ধারাবাহিক
হ্যান্টেড কাহিনী--৪৪
পালচৌধুরীদের
জমিদারী জীবনযাত্রার এক ঘটনা নিয়েই ডাক্তার নীহাররঞ্জন গুপ্ত তাঁর নূপুর বই
লিখেছিলেন। সে ছিল এক নাচঘরের কথা। জমিদার বাড়ির আমোদ-প্রমোদের বেশীর ভাগটাই চলত বাঈজীদের নাচগান নিয়ে। সে সময়
বাঈজীদের ভাড়া করে নিয়ে আসা হত। অনেক সময় বাঈজীর বদলে ভাল ঘরের সুন্দরী মেয়েদের
জোর করে নিয়ে আসা হত। সে সব মেয়েরা ভাল নাচতে পারত না। তা ছাড়া ভাল ঘরের মেয়েরা
বাঈজীদের মত নাচতে চাইতও না। সে সব মেয়েদের মর্যাদা হানীর ভয়-সঙ্কোচ
তো থাকতই। তবু জোর পূর্বক জমিদাররা
তাদের নাচাতে বাধ্য করত। এমনি এক মেয়ের কথা নূপুর বইতে লেখক বর্ণনা করে গেছেন।
মেয়েটিকে জোর করে জমিদারের নাচমহলে তুলে নিয়ে আসা হয়েছিল। তার পায়ে পরিয়ে
দেওয়া হয়েছিল নাচের ঘুঙ্গুর।
মদ্যপ
জমিদার তাকে নাচতে আদেশ দিলো। নিজের আত্মসম্মান তখনও ভুলতে পারেনি মেয়েটি। সে চুপ
করে নাচের গোলঘরে দাঁড়িয়ে ছিল। জমিদারের সাগরেদরাও তখন নেশায় টং হয়ে নাচের আনন্দ
নেবে বলে অধীর আগ্রহে ছটফট করে যাচ্ছিলো। না, মেয়েটি তখনও মাথা নিচু করে চুপ
হয়ে বসেছিল। জমিদার তখন মেয়েটিকে বলে উঠল, বাঁচতে চাস তো নাচ বলছি--না হলে
তোর আজই শেষ দিন হবে !
শেষ
পর্যন্ত মেয়েটা নাচতে গেলো না। জমিদার রেগে মেগে বন্দুক উঠিয়ে গুলি চালিয়ে দিলো
মেয়েটির ওপর। মেয়েটির মৃত্যু হল। জমিদার
তার লোকজন দিয়ে তার জমিদারী বাড়ির শেষ
সীমানার দেওয়ালের পাশে মেয়েটিকে পুঁতে দিল আর সে জাগায় লাগিয়ে দেওয়া হল এক স্বর্ণ
চাঁপার গাছ। এমনি অনেক অত্যাচার সেই জমিদার বাড়িতে চলত। বেশকিছু স্বর্ণচাঁপার গাছ
ছিল জমিদারদের উদ্যানে। লোকে বলে জমিদারদের অত্যাচারের ফলে যে মেয়েরা মৃত্যু বরণ
করত তাদের মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে তার ওপরে লাগিয়ে দেওয়া হত স্বর্ণচাঁপার গাছ।
জমিদারীতে কারণে-অকারণে অনেক লোককে মেরে ফেলা হত। এমন কি শাস্তির জন্যে জমিদার বাড়িতে ছিল বিশেষ
ব্যবস্থা। ছিল ফাঁসি ঘর, সুড়ঙ্গ ঘর, নানা ভাবে যন্ত্রণা দেবার ব্যবস্থাও রাখা ছিল। অপরাধীদের ফাঁসির শাস্তিও হত।
মৃত্যুদণ্ড দেবার পর মৃতদেহগুলোকে সুড়ঙ্গ ঘরের সুরঙ্গে ফেলে দেওয়া হত। সেই
সুড়ঙ্গের সঙ্গে যোগ ছিল কিছুটা দূরত্বে থাকা চূর্ণী নদীর। এক সময় সে মৃত দেহগুলি
সুড়ঙ্গ দিয়ে গিয়ে নদীতে পড়ত। আর নদীর বহমান জলে দূরে ভেসে যেত। এমনি দীর্ঘ এক
