গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৬

মুস্তাইন সুজাত

দেবুদা এন্টারপ্রাইজ


এক

মুকুন্দপুর নেমে প্রথম কাজটা ছিল, মোটামুটি মানের একখানা গেস্ট হাউস খুঁজে বের করা । বাইপাস থেকে মুকুন্দপুরের দিকে নেমে আসা রাস্তাটা ধরে ডানহাতে হাসপাতাল রেখে তিন দিকে সারি সারিদালান-বেশিরভাগ দু’তলা থেকে পাঁচতলা ।অচেনা জায়গা । তাই কিছুক্ষনঘুরে খোঁজখবর নিয়ে অবশেষেঅরুনোদয়গেস্ট হাউজেউঠলাম । ক্ষুধার জ্বালায় পেট জ্বলছে ।গেস্ট হাউসের কমবয়সী ম্যানেজার ছেলেটার কাছ থেকে ডিরেকশন নিয়ে লালুর খাবারের হোটেলের দিকে পা বাড়ালাম ।

সেদিনইবিকেল বেলা, গুরিগুরি বৃষ্টির মাঝে দেবুদার দোকানটা খুঁজতে বেরিয়েছিলাম ।এই তোহাসপাতাল গেটের সামনে৩ রাস্তা মোড়টা ঘুরলেই বাঁ হাতে বিশাল সাইনবোর্ডে লেখা-দেবুদা এন্টারপ্রাইজ ।

দেশ থেকে আসার সময় খবর নিয়ে এসেছি-কোন কিছুই দেবুদার অসাধ্যনয়। আর্জেন্টমোবাইলের সিম লাগবে ?চলে যাও দেবুদাএন্টারপ্রাইজে। সাথে একখানা ছবি আর পাসপোর্টের প্রথম পেইজের ফটোকপি-ব্যাস, হয়ে গেল । এরপর মাত্র কয়েকঘণ্টা সময় । সিম একটিভ । হঠাৎ অপারেশনের টাকা আনাতে হবে দেশ থেকে ? দেবুদা ভরসা । দূরপাল্লার বাস কিংবা বিমানের টিকিট লাগবে-সেখানেও দেবুদা । লোকে এখন তার মুলনামটাও ভুলে বসে আছে । ভুলবেনা ? মনে রাখারও তো একটা কিছু তরিকা থাকে !তা তো নেই-ইউপরন্তুদোকানেরনামটাইযখন‘দেবুদা এন্টারপ্রাইজ’ হয়ে গেছে তখন আর কি !
অপরিচিত নতুন জায়গাতে গেলে এখনকার দিনে যা হয় আমারও হয়েছিল তাই । প্রথম যে জিনিসটার অভাব টের পেলাম তা হল মোবাইলের সিম ।বনগাঁ থেকে নিয়ে নিলেই ভাল হত । নেইনি । পরিদা বলেছিল বার কয়েক-গা করিনি । ভেবেছিলাম দেবুদা নামের একজন তো আছেই !তখনকি আর জানতাম, প্রতি রোববার করে দেবু এন্টারপ্রাইজ বন্ধ থাকে ?
বনগাঁ হয়ে সোজা নিউমার্কেট যাওয়ার মৈত্রী ডিলাক্স কোচটা আমাদের নামিয়ে দেয়উল্টোডাঙ্গা মোড়ে । আমাদের বলতে আমি, পরিদাআরবৌদি । আগের রাতে ঢাকা থেকে রওয়ানা দিয়েছি, ভোরেবেনাপোল সিমান্তে । তারপর কাস্টমস ইমিগ্রেশন দু’দেশেরই । পাক্কা দু'ঘণ্টার মামলা । ১২ টা নাগাদ উল্টোডাঙ্গা পৌঁছেছিলাম । তখনোগুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে । রাস্তায় মানুষজননেই তেমন । মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায় সৌজন্যেকোন এক ওয়ার্ড কমিশনারের দেয়া একটা যাত্রী ছাউনিতে মাথা গুঁজলাম আমরা । আপাদত চিন্তা-বৃষ্টি থেকে লাগেজগুলো বাচিঁয়ে একটা ট্যাক্সি-ক্যাবধরা ।অল্পক্ষনের মধ্যেইদু’শ রুপিতেভাড়া দফারফা করে যাত্রা করেছিলাম মুকুন্দপুরেরদিকে । আগেই বলে নেই, কেন এই মুকুন্দপুরে ? কারন-পরিদার চিকিৎসা ।
জায়গাগুলোসবচেনাছিল আমার । অনেকবার এসেছি এদিকটায় । যখন কল্যানিতে ছিলাম ৪ বছর পড়াশুনা সুবাদে, তখন ।এখন অনেক কিছুই পাল্টেছে । তবুও চিনতে কষ্ট হচ্ছিল না । বিধাননগর-সল্টলেক-স্বভূমি-বাইপাস । চেনা-জানা বলেইপরিদা আমাকে সঙ্গেএনেছিল । ট্যাক্সিটাএগিয়ে যাচ্ছিল সল্টলেকের ভেতর দিয়ে-বাইপাস ধরবে । আকাশেমেঘের তর্জন গর্জনবাড়ছে, সেই সাথে বড়ছে বৃষ্টির তোড়-আছে হাল্কা বাতাসও। ট্যাক্সিটা সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ড্রাইভার খৈনির যে দলাটা মুখে পুরেছিল, পিচকারী বাইরে ফেলতে যেই কাঁচটা নামালো, অমনি এলোপাথাড়ি কিছু জলের ফোটা ভেতরে ঝাঁপটা দিয়ে গেল ।
ট্যাক্সি যাত্রা শুরুর ঘণ্টা দেড়েক পর গন্তব্যে পৌঁছেছিলাম ।
দুই
দোকানেরভেতরের স্পেসটা যে এতো কম হবে ভাবিনি । কাউন্টারের সামনে বড়জোর দুইকি তিনজনেরদাঁড়াবার জায়গা আছে । দেবুদা সহ তিনজন রয়েছে একবুক উঁচুঘেরা কাঁচের ওপাশে । জেরক্স মেশিন চালাচ্ছে একজন । একজন মোবাইলে টপআপ দিচ্ছে । দেবুদা ক্যাশবাক্স সামলাচ্ছে ।

