গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৬

রুখসানা কাজল

মেলা

নিজেই থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর দেখছি। এটা আমি পারি। বাপি হচ্ছে হাতুড়ে ডাক্তার। আসলে ওষুধের ব্যবসায়ী। কি করে কেন যেন সবাই ডাক্তার বলত কে জানে। ব্যাপক পসার । তাতে কি আমার মা কখনো বাপির ওষুধ খেতো না। কিছু হলেই রমানাথ কাকুর কাছে চলে যেত। লেজ ধরে আমরাও।তারপর চৌ আমি ভাইয়া আর মা রমানাথকাকু আর কাকিমা হিরণ্ময় সময় ছিল আমাদের।

কালিপূজোর মেলা ছিল  আমাদের শহরের প্রাণ । সবাই ঘুরছে , কিনছে , খাচ্ছে , খেলছে , দেখছে আমার জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। গত বছরের মেলার রঙ্গিন হাঁড়ি , মা পুতুল, ঘোড়া নীলগরু কাগজের কুমির  মা আমার বিছানার পাশে রেখে দিয়েছে। জিলিপি এনেও খাইয়েছে। কিন্তু আমি খ্যানখ্যান করে কাঁদছি , এগুলো পুরনো এগুলো পুরনো!সবাই বুঝি সব কিনে ফেললো। মাও ঘুরে এসেছে মেলা। একগাদা কাঠের খুন্তি চামচ, মসলা রাখার খোপ খোপ প্লেট, বাটি কিনে হেসে হেসে দেখাচ্ছে ফুপিকে । জ্বরের মাতালে কখনো দেখছি কখনো চোখ বন্ধ করে শুনছি। অন্ধকূপের  মোটর সাইকেল চালানো লোকটা আমার মাথার ভেতর ঘুরছে। গান বাজছে , এক হৃদয়হীনার কাছে হৃদয়ের দাম কি আছে 
---
মাথা ধুইয়ে মা বলছে, এই ত জ্বর কমেছে। কাল সিওর যেতে পারবে মেলায়। আমি সারারাত ঘুমের ভেতর মেলায় ঘুরি। সার্কাস পুতুলখেলা, নাগরদোলা আমার ভাল লাগে না। বিশাল জায়গা নিয়ে যাত্রা প্যান্ডেল। অনেকেই চোরা পথে যাত্রা দেখে। একবার দিনের বেলায় আমরাও ঢুকেছিলাম । খা খা করছে প্যান্ডেল । মাথার উপর  ঝুটি বাঁধা সামান্য কতগুলো মেয়ে বসে বসে গল্প করছে। কতগুলো ছেলে তেল মাখছে গায়ে। জেফরুল আমাদের দলে বড়। ও বল্ল এরাই রাতে পরি হয়ে যায়। আর অই যে চুলওয়ালা ছেলেটা ও বিবেক হয়। এমনিতে ঘোষের দোকানে মিষ্টি কাটে। আমি কোনদিন যাত্রা দেখিনি। একটু রাত হলেই ঘুমিয়ে যাই। তখন কে বয়ে আনে! মা তাই আমাদের রেখে দলবেঁধে চলে যায় সিঁদুর নিও না কেড়ে, জোশআলেয়া দেখতে। পরদিন বিকেলে আমাদের পাকা উঠোনে সেই যাত্রাপালার গল্প হত। সবিতা কাকিমা বলত চুলগুলো নকল আমি হলপ করে বলতে পারি। পারভিন আন্টি বলে উঠত, নারে সবিতা আসল চুল। ইসস ওরকম চুল যদিআমার হতমা কায়দা করে নিজের হাঁটু পর্যন্ত চুল আলগোছে ছড়িয়ে দিয়ে বলত, চুল হচ্ছে বংশগত। আলেয়ার শাড়ি দেখছ ভাবি! রমলা পিসি উস্কে দেয়, মার চোখ চকচক করে উঠে,কোথায় পাওয়া যাবে বলত!এরমধ্যে আজান ভেসে আসত। সবিতা কাকিমা রমলা পিসি উঠে পড়ত। আর কিছু পরেই শোনা যেত শাঁখের দমবন্ধ সুর ঝলক ঝলক ঘন্টা ধ্বনি।আমাদের ঘরে ধূপ ধুনো আগরবাতির গন্ধ।

মা আমার চায়নিজ কাট্‌ উলুঝুলু চুল ভাল করে আঁচড়ে দিয়ে জামা বাছাই করছে। আমার কত যে জামা। সব লাল কমলা। মার সাথে বেরুলেই কেউ কেউ আফসোস করে, এহে এই মেয়ে বিয়ে দিতে কত টাকা যে লাগবে। ছোটমেয়েটাই কালো কুচ্ছিত হলো! ব্যাড লাক বউমা! মা রেগে মেগে তাদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিতো কিছুদিন

জামার পকেটে কিছু টাকা লুকিয়ে দিয়ে দেয় মা। তোমার যেটা খুশি তাই কিনো কেমন! বাপির হাত ফস্কে আমি উপুড় হয়ে বসে পড়ি মাটির হাঁড়িপাতিল পুতুল গরুর দোকানে। বাপি বাপি সব নেবো সব। নাও নাও ওরে ও অখিল এইসব কিন্তু আমার ছোটকন্যার। দোকানকাকু লাল গামছায় মুখ মুছে বলত, সব তোমার মা জননী। তুমি দুই হাত ভরি নিয়ি যাও ত দিখি।


আমি চোখের জল চশমার কাঁচে ঢেকে দোয়েল চত্বর চষে ফেলছিঅই লাল, হলুদ, সবুজ, কালো রঙের সরলফুলতোলা মাটির হাঁড়ি পাতিল, লালগরুর কালো লেজ,পেটের সাথে জড়ানো বাছুর, নীল গরুর কালো চোখ আর কাগজের কুমিরের ঘুচঘুচ চলা আমার যে চাই। আমি মানুষ হতে চাই। হিন্দু কি মুসলিম, খৃষ্টান বা ইহুদী কিচ্ছু না কিচ্ছু না।