কলঙ্কময় ইতিহাস ধরে রেখে ছিল এই পালচৌধরী জমিদাররা। এ সব অপঘাত মৃত্যুর ফলেই নাকি
পরবর্তী কালে এই জমিদার বাড়িতে অনেক অলৌকিক ঘটনার সৃষ্টি হয়েছিল। তার মধ্যে সেই
নাচের মেয়েটার ঘটনা নূপুর বইতে লেখা আছে। এই মেয়েটাকে মেরে মিটিতে পুঁতে ফেলার পর
থেকেই নাকি সেই দেওয়াল ঘেরা বাগান ও তার
আশপাশ থেকে গভীর রাতে ভেসে আসত নূপুরের রুমঝুম আওয়াজ।মনে হত কেউ যেন নূপুর
পরে নেচে বেড়াচ্ছে। জমিদার বাড়ির
অনেকেই এ নূপুরের শব্দ শুনেছে। ভয়ে তারা রাতে সেই প্রাচীর ঘেরা বাগানের দিকে কেউ
যেত না। এ সব ঘটনা জানার পর থেকেই একদিন
শশীভূষণ যথারীতি তাঁর বন্ধু জনান্তিক ও অর্ণবকে নিয়ে সেখানে যাবার দিন স্থির করে
ছিলেন।
শশীভূষণ
অকৃতদার। অর্ণব বিপত্নীক আর জনান্তিকের স্ত্রী আছেন কিন্তু ছেলেপুলে না হওয়ায়
সংসার নিয়ে তিনি তত জড়িয়ে পড়েননি। কাজেই একমাত্র তাঁদের দ্বারাই সম্ভব এ ধরনের
মিস্টিরিয়াস ঘটনার পেছনে ছুটে ফেরা। ওঁদের নিজস্ব পেশা থাকা সত্ত্বেও নেশা হিসাবে
এই কাজটা তাঁরা মাঝে মাঝেই চালিয়ে যান।
রানাঘাটের
অলক রায় শশীভূষণের ছোটবেলার বন্ধু। তার সঙ্গে মাঝে মধ্যে ফোনে কথার আদান-প্রদান
হয় শশীভূষণের। তিনি ভেবে নিয়ে ছিলেন যদি অলৌকিকতা নিয়ে চৌধুরী বাড়ির জমিদারির পড়ো দালান-কোঠাগুলো একবার ঘুরে আসা যায়--
ঘুরে আসা
যায় সেখানকার বাগান ও চাঁপাগাছ তলা।
ফোনে
একবারেই অলককে পাওয়া গেল। সেখানে বন্ধুদের নিয়ে শশীভূষণ যেতে চান শুনে অলক
আনন্দিত হলেন।তার কথাবার্তায় সামান্য উত্তেজনা প্রকাশ পাচ্ছিল। অলক জানিয়ে ছিলেন
যে তিনিও বন্ধুদের সঙ্গে রাতে পাল চৌধুরী বাড়ির ভেতরে ঘুরে আসতে চান। ভয় ও
রোমাঞ্চ অনেকেই ভালবাসে। এ ভাবেই ঠিক হল শশীভূষণ ও তার তিন বন্ধু মিলে রাতের
অভিযানে বেরোবেন পালচৌধুরী বাড়ির পরিত্যক্ত সেই জমিদারি বাড়িতে। অলকের মুখেও
শশীভূষণ শুনেছেন, পালচৌধুরী বাড়ির অলৌকিক কিছু ঘটনার কথা।
কলকাতার
কিছু ভৌতিক ঘটনার পেছনে অনেক ছোটাছুটির পর অনেক মানসিক বিশ্লেষণের পর শশীভূষণের
মনে পড়ে গিয়েছিল রানাঘাটের পালচৌধুরী বাড়ির কথা। যাই হোক, একটা দিন
নির্ধারিত হয়ে গেল। শশীভূষণ রানাঘাটের পালচৌধুরী জমিদার বাড়ির ঘটনাগুলি জানার পর
থেকেই সেখানে যাবার পরিকল্পনার কথা ভাব ছিলেন।রাত নটায় গাড়ি ছিল। শিয়ালদা থেকে
রানাঘাট। রানাঘাট পৌঁছাতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেগে গেলো। জনান্তিক, শশীভূষণ ও
