গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৭

শীলা পাল

এই জীবন

ছোট থেকেই ভবঘুরের মতো মন।হাবভাব কিছুই  মেয়েলি মার্কা ছিল না। যতো ছেলেদের সঙ্গে খেলা দৌড়ঝাঁপ সাঁতার কাটা গাছে চড়া।এমন মেয়ে  নিয়ে তখনকার দিনে  আমার মা বড়ো বিব্রত থাকতেন ছোট গ্রাম যে প্রান্তে  যাই করি ঠিক মায়ের কানে এসে পৌঁছে যায় আলতাফ আমার প্রিয় বন্ধু ছিল সবার সাথে ঘুরে বেড়িয়েছি বনে জঙ্গলে  ওর হাত সবসময়ই আমার হাতে ধরা থাকতো।ও যে ভীষণ ভালোবাসতো আমায়।গ্রামের পাঠশালা থেকে প্রাইমারি স্কুল  তারপরে হাইস্কুল সব এক সঙ্গে পড়েছি কখন যে দুজনের মন বাঁধা পড়ে গেছে বুঝতে পারি নি এমন একটা সময় এলো কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারতাম না
    এবার  এই ব্যাপারটা সব বন্ধুদের মধ্যে ছড়িয়ে গেল সেখান থেকে বাড়িতে খুব শাসন চললো কদিন আমি লক্ষ্মী মেয়ের মতো বাড়িতে থাকলাম  কদিন তার কদিন পরেই জয়েন্টর রেজাল্ট  বেরোল। আমরা দুজনই ডাক্তারিতে চান্স পেলাম
একটা আনন্দ উচ্ছ্বাসের স্রোত বয়ে গেল বাড়িতে আমার সব দোষ মাফ হয়ে গেল কলকাতা যাওয়ার তোড়জোড় ছোটাছুটি তে দিনগুলি হৈ হৈ করে  এগিয়ে গেল। আমাদের দুজনের  যোগাযোগের মাধ্যম ছিল টুকু বলে এক বন্ধু ছোট ছোট চিরকূটে আমাদের বন্ধন কেউ কাটাতে পারেনি।আমরা যেমন ছিলাম তেমনই  আছি।ও কোথায় উঠছে কোথায় দেখা হবে কখন আসবে আমার  কাছে সব জানা আমার
ডাক্তারি পড়ার সময়  আমরা স্বাধীন ভাবে মনের সুখে চলতে থাকলাম বাড়ির  কেউ জানতেই পারলো না আমরা আগামী জীবনের সব প্ল্যান করতে থাকলাম কখনও  একসাথে গ্রামে  আসতাম না।যখন আসত আমি আসতাম না।আমি এলে আসত না।বাড়ির  কেউ কিছু টের পেল না।আমরা শীত গ্রীষ্ম বসন্ত  অনেক গুলো পার হয়ে পাস করলাম একদিন আমাকে বললো সু এবার  তো ভাবতে হবে।ওই নামেই আমাকে ডাকতো।
আমি একটু সময়  চাইলাম বললো ভয় পাচ্ছিস? আমি ঘাড় নেড়ে বলেছিলাম তুই কাছে থাকলে আমি কাউকে  ভয় পাই না।তবু একটু অপেক্ষা করতে চাইছিলাম রেজিস্ট্রি করার  আগে মাকে জানাতে চাই।আলতাফের ইচ্ছে  একেবারে  বিয়ে করে জানানোর ওর বাড়ি আমার বাড়ি  যদি না মেনে নেয়। কোনও দ্বন্দ্বের মধ্যে  যেতে চায় না। আমাদের জীবনের  সব টুকু  আমরাই করবো।কে মানতো কে মানলো না তাতে ওর কিছু এসে যায় না।
একটা গ্রামের  হাসপাতালে  আমরা জয়েন করলাম সার্জারিতে এতো নাম করলো গ্রামের  লোকেরা  ওকে ভগবানের মতো শ্রদ্ধা করত লাগলো এই সময়  এখানেই  আমরা বিয়ে করে নিলাম রেজিস্ট্রি করে।তার আগে মাকে জানিয়েছিলাম মা আশীর্বাদ করে উত্তর  দিয়েছিলেন সুখী হও দুজনে।কিন্তু আমাদের  কাছে  আসার  প্রয়োজন নেই। যেখানেই থাকো আমার  আশীর্বাদ তোমাদের সঙ্গে থাকবে।
খুব কেঁদেছিলাম আমি।একটা জীবন মুছে গেল  চিরতরে।
     আজ আমার  জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আলতাফ আর কখনও  ওর বাড়িতে  যায় নি।ও আমার  জন্য  এই ত্যাগ স্বীকার করেছিল আমরা কোনও  অন্যায় করি নি।মেনে নেওয়া  না নেওয়া সমাজ কে আমরা ভয় পাই নি।এই গ্রামের  সবাই আমাদের সম্মান করে মাথায় করে রেখেছে এখানে বিভিন্ন ধর্মের  মানুষ আছে কিন্তু  তার  ওপরেও আমাদের  সেবার ওরা অনেক  অনেক দাম দিয়েছিল।
     আমাদের  ছেলে মেয়ে  জীবনে প্রতিষ্ঠিত বিদেশে ওরা খুব  ভালো আছে।আজ আমার  এতো কথা লিখতে ইচ্ছে করছে আমার  আলতাফ  আমাকে ছেড়ে  চলে গেল। এবারে আমি সত্যিই  একা হয়ে  গেলাম এখানকার  লোকজন  আমাকে মায়ের মতো মনে করে।বাকী জীবন  কতোদিনের আমার  জানা নেই তবু এরাই আমার  প্রিয়জন  হয়ে থাকবে আমি জানি জন্মান্তর বলে যদি কিছু  থাকে আলতাফ  ঠিক  আমার  জন্য  অপেক্ষা করে থাকবে।