গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

নীহার চক্রবর্তী

যেখানে প্রেম নেই


 শ্রুতি সেন প্রথমদিন কলেজে এসে তার সব কলিগের সঙ্গে পরিচিত হল । কমবেশি সবাইকে তার ভালো লেগে গেলো । ওকেও সবাই সাদরে গ্রহণ করলো ।
তার বাংলা-বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক নবারুণ দত্ত ওকে প্রবোধ দিলো,’’এখানে সব ফ্রেন্ডলি । এমন করেই আমাদের সাথে চলবেন । কেমন ?’’
শ্রুতি অনাবিল-হেসে তাকে বলল,’’একদম,স্যার ।‘’

কিন্তু বেলা গড়াতেই শ্রুতির চোখে পড়লো এক তরুণের দিকে ।
এক কলিগের কাছে জানতে সে বলল,''ও পুলক । আমাদের কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী । ভীষণ মিশুকে ছেলে । আর ছটফটে খুব । কথা বলে দেখবেন ।''
তার কথা শুনে শ্রুতি খুব আগ্রহী উঠলো পুলকের ব্যাপারে ।
একমুখ হেসে তাকে বলল,''সুযোগ পেলেই কথা বলবো তবে ।''

দুদিন পরেই সে সুযোগ এসে গেলো শ্রুতির কাছে । স্টেশনে ওর দেখা হল পুলকের সাথে । শ্রুতি যাবে কোলকাতা । আর পুলক ?
শ্রুতি এগিয়ে এসে একগাল হেসে ওকে বলল,’’আপনি তো আমাদের কলেজেই আছেন । তাই না ?’’
শুনে খুব লজ্জা পেলো পুলক । 
সলাজ-হেসে পুলক উত্তর দিলো,’’আমাকে আপনি বলবেন না । আমি কলেজের চতুর্থ শ্রেণির সামান্য কর্মচারী । তুমি বলুন আমাকে ।‘’
শ্রুতি মিষ্টি-হেসে বলল,’’শুরুটা এমন করেই হওয়া উচিৎ । তাই না ?’’
পুলক একটু চুপ করে থেকে স্মিত হেসে বলল,’’তা কিন্তু ঠিক । তবে আমি আপনিই বলব । আপনি অধ্যাপিকা বলে কথা ।‘’
শ্রুতি খানিক হেসে সে প্রসঙ্গে না গিয়ে বলল,’’তা যাচ্ছ কোথায় ?’’
পুলক জবাব দিলো,’’আমি খড়দায় নামবো । আমার বাড়ি ওখানে ‘’
তারপর ট্রেন চলে এলে দুজন দুই কামরায় ঝটপট উঠে পড়লো ।

বাড়ি ফিরে শ্রুতির খুব মনে পড়লো পুলকের মুখটা । বেশ মায়ালু-চাউনি । কবি-কবি ভাব । মাথায় আবার ঝাঁকড়া চুল । গায়ের রঙ বেশ বাদামী-বাদামী । একটু অন্যরকম মনে হল ওকে ওর । 
ওদিকে পুলকও খুব ভাবল শ্রুতির মুখ গায়ের রঙ চাপা । কিন্তু হাসিটা খুব মধুর । গালে আবার টোল পড়ে বেশ । হাসিতে যেন মুক্তো ঝরে । এলোমেলো বাতাসে যখন চুল উড়ছিল বেশ লাগছিলো ওকে ।
কিন্তু এত ভাবার পর পুলকের মনে হল,কাকে নিয়ে এত ভাবছি আমি ? আমি কি তার কোনোদিক থেকে যোগ্য ? আমার মনের কথা কেউ জানলে তো আমাকে মারতে আসবে ।
এসব ভাবতে ভাবতে একা-একা হেসে ফেললো ও ।   
ওর সদ্য-বিধবা মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,’’তোর আবার কী হল ? কেউ মন দিলো নাকি তোকে ? দিলে বেশ হয় কিন্তু । ঘরে আমার একজন লক্ষ্মী দরকার ।‘’
পুলক লজ্জা পেয়ে উত্তর দিলো,’’তেমন কিছু না গো,মা । ট্রেনে একটা মজার ব্যাপার দেখে এখনো হাসি পাচ্ছে ।‘’
‘’পাগল কোথাকারে ।‘’
মা বলে চলে গেলে পুলক আগের ভাবনায় ফিরে গিয়ে নিজেকে পাগল ভেবে আবার হেসে উঠলো ।