অর্ণব মিলে রানাঘাট এসে পৌঁছলেন। তখন রাত এগারোটা কাছাকাছি হয়ে গেছে। পালচৌধুরী
জমিদার বাড়ির শেষ সীমার উঁচু মোটা
প্রাচীরের বাইরে দিয়ে একটা রাস্তা চলে
গেছে। রাস্তার অন্য পার দিয়ে শুরু হয়েছে ঘটকপাড়া। এই ঘটক পাড়াতেই অলক সপরিবারে
থাকেন। শশীভূষণ ও তাঁর বন্ধুরা অলকের বাড়িতে পৌঁছে দেখলেন, অলোক
মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। এত সময় ধৈর্য ধরে অলক বন্ধুদের আগমনের
প্রতীক্ষাই করছিলেন। অলোক বললেন, তোরা সবাই
খেয়ে এসেছিস তো ? নাকি অল্প কিছু খেয়ে নিবি ?
--না না, এখন সময়
নেই, তা ছাড়া আমরা ঘর থেকে খেয়ে বেরিয়েছি, শশীভূষণ বললেন।
জমিদার
বাড়ির সীমানার প্রাচীর অনেক জায়গায় ধ্বসে গেছে। চাইলে বাইরের লোকজন অনায়াসে
ভেতরে প্রবেশ করতে পারে তবুও অলক বলল, না না, এ সব দিক
দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করাটা ঠিক হবে না। একে তো পথঘাট নেই, তার ওপর
জঙ্গলে ভরা, সাপ খোপের ভয় আছে। তার চেয়ে সদর গেট দিয়ে প্রবেশ করাটাই ভালো হবে।
কাল
বিলম্ব না করে ওরা হেঁটে চললেন জমিদার বাড়ির দিকে। ভাঙাচোরা সে সব ইমারতের কিছু
কিছু ঘর ভেঙে পড়ে গেছে, আবার ভেতর দিকের বেশ কিছু ঘর তখনও শক্তপোক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। জমিদার বাড়ির
প্রধান গেট এখনো দাঁড়িয়ে আছে বটে, কিন্তু তা দরজার পাট ছাড়া
অবারিত দ্বার। ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত সেই জমিদার বাড়ির ভেতরে শশীভূষণ, জনান্তিক, অলক ও
অর্ণব উপস্থিত হল। ওঁরা মাঝে মাঝে নিজেদের মোবাইলের টর্চ জ্বেলে নিচ্ছিলেন।
জায়গাটা প্রচণ্ড অন্ধকার, ঘন কালো অন্ধকার। ওরা দেখলেন, একপাশে এক কোন দিয়ে একটা সিঁড়ি উপরের দিকে উঠে গেছে।
জনান্তিক
বললেন, চল না ঐ সিঁড়ি ধরে আমরা উপরে উঠে দেখি।
শশীভূষণ
একবার কিছু একটা ভেবে নিলেন, তারপর বললেন, না চল সোজা ওই যে সামনের ভাঙ্গা ঘরটা, ওটাতে একবার গিয়ে দেখি।
অর্ণব
এতক্ষণ একেবারেই চুপচাপ ছিলেন। এবার যেন তিনি সক্রিয় হয়ে উঠলেন। তাঁর এই দোষ, হঠাৎ হঠাৎ
তিনি সাহসী হয়ে পড়েন। আবার হঠাৎই ভয় বিহ্বল হয়ে পড়েন। অর্ণব বলে উঠলেন, আজ আমার
একদম ভয় নেই--চল সিঁড়ি দিয়েই যাই--আজ ভালো
করে দেখে নিই ওপরের সব ঘরগুলিতে কি রহস্য লুকিয়ে আছে ! জনান্তিক একবার অর্ণবের ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, সাবাস, এমনি
সাহসী লোকেরই তো এই অভিযানে আমাদের বেশি দরকার !
