গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

আফরোজা অদিতি

একজন চাকরীজীবীর বেকারত্বের কাহিনী


     
      চাকরী আছে; কিন্তু বেতন নাই। অফিস আছে, হাজিরা আছে কিন্তু মাস গেলে অর্থ আসে না হাতে! প্রতিদিন অফিসে আসতে হয়! আজও এসেছে। অফিস শেষে হাঁটছে, কিন্তু বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করছে না। পকেটে একটা টাকা নেই। ব্যাংক হিসাবে মাত্র ৫০০ টাকা আছে; ওটা না থাকার সামিল। ঐ টাকা উত্তোলন করা যাবে না। গিন্নী বলেছে চাল বাড়ন্ত। সে জানে কারো কাছে ধার চাইলে পাওয়া যাবে না তবুও কয়েকজনের কাছে হাত পেতে মুখ খুলেছিল। কিন্তু বৃথা। পাঁচমাস বেতন দেওয়ার পর তিনমাস বন্ধ! তার অন্য কলিগদের কথা বলতে পারবে না, কিন্তু নিজের ঘরে সকলেই প্রায় অভূক্ত; বয়স্ক বাবা-মা, স্ত্রী-পুত্র সকলেই! কী করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। মাঝেমধ্যেই এমন হয়; কয়েকমাস পরে পাওনা অর্থ পরিশোধ করে মালিক। আর  মালিক যখন বকেয়া-বেতন দেয় তখন সে টাকাগুলো খরচ না করে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রেখে দেয়। এবারেও রেখে দিয়েছিল কিন্তু মায়ের অসুখে এবং মেয়েটার অসুখে সব শেষ হয়ে গেছে। মা বেঁচে আছে কিন্তু তাকে নিঃস্ব করে চলে গেছে মেয়েটি; স্নেহ-ভালোবাসা, অর্থ সবদিক দিয়েই নিঃস্ব সে আজ।  মেয়ের কথা মনে হতেই চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে বুকের ওপর। ভেজা চোখে জামার পকেটে হাত দিয়ে বের করে আনে একটি ছবি; মেয়ের ছবি। শান্ত মুখশ্রীতে টলটলে শান্ত দিঘীর মতো দুটি চোখ; ছবিটি দেখলেই মনে হয় তার দিকে তাকিয়ে হাসছে মেয়ে; মেয়েকে দুচোখ ভরে দেখে পকেটে রেখে দেয় ছবি। সে হাঁটছে, মেয়ের মুখ মনে করে হাঁটছে; মেয়ের ছবি দেখলেই মনে জোর কমে যায়; বাঁচতে ইচ্ছা করে না তার।

     প্রায় দিনই হাঁটতে হয়; হয় পকেটে টাকা থাকে না, না হয় যানজটে গাড়ি নড়ে না। এছাড়াও মাঝেমধ্যেই এইসব সড়কে বিভিন্ন রকমের সমস্যার সৃষ্টি হয়ে রাস্তা অবরোধ করে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় ছাত্র-জনতা। কয়েকদিন আগে, যানজট নিরসনের লক্ষ্যে রাজধানীর কয়েকটি রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধ করাতে রিকশা-ওয়ালারা রাস্তা বন্ধ করেছিল; কোন গাড়ি না চলাতে হাঁটতে হয়েছিল। আজ তা নয়, পকেট গড়ের মাঠবলে হাঁটতে হচ্ছে। হাঁটতে ইচ্ছা করছে না তার; বসে পড়ে ফুটপাতে। প্রবাদ-প্রবচনে আছে, “অলস মস্তিষ্ক, শয়তানের কারখানা;” তারও হয়েছে তাই! আজেবাজে নানা রকম বল্গাহীন চিন্তার সঙ্গে দৌড়বাজী করছে তার মন! এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে তার চাকরীর সঙ্গে সঙ্গে যে কোন একটা ব্যবসা করলে ভালো হতো। এখন তা না করার জন্য আফশোস হচ্ছে।

       মন খারাপ করা আফশোসকে সরিয়ে হাঁটছে সে। অনেকক্ষণ হেঁটেছে। এখন খুব ক্লান্ত লাগছে তার; ভাবছে সে জীবন-যাপনের অর্থ না থাকলে ক্লান্তি এসে ভীড় করে দেহে-মনে! শরীর-মন চাঙ্গা রাখতে অর্থের প্রয়োজন। অর্থ না থাকলে শরীর-মনকে কব্জায় রাখা দুষ্কর হয়ে ওঠে! অন্যদের কী এমনি হয়? জানে না সে; জানতে চায় না। কী হবে জেনে? সবকিছু ছাপিয়ে ক্লান্ত মনে বারবার ভেসে উঠছে ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটার মুখ; আহা, বেঁচে থাকলে স্কুলে যেতো, লেখাপড়া করতো! স্কুলের কথা মনে হতেই শিউরে ওঠে তার শরীর। তার মনে হয় ভালো হয়েছে মেয়েটা নেই; থাকলে কে জানে কোন দূর্ঘটনা ঘটতো না; পরক্ষণেই মনে হয় শুধু কী মেয়েশিশু, ছেলেশিশুর জন্য কি বিপদ ওৎ পেতে নেই। খবরের কাগজে শুধু নারী শিশু নির্যাতনের খবর; শিশুরাই হিংস্রতার শিকার হচ্ছে বেশি! কিন্তু কেন? শিশুরা তো ফুলের মতো, ঈশ্বর বা দেবতার অংশ তারা, তাহলে ওদের ওপরে কেন এই হিংস্রতা? এই কথা মনে আসতেই একই সমান্তরালে আর একটা কথা মনে হয়, তাহলে কী যারা এই সব কাজ করছে তাদের মন থেকে ঈশ্বরভীতি চলে গেছে, চলে গেছে ভালো-মন্দ বিচার-বিবেচনা বোধ! ওরাও তো মানুষ! নাকি মানুষ নয়? মুহূর্তে এই ভাবনা মনের মধ্যে দৌড়ে বেড়াতে থাকে; ভাবনার দৌড়ে সে ভুলে যায় কোথায় আছে; আর রাতই বা কতো?

