সোমনাথদার
বাড়ি যাবে বলে বেরিয়েছিল মৃণাল। সাইকেলটা যণ্ত্রণা দিচ্ছে, যাওয়া হবে না। এটা সারাই করতে দিতে হচ্ছে। কাল অফিস আছে, এতোটা ঠ্যাঙানো যাবে না পায়ে। সোমনাথদা শেষ শয্যায়, মনটা খচখচ করছে। বৌদি সেদিন ফোনে জানালেন সোমনাথদা বারে বারে ওর নাম নিচ্ছেন।
মৃণাল ভেবে
নিলো সাইকেল মন্টুর গ্যারেজে দিয়ে আজই যাবে পায়ে হেঁটে। হোক না পাঁচ মাইল দূর। ও
কিছু না। সোমনাথদার সঙ্গে পায়ে হেঁটে দূর দূরান্তে পার্টির কাজে যাবার অভিজ্ঞতা তো
পুরোনো হয়নি এখনো। এইতো ক'মাস আগেও গেছে। সোমনাথদার বাড়ি তো সকাল বিকেল কতদিন
গেছে।
আজ কিন্তু
সিদ্ধান্ত নেবার পর থমকাতে হলো। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যেন পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে
সজোরে পা দুটিকে টানতে লাগলো। একটা মুখ যেন সমস্ত চেতনাকে দুমড়ে মোচড়ে রক্তক্ষরণে
অবশ করে দিচ্ছিল। মুখটি সুমনার। যাক সেসব। এক্ষুণি রওনা না হলে অসুবিধা হবে।
সোমনাথ
দত্ত পার্টির হোমরাচোমরা নেতা। বয়স তার থেকে বছর ছয়েক বেশি। তবু বন্ধুর মত।
সোমনাথদার জন্যই মৃণাল পার্টি সদস্য হয়। তবে ওসবে ওর তেমন ইন্টারেস্ট না থাকায় আজো
সাধারণ সদস্য থেকে পদোন্নতি হয়নি। সে চায়ও না। ওসব পার্টির কথাবার্তা, মতাদর্শ আর
বাস্তব জীবন তার কাছে একেবারে ভিন্ন মনে হয়। মাটির সঙ্গে কোন মিল নেই। কেমন যেন
আমদানি করা বিদেশি মালের মত! চমক আছে ভিত্তি নেই।
অথচ সোমনাথদা পার্টি অন্ত প্রাণ। পার্টি পার্টি করে সোমনাথ সংসার জীবন সবকিছুকে হেলাফেলা করেই আজ এই অবস্থায়। প্রথমে ডায়াবেটিস, তারপর দুটি কিডনি গেলো। ডায়ালিসিস করে করে বছর খানেক গেছে। টাকার ফুলঝুরি হলো, বৌদির গয়না একটা একটা করে শেষ হলো। বোন সুমনার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল ভাগ্যিস!
আবার
সুমনার কথা মনে এলো। হ্যাঁ সুমনাকে ভালোবেসে ফেলেছিলো মৃণাল। মনে হতো সুমনাও তাকে
ভালোবাসে। কেউ কারও কাছে মন খুলেনি কোনদিন, কোনদিন বলা হয়নি মনের অন্দরে ভালোবাসার অনুরণনের কথা।
মৃণাল তখনো বেকার, চাকরির জন্য দৌড়োদৌড়ি করে হয়রান। সুমনা বি.এ. পাশ করে ঘরে বসা। মৃণাল তখন ছুটে ছুটে আসতো সোমনাথের কাছে
কাজে অকাজে। উদ্দেশ্য অন্য। বৌদি সব বুঝে গিয়েছিলেন। মৃণালকে অসময়ে দেখলে মুচকি হাসতেন। মেয়েরা বুঝি এসব ব্যাপার ছেলেদের চেয়ে বুঝায় পারঙ্গম
বেশি। সুমনা মুখে কুলুপ এঁটে ছিল এ বিষয়ে । অতিরিক্ত সপ্রতিভ দেখালেও সে যেন সহজ
সাবলীলভাবে নানা বিষয়ে কথা বললেও এ বিষয়ে চুপ থাকতো। কোন কিছু হয়নি যেন।
এ ধরনের
একটা হচপচ্ পিরিয়ডে মৃণাল একদিন দুপুরবেলা পাশের গাঁ থেকে ফেরার পথে ওদের বাড়ি
গেলো। মধ্য শরতের আকাশে সাদা মেঘের হুলুস্থুল, বাতাস কেমন আনমনা শীতল। সকালের শিশির শুকিয়ে গেছে।
ওদের বাড়ির সামনেকার শিউলিফুলের গাছ থেকে এখনো অসময়ে হালকা বাতাসে দু'চারটে
শিউলি ঝরছে। নরম একটা মিস্টি গন্ধ আলতোভাবে নাক ছুঁয়ে গেলো।
মৃণাল
সাইকেলটা রোজকার মত গেটের বাইরে স্ট্যাণ্ড করিয়ে ভেতরে ঢুকলো। সে জানে এই
গণ্ডগ্রামে চুরির কোন ভয় নেই। ঢুকেই সামনে শিউলিতলায় স্ট্যাচুর মত সুমনা। মৃণাল
একটুখানি থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলো — ইয়ে, সোমনাথদা আছেন?
