নদীর
মত
এখানে এভাবে কতক্ষণ শুয়েছিল খেয়াল নেই। ঠান্ডা
বাতাসে হাত-পা হিম হয়ে গেছে। নারকেল তেল দেয়া চুল গুলো জমে
শক্ত হয়ে আছে। হাঁটু অব্দী পা জলে ডুবানো, দেহের
বাকি অংশ ডাঙ্গায়। বরাবরই জিন্স প্যান্ট অপছন্দ তার। কাঠ-খোট্টা, শক্ত, খসখসে কোনও পোষাক-ই পছন্দ
নয়। কতগুলো দেশে যে থাকা হ’লো, তবুও ভালোলাগার এতটুকুও
রদবদল হলো না। আজও পাঞ্জাবী, ফতোয়া, পায়জামা
জাতীয় নরম পোষাকেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। প্যান্ট পরে পাতলা প্যান্ট-পিছ কিনে দর্জীর দোকানে বানিয়ে। সুদর্শন অহং-কে
কেউ কখনো টি-শার্ট কিংবা ফ্যাশণেবল পোষাকে দেখেনি। তার চোখের
কান্তিকে অনেকটাই আড়াল করে রেখেছে তার চশমা। রোদ চশমার মত ফটোক্রোমাটিক গ্লাস ব্যবহার
করে তার চশমায়।
বিরাট এক ঝাঁকুণিসহ হাঁচি দিয়ে, দেহটাকে দুই ভাঁজ করে দু’পায়ে ভর করে দাঁড়িয়ে পড়ে অহং। এবার বাম হাতের
আঙ্গুল গুলো দিয়ে কোমরের বা’ দিকটা চেপে ধরে, ডান
পা’ টা তীর্যক করে চমৎকার কৌশলে দাঁড়িয়ে; কোকড়া চুল গুলোতে ডান হাতে আঙ্গুল চালায়। নদীর সাথে আজ আর কথা বলা হলো না, তার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে নদীর তট ঘেঁষে। প্যান্টের ভেজা অংশটুকুকে চিপে পানিটা
ঝরিয়ে নেয়, তারপর দু’হাতকে
বুকের উপড় দিয়ে ক্রস চিহ্নের মত করে দু’কাঁধ চেপে ধরে অনেক দূর
পর্যন্ত হেঁটে যেতে থাকে।
মেয়েটা যেন কেমন! ধরা
যায়না, ছোঁয়া যায়না, আবার
কেমন এক অলখ মায়ায় জড়িয়ে রাখে তার প্রতিটি ক্ষণ। -“নম্রতা, তুমি কেমন আছ?” বিড়-বিড়
করে বলে ওঠে অহং। নদীকে এবার পেছনে রেখে খানিকটা সামনে এগিয়ে যায়। আচমকা দমকা হাওয়ায়
টাল সামলাতে পারে না তার দেহ। বাতাসের বেগ কটির বা’ পাশটাকে
একদিকে ঠেলে নিয়ে যায় অনেকটা দূর। কি মনে করে পেছন ফিরতেই দেখে- নদীতে ভাসমান কার গাঢ় নীল শাড়ি। ও কী! কে
ওখানে ভেসে? কোন মহিলা? মেয়ে? নাহ! তা কেন হবে? একটা
মাটির চাকা নিয়ে ঢিল ছুঁড়তেই ছল্কে ওঠে নদীর ঢেউ। ভেসে ওঠে নম্রতার ভেজা বুক।
আশ্চর্য! নম্রতা! এখানে? দমকা বাতাস ছুঁয়ে দিয়ে যায় নম্রতার শাড়ি। জলের ঘূর্ণির দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে
অহং দেখে- নম্রতার হাসি মাখা মুখ, লাজুক হাসি, টলটলে চোখ অহংকে দেখছে।
–“ নম্রতা!”
অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করেই এক রাশ হতাশায় নিমজ্জিত
হয়ে পড়ে অহং এর মন। নম্রতাকে সে এখানে কেন খুঁজছে? নম্রতা
তো এ দেশে আসার কথা নয়! অহং থাকে অনেক দূরের দেশে। বাংলাদেশ থেকে অনেক
দূর সে দেশ। যে দেশে কখনো কোন বাঙ্গালী রমণী কন্ঠ-ও ভেসে
আসে না ফোনে। কত রাত কান পেতে শুনতে ইচ্ছে হয়েছে কোন বাঙ্গালী নারীর হাতে পরা রেশমী
চুড়ির রিণি-ঝিণি। ভেবে সুখ পেতে চেষ্টা করেছে কোনও কোমল হাত
রেশমি চুড়ির ছন্দ তুলে লিখছে তাকে প্রেমের চিঠি। দীর্ঘ সে চিঠি!, যেখানে মায়া মমতা ভালবাসা দুষ্টুমী ভরা অনেক কথার সমাবেশ। বহু
রাত বিছানায় শুয়ে চিঠি পড়েও যে চিঠি পড়া শেষ হয়না।
কালকের পাওয়া ই-মেইলটা
ঠিক তার মনের চাওয়ার মত। এত সুন্দর করে কিভাবে ই-মেইল
লিখে মেয়েটা!?!হঠাৎ করেই এই পাঠিকার আগমণ তার জীবনে। প্রবাস
জীবনের নিঃসঙ্গতা, নম্রতাকে না পাওয়ার যাতনা আর বহুসংখ্যক সদস্য
বিশিষ্ট নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় সন্তানের কঠোর পরিশ্রম আর বিত্তবান হওয়ার কঠোর
সংগ্রামের এই নিরলস জীবনে এতটুকু মিষ্টতার যোজন ছিলোনা। কত দিন অফিসের টেবিলে মাথা
নিচু করে ডুকরে কেঁদে ওঠেছে এই শুষ্ক জীবন-যাপনের
দিন ক্রমের কথা ভেবে। আশ্রয় খুঁজেছে সাহিত্যের আখড়ে। বাইরে কন্টকময় প্রকৃতি, অচেনা মানুষের ঢল আর এই সব বৈরিতার মাঝে সেই ভক্ত পাঠিকার ই-মেইলগুলো যেন ফুলেল সুবাস। আফ্রিকার পাহাড়কাটা অসুন্দর মুখাবয়বের মানুষদের ভীড়ে
সৌন্দর্য্য বলতে যা দেখেছে তা হলো নারীদের স্ফীত বক্ষ। বিশাল সুবক্ষা একেকজন কালো নারী।
তাদের গায়ের বর্ণেও এক ধরনের আকর্ষন রয়েছে ধরে নিয়েছে অহং। আসলে একটা কিছু ভেবে সময়টা
কাটিয়ে দেয়া, মানিয়ে নেয়া- এই
আর কি! সদ্য যৌবণপ্রাপ্ত ওদের অনেক তরুণীকেই সে দেখেছে
খোলা বুকে ঘুরে বেড়াতে।কিন্তু নম্রতার চমৎকার বক্ষ অহং ভুলতে পারেনা। প্রায়-ই ইচ্ছে হ’তো মোটর সাইকেলে নম্রতাকে পেছনে বসিয়ে পংখীরাজ
ঘোড়ার মত ছুটে চালাবে আর নম্রতা তার পিঠে মাথা এলিয়ে দিয়ে তাকে পেছন থেকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে যখন বসে থাকবে, তখন সে নম্রতার বুকের
উষ্ণতা নেবে। নম্রতার এলো চুলের ঘ্রাণে মৌ-মৌ
করবে তার চারপাশ। আহ! সেই সুখের দিন গুলো কি আদৌ আসবে তার জীবনে? ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখের কোল বেয়ে শৈত্যাশ্রু গড়িয়ে পড়ে, খেয়াল থাকে না।
অফিসে বাঙ্গালী দ্বিতীয় আর কোনও পুরুষও নেই যার
সাথে গল্প করে সময় কাটাবে। অগত্যা সাপ্তাহিক ছুটির দিন গুলিতে অহংকে ছুটে যেতে হয় মিশনে
আসা সেনা বাহিনীর লোকদের কাছে। ওখানে বাঙ্গালী যে কয়জন সেনা অফিসার পায় তাদের সাথে
বাংলায় কথা বলে, গল্প করে মনটা হাল্কা করে। আজ অফিস থেকে সবাই
