে। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়!
- তাহলে কি ডাকব, স্যার?
-
আপনি 'মেঘ' বলে নাম ধরে ডাকেন। আর তুমিকরে বললে আরও খুশি হব।
-
না, না। তা হয় না। সম্মানী মানুষকে সম্মান দিতে হয়। ছোটরা তো আমাদের দেখেই শেখে! ছোটদের কাছে আমাকে এতটা বেয়াদব বানাবেন না, প্লিজ। তাহলে আমি বরং আপনাকে প্রফেসার সাহেববলি?
- না, না, স্যার! প্রফেসার অনেক বড় পদ। আমি প্রভাষক মাত্র।
-
তাহলে মাস্টার মশাইডাকি? তবুও তো ভাল শোনায় না!
-
আপনার যা খুশি ডাকুন স্যার । তবে স্যারডাকবেন না আমাকে, প্লিজ।
গল্পটির পাঠ শুনতে এখানে ক্লিক করুনঃ http://youtu.be/1_NG23SY2Ik?hd=1
[পাঠক রিয়েকশানঃ "আপনার গল্প প্রায় সবটাই পড়ার চেষ্টা করি। এটাও পড়লাম দাদা। আবেগের দলাটা গলা অব্দি ঘোরাঘুরি করছে। এমন সাবলীল উপস্থাপনা আপনার দ্বারাই সম্ভব। আপনার গল্প পড়ে আমি আমার বাবুল'দাকেই খুঁজে পাই, যে বাবুল'দার ছবিটা আমার মানসপটে আঁকা। ধর্ষিতা শালবনের বাবুল ডি নকরেককে। লেখায় আপনার আবেগ যে কাউকেই ছুঁয়ে যাবে। অনেক ধন্যবাদ দাদা, নিজের যাপিত জীবনের বিষয়গুলোকে কী চমৎকার ভাবে গল্পের ঢঙে বলে যান আপনি। যেখানে উজ্জীবিত হওয়ার মতন অনেক রসদই থাকে।
শালবন আপনাকে মিস করে 😍😍"
- জহির, প্রিন্সিপাল অফিসার, সোনালি ব্যাংক]

দুই

শোভন একদিন আমার কাছে খুব মন খারাপ করে এসেছে। কারণ জিজ্ঞেস করতেই সে খুব কান্না-কাটি করছে। সে যা বলল তার সার সংক্ষেপ হচ্ছে, কত কত জায়গায় জব ইন্টারভিউ দিচ্ছে, জব হচ্ছেই না। বাবার শরীর খুব খারাপ। আয় রোজগার একদম নেই। তার খুব খারাপ লাগে। মাঝে মাঝে নিজেকে শেষ করতে ইচ্ছে করে তার। একদিন রেল-লাইনে আত্মহত্যা করতে গিয়েও ফিরে আসে বাবা, মা, ভাই-বোনদের কথা ভেবে।
তার কথা শুনে আমি বললাম, আত্মহত্যা মহাপাপ। এটা করে বাবা-মা-ভাই-বোনকে সীমাহীন কষ্ট দিয়ে লাভ টা কী হবে? আত্মহত্যা করলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? জীবনে সংগ্রাম করে সাফল্য ছিনিয়ে আনতে হয়। তোমাকে আরও পরিশ্রম করতে হবে। ছোট ক্লাশে পড় নি একবার না পারিলে দেখ শতবার’? মনে রাখবে, পৃথিবীতে যারাই সফল হয়েছেন, বড় মানুষ, ভাল মানুষ হয়েছেন, তাঁরা সবাই অসংখ্যবার ব্যর্থ হয়ে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েই সফল হয়েছেন। তুমিও তোমার ভুল থেকে শিক্ষা নাও। হতাশ না হয়ে কি জন্য চাকুরী হচ্ছে না, তোমার মধ্যে কী নেই যা চাকুরী দাতারা চায়, সেগুলো খুঁজে বের কর এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নাও।
- জী স্যার, আমি তাই করব। কিন্তু আমার খুব শীঘ্র একটা কিছু দরকার। খুব।
-
তুমি মাত্র ব্যাচেলর ডিগ্রী শেষ করলে। এখনই হতাশ হওয়ার কিছু নেই। Arthur Ashe বলেছেন, ‘Success is a journey not a destination’ তোমাকে একটু একটু করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
ফুটবলের রাজা পেলে'র একটা ইন্টারভ্যু দেখছিলাম। তিনি বলছিলেন, "Success is no accident. It is hard work, perseverance, learning, studying, sacrifice and most of all, love of what you are doing or learning to do."
যা বলতে চাইছি তা হল, হুট করে তোমার জব হয়ে যাবে না। তার জন্য তোমার কঠোর পরিশ্রম, অধ্যাবসায়, অনবরত শিখে যাওয়া, বিস্তর পড়াশোনা করা, ত্যাগ এবং যা করতে চাইছ তা ভালোবাসা দিয়ে প্রতিদিন করে যেতে হবে। নিজের মধ্যে নিজের দায়িত্বের প্রতি আস্থা তৈরী করতে হবে। যে কাজ তুমি খুঁজছ, তার জন্য তোমাকে নিজেকে যোগ্য করে তৈরী করতে হবে। দেখবে, তখন তোমাকে আর কাজ খুজতে হবে না, কাজই তোমাকে খুঁজে নিবে একদিন।
-জী স্যার, আমি তাই করব। দোয়া করবেন স্যার।
শোন, এবার তোমার লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার পর আমাকে বলবা। আমি দেখি কোন মন্ত্রীকে অনুরোধ করে দেখব তোমার জন্য। আমি কখনও কোন মন্ত্রীর কাছে কিছু চাই নি। তোমার জন্য চাইব!
[পাঠক রিয়েকশানঃ স্যার, আপনার গল্পটা পড়লাম হৃদয় ছুয়ে গেছে। আসলে আমরা অভাগা জাতি মানুষের সত্যিকারের মূল্য দিতে জানি না । তাইতো আজ আপনি দূর দেশে পড়ে আছেন । আপনাদের মতো হিরোদের আমাদের মতো শোভনদের অনেক দরকার ছিলো স্যার । আপনারা যদি দেশে না থাকেন তবে আমাদের মতো শোভনরাতো রেল লাইনে মাথা দিবেই । তাদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্বতো আপনাদের মতো হিরোদের নিতে হবে। স্যার আমার জন্য দোয়া করবেন ।
হাসান, পুলিশ কর্মকর্তা , হেড কোয়ার্টার, বাংলাদেশ পুলিশ ]