     অনেকটা সময় বসে আছে; তার তোয়াক্কা না করেই গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে রাত! ভাঁজ করা হাঁটুর ওপরে দুই হাত প্রসারিত করে মাথা নিচু করে বসে আছে। মনের মধ্যে এখন তার পরিবার-পারিজন ঘোরাফেরা করছে; ওরা কী কেউ চিন্তা করছে তার জন্য? তার ছেলেটা! ছেলেটা কী করছে? ছেলেটাকে খেতে দেওয়ার মতো একটু কিছু খাবার কি আছে ঘরে? তার নিজের অংশ থেকে সৃজিত, তাকেই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে সে; সন্তানের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অধিকার নেই তার। কিন্তু! আবার এক কিন্তুর ফেরে পরে সে; সন্তানকে বঞ্চিত করতে চায় না সে; সবই ভাগ্য! বাবা-মায়ের বয়স হয়েছে, মায়ের শরীর ততোটা সারেনি এখনও; পথ্য দরকার, দরকার ওষুধের। সেদিন দেখেছে স্ত্রীর কাপড়টা ছিঁড়ে গেছে, মাথার চুলে তেল নেই। কিন' কী করবে সে?এতোটাই অপারগ, অক্ষম সে; সবদিক দিয়ে অক্ষম! অক্ষম পুত্র, অক্ষম স্বামী, অক্ষম পিতা!  মনের ভেতরে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এই কয়টি মাসের টানাপোড়নে কখনও গেহতে ইচ্ছা করেছে, কখনও মাদক চোরাচালানের ইচ্ছা  জেগেছে, কখনও বা ইচ্ছা হয়েছে ছিনতাই করতে, চুরি করতে, চুক্তিবদ্ধ হয়ে অর্থের বিনিময়ে খুন করতে! কখনও কোন রাতে স্ত্রীর পাশে শুয়ে স্ত্রীকে বিক্রি করে দেয়ার ইচ্ছাও জেগেছে! কিন্তু কিছুই করতে পারেনি, তার মানসিকতা এইসব কাজ করতে বাদ সেধেছে! তার স্থির বিশ্বাস মানব-মনের মধ্যে ঈশ্বরের বাস; তাঁকে অস্বীকার করা যায় না! তাঁকে অস্বীকার করার কথা ভাবতে পারে না সে। তাছাড়া সে শিক্ষিত, মার্জিত এক যুবক; এই কথা মনে হতেই হা-হা উচ্চস্বরে হাসে পাগলের মতো! রাত চিরে যাওয়া হাসি থামলে স্বগোক্তি করে সে, যুবক নয় বেকার যুবক!
     
     রাত গড়িয়ে গভীর হয়েছে। সে বসে আছে। সামনের রাস্তা দিয়ে নাইট-কোচ হুশহাস শব্দ করে চলে গেল কয়েকটা! হঠাৎ ধুপধাপ শব্দ; তার মনে হলো কারা যেন দৌড়ে আসছে! পেছনে গাড়ির শব্দের সঙ্গে পরিচিত হুইসেল। হঠাৎ গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ; যারা দৌড়ে আসছে তারা এলোপাথারি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আসছে। কী হয়েছে তা ভালো করে দেখার জন্য উঠে দাঁড়ালো সে; উঠে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখছে হঠাৎ গরম সীসা ঢুকে গেল ওর দেহে; অন্ধকার হয়ে এলো চোখ; সে বুঝতে পারলো তার দেহ পড়ে যাচ্ছে নিচে; পড়ে যেতে যেতে সে কয়েকদিন আগে শোনা ইংরেজী একটি গানের কলি গাইতে চেষ্টা করে; তার শরীরের সবটুকু শক্তি একত্রিত করে সে গাইল উই আর ওয়েটিং ফর চেঞ্জেস....সে এই একটি লাইনই ঘুরেফিরে গাইতে থাকে। ক্রমশ তার কণ্ঠ নিস্তেজ হতে হতে স্তব্ধ হয়ে যায়; তার দেহের অর্ধেক চিৎ হয়ে থাকে ফুটপাতের ওপর বাঁকি অর্ধেক নিচে!