গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৭

মনোজিৎকুমার দাস

ওয়ারিশ                                                                   
                                                                                                                              

পটলার বরাবরই ইচ্ছে,এমন একজন শ্বশুরের মেয়েকে সে বিয়ে করবে,যার কোন পুত্র সন্তান থাকবে না।শ্বশুরের পুত্র সন্তান না থাকলে একদিন সে বিনা কষ্টে শ্বশুরের সহায় সম্মতির মালিক হবে। সে তার মা বিরজাসুন্দরীর মাধ্যমে বাপ শ্রীগোকুল চোকদারকে তার মনের বসনার কথা জানিয়ে দেয়। সে মাকে বলে শ্বশুরের এক মেয়ে থাকলে ভাল হয়, দুই মেয়ে থাকলেও তার আপত্তি নেই। এলাকার নামকরা ঘটক বিরিঞ্চি প্রামাণিক একুনে ঊনচল্লিশটি মেয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয় পটলার বাপের কাছে। কিন্তু একমাত্র পুত্ররত্নের শর্ত্ পূরণ না হওয়ায় ঘটক প্রত্যেকবারই ব্যর্থ্ মনোরথ হয়ে ফিরে যায়।

শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর পটলার বাসনা পূরণ করেন করণকান্দির দুই কন্যার মা  কিরণবালা ও বাবা শ্রীবাসের বড় কন্যা মিতালীরানীর সাথে পটলার পরিণয় সুসম্পন্ন করে। মিতালীরানীকে সুশ্রীবতী বলতে হয়। তাকে বিয়ে করার পর পটলা ওরফে পটলকুমার চোকদার ডিএম কোর্টের চাপরাশি চাকরী পাওয়ায় সে ভাবে,তার বউ মিতালীরানী বেজায় পয়মন্ত। বছর তিনেক যেতে না তার বউ তাকে একটা পুত্র সন্তান উপহার দিলে পটলা বউয়ের উপর বেজায় বেজায় খুশি হয়। তখন পটলার মনে খুশি আর ধরে না!

শ্বশুরের অগাধ সহায় সম্পত্তি, একমাত্র শালিকা কমললতা দিনে দিনে বিয়ের বয়সী হয়ে উঠছে। দেখতে শুনতে কমললতা মিনতিরানির চেয়ে সুন্দরী। পটলকুমার মানে আমাদের পটলা ভাবে, দিনে দিনে কমললতা যেন নববর্ষার জলের কলমির মতো লাবণ্যময়ী উঠছে। কী সুন্দর মুখশ্রী, দেহবল্লরী যেন তন্বীতনুলতার মতো। এক সন্তানে মা মালতিলতার পাশে কমললতা দাঁড়ালে পটলার ইচ্ছেই হয় না নিজের বউয়ের দিকে তাকাতে। তার মনে শংকা জাগে কমললতার অন্যত্র বিয়ে হলে শ্বশুরের সম্পত্তির একজন ভাগীদার জুটবে। বিষয়টা ভেবে পটলার কপালে বলিরেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে মনে মনে ফন্দি আটতে থাকে।

এদিকে, মালতিরানী আবার সন্তান সম্ভবা হয়। সাত মাস চলছে। আলট্রাসনো করে পটলা জানতে পারে, এবার তার বউয়ের কন্যা সন্তান হবে। সোয়ামির মুখ থেকে খবরটা শুনে মালতিরানীর মনটা খুশিতে ভরে ওঠে এই ভেবে একটা ছেলের পিঠে একটা মেয়ে! ভগবান তার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। কিন্তু পটলা কন্যা সন্তানের কথা শুনে মোটেই খুশি নয়, খবরটা শোনার পর পটলার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হয়। সে রাগের মাথায় বউকে বলে, ' প্যাট খালাস করে ফেলতি হবি, মদনার বউ প্যাট ফেলানোর-------' সোয়ামীর কথা শুনে মালতিরানী তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে সোয়ামীকে গালিগালাজ করতে থাকে। পটলাও বউকে মাগীছাগী, এমনকি বউয়ের বাপমাকেও গালমন্দ করতে কসুর করে না।