তিন

অনেক ভেবে চিনতে একদিন আমাদের মন্ত্রী মহোদয়ের মিন্টু রোডের সরকারী বাস ভবনে গেলাম। পা ছুঁয়ে সালাম করে বললাম, নিজের জন্য চাইছি না স্যার। আমার প্রিয় একজন ছাত্রের জন্য চাইছি। খুব ভাল ছেলে। ছাত্রও খারাপ নয়! রিটেন পরীক্ষা দিয়েছে। একটু যদি দয়া করতেন স্যার। তার বাবার খুব অসুখ। আহত মুক্তিযোদ্ধাও বটে!
মন্ত্রী বাহাদুর বললেন, আমি অবশ্যই দেখব। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। আমি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা! আমি যদি ছেলেটার জন্য কিছু করতে পারি আমার খুব ভালোলাগবে। একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য কিছু করতে পারলে খুশি হব।
তারপর মন্ত্রি মশাই যা বললেন আমি তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি বললেন, “তুমি একটা পাগল ছেলে। তুমি নিজে গ্রামে পড়ে আছ কেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স, মাস্টার্স করে কেউ মধুপুরের শালবনে পড়ে থাকে? নিজের ভালোটাও বুঝো না? তুমি বিসিএস দাও। আমি একটা ব্যবস্থা করে দিই। কী? বিসিএস দিবা?
- না স্যার। আমি গ্রামে ফিরে গেছি, গ্রামেই থাকতে চাই।
-
কী? শালবন খুব পছন্দ?
-
জি, স্যার।
-
তোমার ধর্ষিতা শালবনবইটা পড়েছি! একটু এগজাজারেশান করেছ মনে হয়...
-
না স্যার, যা সত্যি মনে হয়েছে, তাই লিখেছি ...
-
ভালো লিখো ত তুমি! আমি তোমার লেখা গানগুলোও শুনেছি। খুব সুন্দর। ডিফরেন্ট! আমার মেয়ে আর তার মা তো তোমার বড় ফ্যান। তারা তাদের মোবাইলেও তোমার গানের রিং টোন সেট করে রেখেছে। আর তোমার লেখা প্রথম আলোতে ছোট গল্পগুলো তারা খুঁজে খুঁজে পড়ে। আমি তোমার ছোট গল্পগুলো তাদের কাছেই শুনি।
- বলেন কি স্যার! জেনে খুশি হলাম। তাঁদেরকে আমার শুভেচ্ছা জানাবেন।
-
তা জানাব। আমি বলি কি, সব বাদ দিয়ে বিসিএস দাও! আমাদের ট্যালেন্ট অফিসার আরও দরকার। সবুজ বন পছন্দ? বান্দরবান পোস্টিং দিয়ে দিব নি। গভীর বন জঙ্গলের কোন এক গ্রামে ...
- ধন্যবাদ স্যার। আমি মধুপুর শাল-অরণ্য ছেড়ে আর কোথাও যাব না। আমি গ্রামের ছেলে, গ্রামে ফিরে গিয়েছি। আমৃত্যু সেখানেই থাকতে চাই!