আমরা যখন দোকানে গিয়েছিলাম, সময়টা ছিল পরদিন সকালবেলা । মুষলধারে তখনো বৃষ্টি পড়ছে, তাই দোকানটা একটু ফাঁকা ।আমি আর পরিদা পরপর ঢুকছি, পরিদা আগে আমি তার পেছনে ।
-দেবুদা আছেন ?
-হ্যাঁ, আছি । দেবুদা বলচি ।
নাকের ফুটো থেকে উপরের ঠোঁট পুরুটা ঢেকেও দুই ঠোঁটের মাঝামাঝি কোয়ার্টার চাঁদের মত একফালি গোঁফ ঝুলে আছে, ঘন-কালো । এতোটাই কালো যে সদ্য কলব মেরেছেন-বুঝা গেল ।ভুঁড়িটা সামনে একটু বেশিই যেনবাড়ানো । কাঠের উঁচু চেয়ারে আসীনবলে শারীরিক আকৃতিটাঠিকমত ধরা যাচ্ছে না । একমনে টাকা গুনছে ।
-নমস্কার । আমরা ঢাকা থেকে এসেছি ।
-কি সেবা করতে পারি দাদা ?
-না না আপনি টাকাটা গুনে তারপর কথা বলুন । পরিদা সামলে নিচ্ছিল তখন ।
-টাকা আমি পরেও গুনতে পারব । ক্রেতা লক্ষ্মী, ক্রেতা ভগবান । ভগবানের সেবাই আমার প্রথম কাজ । আপনাদের কি চাই বলুন ?
-একটা সিমকার্ড লাগবে দাদা ।
-পেয়ে যাবেন এক্ষুনি । পাশে তাকিয়ে হাঁক দিলেন-এই কি করছিস রে ? দাদাকে একটা সিমকার্ড দে । দাদা, পাসপোর্ট এনেচেন?
-এনেছি ।
-একখানা ছবিও যে লাগবে ?
-আছে ।
-দিন ওকে । আপনারা ওখানটায় একটু বসুন । রেডি করে দিচ্ছে ।

