গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

তাপস দাস

হয়তো আমাদের কথা


আজ আবারও কোর্টে মানবকে তোলা হবে l আজ রায় দেবার দিন , মানবের স্ত্রী'  অনিচ্ছাকৃত হত্যার অপরাধে , মানবকে দোষী প্রমাণ করা হয়ে গেছে l মানবের আত্মীয় পরিজন ,প্রতিবেশী সবার সাক্ষ্যপ্রমানে l আমিও উপস্থিত সেখানে,আমি ওর বন্ধু l 
" মানব চক্রবর্তী , আপনার কিছু বলার আছে ?  আপনি বলতে পারেন l "
অনেক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়ায়ে মানব l  বিচারপতি আবারও বললেন " আপনি কি কিছু বলবেন ?  " দুচোখ জলে ভেসে যাচ্ছে মানবের l "হ্যাঁ , ধর্মাবতার বলার আছে ........সেদিন লক্ষী পুজো ছিলো,বাবাকে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে lআমি আর দিনের মতই খেলছিলাম,মামাতো দাদা দিদি এবং প্রতিবেশী বন্ধুদের সাথে l
আমি সেদিনও খেলছিলাম,যেদিন বাবাকে কাঁধে করে নিয়ে এলো বাড়িতে এবং নিয়ে গেল l বাড়িতে মানুষজনের মুখে শুনলাম বাবার ক্যান্সার হয়েছিল , আমাদের সব টাকা তার চিকিৎসা করতেই শেষ হয়ে গেছে l আমাদের চলবে কি ভাবে , পড়াশুনা চলবে কি ভাবে,খাবো কি,মা কি করবে একা মহিলা একটা এগারো বছরের বাচ্চা নিয়ে ,এমন নানা  কথা  পরের বারো তেরো দিন  বাড়িতে আসা বিভিন্ন আত্মীয় পরিজন এবং লোকের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠলো ,  আমি সেই সব দিন গুলোয় খেলেছি,কোনো অনুভুতি আমার হয়নি আলাদা করে l হয়তো সে সময়কার বাচ্চারা এমনই হয়, বোকা বোকা l
বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পরের দিন থেকে বাড়ি ফাঁকা , শুধু মা আর আমি l  দিন গড়াতে লাগলো অভাব বাড়তে লাগলো l মা ঢ্যারস সেদ্ধ দিয়ে ভাত মেখে দিতো , কিন্তু প্রচন্ড ঝাল দিতো, পরে বুঝেছিলাম,যাতে ঝালের জন্য জল খেয়ে পেট ভরে যায় lধীরে ধীরে সারাদিনের খাবারের পরিমাণ কমতে লাগলো l স্কুল টিউশন প্রায় বন্ধ হবো হবো l হঠাৎই মা চিৎকার করতে লাগলেন একদিন রাত্রে l প্রতিবেশী এক কাকু যার নাম শম্ভু ,ওনার সাহায্যে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম, সেদিন জেনেছিলাম মায়ের বয়স তখন মাত্র বত্রিশ বছর l  বাবার চলে যাওয়াটা মা কে মানসিক ভাবে শেষ করে দিয়েছিল l ডাক্তার তাই বলেছিলেন l
হটাৎই  বুঝতে পারলাম আমাদের কেউ নেই l শম্ভু কাকু পরামর্শ দিলেন কিছু করার l লোকের বাড়ির গাড়ি ধোয়া কাজ করতে লাগলাম  l স্কুলেও যেতে লাগলাম l শম্ভু কাকু ,স্কুলেও বলে এলেন আমাদের অবস্থা lনা , কোনো স্যার আমায় কোনো রকম ভাবে সাহায্য কোনোদিন করেনি ,আমার ছেঁড়া স্কুল ড্রেস বা ছেঁড়া বইখাতা দেখেও কোনো দিন কিছু জানতে চায়নি তারা l তাই কোনো দিনই ওদের সন্মান দিইনি ,আজও না lকিছু বন্ধু তাদের সাধ্যমত সাহায্য করতো ,  তাদের পুরনো জামা প্যান্ট ,তাদের মায়েদের শাড়ি জামা , বই খাতা দিয়ে l