পটলার পেয়াতি বউ বাপের বাড়ি চলে যায় তার পরদিনই। বাপের বাড়ি গিয়ে মালতিরানী ভাবে, তার যদি একটা ভাই থাকতো তবে সে সবচেয়ে আহ্লাদিত হতো। সে সোনাইমুড়ি স্কুলে দশ ক্লাসে উঠেছিল সে সময়ই বাবা সকলের অমতেই তাকে পটলকুমার চোকদারের সাথে এককাড়ি টাকা,মটর সাইকেল বরাবরণ বরশয্যা দিয়ে জামাই করে ঘরে আনে। মালতিরানী ভাবে, তাদের মা বাবার বয়সই বা কত! এখনো যদি তাদের একটা পুত্র জন্মাতো তবে একদিন তার ভাই শাস্ত্রীয় বিধিবিধান পালন করতে পারতো। সোনাইমুড়ি স্কুলের পণ্ডিতমশাই বলতেন, ' পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা! পুত্রই একমাত্র পিতার পিণ্ডদান করার অধিকারী।সেই পুত্রই তার বাপের কপালে নেই। কথাটা ভেবে মালতিরনীর বড়ই দু:খ হয়।

 এদিকে, মিনতিরানীর সোয়ামী পটলার মনে অন্য ভাবনা কাজ করতে থাকে। পটলার বন্ধু সুনীতকুমারের শ্বশুরের পুত্র সন্তান নেই। দুটোই কন্যা সন্তান। পটলা ভাবে, সুনীত বড়ই ভাগ্যবান! সে গত বোশেখে তার ছোট শ্যালিকা চম্পকলতাকে বিয়ে করে শ্বশুরের সমস্ত সহায় সম্পত্তির অধিকারী হওয়ার পথ সুগম করেছে।  সুনীতের বড় বউ শ্যামাবতী ছোটবোন চম্পকলতাকে সতীন হিসাবে মেনে নিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে সংসার করছে।

পটলা প্রায় প্রায়ই সুনীতের সাথে ঘুজুরঘুজুর ফুসুর করে। সুনীত পটলাকে যুক্তি দেয় কমললতাকে বিয়ে করে শ্বশুরের সম্পত্তি ভাগাতে। মালতিরানীর ভয়ে পটলা কথাটা শ্বশুর শাশুড়ির কাছে পাড়তে সাহস করে না। সে সুনীতকে বলে,' আমি তোর বৌদি মাগিকে বসে আনতে পারবো নানে।তোর বউটা তো তোর নেওটা! যা কলি তাতেই হু।'

বউ ভরা পোয়াতি, পটলা কিন্তু ভুলেও শ্বশুর বাড়ি মুখো হয় না। বউয়ের উপর তার রাগের কারণ: সে তাদের পাড়ার মদনার বৌয়ের দিয়ে বউয়ের পেটের বাচ্চাটাকে খালাশ করতে চেয়েছিল কিন্তু বউ সেদিকে পা বাড়ায় না।

ঈশ্বর কেন যেন পটলার ইচ্ছেকেই পূরণ করলেন আট মাসের শেষ দিকে মালতিরানীর গর্ভপাত হওয়ায় সোয়ামীর হাত থেকে নিষ্কৃতি পেল। অসুস্থ শরীরে মালতিকে বাপের বাড়ি থেকে বাড়ি ফিরে এসে সোয়ামীর রণচণ্ডী রূপ দেখে মালতি আতঙ্কে উঠে। এটাই মোক্ষম সময় বুঝে পটলা বউকে বললো,' কমললতাকে সাথে আনোনি ক্যানে। নিজির তো এহন কোনই মুরোদ নেই। কমললতাকে সাথে আনলি কাজ কাম করে দিতি পারতো!'                                                                                                সোয়ামীর কথার জবাবে মালতি মিনমিনে গলায় বললো,' তার পড়াশোনা আছে না। কমললতা তুমার শালী। সে ক্যানে আমাদের সেবাযত্ন করতে আসবি।'                                                                             বউয়ের কথা শুনে পটলা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললো,' সুনীতের শালী ক্যানে তার দিদির ওখানে থাকতো? এক সময় তো ওর দিদিই তার বাপকে বললো, "চম্পকলি'র বিয়ে জন্য পাত্র না খুঁজে ওকে তোমার বড় জামাই সুনীতে সাথে বিয়ে দিলে ভাল হয়। আমরা মিলেমিশে থাকবো,তোমার অগাধ সম্পত্তির অন্য ভাগীদার কেন আনবে?"