চার

ছেলেটির জব হয়ে গেল। স্যাকেন্ড ক্লাশ জব যদিও, সরকারী জব তো! তার ছোট বোন তো বেশ কয়েকবার ফোন করে থ্যাংক ইউ স্যারবলেই যাচ্ছে। ওর মাও ফোন করে বেশ কয়েকবার বলল, “স্যার, আপনি আমাদের যা উপকার করেছেন সেটা আল্লাহর ফেরেস্তার কাজ করেছেন!
নিজেকে হিরো হিরো লাগছে। কী অসাধ্য সাধন করে ফেলেছি এমন অনুভূতি! ২৫-২৬ বছরের টগবগে যুবক তখন আমি। মনে হচ্ছে এমন পূণ্যের কাজ এর আগে করিই নি! হৃদয়-মন যেন ময়ূরের মত নেচে চলেছে বিরতিহীন বেশ কিছুদিন ধরে। কী আনন্দ আকাশে বাতাসেঅনুভূতি...

পাঁচ

একদিন আমার গ্রামের বাড়ি গাছাবাড়ি'তে শোভন এর বাবা এলেন। বিধ্বস্ত চেহারা। চোখে মুখে যেন রাজ্যের হতাশা!
আমি বললাম, স্যার, আপনার শরীর কী খুব খারাপ? [মুক্তিযোদ্ধাদের আমি স্যার সম্বোধন করি!]
- না, মেঘ স্যার। স্যার, আমি খুব গরীব মানুষ! আমাকে একটু দয়া করেন স্যার।
-
ছিঃ ছিঃ কী বলছেন স্যার। বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি?
-
যে দেড় লক্ষ টাকা দিয়েছি, তা জমি বেঁচে দিয়েছি। আমার শুধু বাড়ি ভিটেটাই আছে স্যার। জমি-জমা যা ছিল সব বিক্রি করে ছেলে-মেয়েদের পড়িয়েছি। আমার আর কোন জমি নেই! একটু দয়া করেন, আমি আর কোন টাকা দিতে পারব না স্যার ...
- টাকা দিয়েছেন! কাকে?
-
আপনাকে! পান নি?
-
আপনি আমাকে টাকা দিয়েছেন! আমাকে?
-
আমার ছেলে দিয়েছে, দেয় নি?
-
আপনার ছেলে কোথায়?
-
২৫ মাইল ...
-
ডাকেন, তারে ডাকেন। ফোন আছে তার কাছে?
-
জি, আছে।
-
এই নেন ফোন। ফোন করেন ...
শোভন এলে আমি তাকে বললাম, তুমি না কি আমাকে টাকা দিয়েছ! তুমিও শেষ পর্যন্ত ...
সে মাথা নিচু করে রইল...
তার বাবা স্যান্ডেল খুলে এপাশ ওপাশ দুই গালে মারতে মারতে হাউ মাউ করে কেঁদে বললেন, “তুই একটা অমানুষ! নিজের বাবাকে ফাঁকি দিস! কিন্তু এই যে মানুষ টা যে তোকে শিখিয়ে পড়িয়ে মানুষ করলেন, জীবনের পথ দেখালেন, তাকে ক্যান ছোট করিস? ক্যান ছোট করিস? কুত্তার বাচ্চা! তুই মানুষ হবি না কোনদিন! আমি তোকে অভিশাপ ...
আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললাম, স্যার, ও ছেলে মানুষ, ওকে অভিশাপ দিবেন না প্লিজ ...
ছয়