স্পষ্ট গলার জবাব —
না, নেই । তুমি কি শুধু দাদার কাছে আসো ?
স্পষ্ট গলার জবাব —
না, নেই । তুমি কি শুধু দাদার কাছে আসো ?
না -আ -হ্যাঁ। এ কেমন জবাব?
মানে?
কিছু না, একটা কথা ছিলো।
মৃণাল
ততোক্ষণে ধাতস্হ হয়েছে। সুমনার মুখের দিকে কিছু আগ্রহ অনেকটা কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে চমকে গেলো। করুণ মুখখানি নিচু করে মাটির দিকে
সুমনা তাকিয়ে আছে। বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। অসহায় একটা অস্তিত্ব যেন তার।
মৃণালের ইচ্ছে করছিল সুমনার হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। পারলো না। খুব নরম.
গলায় মায়া
মাখিয়ে বললো — বলো!
জবাব এলো ম্রিয়মান গলায় — আমার বিয়ে ঠিক হচ্ছে। বীরভূমে এক বিরাট ধনী পরিবারে। এককালে ওরা জমিদার ছিলো। পাত্র দোজবরে। হোক না, টাকা তো আছে। সুখে সংসার করবো।
কি হলো চুপ
যে? কিছু বলবে না? মৃণালের প্রথমে মনে হচ্ছিল পায়ের তলার মাটি সরে
যাচ্ছে, শরীর কাঁপছে। তারপর সুমনার মুখে টাকা আছে, সুখে সংসার করবে এসব শুনে শক্ত হয়ে গেলো। সুমনা কি ব্যঙ্গ
করলো তাকে? ওতো বেকার, দরিদ্র পরিবার ওর। এই মুহূর্তে বিয়ে সে যেমন ভাবতে
পারে না, তার পরিবারও এ অবস্থায় কক্ষণো রাজি হবে না। সুমনা তাকে কেন
ব্যঙ্গ করলো? সুমনের সঙ্গে তো তার সম্পর্ক তেমন গড়ে ওঠেনি যে এই
মুহূর্তে বিয়ে হতে হবে! নিজেকে সামলে মৃণাল ম্লানভাবে বলতে পারলো— বেশ তো! খুশি হলাম! সুখে থেকো! নেমন্তন্ন করবে তো?
সুমনা হঠাৎ হু হু কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ' তোমরা সবাই এক, দাদার চেলা তুমি, দাদার মতই পাষাণ ' বলে ছুটে ঘরে ঢুকে পড়লো। আর মৃণালের অবস্থা তখন ন যযৌ ন তস্থৌ! মিনিট পাঁচেক এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে টলতে টলতে সে বেরিয়ে সাইকেল ঠেলে ফিরতে লাগলো। চালানোর মত অবস্থা তার ছিলো না। সুমনার শেষ কথাগুলো তার মস্তিষ্কে, বাতাসে, আকাশে অনুরণন তুলতে লাগলো কেবলই।
তারপর অনেকদিন পার হয়ে গেছে। সুমনার বিয়ে হয়ে গেছে। যেদিন শেষ দেখা সেদিনই পাকা কথার জন্য সোমনাথ গিয়েছিলেন। পরে জেনেছে মৃণাল। সে আর সোমনাথের বাসায় যায়নি। সোমনাথের সঙ্গে সম্পর্কও তার ছিলো না। এতোদিন পর এভাবে আসতে হলো। বেলা ঢলে পড়েছে। দেরি হয়ে গেছে।
সদর দরজায় কড়া নাড়লো সে! সেই নিস্তব্ধতায় কড়ার শব্দ বড় কড়া শোনালো। কিন্তু কেউ সাড়া দিলো না। আবারো আরো জোরে কড়া নাড়লো। এবার মৃদু পায়ের শব্দ শোনা গেলো। দরজা খুললো। থতমত হয়ে মৃণাল দেখলো থান পরা এক নারী দাঁড়িয়ে। ভাঙ্গাচুরা শরীরের সেই নারী প্রায় রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, বড়ো দেরি করে এলে তুমি!
কে বৌদি?
পেছনে সাদা থান পরা এমনি আরেকজন প্রশ্নটা করেছিলেন। সামনে এগিয়ে আসার পর মৃণালের চিনতে দেরি হলো না কে। সে মাথা নিচু করে ফিরে আসতে লাগলো, তার কানে দু'জন সাদা থান পরা নারীর কথা অনুরণনের পর অণুরণন তুলে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আকাশে ছড়িয়ে সারাটা আকাশ ঢেকে ফেললো।