অর্ণব
জনান্তিকের কথাটার সঠিক অর্থ বুঝে উঠতে পারলেন না। ওঁর মনে হল, এই কথার
মধ্যে ব্যঙ্গ থাকলেও থাকতে পারে। একটা ঘরের মধ্যে ওঁরা প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ একটা শব্দ হল, তারপর
একটা বড় পাখি যেন তাদের প্রায় মাথা ঘেঁষে বাইরে বেরিয়ে গেল। অর্ণব চীৎকার দিয়ে
উঠলেন, ভুত, ভুত--
শশীভূষণ
তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ওটা তো একটা বাদুড় হবে রে--ভয়ের কিছু নেই--
বন্ধুরা
এবার আরও এগিয়ে গেলেন। ভাঙ্গা ঘরের দরজা ছাড়িয়ে আরও একটা ঘর তারপর আরও আরও--কোনটারই
দরজা-জানালার পাট নেই। আশপাশের লোকেরা হয়ত নিজেদের কাজে তা খুলে
নিয়ে গেছে। আরও দুটো ঘর পেরিয়ে এগিয়ে গেলেন ওঁরা। মোবাইলের আলো মাঝে মাঝে
জ্বালাতে হচ্ছিল। ওঁরা দেখলেন, সামনে
আবার একটা সিঁড়ি। সিঁড়িটা অনেক সংকীর্ণ। তার উঁচু উঁচু ধাপ চলে গেছে উপরে।
শশীভূষণের কি যেন মনে হল, তিনি বললেন, চল এবার আমরা এই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দেখি।
অর্ণব যেন
এবার তার সমস্ত সাহস হঠাৎ করেই হারিয়ে ফেললেন, বললেন, না না, এত
অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে উঠে গেছে সিঁড়ি, নিশ্চয়ই আমাদের জন্যে কোন বিপদ
ওখানে অপেক্ষা করছে।
অর্ণবের
কথা কেউ কানে নিলেন না--ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে সবাই ওপরে উঠতে লাগলেন। একলাগা টর্চ জ্বেলে রাখতে হল।
অর্ণব প্রত্যেক বারের মত বন্ধুদের মাঝখানে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। ভয়ে ভয়ে
তিনিও এক পা এক পা করে সিঁড়ির ধাপ এগোচ্ছেন। এক তালা নাকি দোতালা ? মোবাইলের
অস্পষ্ট আলোয় তা বোঝা যাচ্ছিল না। ওঁদের নাকে এসে ঠেকছিল ভাপসা পচা একটা গন্ধ।
কিসের হতে পারে ? জনান্তিক সাহসী, তিনি বললেন, হবে কোন পাখি মরে পড়ে আছে, তারই গন্ধ।
অর্ণব
তাড়াতাড়ি ফিসফিসিয়ে চাপাস্বরে বলে উঠলেন, না না, এটা
অলৌকিক কোন ব্যাপার হবে !