দেবুদা টাকা গুনছে, কাস্টমার সামলাচ্ছে, কখনো রিসিভার উঠিয়ে কথা বলছে ফোনে । খোঁজ নিয়ে দেখা যায়-প্রতিটা পাড়ায়, প্রতিটা মহল্লায় এরকম একজন করে দেবুদাসম মানুষ থাকে । ভিন্ন ভিন্ননামে-এই যেমন ডাব্বুদা, দুষ্টুদা,বাপিদা, রাজাদা এইরকম আরকি। পাড়ার বিয়ের প্যান্ডেল থেকে শুরু করে খাবার-দাবার তদারকি করে ওরা ।এমনও দেখা যায়,নিজেরই প্রেমিকার বিয়ে হচ্ছে-আর ওরা হাসি হাসি মুখ করে সব দিকে নজরদারি রাখছে । একদিকেযেমনএলাকার পূজামণ্ডপেওদের সর্দারিবলবত থাকে, আরেকদিকে থাকেশ্মশানঘাটপর্যন্তওদের আধিপত্য । কম বয়েসি এমনছেলেমেয়েরা ওদের শিশ্য, অভিবাবকদের কড়া শাসনের পরে দেবুদারা যাদের শেষ ভরসাস্থল।পাড়ার ছেলেমেয়েদের প্রেমেপড়া, প্রেমে ছ্যাঁকা খাওয়ার বিষয়গুলোদেবুদারাইকিভাবে যেন আগে আগে জেনে যায়।প্রেম যেমন ফিক্স করে দেয়-আবার দেবদাস হওয়া থেকেও ফিরিয়ে রাখে মূর্খ প্রেমিককে ।

সাতবছর আগের একটা সময় । কল্যাণী এ-ব্লকের বুদ্ধপার্কে থাকি আমরা । বন্ধু অরিত্র সেদিন রাজাদার হাতে ধরা না পরলে আজকে সোনালিকে নিয়ে সংসার পাততে পারতো না । উঠতি বয়সের প্রেমে ছেঁকা যে ভীষণ খারাপ অরিত্রকে দেখে বুঝেছিলাম । সিগারেট তো আগেই ধরেছিল, এরপর গাঁজা-মদের গেলাস যেন বেচারার নিত্য সঙ্গী । পেটে ভাত-রুটি পরেছে কি না সেদিকে খেয়াল নেই, গাঁজার ছিলিম তার চাই-ই চাই । মদের গেলাস থাকে মাথার কাছে । সেই গেলাসে চুবিয়ে বিস্কিট খেয়েছে কতদিন সকালে !পড়াশুনা লাটে উঠেছে, শরীর স্বাস্থ্য ক্ষয়ে গেছে । সেই অরিত্রকে বাঁচালেন রাজাদা । ওই যে বললাম, একজন করে দেবুদাসম মানুষ থাকে প্রতি পাড়ায় ! আমাদের ছিল রাজাদা । ঘটনার আগাগুড়ি সব শুনে বুদ্ধি দিলেন, ছেঁকা যেহেতু খেয়েছে গভীর, এবার একটা প্রেম জুটলেই সব ঠিক হয়ে যাবে । আমাদের সহপাঠী সোনালিকে ম্যানেজ করেছিলাম সে কি কষ্টে ? অভেদ্য শেল । একেবারে কুইনাইনের মত তুড়ন কাজ দিল । অরিত্র ঝুলল । না না, ফাঁসিতে নয় সোনালিতে । এখন দিব্বি সংসার করছে ওরা ।

এতোসববাইরেও আরো অনেককিছু থাকে দেবুদাদের । লক্ষ্য করলে দেখা যায় দেবুদা শ্রেনীরমানুষদের মধ্যে এমন সবগুনাবলি, এমনআশ্চর্য আকর্ষন থাকে যা সাধারনকে সহজেই আকৃষ্ট করে । মুখের মিষ্টি মধুর কথাই ওদের জীবন-জীবিকার মুল পাথেয় হয়ে উঠে । এরা যখনবলে, মোহিত করে সবাইকে । এরাবিধাতার স্পেশাল সৃষ্টি । মুকুন্দপুরবাজারে আরো তো গোটা চল্লিশেক ইমুক এন্টারপ্রাইজ, তমুক এন্টারপ্রাইজ আছে-কিন্তুকই ? দেবু এন্টারপ্রাইজের মত লোকের মুখে মুখে কোনটার নাম তো শোনা যায়নি ! কোনটার যশ তো ওইদেশ ছাড়িয়ে এপারে এসে পৌঁছেনি-যতটা না দেবু এন্টারপ্রাইজেরক্ষেত্রে হয়েছে!

কেবল দেবুদাদের ঘিরে গল্প হয় না ।আবার তাদেরবাদ রেখেও হয়না-আধুরা থেকে যায় অনেক কিছুই ।গল্পেএক এক মানুষ ঢুকে পরবে হঠাত । যেমন এক্ষণে দেবুদার শ্বশুর । একমাত্র মেয়েকে দেবুদা বিয়ে করে শ্বশুরের সব সম্পত্তি পেয়েছেনবলে কৃতজ্ঞতায় নয়, এমনি ভালোবাসায় শ্বশুরকে নিজ বাড়িতে নিয়ে এসেছেন শাশুড়ি স্বর্গে যাবার পর । দেবুদার বাবা-মা তো গত হয়েছেন অনেকদিন, তাই শ্বশুরকে সেই আসনে বসিয়েছেন।এতে স্ত্রী খুশী হল, শ্বশুরও খুশী হলেন । লোকে পাঁচমুখে ভালো বলল । একূল অকূল দশ কূল রক্ষা হল । সে গল্পের রেশ পরে টানছি ।

