গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৬

শমিতা চট্টোপাধ্যায়

তিতলির বৃষ্টি
     
    আমার বয়েস তখন ছয় বছর। এইতো কদিন আগেই পাঁচ পেরিয়ে ছয় বছরের জন্মদিন পালন হল। বিরাট কেক, মোমবাতি, সারা বাড়ি আলো দিয়ে সাজানো হয়েছিল। এখনও মনেআছে, আমার বন্ধুদের চেয়ে মা- বাপির বন্ধুই বেশি এসেছিল। হল জুড়ে ওদেরই কথাবার্তা, হৈ চৈ ---আমি তো আমার কয়েকজন বন্ধু নিয়ে ওপরের ল্যান্ডিং-এ আমার খেলনা নিয়ে সোনামাসীর তত্বাবধানে। সোনামাসি আমায় ভালবাসতো খুব। জামাকাপড় পরিয়ে দেওয়া,  ইস্কুল যাবার সময় মাখন ভাত দিম সেদ্ধ দলা করে মুখে গুঁজে দেওয়া, বিকালে বাগানে বেড়ানো, খেলা সবই করত। যেদিন যেদিন বাপি মা পার্টিতে যেত,অত বড় বাড়িতে আমি আর সোনামাসিই তো থাকতাম। রাত হয়ে যেত, মা বাপিরা আসছে না দেখে আমার খুব কান্না পেত। তারপর ফিরেও তো দুজনে ঝগড়াঝাঁটি চলতো, আমাকে গুডনাইট বলার জন্য এ ঘরে আসত একবার শুধু, তবে দুজনেই যেন কেমন অন্য রকম! ---মুখদিয়ে কি বাজে গন্ধ,সোজা দাঁড়াতেও পারত না, আমি খুব ভয় পেতাম। তখন সোনামাসি আমাকে জড়িয়ে বুকের মাঝে নিয়ে ঘুম পাড়াতো।

         আমার ঘরের একদিকে একটা বিরাট জানালা ছিল। প্রায় সারা দেওয়াল জুড়েই সেই জানালা। ভারী একটা পর্দা ঝুলত, বাইরের আলো হাওয়ার যেন সেখানে ঢুকতে মানা। এক একদিন বিকালে আমার যখন কিছু ইচ্ছে করত না, বাগানে যেতেও না, তখন আমি সেই জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কত সময় কাটাতাম। বাইরে একটু দূরে কি সুন্দর সবুজ ঘাসে ঢাকা একটা বিরাট মাঠ, একপাশে সার দিয়ে কৃষ্ণচূড়াগাছ --- বসন্তে লাল হয়ে থাকত। আর মাঠের ও পারে ছোট ছোট মাটির বাড়ি টিনের বা টালির চালের সার সার ঘর। বিকেল বা দুপুর --  কোন সময় নেই,সব সময়ই ওখান থেকে পিলপিল করে বাচ্ছারা এসে ওই মাঠে খেলা করত। আবার বড়রাও জটলা পাকিয়ে জায়গায় জায়গায় বসে গল্প করতো। সোনামাসী বলত, ওদের বাড়ি পাখা, এসি এসব কিচ্ছু নেই, তাই নাকি ওরা ভগবানের দেওয়া গাছের হাওয়ায় ওরা শরীর জুড়োয়।

          যখন বৃষ্টি হতো কাল বৈশাখী ঝড়ের পরে,----সারা মাঠ জুড়ে জল ছপছপ --- বাচ্ছারা তখনও ভিজে ভিজে খেলতো। ওদের মা বাপিরা কি ভাল, কখন কোন কিছুতেই মানা নেই। আর আমি একটু বৃষ্টিতে ভিজিওনি, শুধু একটু হাত বাড়িয়ে জল নিতে গেছি, অমনি মায়ের বকুনি, নয় সোনামাসীর শাসন --- একদম ভিজবেনা,জ্বর শরীর খারাপ হলে ইস্কুল কামাই হবে --- উফঃ! আমার তো কনোদিন বৃষ্টিতে ভেজাই হয়নি।

        একদিন দুপুরে খুব বৃষ্টি। মা নিজের ঘরে,রান্নার মাসী পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছে, আর সোনামাসী আমার ঘরে দিব্যি ঘুমিয়ে পরে আছে কার্পেটের ওপর। ব্যাস, এই সুযোগ, দরজা খোলা পেয়ে আমিও সোজা ঐ মাঠে এসে পৌছালাম। সবুজ মাঠ, ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। একদল আমার বয়েসী ছেলেমেয়ে ছুটোছুটি করে  খেলছে। আমিও লাফাতে লাফাতে ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম একেবারে মাঠের মাঝখানে। কিন্তু আমাকে দেখেই ওরা খেলা থামিয়েএক জোট হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। আমি বললাম, এসো না, আমিও তোমাদের সাথে খেলবো। আমার নাম তিতলি, তোমাদের? অমনি ওরা আরও একটু দূরে সরে গিয়ে অবাক চোখে আমায় দেখতে লাগলো। আমি বললাম, এসো এসো, আমি তোমাদের সাথে খেলতে এসেছি। চটপট একটু খেলেই আমি চলে যাব। আমার মা আর সোনামাসী ঘুমাচ্ছে, ঘুম ভেঙে, আমি এখানে এসেছি জানতে পারলে খুব বকবে আমায়।

      কেউ সেদিন এগিয়ে এলনা আমার সাথে খেলতে, জানো? শুধু ওদের মধ্যে থেকে একটা বড় ছেলে এগিয়ে এসে কি বাজে করে রুক্ষ ভাষায় আমার সাথে কথা বললো। শোনো, তোমার সাথে আমরা কেউ খেলবোনা। তোমরা তো অনেক বড়লোক, তোমার বাবা একদল লোক নিয়ে এসে কদিন ধরে আমাদের বস্তিতে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। বস্তি খালি করতে হবে। তাহলে আমরা কোথায় যাব? আমাদের বাড়ি ভেঙ্গে দেওয়া হবে, সেখানে নাকি অনেক বড় বড় দোকান হবে, তাকে নাকি মল বলে। এই আমাদের খেলার মাঠটাও আর থাকবেনা, সেখানে এত্ত উঁচু উঁচু বাড়ী হয়ে যাবে। আমাদের বাড়ির বড়রা তো বটের তলায় রোজ সন্ধ্যে বেলা মিটিন করছে। একটা কিছু করতে হবে। আমাদের বাড়ি ভেঙ্গে দিলে আমরাও ছাড়বোনা ---- এবার তাহলে আগুন জ্বলবে। তুমি আমাদের বন্ধু হতে পারোনা, তুমি চলে যাও নিজের বাড়িতে। এই মাঠ আমাদের, আমরা এখানে যেমন খুশি থাকি, খেলি, আমাদের কেউ কিছু বলেনা।
        
আমার চোখ ফেটে সেদিন জল এসেছিল। আমি থমকে দাঁড়িয়ে ঐ ছেলেটার কথা শুনেছিলাম ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে। আমার চোখের জলের সাথে বৃষ্টির জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল।আমি ফিরে এসেছিলাম একটা অপরাধ বোধ আর লজ্জা নিয়ে। আমি আর কোন দিন ঐ জানলার পর্দা সরিয়ে সবুজ মাঠ দেখিনি, ---- আমি আর কোনদিন বৃষ্টিতে ভিজিওনি।