পুলক কলেজে খুব একটা স্টাফ-রুমে আসতে পারে না । কালেভদ্রে প্রয়োজন হলে তবেই । তাও মাস খানেক ও নীচেই থাকে । সেদিন শ্রুতির সঙ্গে ওর দেখা হয়ে গেলো হঠাৎ করেই । তবে নীচের খোলা জানলা থেকে দেখে ওকে । 
কলেজের প্রবীণ করণিক সুকুমার দত্ত বলে ওকে,’’আমাদের কলেজের নতুন অধ্যাপিকা রে । আজ প্রথম এলো ।‘’
সাথে-সাথে পুলক ঘর থেকে বাইরে এসে কিছুক্ষণ শ্রুতির মুখোমুখি হয় । দুই অচেনা মানুষের স্মিত হাসি । এটুকুই আর কি । তারপর পুলক ওকে দেখেছে কখনো-কক্ষন কাজের ফাঁকে । নিমেষে ছবি হয়ে সরে গেছে ওর চোখের সামনে থেকে । 
তার দুদিন পরেই একেবারে সামনা-সামনি । কিছু কথাও হল দুজনের স্টেশনে দাঁড়িয়ে । কিন্তু সে কথায় পুলক তৃপ্ত নয় । আরও কিছু কথা বলতে চায় শ্রুতির সঙ্গে ।
ওদিকে শ্রুতি আরও কিছু বলে পুলককে ছুঁতে চেয়ে ব্যাকুল । কলেজে দেখা করা সম্ভব নয় । স্টেশনে সেদিনের পর থেকে পুলকের সাথে ওর আর দেখা হয়নি । দুচোখ খুব খুঁজেছে ওকে ।
শুধু দুই প্রান্ত থেকে অপেক্ষা আর অপেক্ষা ।

তার এক সপ্তাহ পর দ্বিতীয়বার দেখা দুজনের । এবার পথে । শ্রুতি কলেজ থেকে বাড়ি যাচ্ছে । পুলক ওকে দেখে প্রায় ছুটে গেলো ।
একেবারে পাশে গিয়ে অমায়িক-হেসে বলল,’’কি ভাগ্য আবার দেখা হয়ে গেলো । কলেজে দেখি । তবে দূর থেকে । কাজে ব্যস্ত থাকি তখন । আর আপনার সাথে কলেজে কথা বলা কি ঠিক ?’’
চলতে চলতে শ্রুতি মিষ্টি-হেসে বলে,’’আমিও তো তোমাকে খুঁজছি । কলেজে তুমি ব্যস্ত । আমিও । কথা কি করে আর হয় । তবে এমন নয় আমি কলেজে পড়াই বলে আমার সঙ্গে কলেজে বলতে পারবে না ।‘’
ওর কথা শুনে পুলক খুব খুশী ।
বিনয়ের সুরে বলে,’’বেশ তো । এবার দেখা হলেই কলেজে টুক করে কথা বলে নেবো । তা এখন বাড়িতে যাচ্ছেন তো ? আমিও যাচ্ছি খড়দায় ।‘’
শ্রুতি তখন একটু অভিমানের সুরে ওকে বলে,’’তা তোমাকে আর স্টেশনে পাই না কেন ?’’
পুলক উত্তর দিলো আনমনা-সুরে,’’আসলে আমাদের বেরোতে হয় সন্ধের আগে । কাজ তো কম না আমাদের ।‘’
শ্রুতি পুলকের কথা শুনে ছোটো একটা শ্বাস ফেলে বলল,’’তাইতো । তোমরা কলেজের চলৎশক্তি । বুঝি আমি ।‘’
তারপর দুজন একসাথে স্টেশনে এসে ঢুকল ।

