পেয়ারার ডালে ধুতি চাদর রেখে বাঁধানো ঘাট বেয়ে জলে নামে গদা
চক্রবর্তী। ঘাটের অবস্থা যাচ্ছে তাই ।
ভেঙ্গে চুরে সাপ খোপের বাসা হয়ে গেছে। এবার মেরামত না করলে আসছে বর্ষায় আর নামাই
যাবে না পুকুরে। দু বেলা দু মুঠো খাবার
জোটানোই যেখানে আকাশ কুসুম সেখানে কি করে এই খর্চা করবে ভাবতে গা শিউরে ওঠে পূজারী
ব্রাহ্মণের ।
ওপারে জলের শব্দ। ইন্তাজ অজু করেতে নেমেছে। ওদের ঘাটটা তাল খেজুরের গাছ পেতে
বানানো। কাঁচা ঘাট। বেশ মজবুত। বাতের ব্যথায় কাহিল ইন্তাজের নামা ওঠায় কস্ট হয়
খুব। শীতে ভোগে বেশি। এমন হয় যে কাজকর্ম
মাথায় ওঠে। “গাড়োল একটা । কিছুতেই ঘাট বাঁধাবে না। পুর্ব পুরুষের কাটা
পুকুরে একটাই বাঁধানো ঘাট থাকবে। জাত গেছে যুগ যুগ আগে । জিদ যায়নি ওদের। কে জানে
ওষুধটা খেয়েছে কিনা। কবিরাজিতে ওর বিশ্বাস নেই এক ফোঁটা।”
কস্ট করেই অজু করে ইন্তাজ শেখ। অমাবস্যা পুর্ণিমায় আজকাল বড় কষ্ট
পাচ্ছে ব্যাথায়। ঠান্ডাও পড়েছে জাঁকিয়ে।
জল কাটার শব্দে চোখ তুলে তাকায়। কোমর জলে দাঁড়িয়ে সুর্য প্রণাম সেরে নিচ্ছে পুজারী
ঠাকুর। খালি গায়ে নামাবলীটা কেবল জড়ানো। “ গাড়োল একটা। এবার শীতে বুকে ঠান্ডা জমে
গেলে বাঁচানো কঠিন হবে। তা ছাড়া খাওয়া দাওয়া ত নেই বললেই চলে। ভাঁড়ারে মা ভাবানী।
আজকাল পূজা আর কজন করে বা দেয়! অই পূজা
ছাড়া জানেও ত না আর কিছু। সুবহে সাদিকের আগে মন্দিরের বারান্দায় বস্তা ভরে
চাল, ডাল, তেল, আলু, কপি রেখে এসেছি।
গাড়োলটা দেখেছে কিনা কে জানে!”
ভাঙ্গা সিঁড়িতে সাবধানে পা ফেলে ফেলে উপরে উঠে যায় গদা চক্রবর্তী।
ঠাণ্ডায় কোমর টন টন করছে। পা দুটোতে ও বেশ
ব্যাথা ছিল। দুর্যোধন কবিরাজের ওষুধে ব্যাথাটা কম মনে হচ্ছে কিছুদিন ধরে। সেই
ওষুধই কাল সাঁঝ বেলা ইন্তাজের জন্য দিয়ে এসেছে বড় বউমার হাতে । এই ঠান্ডায় সেই কোন
ভোরে উঠে অজু করে। বাতের ব্যাথা ঠাণ্ডায় বড় বাড় বৃদ্ধি হয় ।
খুব আস্তে আস্তে কাঁচা ঘাট বেয়ে উপরে উঠে ইন্তাজ শেখ। শর্ষে তেলটা
এবার একটু বেশী দিয়েছে। ঠাণ্ডা সিমেন্টে
নাম মাত্র একটা পাতলা আসন। তাতে বসে পূজা করে। গায়ে নামাবলী ছাড়া একটা পাতলা হাতাওলা
গেঞ্জি। গেল শীতে যমের হাত থেকে কোন রকমে বেঁচেছে ।গরম তেলে রসুন ফেলে ডলে নিলে আরাম
পাবে। খদ্দরের চাদরটা ভালো মনে করে গায়ে জড়ালে হয় !
ইন্তাজ শেখ যাওয়ার আগে ঘুরে তাকায়। শুকনো ধুতির উপর খদ্দরের চাদর জড়িয়ে
এদিকেই তাকিয়ে আছে গদা চক্রবর্তী। স্নেহে
আদরে ভালবাসায় টলটল করছে অগ্রজের দৃস্টি সন্মোহন। ইন্তাজ শেখের দৃস্টিতেও অনুজের
শ্রদ্ধা, সন্মান,সম্ভ্রম আর মান্যতার টলটলে ভালবাসা। ধর্ম বদলেছে পুরুষ পুরুষ আগে।
তাতে কি ? রক্তের রঙ ত লাল!