তিন
ডা খৈতান হার্ট স্পেশালিষ্ট । চল্লিশের মতবয়েস-তবু দেখে বুঝার জো নেই । হালকা পাতলা গড়ন-তবে এতোটাই হালকা যে বয়েস তিরিশ-বত্রিশ বলে মনে হয় । এনজিওপ্লাষ্টেদারুনহাতযশ তার । পরিদাকে নিয়ে গিয়েছিলাম ডা খৈতানকে দেখাব বলে ।দেখালামও । কথায় কথায় একদিনদেবুদার কাছে জানতে পারি, তার শ্বশুরমশায়কে প্রথম এই হাসপাতালেই চিকিৎসা করিয়েছিল । বছর সাত আগে । হার্ট ঠিক হয়ে গেলেও বয়সের ভারে নানা রোগ ভর করে শরীরে এরপর থেকে । বিছানা নেয়ার সাথে সাথে যেনসিমটমগুল জানান দিতে থাকে । একপাশ প্যারালাইজ্‌ড হয়ে যায় । এখনসারাদিন শুয়ে থাকে । পটিতে পায়খানা প্রস্রাব করাতে হয় । তার সেবার জন্যএকজনপার্মানেন্ট লোক প্রয়োজন । দেবুদা সারাদিন ব্যাবসারকাজে ব্যস্ত, ভাবছিলেন মেয়েইতো বাবাকে সেবা করবে কাছে থেকে । তার এ ভাবনা বৃথা । দেবুদার স্ত্রী কনা বৌদি প্রথম ক’দিনেই নাকি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন । নাকে কাপড় চাঁপা দিয়ে যখন শ্লেষ্মা ভরে বাবার দিকে তাকাতেন-দেবুদার কষ্ট হত শ্বশুরের জন্য । ফলে নিজের কাঁধে তুলে নেয় শ্বশুরের শুশ্রূষার ভার । তবে কাঁহাতক চারদিক সামলানো ! হিমশিম খায় সে ।
-শোন, একটা নার্স রাখলে হয় না ?
-নার্স কেন ? এই তো চলছে ।
-না মানে বলতে চাইছিলাম কি, একজন নার্স থাকলে সার্বক্ষণিক সেবাটা হতো । এই আর কি ?
-দেখি চিন্তা করে ।
-চিন্তার কিছু নেই । রেখে ফেল । পাপনটাবড় হচ্ছে । দেখুক ওদের দাদুর জন্য কত্তো টাকা পয়সা খরচা করে নার্স রেখে সেবা করছি !

এরপর একজন নয় । দুই দুইজননার্সরেখেছে দেবুদা ।নিজেও যতটুকু পারে সেবা করে । কিন্তু কনা বৌদি দূর থেকে কেবল দেখে ।কাছে গিয়ে বাবার মাথায় কখনোসখনো হাত বুলায়-এর বেশি কিছু নয়। দেবুদা আক্ষেপ করে বলেছিল একদিন । বুড়ো এখনো পৃথিবীর আলো বাতাস নিচ্ছে ।

চার
তখন পরিদার চিকিৎসা চলছে ডা খৈতানের অধীনে । প্রাইমারী এনজিওগ্রামে হার্টে একখানা ব্লকধরা পরে । বাকি সব কিছু ঠিকঠাক রয়েছে । এনজিওপ্লাষ্ট করাতে হলেতিনদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে-এরকমটা ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছিল।দেশ থেকে আসার সময় আমাদের প্রিপারেশন ছিল-শুধু ডাক্তার দেখিয়েই চলে যাব । অপারেশন টপারেশনের দরকার হলে পরে আবার আসব। তাছাড়া পর্যাপ্ত টাকাপয়সাও নিয়ে আসা হয়নি । ডা খৈতান যখনবললেন, দু’চারদিনবেশি থেকে গিয়েরিংটাএকেবারে পরিয়েই যান-মাস তিনপরে এসে নাহয়একটা চেকআপ করিয়ে যাবেন-তখন সম্মতিদিতে হয়েছিল।তবে বলা ছিল, দিনতারিখ ঠিক করা হবে কবেটাকা আসবে-এর উপর। আর টাকা আনাতে হবে দেবুদা মারফত । ডাক্তারের সাথে যেদিন এনজিওপ্লাষ্টের কথা হয় সেদিন বৃহস্পতিবার । পরদিন শুক্র । প্রতি শুক্র-শনি আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোবন্ধ থাকে । ফলে আসছে সপ্তাহ ছাড়া কোন গতি নেই । ঐ কয়দিন আমি এদিক ওদিক ঘুরেছি ইচ্ছেমত। কলেজ স্ট্রীট, বারাসাত, কল্যাণী ঘুরে ঘুরে পুরনো বন্ধুদের অনেকের সাথেই দেখা করেছি ।মুকুন্দপুর থাকলে দেবুদার দোকনে যেতাম প্রায়ই। বসে গল্প করতাম ।