মায়ের পাগলামো আরও বেড়ে গেল,সঙ্গে আমার দ্বায়িত্ব l যা হোক ফুটিয়ে রান্না করা , মা কে খাওয়ানো ,স্নান করানো ,ওষুধ যোগাড় করা ও খাওয়ানো প্রায় কুস্তি করে ,সেই বয়সেই সময় সব শিখিয়ে দিয়েছিল l এর সাথেই গাড়ি চালানো শিখে রোজগার বাড়ালাম l  ততো দিনে আমি যুবক হয়ে গেছি আঠারোর l সঙ্গ দিলেন দুজন মানুষ ,শৈবালদা ,দীপকদা l আমায় বিনা পয়সায় পড়াতে লাগলেন  l  কি পড়বো , কোথায় পড়বো সব ওনারা বলে দিয়েছিলেন l সারা দিন গাড়ি চালিয়ে ,রাতে মাকে ঘুম পাড়িয়ে,পড়তে যেতাম  সপ্তাহে তিনদিন l  বাকি তিনদিন নাইট কলেজ l পাশের বাড়ির শম্ভু কাকুর বউকে বলে যেতাম একটু খেয়াল রাখতে lবাড়ির চাবিও দিয়ে আসতাম,যদি বিপদ ঘটে সে আশংকায় l যদিও ওষুধের প্রভাবে মা প্রায় অচৈতন্য থাকতো l
সে সময়ই বাসে আলাপ হলো তিথির সাথে l সে বয়সের প্রেম জাগেনি মনে , তবে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছিলাম lতিথিও সানন্দে রাজি হয়েছিল l বন্ধুত্ব প্রাণের হলো l তেমনই একদিন ,ওর চোখে জল দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো l জানতে চাইলাম কি হয়েছে ? বললো ,আর মাষ্টার্স করতে পারবে না lওর বাবা ডানলপে কাজ করতেন ,সেটা বন্ধ অনেকদিন ধরে l আর চালাতে পারবে  না l  হুজুর ......সারারাত পড়ায় মন বসেনি সেদিন l  পরদিন বললাম ওকে ফর্ম তুলতে l টাকা নিয়ে যেন মাথা না ঘামায় ,যা লাগবে আমি যোগাড় করবো l সব খরচ দিতে লাগলাম ,অভাব বাড়লো আমার l
দুজনেরই চাকরি হলো। আমার প্রাইভেটে, ওর স্কুলে l  দুটো পরিবারে আস্তে আস্তে সময় ঘুরতে লাগলো l মা সুস্থ হতে লাগলো l
দুই পরিবার চাপ দিতে লাগলো আমাদের ,  বিয়ের জন্য l আমরাও বহু আলোচনা করলাম,বিয়ে করা কি উচিৎ বন্ধুকে ? তিথিই  জোর দিলো বিয়ের জন্য বললো, ও নাকি আমায় হাড়ে হাড়ে চেনে l তাই প্রেম আর বিয়ে আমাকেই করবে l
বিয়ের দুবছর পর থেকে হটাৎই রাত হতে লাগলো ওর ফিরতে l রাগ করতে লাগলাম ,বাড়িতে মা একা ,  অসুস্থ  l  ও বলতে লাগলো স্কুলের ভিলেজ প্রোগাম চলছে তাই লেট হয় l  মাথায় ঘুরতে লাগলো কথাটা ......রোজই ভিলেজ প্রোগাম ?  কাজে মন বসাতে পারছিলাম না l সন্দেহ করতে শুরু করলাম l অশান্তি , চিৎকার , যুক্তি পাল্টা যুক্তি শুরু হলো l শিক্ষিত স্বাবলম্বী মহিলা ,  কিছুতেই বাগে আনতে পারছিলাম না l কোনো কথাই আর শুনতো না l ধীরে ধীরে আমার প্রতি অনীহা অবহেলা ঘৃণা প্রকাশ করতে লাগলো l আমাদের বাবা মায়েরা এতে নাক গলাতেন না l আমি প্রায় উন্মাদের মতো আচরণ করতে লাগলাম l  ঘুম আর শান্তির জন্য মদ খাওয়া ধরলাম , ফল বিপরীত হলো l  আরও অশান্তি করতে লাগলাম l
খুব কাছের বন্ধু ও তার স্ত্রী জোর করে আমাদের দুজনকে ফ্যামিলি সাইক্রিয়াটিসের কাছে নিয়ে গেলো l  আমি ভালো হতে চেয়েছিলাম হুজুর ..........সব বললাম ওনাকে , বাবা মারা যাবার পর কি কি ঘটেছে ....যে শম্ভু কাকুকে পিতৃজ্ঞান করতাম , তিনি তার স্ত্রী' র সাথে কি দুর্ব্যবহার করতেন , গাড়ি ধুতাম যখন মালিকেরা কি গালিগালাজ করতো , চোর পর্যন্ত বদনাম দিয়েছিল বোনাস চেয়েছিলাম বলে ,আত্মীয় পরিজন কেউ খোঁজ নিত না ,  তিথি কি করছে আমার সাথে , আমার কি ধারণা তিথিকে নিয়ে .......সব , সব বলেছি ডাক্তারকে l উনি ওদের বলেছিলেন,আমার নাকি ..... ডি .এইচ .ডি ছিলো ছোট বেলায় l বিনা চিকিৎসায় সেটা বেড়ে গেছে l বর্তমানে আমি নাকি স্ক্রীজোফেনিয়ার রুগী l আমি কাউকেই বিশ্বাস করতে পারবো না ,প্রচন্ড রাগ হবে ,চিৎকার করা মারধোর করা স্বাভাবিক আচরণ ,অস্থির মতি , ভীতু হওয়া এগুলো সবই এর লক্ষণ lওষুধ, সাইকোথেরাপি আর প্রিয় জনের ভালোবাসাই  আমায় সুস্থ করতে পারে l