এবার অলক
তাঁর নীরবতা ভঙ্গ করে অর্ণবের পিঠে হাত রেখে বলে উঠলেন, হাঁ, তা হতেই
পারে--
অর্ণব আরও
ভয় পেয়ে গেলেন, তাঁর মুখ দিয়ে শব্দ বেরিয়ে এলো, ওরে বাবা ! অলোক আবার বলে উঠলেন, শুনেছি জমিদাররা অপরাধীদের শাস্তির জন্য এ দিকেই কোথাও ফাঁসি ঘর, সুরঙ্গ ঘর
বানিয়ে রেখেছিল।
শশীভূষণ
বললেন, আমি চাচ্ছি, সেই ঘরগুলি খুঁজে বের করতে। ওঁরা সাবধানে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, পচা
গন্ধটা যেন আরও কাছে এসে যাচ্ছে। পাশে একটা ছোট্ট ঘর ওঁদের চোখে পড়ল।
জনান্তিক
বললেন, চল আমরা এই ঘরের ভেতরটা একবার দেখে নি--
শশীভূষণ
বললেন, হ্যাঁ হতে পারে এটাই সুরঙ্গ ঘর।
অর্ণবের
মুখ দিয়ে আবার ভয়ের শব্দ বেরিয়ে এলো। এই ভয়ের মুহূর্তগুলিতে তাঁর মুখ দিয়ে খুব
বেশি কথা বেরোয় না, আর বেরোলে বিহ্বল উচ্ছলতার মধ্যে সাহসীদের মত অনেক কিছুই বেসামাল কথা বেরিয়ে
আসে। না ঘরটা খালি, কোন কিছুই ঘরের মধ্যে চোখে পড়ল না। তবে এই ঘরটার ভেতর দিয়ে দু-দিকে
আরও ঘর রয়েছে। সে ঘরগুলির দুই প্রবেশ দরজা পাটহীন হাঁ করা খোলা। ওঁরা এক
পাশের দরজা দিয়ে অন্য একটা ঘরে প্রবেশ করলেন। মনে হচ্ছিল যেন ঘুলঘুলির মত জাগাটা--এক দিক থেকে অন্য দিকে গেলে হয়ত হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। শশীভূষণ কিছুটা ভয়
পেলেন। এই গভীর রাতে তাঁরা যদি আর বাইরে
বেরোতে না পারেন ! তবু একটা দুটো ঘর ওঁরা দেখে যাবেন বলেই স্থির করলেন। অলোক মুখ খুললেন, হতে পারে আশেপাশের কোন ঘর ফাঁসি ঘর আর সুরঙ্গ ঘর হবে।
প্রায়
আরও একটা ঘণ্টা ওরা এদিক ওদিক, এ ঘর, ও ঘর করেও সেই সুরঙ্গ ঘর আর ফাঁসি ঘরের হদিশ পেলেন না। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক
সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। ঘরগুলির মধ্যে কিছু খুটখাট শব্দ, পাখির
পাখা ঝাপটানোর শব্দ ছাড়া আর কিছুই তাদের কানে বাধল না। তাই ওরা ধীরে ধীরে ফিরে
আসছিলেন। তেমনি মোবাইলের আলো জ্বেলে জ্বেলে এক ঘরের ভেতর দিয়ে আরেক ঘর পার করে
করে এক সময় সেই প্রধান প্রবেশ গেটের সামনে এসে ওঁরা দাঁড়ালেন।
জনান্তিক
বলে উঠলেন, এভাবে আজকের দিনটা নিষ্ফলা যাবে ভাবতে পারিনি--
অর্ণব
বললেন, আমার মনে হয়, এই নিচের সিঁড়ি দিয়ে গেলেই ভাল হত--
শশীভূষণ
এবার সবাইকে থামিয়ে দিলেন, বললেন, এই চুপ, চুপ ! কান পেতে তিনি
শুনবার চেষ্টা করতে লাগলেন। সবাই চুপ করে দাঁড়ালেন। শশীভূষণ আবার বললেন, তোরা
শুনতে পারছিস ?
অর্ণব
কাঁপা গলায় বললেন, কি ? কি ?
শশীভূষণ
চাপা স্বরে বললেন, কেমন ঝুম ঝুম একটা শব্দ !
সবাই যেন
এবার সজাগ হয়ে উঠলেন। জনান্তিক ও অলক এক সঙ্গে বলে উঠলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ--
অর্ণব
এবার বন্ধুদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন, খুব নিচু গলায় বললেন, আরে সেই
মেয়েটা নয় তো রে ! সেই যার ওপর চাঁপা গাছ লাগানো হয়ে ছিল?