নানান কথা হত । ধর্ম-শাস্ত্র-রাজনীতি, দেশ-কাল-সমাজ হেন কোনবিষয় নেই যাতে দেবুদার দখল নেই ।খুব পড়াশুনা না থাকলে এসব জানার কথা না কারো । এতো বড় একটা দোকান চালানোর পর পড়াশুনার ধৈর্য থাকে না কারো-দেবুদারও থাকার কথা না।তবে ? আমি প্রায়ই লক্ষ্য করতাম-দেবুদার কথাগুলো কোন বইয়ের লিপিবদ্ধ অক্ষর নয় । প্রতিটা কথা, প্রতিটা যুক্তি-এই সমাজ থেকে নেয়া । সমাজের প্রতিটা স্তর থেকে নেয়া । যেন কাল থেকে আহরণ করা । যেনবাস্তবতার নিরীক্ষে তার তাবৎ শিক্ষা-তার সবতর্কবিতর্ক । ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দবলার যে সহজাত সাবলিলতা তার কথায়, ভালমানুষের যে বেশ সে ধারণ করে আছে-তাতে কোন ভনিতা নেই । অন্তত আমি পাইনি ওই কয়দিনে ।

সেদিও প্রচণ্ড বৃষ্টিছিল । মুষলধারে সেই সকাল থেকে বর্ষণ হচ্ছে তো হচ্ছেই । দেবুদার দোকানটা তাই ফাঁকা । আমি আর পরিদা হোটেল থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে ভিজেই ফিরলাম তার দোকানে । দেবুদা খেতে যাবেবাড়ীতে-কিন্তু যেতে পারছে না । বুঝলাম, আমাদেরকে বের করে দিয়ে সে যাবে না । ঐ যে ক্রেতা লক্ষ্মী-ক্রেতা ভগবান- এই ক্রেতাকে কিভাবে দুর্যোগে ছেড়ে দেয় ? কাস্টমার নেই দোকনে । দেবুদা কসিয়ে বসলেনচেয়ারে ।আড্ডা চলছিলনানা বিষয় নিয়ে ।আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছি-প্রতিটা দোকনেই কোন না কোন দেব-দেবীর ছবি থাকে, ভগবানের ছবি থাকে । চারদিক তাকিয়ে দেখলাম, তার দোকনে সে রকম কারো ছবি নেই । পেছনে মাথার উপর কেবল দুইজন মানব-মানবীর ছবি একই ফ্রেমে । আর কাঠের ফ্রেমটা ঘিরেবাসিফুলের মালা জড়ানো। হয়তো সকালে তাজা ছিল ফুলগুলো ।

কথার ফাঁকে প্রসঙ্গক্রমে এক সময় দেবুদা বলেছিল, বিশ্বাস করুন দাদা, আমার ভগনবানে একদম আস্থা নেই । আমার জন্যপূজনীয় হচ্ছেন আমার মা-বাবা । তারাই আমাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন । তারাই আমার কাছে সাক্ষাৎ ভগবান ।এই দেখুননা, আমার ভগবানের ছবি মাথার উপর টানিয়ে রেখেছি ।

ষাটোর্ধ দু’জন মানব মানবী পাশাপাশি রয়েছেন। স্মিত হাসি লেগে আছে দু’জনেরই ঠোঁটে । আর এদের সামনে পয়ত্রিশোর্ধ একজন পুরুষ যে কিনা এদেরই সন্তান-যে কিনা পিতৃ-মাতৃ ভক্তির চরম আদর্শ ধারন করে আছে-তাকে আমি দেখছি তন্ময় হয়ে ।দেখছি তার চোখের কোণ জলে চিকচিক করছে ।

আমার দিব্য বিশ্বাস, যার যার ভগবানের জন্য বোধহয় সবাই এমনই করে কাঁদে । এমনই অশ্রু ফেলে নীরবে ।