গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

তাপসকিরণ রায়

ধারাবাহিক হ্যান্টেড কাহিনী--৩৮

পুরুলিয়া জংশন স্টেশন থেকে ফরেস্ট বাংলোর পথে


আজ থেকে প্রায় বছর পঁচিশ আগের ঘটনা। আমার বয়স তখন আঠার মত হবে।  সবে মাত্র ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টেরফরেস্টারের চাকরিতে ঢুকেছি। আমার পোস্টিং সদর পুরুলিয়া জেলার এক সংরক্ষিত জঙ্গলে হয়েছিল। দূরত্ব কম ছিল না।শুরুর জঙ্গলের চাকরিতে একেবারে একা যেতে সাহস পাইনি বলে সঙ্গে দু-তিন জন বন্ধুকে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমরাশুরুতে গিয়ে কলকাতার এক ফরেস্টবাংলোতে উঠেছিলাম। সেখান থেকে পুরুলিয়াগামী ট্রেনে পুরুলিয়া জংশনে পৌঁছতেপ্রায় সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে মিনিট পঁয়তাল্লিশ যেতে হয় স্থানীয় ফরেস্ট বাংলোতে পৌঁছাতে। আমরা বন্ধুরাএকটা গাড়ি ভাড়া করবো ভাবছিলাম। কিন্তু কোন ড্রাইভারই সন্ধ্যের পর সেখানে যেতে চাইল না। ড্রাইভার বলল, ফরেস্টবাংলোর দিকটা নাকি ভালো না--রাস্তা খুব খারাপ আছে। তা ছাড়াও ওই এরিয়ার বদনাম আছে।
আমাদের বাংলোতে পৌঁছবার তাড়া ছিল। আগামীকাল আমায় জয়েন করতে হবে, সেই জায়গাটাও ফরেস্টবাংলো থেকেকয়েক ঘন্টার রাস্তা হবে। তাই সে দিন  রাতের মধ্যে বাংলোতে পৌঁছে যাওয়া খুবই জরুরি ছিল। কিন্তু ড্রাইভার রাতেকিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। শেষে এক টাটাসুমোর ড্রাইভারকে অনেক বলে কয়ে ডাবল পয়সার লোভ দেখিয়ে রাজিকরানো হল। ততক্ষণে সন্ধ্যা থেকে রাত নেমে গেছে, আমরা তিন বন্ধু আর আমি ফরেস্ট বাংলোর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।টাটা সুমো গাড়ির ড্রাইভার  পথে বিশেষ একটা চলাচল করেনি। তা ছাড়া রাস্তায়ও লাইট নেই। চারদিক অন্ধকার,অমাবস্যার রাত ছিল কিনা জানি না। চাঁদের দেখা নেই। একটা ছাইরঙা আবছা আলো চারিদিক ঘিরে আছে। রাস্তার দুপাশে হালকা ঝোপঝাড়ের জঙ্গল। কোথাও ঝিঁঝি পোকা ডেকে উঠছিলো। মাঝে মাঝে জোনাকি জ্বলে জ্বলে উঠছিলো। একভয়াবহ পরিবেশের মধ্যে মনে হচ্ছিল আমরা যেন কোন অচিন দেশের মধ্যে দিয়ে চলেছি। 
রাস্তায় একটিও জনপ্রাণী নেই, কোথাও সাড়া-শব্দ নেই। আমরা চলেছি তো চলেছি।   ভাবে প্রায় ঘন্টা খানেক চলারপরেও যখন পৌঁছাতে পারলাম না, বুঝতে পারছিলাম আমরা  নির্জন পথের দিশা হারিয়েছি। তা না হলে আমাদের তোবেশী হলে এক ঘন্টার মধ্যে পৌছে যাবার কথা ছিল !
--কি ব্যাপার, ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, এখনো তো পৌঁছাতে পারলাম না ? ড্রাইভার কিছু ভাবছিল মনে হল, খানিকচুপ থেকে সে বলল, মনে হচ্ছে আমি রাস্তা ভুল করেছি। এতো অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারছি না ! ভয় পাবেন না, দেরীহলেও আমি আপনাদের পৌঁছে দেব।