সোয়ামীর কথা শুনে মালতি বুঝতে পারলো তার মতলবটা। ' সম্পত্তি লোভে। তুমার বউ নিজের একমাত্র বোন কমললতাকে সতীন বানাতে পারবে না জেনে রেখো তুমি! আমি বাপের সম্পত্তির জন্য লোভী করতে যাবো কোন দু:খে। মনে রেখোসুনীতের বউয়ের মতো আমি লোভনেই।’                                                                                                                     ' এক সময় এক কথা দুই কথা তাদের দুজনের মধ্যে ঝগড়া চরমে উঠলে পটলা যাচ্ছেতাই বলে সোয়ামীকে গালিগালাজ করতে শুরু করলো। মালতিও কম যায় না।                                        ' তুমার মতো লোভী পুরুষের ভাত খেতে আমার বয়ে গেছে!'



পটলা অবস্থা বেগতিক দেখে সুনীতের শ্মরণাপন্ন হলো। সুনীত সবকথা শুনে পটলাকে বললো, ' কৌশল বদলাতে হবে বুদ্ধু। ভালবাসার ভান করে কার্যসিদ্ধি করা লাগবে। বউকে এমন ভাবে আদর সোহাগ করতে হবে যাতে তোর বউই একদিন নিজেই প্রস্তাব দেবে কমললতাকে তোর সাথে বিয়ে দিতে। আমার বউকে দেখে তুই কিছু শিখতে পারিস্ নি। বাড়ি যাওয়ার আগে তুই তোর বউ এর জন্য শাড়ি,ব্লাউজ  দামী পাউডার সেন্ট এমনকি ৩৪ ,৩৫ সাইজের ব্রাও গোটা তিনিক কিনে নিয়ে বাড়ি যাবি। গঞ্জের রসময় ময়রার রসমালাই ও খিরের চমচম নিতে কিন্তু ভুলিস্ নে।কথাগুলো বলে সুনীত ফিক করে হেসে ফেলে।

সুনীতের হাসি দেখে পটলার বেজায় রাগ হয়। সে তার বন্ধু সুনীতকে বলে, ‘ আমি মরছি আমার জ্বালায় , আর তুই------’   পটলার কথা শেষ করতে না দিয়ে সুনীত আবার মুখ খোলে,‘ আদর সোহাগে বউয়ের মন জয় করবি।  ভরণপোষণ আর আদর সোহাগ করলেই মেয়ে মানুষ কুপোকাত। আর আমার মালতি বউদি তো তোর নেওটা , তা তো আগাগোড়া আমার জানা।

সুনিতের বলা নতুন থেরাপি প্রয়োগ করতেই যেন মালতি সোয়ামী কথায় উঠবস করতে শুরু করলেও একদিন মালতিরানীর মনে হলো, তার ধুরন্ধর সোয়ামী নতুন কোন মতলব ফাঁদছে না তো!

মোবাইল ফোনটা হঠাৎ নষ্ট হওয়ায় সে তার ছোট বোন কমললতার সঙ্গে কথা বলতে পারে না। পাশের বাড়ির মিঠুন মোবাইল ফোন মেরামত করে, তার কাছেই মালতি ফোনটা সারাতে দিয়েছে। মিঠুন সম্পর্কে দেওর হয়।
সোয়ামীর ফোনে কমললতার সাথে কথা বলতে মালতির ইচ্ছে করে না। মালতি বুঝতে পারে কমললতার উপর তার সোয়ামীর নজর ভাল না। মায়ের সাথে মালতির কথা বলতে সব সময়ই ইচ্ছে করে। দিনের পর দিন গড়িয়ে যায়। মালতি ভাবে , তার মেয়েটা বেঁচে থাকলে এতদিনে ছয মাসে পড়তো।
সেদিন সন্ধ্যায় মিঠুন মোবাইলটা মেরামত করে মালতিকে ফেরত দিয়ে গেছে। ওই দিন সন্ধ্যার পরে ফোনে রিংটোন বেজে উঠলে মালতি ভাবে, কমললতা না হয়ে পারে না। সত্যি কমললতা!
ফোন রিসিভ করলে কমললতা যা বলে তা শুনে মালতি আনন্দে যেন আত্মহারা হয়ে পড়ে।ফোনের ও প্রান্ত থেকে কমললতা বলে,' আমাদের ভাই আসছেরে দিদি!' ছোটবোনের কাছ থেকে সব কথা শুনে মালতিরানীর আনন্দ আর ধরে না। তাহলে শেষ পর্যন্ত আমাদের বাপের সম্পত্তির একজন ওয়ারিশ আসছে!

পরক্ষণেই তার মনে পড়ে তার লোভী সোয়ামীটার মুখ,যে কিনা শ্বশুরের অগাধ সম্পত্তির মালিক হওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। এই খবরট জানার পর কী লঙ্কাকান্ডই বাঁধাবে সে তার সাথে, তা ভেবে মালতি আতঙ্কিত হয়!