ভয়ের গলা
নিয়ে অর্ণব নিজের কথা আর শেষ করতে পারলেন না। নূপুরের ধ্বনি যেন আগে থেকে আরও বেশী
সরব হয়ে উঠেছে। তবে সে ধ্বনি কখনও বাড়ছে আবার কখনও কমে যাচ্ছে। কোথা থেকে আসছে যা
বোঝা যাচ্ছিলো না। ওঁরা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে খানিক দাঁড়িয়ে থাকলেন। মাঝ রাতের মরা
চাঁদের আলোয় সব কিছু অস্পষ্ট ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছিল। তবু অলৌকিক দালানকোঠাগুলি
দৃশ্যমান। অন্ধকার যেন এর চে ভাল ছিল, এতটা রহস্যময় ছিল না। মনে হচ্ছিল
এক অলৌকিক স্বপ্ন পুরীতে ওঁরা দাঁড়িয়ে আছেন। যখন তখন হঠাৎই কোন অলৌকিক ঘটনা
ওঁদের সামনে ঘটে যেতে পারে। আর ওঁরা যেন
সে অপেক্ষাতেই মুহূর্ত গুনছিলেন।
হঠাৎ ওঁরা
চমকে উঠলেন। প্রবেশ দ্বারের পাশের কোনার সিঁড়িতে ধুপধাপ পায়ের শব্দ হতে লাগল। মনে হল
একজন না, কয়েক জন বুট পরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। স্তব্ধতা ভেঙে শশীভূষণ ফিসফিসিয়ে বলে
উঠলেন, চল চল, আমরা আড়ালে গিয়ে দাঁড়াই!
ও দিকে
জুতোর শব্দগুলি আরও কাছে এসে পড়েছে। শশীভুষণরা চট করে এক পাশে আড়ালে দিয়ে
দাঁড়ালেন। হ্যাঁ, তিনটে কালো ছায়া, ছায়া না বাস্তব তা বোঝা যাচ্ছিল না। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে ছায়ামূর্তিগুলি ওদের
পাশের গেটের দিকে হেঁটে যাচ্ছে…
এসব দেখে
অর্ণব ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ভূত, ভূ….
জনান্তিক
তার মুখ চেপে ধরলেন। অন্য দিকে ছায়া মূর্তিরা অর্ণবের মুখের শব্দ পেয়ে থমকে
দাঁড়াল। তারপর এক ছায়ামূর্তি কথা বলে উঠল, কে ? কে ওখানে ?
অর্ণব ও
বন্ধুরা কেউ কথা বললেন না। ছায়ামূর্তিরা এবার বন্ধুদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো--তাদের
জোরালো টর্চের আলো এসে বন্ধুদের চোখে পড়লো।
এবার
অর্ণবের মুখ থেকে গোঁ গোঁ আওয়াজ বের হতে লাগলো। বোঝা যাচ্ছে, প্রতিবারের
মত এবার ভয়ে জ্ঞান হারাবে অর্ণব। তাই হল, অর্ণব জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গেল।
এদিকে তত
সময়ে তিনটে ছায়ামূর্তি ওঁদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
--কে তোমরা? ছায়া
মূর্তির একজন কর্কশ স্বরে বলে উঠল।
--আমরা চোর ডাকাত নই--শশীভূষণ
বলে ওঠেন।
--তবে তোমরা এত রাতে এখানে! আর একটা
ছায়া মূর্তি বলে উঠলো।
লাইট বন্ধ
করো প্লীজ--জনান্তিক বিনয়ের সঙ্গে বলে উঠলেন।
এটুকু
বোঝা যাচ্ছিল যে ওঁদের সামনের তিন ছায়ামূর্তি আর যাই হোক না কেন ভূত বা অলৌকিক
কিছু না।
শশী বাবু
এবার হাত জোর করে বললেন, আমরা নেহাতই কৌতূহল বশে এখানে এসে পড়েছি--
--কৌতূহল? এক
ছায়ামূর্তি বলে উঠলো।
--হ্যাঁ, আমরা
অলৌকিক ঘটনার সত্যাসত্য যাচাই করি--এ সবের মাঝে রহস্য ও রোমাঞ্চ খুঁজে বেড়াই। আমরা তিন বন্ধু
এভাবে সমস্ত ঘটনার খোলসা করার চেষ্টা করি।
তিন ছায়া
ভূত ছিল না। ওরা ওয়াচমেন ছিল। রাতে এই বিশাল বিল্ডিং ওরা একবার চক্কর দিয়ে পাহারা
দিয়ে যায়। এ ভাবে সমস্ত ঘটনার খোলসা হল। অন্য দিকে বন্ধুদের কানে এসে আবার সেই
ঝুমঝুমাঝুম শব্দ ভেসে আসতে লাগলো, সেটা কি সত্যি নূপুরের ছিল?