অধৈর্য হয়ে আরও আধঘণ্টা পার করলাম। পথে এক জনও লোক নেই যাকে জিজ্ঞাসা করা যাবে। কিছুদূর গিয়ে হঠাৎআমাদের চোখে পড়লো একজন স্ত্রীলোক রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এই নির্জন রাস্তায় তার একলা যাবার কথা নয়। তারপোশাক-আশাক দেখে মনে হল স্থানীয় কোন গ্রামের হতে পারে। সে রাস্তা পার করছিল। আমি ড্রাইভারকে বললাম, ওরকাছে নিয়ে গাড়িটা থামাও !
ড্রাইভার একটু এগিয়ে স্ত্রীলোকটির সামনে এসে গাড়ি থামাল। সে তখন রাস্তা প্রায় ক্রস করে নিয়েছে। আমি স্ত্রীলোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, বলতে পারেন এখানকার ফরেস্ট বাংলোটা কোথায় ?
কোন উত্তর নেই, চুপচাপ হেটে যাচ্ছে স্ত্রী লোকটি। কি ব্যাপার বোঝা গেল না, আমার বন্ধু ভরত এবার জোরে ডাক দিয়েজিজ্ঞেস করল, এই যে শুনছেন, এখানকার ফরেস্ট বাংলোটা কত দূর বলতে পারবেন ?
এবার থামল স্ত্রীলোকটি। সে তার ডান হাতটা ওপরে তুলল, তারপর একটা দিক নির্দেশ  করলো, মুখে অস্পষ্ট স্বরে কিছুযেন বলল। ড্রাইভার এবার স্ত্রীলোকটির নির্দেশ মত গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো। কয়েক মুহূর্ত পার হল, হঠাৎ গাড়ির পেছনের সিট্থেকে আমার এক বন্ধু ভীত গলায় চীৎকার দিয়ে উঠলো। আমরা সবাই চিৎকার শুনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ফিরে তাকালাম।পিছন দিকে তাকিয়ে যে দৃশ্য দেখতে পেলাম তাতে আমাদের আত্মারাম খাঁচা হয়ে যাবার যোগাড় হল। দেখলাম সেইস্ত্রীলোকটি  মাটি থেকে প্রায় চার পাঁচ হাত ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। স্পষ্ট আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম, স্ত্রীলোকটি এক জাগাথেকে আর এক জাগায় উড়ে বেড়াচ্ছে। এক সময় সে উড়তে উড়তে আমাদের চোখের বাইরে চলে গেলো। আমরাহতভম্ব, ভয়ে আমাদের গা শিহরিত হয়ে উঠছিল। আমরা সবাই মাঝে মাঝে আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে উঠছিলাম। ড্রাইভারতার ঘাড় ফিরিয়ে সব কিছু দেখছিল। গাড়ি এক জাগায় দাঁড় করানো ছিল। হঠাৎ যেন ড্রাইভারের হোঁশ ফিরলো, সে সঙ্গেসঙ্গে ভয়ে হবে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে স্পিডে চালিয়ে দিল।
আমরা কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ফরেস্ট বাংলাতে পৌঁছালাম। সেখান কার ফরেস্ট বাংলোর গার্ডকে জিজ্ঞেস করা হল, কিব্যাপার ? ওখানে আমরা  রকম একটা দৃশ্য দেখলাম ! আমাদের মুখের বৰ্ণনা শুনে ফরেস্ট গার্ড যেন কিছুটা ভয় পেয়েগেলো, সে নিচু স্বরে বলল, হ্যাঁ দাদারা, এখানে ভয়ের ব্যাপার আছে। আপনারা যে জায়গাটার কথা বললেন সেখানেকয়েক বছর আগে এক ডাকাতের দল এক পরিবারের সবাইকে হত্যা করে ছিল। সেই পরিবারের কাছে নাকি অনেক টাকাপয়সা সোনা দানা ছিল। সেই থেকেই সন্ধ্যের পরে  রাস্তায় কেউ যাতায়াত করে না। আপনারা যখন আজকে রাত্রেথাকছেন, খুব সাবধান, রাত্রে কখনও একা একা যেন বাইরে বেরোবেন না। আমাদের ড্রাইভারও সে রাতটা ভয়ে সেখানেইথেকে গিয়ে ছিল।
এই ছিল আমার পুরুলিয়ার চাকরির প্রথম জয়েন করার দিনের ভৌতিক ঘটনার গল্প ।