আমি কী বলব, ভেবে কিনারা করতে পারলাম না। সারারাত এপাশ ওপাশ করি। ঘুম আসে না! ভাবি, কী সাংঘাতিক মানুষের জীবন! সারারাত চুপচাপ চোখ মুছি। খুব কষ্ট লাগছে, অসহ্য সে কষ্ট! প্রিয় ছাত্র, তাকেও বিশ্বাস করতে পারব না? উহ! ভাবছি, অধ্যাপনা ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাব। দূরে কোথাও। আমার হয় তো বান্দরবনই চলে যাওয়া উচিত! মানুষকে বিশ্বাস করা ঠিক না। মানুষ বেঈমান! মানুষ বেঈমান!
আবার ভাবি, বান্দরবনেও তো মানুষ থাকে। আমাকে যেতে হবে যেখানে মানুষ নেই ...
এপাশ ওপাশ করে ভোর হয়ে গেল! খুব মন খারাপ। ভয়াবহ মন খারাপ। কাকে বলি এই ভয়ংকর কষ্টের কথা? কাকে বলি? রঞ্জিত রুগা, হ্যা, রুগা রঞ্জিত মৃঃ আমার মসা১, তাকেই বলি! তাকেই সব দুঃখ - কষ্ট হাসতে হাসতে বলা যায়। রঞ্জিত রুগা এমন একজন মানুষের নাম, যে সবখানে পজিটিভ খুঁজে পান! কাউকে খারাপ বললে, বলবেন কেউ খারাপ না! ভালো - মন্দ মিলিয়ে মানুষ!
ফোন দেই, মসা মন খুব খারাপ! তাই আপনারে ফোন দিলাম।
-
আরে মিয়া, গ্রামে ফিরে গেছ, গ্রামের মানুষের কাছে; মধুপুর বনে থাকবা, মামলা খাবা, ইকোপার্ক নিয়ে লড়াই - সংগ্রাম করবা আর সুখ উপছে পড়ব? চালায়া যাও মসা। ফিরে যখন গেছ, মন খারাপ হোক আর না হোক চালায়া যাও। মন থাকলে খারাপ তো করবেই। ঐটা কিছু না। চালায়া যাও। সত্যি মন খারাপ না কি? সিরিয়াস কিছু?
-
না, মসা ...
-
কী হইসে? কও ...
-
কিসসু হয় নাই। হাহাহা...
-
বললা যে মন খারাপ!
-
না না। আমার মন ভাল। ভয়াবহ রকমের ভাল। মস্করা করলাম একটু। ভালই লাগছে গ্রাম, গ্রামের মানুষ, সবুজ সবুজ বন - বনানী, বংশাই নদী, কলেজ, মধুপুর, মধুপুরের মানুষ। কোন প্রব্লেম নাই! সুখে আছি, প্রশান্তিতে ছেয়ে আছে মন। খুব ভাল আছি মসা; একদিন বেড়ায়া যান?
ফোন ছেড়ে দিয়ে ভাবি, জীবনে প্রথম কারোর জন্য কোন মন্ত্রীর পা ধরেছিলাম! প্রথম মাথা নত করে ভিক্ষে চেয়েছিলাম! ভাবলাম, কান ধরেছি এই। জীবনে কোনদিন কারোর ভাল করব না।
কলেজে যাই নি আর। ফোন করে প্রিন্সিপাল স্যারকে বলেছি, খুব জ্বর!

সাত
পরের দিন সকালে ছেলে টি তার ছোট বোন শোভাকে নিয়ে এল। আমি ওকে দেখেই ক্ষেপে গেলাম! বললাম, গেট আউট, আই সে গেট আউট!
-
আমার জাস্ট একটা কথা শুনবেন প্লিজ স্যার, জাস্ট একটা ...
-
ইউ শাটাপ! জাস্ট কীপ ইউর মাউথ শাট এন্ড গেট আউট ...
ছেলেটি ঝাঁপিয়ে পড়ে পা ধরে বলল, স্যার বাবার চিকিতসার জন্যই টাকা টা খরচ করা হয়েছিল। আপনার কথা না বললে, বাবা জমিটা বিক্রি করত না। জমিটা বিক্রি করেই চিকিৎসা করিয়েছি। ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসা বিল এসেছে প্রায় ৫ লক্ষ টাকা যার পুরোটাই সুদে ঋণ নেওয়া। মিথ্যে গল্প টা না বললে বাবাকে বাঁচানো যেতো না! স্যার, আমার ক্ষমা অযোগ্য অন্যায় হয়েছে। আপনি আমাকে মেরে ফেলেন স্যার!
আমি কিছু বলার আগেই শোভা আমার পা ধরে হু হু করে কাঁদতে শুরু করল। আমি বললাম, “তোমার আবার কান্নার কি ঘটল?”
-
স্যার, আমিই এই মিথ্যে গল্পটার আইডিয়া দিয়েছিলাম ভাইয়াকে! আপনি আমাকেও মেরে ফেলেন, স্যার।
আমি এবার তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, বাবাকে বাঁচানোর জন্য যদি ঐ মিথ্যে কথা সত্যি সত্যি বলে থাকো, তোমরা সারাজীবন এমন মিথ্যে বইল ...
কে দেখে আমাদের এই তিন ছোট মানুষের কান্না? এই কান্না কীসের বুঝতে পারি না। আমি শোভনকে বললাম, “ছেলে মানুষদের কাঁদতে নেই!
শোভন আর শোভার কান্নার যে সাত রঙ, সে রঙের তীব্রতা বাড়ে ...
এই শোভন আর তার বোন শোভা কী ভিলেন?
আমি ভাবি আর ভাবি ...
নাহ! একটা মিথ্যে গল্প বললে যদি দেশ ও জাতির একজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে বাঁচানো যায়, সে মিথ্যে গল্পের মূল্য অনেক...