গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

সুতপা সরকার

সৃজন


পশ্চিমের রোদ বিছানা ছুঁয়ে আছে। শীতের শেষবেলার রোদটুকু অলকবাবুর বড়ো আদরের  ক্ষণ। কাঁচের জানলার গা বেয়ে রক্তিম সূর্য্যটা পাখিদের বিদায়ী সম্বোধন মেখে নেমে যাচ্ছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই বাড়ীটা এমন ভাবে নির্মাণ করেছেন যাতে জানলাগুলো  দিয়ে অনেক দূরের আকাশে চোখ মেলা যায়।

" যাক বাবা কাল থেকে আর চিড়েচ্যাপটা ভিড়ে মৃতপ্রায় হয়ে বাড়ী ফিরতে হবে না।" চল্লিশ বছর অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। বাকী কটা দিন হাতপা গুলোকে আরাম দেওয়া দরকার।

"নাও  তোমার চা টা খেয়ে নাও। আমাকে আবার সন্ধ্যে দিয়ে আমার নাইট স্কুলে যেতে হবে।"সুনন্দা আলগোছে চুল জড়িয়ে এলো খোঁপা করতে করতে কথা কটি বললেন।

"কেন আজ না হয় নাই বা গেলে। তোমার সংগে তো কত কথা বাকী রয়ে গেল। আজ নাহয় দুজনে একসঙ্গেই কাটাই।"

"তাও কি হয়! আমার অপেক্ষায় ওরা যে বসে থাকবে।"অভিমান হলেও চুপ করেই রইলেন। তাছাড়া তিনি তো ঠিক করেইছেন প্রত্যেক টি মূহুর্ত আরাম আর আলস্যে কাটাবেন। টিভি টা চালিয়ে একের
পর এক সিরিয়াল গুলো দেখে চললেন।তারপর এক সময় খাওয়াদাওয়া করে দেদার ঘুম। এইভাবে বেশ কাটছিলো দিনগুলো।তার দোহারা চেহারাটা ভরাট হয়ে উঠল।কিন্ত যা ভেবেছিলেন অঙ্কে মিলছে না।  ভেবেছিলেন রিটায়ারের পরের পর্বে দায়ভার হীন পাখির মত আকাশ ছুঁয়ে উড়ে বেড়াবেন।কিন্ত মাঝে মধ্যেই ডালহৌসি স্কোয়ারের মুড়ি চানাচুর মাখায় হৈহৈ করা অফিসের দিন গুলোয় উঁকি মারে। বড় একা লাগে।
ছেলেমেয়েরা সুপ্রতিষ্ঠিত। অফিস ফেরত যে যার জীবনের মধ্যে ঢুকে পড়ে।তাদের তিনি দোষ দিতে পারেন না। জেনারেশন গ্যাপ টা তো থেকেই যায়। ওরা ওদের স্বাধীনতায় জীবন যাপন করবে সেটাই তো স্বাভাবিক। তিনিও তো এই স্বাধীনতা টাই এতদিন চেয়ে এসেছেন। আর আজ যখন তিনি সব দায়ভার থেকে মুক্ত তবে তাকে সেভাবে উপভোগ করতে পারছেন না
কেন!! স্ত্রী নন্দা তার দৈনন্দিন  সাংসারিক কর্মব্যস্ততা য় আর নাইটস্কুলে পড়ানো নিয়ে রুটিন মাফিক চলছে তবুও সে  এতটুকু ক্লিশ নয়।অভ্যেসের নামতায় গড়্গড়  করে তার জীবন চলছে।তিনি তাঁর আবাল্য পরিচিত জায়গা ছেড়ে
এ পাড়ায় এসেছেন,তাই পাড়ায় তাঁর তেমন বন্ধুবান্ধব কখনোই গড়ে ওঠে নি।জমিটা খুব সস্তায় বিক্রি হচ্ছিল তখন সাতপাঁচ  না ভেবে কিনে নিয়েছিলেন। তারপর কর্ম ব্যস্ততায় আর বন্ধুত্ব সেরকম গড়ে ওঠে নি।তবে তাঁর স্বভাবটাও বেশ অন্তর্মুখী।

তবু,নন্দার কথামতআজকাল সকালে হাঁটতে যান----- সুগারের প্রকোপে পড়েছেন। কিন্ত দুএকজনের সাথে আলাপ পরিচয় হতে দেখেছেন তারা রোগের আলোচনা করতে বড্ড বেশী ভালবাসেন। রিটায়ারমেণ্টের পর মৃত্যুভাবনা ছাড়া আর কিছুতেই তাদের তেমন করিয়ে উৎসাহ নেই। কিন্ত অলক বাবু টাটকা সবুজ জীবনের স্বাদ চান। ক্রমশঃ  দেখা যায় তিনি এক টা একলা দ্বীপ হয়ে যাচ্ছেন।

ঠিক এইসময় নাতি টুবলু তাকে একটা ফেস বুক একাউন্ট  খুলে দেয়। অলক বাবু দেখেন তাঁর বয়সীরাও কত সৃজনে রয়েছে। কলেজ লাইফে তিনিও একটু আধটু লিখতেন। আবার কলম হাতে উঠে এল। কবিতা, গল্প,বায়োগ্রাফি লোকে চেটে পুটে পড়তে শুরু করেছে।তাঁর ফলোয়ারদের সংখ্যাএখন কমকরেও হাজার দুই ছুঁই ছুঁই।নিত্য অনুষ্ঠানে  আবৃত্তি করতে ছুটছেন। মেসেঞ্জার সরগরম । ভোর হলেই---" দাদু লেখাটা দাও"
বা " মেসোমশাই আমাদের অনুষ্ঠানে আসতেই
হবে"----
এখন তিনি পাখির মত সবুজ ধানঠোঁটে করে গ্রুপে গ্রুপে বীজ বুনে দিচ্ছেন। এখন তিনি মহাসাগর আর সাগরের কোলে অজস্র ছোট ছোট তরীদের নিয়ে খুশীর মরশুম।সৃস্টির হাত ধরে আত্মক্ষরণে প্রতিটি মূহুর্তে অপরিমেয় জীবন ধারণ।