ট্রেন আসতে বেশী দেরী নেই । তাই কথাও হবে না বেশী ।
সামান্য কথার পর শ্রুতি বলল পুলককে,’’তোমার নাম্বারটা দাও । ছুটির দিনে বেশ কথা বলা যাবে ।‘’
শুনে অবাক পুলক । বুকে তখন ওর আনন্দের তরঙ্গ খেলে যাচ্ছে ।
চোখেমুখে খুশীর ঝিলিক নিয়ে বলল,’’কি ভাগ্য আমার । আমার নাম্বার আপনি চাইছেন ? বেশ তো বলছি  ফোনে সেভ করে নিন ।‘’
পুলক সারা মুখে হাসি নিয়ে নিজের নাম্বার বলতেই শ্রুতি ওর ফোনে সেভ করে নিলো । তারপরেই সেদিনের মতো ট্রেন ঢুকল প্ল্যাটফর্মে দুজন সহাস্যে পরস্পরকে বিদায় জানিয়ে দুই কামরায় উঠে গেলো ।

পরেরদিন ছিল শ্রুতির অফ-ডে ।
তাই কোনোভাবেই পুলকের সম্ভব ছিল ওকে দেখার । জেনেওছিল ও কলেজের করণিক ধ্রুব সাহার কাছে । সে ওপরে যায় খুব । খোঁজ রাখে অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের অফ-ডে কবে । তাই পুলক আর কিছু ভাবল না । অপেক্ষা করতে থাকলো পরশুদিনের জন্য । রবিবার । শ্রুতি কথা বলতে পারে ওর সাথে । 
সেটাই হল । পুলক যখন বাজারে বেরিয়েছে। তখন শ্রুতির ফোন এলো । সঙ্গে-সঙ্গে পুলক মহানন্দে রাস্তা থেকে বেশ দূরে একটু নিরিবিলি জায়গায় ফোন ধরল ওর ।
শ্রুতি শুরুতেই জানালো গুড মর্নিংপ্রত্যুত্তরে পুলকও ওকে উইশ জানালো ।
তারপরেই শ্রুতি সেন জিজ্ঞেস করলো খুশি-খুশি গলায়,’’কিছুই জানা হয়নি তোমার সম্বন্ধে । তা বাড়িতে কে কে আছে তোমার ?’’
আনন্দে গদগদ পুলক বলতে থাকলো,’’বিধবা মা,ডিভোর্সি দিদি,তার এক সাত বছরের ছেলে আর আমি ।‘’
শ্রুতি পুলকের কথা শুনে এবার বলল,’’মনে হচ্ছে তুমিই বাড়ির সব । তুমিই চালাও সবাইকে । তাই না ?’’
পুলক উত্তর দিলো,’’মার সামান্য পেনশন পান । আমার বেতন । আর দিদি কিছু খোরপোশ পায় । চলে যায় আর কি । এবার আপনারটা জানতে চাই ।‘’
শ্রুতি শুনে হেসে উঠলো ।
হাসতে হাসতে বলল পুলককে,’’আজ আমি ফোন করে জেনেছি । আর একদিন তুমি ফোন করে না হয় জেনো ? আর একটা কথা বলি ?’’
পুলক হেসে আগ্রহের সঙ্গে বলল,’’বলুন ।‘’
‘’মানে তোমার কেউ পছন্দের নেই ? তার কথা কিছু বলবে না ?’’

রাস্তা দিয়ে তখন গাড়ির পর গাড়ি । এক-একটা গাড়ির বিকট শব্দ । তাই পুলকের পরের লাজুক-লাজুক কথাগুলো সেভাবে কানে গেলো না ।
শ্রুতি হেসে বলল,’’মনে হচ্ছে পথে কথা হচ্ছে । তাই কিছু বুঝলাম । কিছু বুঝতেই পারলাম না । আজ থাক তবে । পরের ছুটির দিন বাকিটা শুনে নেবো । আজ রাখি ?’’
পুলককে বলতে হল না কিছু । শ্রুতি রেখে নীরবতায় নিজেকে মুড়ে দিলো । খুব হতাশ তখন পুলক । মনে-মনে বলল,কিছুই তো বলা হল না । আমি যে প্রেমের জন্য হন্যে,কিন্তু পাই না,সেকথাই তো বলা গেলো না । তবে অপেক্ষা করতে তো ক্ষতি নেই । এমন ভেবে পুলক জোর করে হাসতে হাসতে বাজারের মধ্যে ঢুকে গেলো ।