হুজুর , সব বুঝে , ডাক্তারের কথা মতই সব  করছিলাম .......কিন্তু ....তিথি ....নিজের জেদ থেকে একচুল নড়েনি l পা ধরে কেঁদে ক্ষমা চেয়েছি ......আর গায়ে হাত দেবনা বলে মায়ের দিব্বি দিয়েছি ....ওর কোনো পরিবর্তন হয়নি l দীর্ঘ একবছর এভাবে কাটিয়েছি হুজুর ......ওর কোনো পরিবর্তন হয়নি .....যতক্ষণ ঘরে থাকতো ফোনে কাদের সাথে গল্প করতো ফিসফিস করে  .......আমি পাশে বসে কথা বললে,উত্তর দিতো না .....গায়ে হাত ঠেকানো তো দূরের কথা ....হ্যাঁ হুজুর ,কোনো শারীরিক সম্পর্ক আমাদের আর ছিল না l ওর কন্ডিশন ছিল .....ওর  সাথে থাকলে,এভাবেই থাকতে হবে .....আমি চাইনি হুজুর .....শুধু চেয়েছিলাম ও আমার হয়েই থাক ....আবারও আমায় আগের মতো ভালোবাসুক .........না .....কিছুই করেনি ও ....আরও ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে আমায় ........আবারও আস্তে আস্তে আমি অসুস্থ হতে লাগলাম ....সব বন্ধ হয়ে গেলো .....চাকরিটাও গেলো ....ব্যাস্ত থাকার জন্য ঘরের কাজ করতে লাগলাম ....ওর খেয়াল রাখতাম ....চা , জলখাবার ...সবের খোঁজ নিতাম আগের মতই ভালোবেসে .....কিন্তু ...ওর মন পাইনি .....
ঘটনার দিন রাত্রে প্রায় পৌনে দশটায় বাড়ি ঢুকতে ,মা জানতে চেয়েছিল এত দেরি হলো কেন ......উত্তরে বলেছিলো ..." তুমি তোমার কাজ করো ,  মা আর ছেলে দুই পাগল মিলে আমায় পাগল করে দিচ্ছো"  ...হুজুর ...মাথার ঠিক রাখতে পারিনি ....চড় মেরেছিলাম ....কিন্তু ...ও সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে নিচে পরে যাবে আর এ ঘটনা ঘটবে ভাবতেই পারিনি ........ওকে প্রাণে মারতে আমি চাইনি হুজুর .....ওকে আমি প্রাণের চেয়েও ভালোবাসি ...হুজুর ........আমায় ক্ষমা করুন হুজুর ......আমার বৃদ্ধ মা একা হয়ে গেছেন...উনি অসুস্থ ...হুজুর ...ক্ষমা ...."
চোখের জল বাঁধ ভাঙ্গল আমার , বুকটা মুচড়ে উঠলো lপরের ঘটনা দেখা বা শোনার সাহস আমার হয়নি  l প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে এসেছি কোর্টরুম থেকে l  বোধহয় আমার নাম ধরে চিৎকার করছিলো মানব ,ওকে বাঁচানোর জন্য l কাপুরুষের মতো পালাতে লাগলাম আমি l  কিসের ভয়ে বুঝতে পারছিলাম না l                                           
কোথাও যেন টুকরো টুকরো মানবকে খুঁজে পাই , আমাদের পরিচিত সমাজের মধ্যে l মানবের মতো আরও কতশত আছে যারা এভাবেই বাঁচে .....নারী পুরুষ নির্বিশেষে ? আমাদের কতটা দ্বায়বদ্ধতা আছে ,এদের পাশে আমরা দাঁড়াতে পারিনা ? ছোট ছোট মানবদের একটু ভালোবাসা একটু আদর একটু সাহায্য করতে পারিনা ? প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরতে থাকে আমার l  কতশত স্বপ্নের সম্পর্ক এভাবে শেষ হয়ে যায় l 
মানবের মা বর্তমানে আমাদের কাছে আছেন l শুধু ঘোলা চোখে তাকিয়ে থাকেন ,আর মাঝে মাঝে বলে ওঠেন "  মানু এলি ? মৌ এলি ?  "  হ্যাঁ ,  উনি তিথিকে ভালোবেসে মৌ বলেন l