আনন্দভ্রমণে বাইরে বেরিয়েছে। অহং এদের খাবার খেতে পারেনা। সব খাবারই এত কোলেষ্টেরলযুক্ত
যে অল্প ক’দিনেই হাল্কা পাতলা অহং মুটিয়ে গেছে। ভূট্টার
স্যুপটায় চুমুক দিতেই চামচের সাথে নিজ ঠোটের স্পর্শে এক ভিন্ন অনুভূতি হ’লো তার। নম্রতার ঔষ্ঠ্যের ছোঁয়া-ও কি এমন-ই উষ্ণ আর মধুর? খুব ধীরে চুমুক দিতে-দিতে
ভাবনার অতলে ডুব দিলো সে।
বিশাল বপুর কেনিয়ান বস খেয়াল করছিলেন তার অফিস-কর্মচারী মিনহাজুল আবেদীন উরফে অহং কিছুটা আনমনা। ছলকে গেলো অহং এর হাতে ধরা
স্যুপের চামচ থেকে স্যুপের কিছুটা। ফিরোজা রঙের চমৎকার ফতোয়াটির মাঝ বরাবর গড়িয়ে গিয়ে
একটি শীর্ণা নদীর রেখা তৈরী হ’লো অহং এর বুকের মাঝ বরাবর। জলের রেখার দিকে চোখ
পড়তেই মনে পড়ে গেলো, আজ নদীর কাছে যাওয়া হয়নি। নম্রতার বুকের শীর্ষতা
পরখ করার নেশা আর মায়াবী তীর্যক হাসির প্রান্ত ছুঁয়ে এখন অহং এর অস্থিরতা বাড়ছে। অন্য
আর কিছুই ভালো লাগছেনা। একটু পরে শুরু হবে নাচের উৎসব। এরা এক অদ্ভূৎ জাতি! অফিসের এক কর্মচারীর মৃত্যু হয়েছে গতকাল। তারই শব দেহকে ঘিরে মৃতের আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুরা মিলে আনন্দ নৃত্যের আয়োজন করেছে। মৃত্যুটা ওদের কাছে মহাপ্রস্থানের
এক আনন্দের বিষয়, আর তাই নিয়েই তাদের এই মহা উৎসব। মশালের আলোক
বিন্দুগুলো ক্রমে ঝাপসা হয়ে এলো। অগ্নিকুন্ডটা স্পষ্ট হতে থাকলো দাউ-দাউ আগুনে। সম্মিলিত স্বরে গানের সুর ভেজে-ভেজে
শব দেহ পুড়াচ্ছে ওরা।
সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে অহং এগুচ্ছে তার গন্তব্যে।
নদী-পথটা এখান থেকে খুব কাছে ও নয়। কিন্তু কি এক অমোঘ টানে হেঁটে
যাচ্ছে সে নদীর ঠিকানায়। বুকে ঝড়, শরীরের পরতে পরতে জ্বলছে কামনার তীব্র বাসনা।
অগ্নিকুন্ডের লেলিহান শিখাটা উস্কে দিয়েছে অহং এর দেহের ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি। মধ্য রাতের
চাঁদ নদীর বুকে দুলছে, হাসছে, দেখছে
তাকে। চাঁদের স্ফীত বুক থেকে গলে গড়িয়ে পড়ছে সাদা জ়োছনার আলো, যেন আকাশ থেকে এক কলস দুধ ঢেলে দিচ্ছে নম্রতা। এক টানে কোমরের ব্যাল্টটা ছুঁড়ে
ফেলে দিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো অহং নদীর বুকে।
এইতো, এইতো
নম্রতার চোখ, টানা জোড় ভ্রু, দীঘল
চুল, চিকন কোমর, নিতম্ব, পেলব
ঠোঁট ছুঁয়ে মধুর হাসি…… “আহ্ নম্রতা! তোমার
বুকের স্পর্শ পাচ্ছি, আমাকে জাপ্টে ধর প্রিয়তমা! ডুবে যেতে দাও আমার সমস্ত আমিত্ব। আমি আজ হারাতে চাই। ভেঙ্গে চুরে দিতে চাই
তোমার সকল জড়তা আর আড়ষ্ঠতা। আমাকে নাও, তোমার ভেতরে নাও, আরো গভীরে নাও! নিবির করো আরও…..”
চাঁদের রশ্মিগুলো বালুকণার মত চিক-চিক করে উঠলো জলের উপরিতলে। ফিরোজা রঙের একটি ভাসমান বস্তুর উপর সমস্ত আলোর
অভিক্ষেপ পড়ে রাতটিকে করুণ বেহাগ রাগের সুরে কাঁদালো।