পরের ছুটির দিন ছিল দুদিন পরেই । সেদিন দোল-পূর্ণিমার ছুটি । বুকে সাহস আর আশা নিয়ে পুলক ফোন করলো শ্রুতিকে ।
শ্রুতি খুব খুশি ওর ফোন পেয়ে ।
বলল পুলককে,বল এবার সেদিনের বাকি কথা ।‘’
মহা উৎসাহে বলতে থাকলো,’’ওই প্রেম-টেম আমার কপালে নেই । ইশারা পাই । সাড়া মেলে না শেষে । এমন করেই চলছে আমার জীবন ।‘’
শুনে খিলখিল করে হেসে বলল,’’এটাই তো হয় । তবে মিলেও যায় একদিন । না মিললেও বিয়ের পর খাঁটি প্রেম মিলেও যেতে পারে । তবে সে কপাল ।
 সাহারায় সামান্য সাড়া পেয়ে পুলক এবার এক চিলতে হেসে বলল,’’এবার আপনার পরিচয় কিছুদিন ।‘’
শ্রুতি কিছুসময় চুপ থাকলো । বেশ অবাক হল পুলক । একবার মনে হল,ফোন কেটে দিলো নাকি ?
কিন্তু তারপরেই শ্রুতি একটু চাপা-গলায় বলতে থাকলো,’’আমার আবার কথা । কিচ্ছুটি নেই শোনার । শুধু বলি আমার জীবন আর তোমার দিদির জীবন একইরকম প্রায় । আমিও ডিভোর্সি । চারবছর আগে মাতাল-দুশ্চরিত্র স্বামীকে বিদায় দিয়েছি । আমার পাচবছরের একটা মেয়ে আছে । মা নেই আমার । দাদার সংসারে পড়ে আছি ।‘’
শ্রুতির কথা শুনে পুলক হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ।
প্রায় অস্ফুট-গলায় বলল,’’ইশ... প্যাথেটিক খুব । আমি ভাবতে পারিনি এমন ।‘’

‘’মানে ? কী বলতে চাও তুমি ?’’
শ্রুতি বেশ উত্তেজিতভাবে জিজ্ঞেস করলো পুলককে ।
ওর গলা শুনে বেশ থতমত খেয়ে গেলো । কি উত্তর দেবে ভাবতে থাকলো ।
শেষে আমতা আমতা করে বলল,’’আমার দিদির অবস্থা আপনার । শুনে খুব খারাপ লাগলো । আমি আর ভাবতে পারছি না ।‘’
শ্রুতি একচোট হেসে বলে বসলো,’’আমার কথা শুনে সব আশা ঘুচে গেলো তোমার ? ডিভোর্সি মেয়েরা কিন্তু এব্যাপারটা বেশ বোঝেডিভোর্সি মেয়েদের কানাকড়ি সম্মান নেই সমাজের প্রায় সব পুরুষের কাছে । তুমি তাদের একজন । বাদ দাও । আমিও তোমার দিদির মতোই একজন । তোমাকে ভাই ভেবে নিলাম তবে । কলেজে কোন সমস্যা হলে তুমি আমাকে ভায়ের মতো রক্ষা করতে এগিয়ে এসো ।‘’
তারপরেই শ্রুতি ফোন কেটে দিলো । লজ্জায় একসার তখন পুলক । চেষ্টা করলো শ্রুতিকে ফোনে ধরবার । কিন্তু ওর ফোন বন্ধ হয়ে গেছে ততোক্ষণে ।
খুব হাত ঘামে পুলকের । ও দেখল ফোনটা একেবারে ভিজে গেছে ।
সহসা ওর মনে হল,এ কি দিদি আর শ্রুতির জলে ভেসে গেলো ?
আর ভাবতে না পেরে পুলক দুচোখ বুজে ফেললো । চোখ খুলতেই দেখা গেলো ওর দুচোখ জলে টসটস করছে ।