ওয়াচমেন
বলল, আর না, এখানে আর থাকা যাবে না
--কেন? প্রশ্ন
করেন শশীবাবু।
--এ এক ভুতুড়ে ঘটনা, শুধু
এটুকু জেনে নিন। এ শব্দ রহস্য জানতে গিয়ে দুই জন লোক এখানে মারা গেছে। আর একজন
জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিল। সে বেঁচে আছে ঠিক কিন্তু পাগল হয়ে গেছে।
ইতিমধ্যে
অর্ণবের জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু তার কি হল বোঝা গেল না। সে সোজা হেঁটে চলল পড়ো জমিদার
বাড়ির ভেতর দিকে। বন্ধুরা তাকে ঘিরে ধরলেন। অর্ণব কারও কথাই যেন শুনতে পারছিলেন না। তিনি যেন নূপুরের
শব্দে মোহিত হয়ে আছেন। উদাসী তাঁর দৃষ্টি। এভাবে অর্ণব এক অদ্ভুত ব্যাপার করে
বসলেন, তিনি সবাইকে ঠেলে দিয়ে ছুটতে শুরু করলেন। ওঁর পেছনে বন্ধুরা ছুটতে লাগলেন। এ
অবস্থায় ওয়াচম্যানরা কি করবে ভেবে নিয়ে শেষে ওরাও অর্ণবের দিকে এগিয়ে গেলো। ওদের সবাইকে দেখলে স্পষ্টই বোঝা
যাচ্ছিল যে এ ব্যাপারে ওরা ভীষণ ভয়ে ভয়ে
আছে।
অর্ণবকে
সবাই খুঁজে বেড়াচ্ছিল। এক সঙ্গে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে গিয়ে ছিল তাই বুঝি ও দিকে
নূপুরের আওয়াজ থেমে গিয়ে ছিল। রাত প্রায়
শেষের দিকে গড়িয়ে গেলো। শেষে খুঁজতে খুঁজতে জমিদার বাড়ির বাগানের শেষ
সীমানার প্রাচীরের পাশে অর্ণবকে খুঁজে পাওয়া গেল।
তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছিলেন। তাঁর মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ বেরিয়ে আসছিল।
এটুকু বোঝা যাচ্ছিলো যে অর্ণব বেঁচে আছেন। তবে তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবেন
তো ? এ প্রশ্ন সবার মনেই আসছিল।
জনান্তিক
বললেন, অর্ণবকে এখান থেকে এখনই নিয়ে যেতে হবে।
একজন
ওয়াচমেন এবার কথা বলল, এই তো সেই জাগা। সেই চাঁপা গাছ, এখান থেকেই নাকি নূপুরের শব্দ বেরিয়ে আসে। সবিস্ময়ে
সবাই সেই দীর্ঘ মৃতপ্রায় গাছটার দিকে তাকাল। তার পাশেই দেওয়ালের এক জাগার বেশ
খানিকটা ধ্বসে পড়ে আছে বোঝা যাচ্ছিলো।
আর দেরী
করা যাবে না। অর্ণবকে ধরে চ্যাংদোলার মত করে ওঁরা জমিদার বাড়ির বাইরে নিয়ে এলেন।
এখনই অর্ণবকে নিয়ে যে বন্ধুদের যেতে হবে হসপিটালে। শেষ রাতের রাস্তা থেকে একটা গাড়ি যোগাড় হয়ে
গেলো। গাড়িতে অর্ণবকে তুলে দিয়ে বন্ধুরা উঠে বসলেন। শশীভূষণ গাড়িতে ওঠার আগে একবার
শেষ বারের মত জমিদার বাড়ির দিকে তাকিয়ে নিলেন। দীর্ঘ জমিদার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ এখনো
বুঝি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কত যে জন্ম-মৃত্যুর ঘটনা, সুখ-দুঃখের জীবনসাক্ষী হয়ে রয়েছে এই ইমারত !