পথের মোড়টা বাঁকতেই বাঁহাতি তিনটে ঝুপড়ির পর একটা টিন দিয়ে
তৈরি ঘর দেখতে পাওয়া যায়। এবং সেখানে একটা টিনের দেয়ালে বড় হরফে লেখা আছে 'কিশলয় মুক্তি মার্গ'। তারই সামনে একজনকে দেখা
গেল, যে প্রায় ত্রিশ জন বাচ্চা
ছেলেমেয়েদের ধারাপাত শেখাচ্ছে।
হ্যাঁ, চেনা গেল। এই হল প্রভাত বারিক। ফেসবুকে
পরিচয়। প্রভাতের এই 'কিশলয় মুক্তি মার্গ'-এর কথা শুনেছিল এবং ফোনেও কথা হয়। কিন্তু সামনে ঠেকে আজ প্রথম দেখল।
প্রভাতের শিক্ষাদানের ধরণটাও দেখল। প্রভাত এই পঁচিশ বছর বয়সেই দরিদ্র
ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে একটা মুক্তির সাধনা শুরু করে দিয়েছে।
ছিমছাম
চেহারার প্রভাতের মুখে হালকা দাড়ি। ঠোঁটের কোণায় হাসির রেশ টেনে দুটো উজ্জ্বল চোখ সর্বদা
ছেলেমেয়েগুলোর উপর ঘুরপাক খাচ্ছে। আন্তরিকতার স্পষ্ট ছবি চোখের মিষ্ট ভাষে। যেন নিজের
ভিতরের সমস্তটা সে সেই নিরীহ শিশুগুলোর মধ্যে উজাড় করে দিতে চায়।
আরামবাগ শহরের প্রত্যন্ত দরিদ্রপল্লীতে
অসহায়, দরিদ্র ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের
ভার প্রভাত একাই নিজের কাঁধে তুলে নেয়। তাদের শিক্ষাদান ছাড়াও দুপুরের অন্নটাও দেয়।
অসুস্থ হলে চিকিত্সা করায়। পূজার সময় নূতন পোষাকও দেয়। শহরে গজিয়ে ওঠা শিক্ষাঙ্গনে বেতনের
ভারে শিক্ষার আলো থেকে বিচ্যুত শিশুরা যাতে পড়াশোনা শিখতে পারে, সেই সাধনায় প্রভাত ব্রতী
হয়। ধনীঘরে কয়েকটা মোটা বেতনের টিউশন পড়িয়ে ও নানা জায়গায় সাহায্যের জন্য হাত পেতে
এই প্রতিষ্ঠানটা চালাত। আর প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল পৈতৃক সম্পত্তির উপর। এককালে পরিবার
আর্থিক অবস্থা ভালো থাকলেও এখন আর সেই স্বচ্ছলতা নেই।
টিনের
ঘরের ভিতরে পাঠদান দেওয়া হলেও সেদিন টিনের ঘরের সামনে একটা আমগাছের নীচে ঘাসের উপর
বসে শিক্ষাদান ও শিখনের প্রক্রিয়াটা চলছিল। বসন্তকাল বলে এই ব্যবস্থা। আমগাছ ছাড়াও
ঐ টিনের ঘরের সামনে ফাঁকা পরিসরটুকুতে কোথাও কাঁঠাল গাছ, কোথাও শিউলি গাছ, কোথাও পেয়ারা গাছ ছড়িয়ে
ছিটিয়ে রয়েছে। নানা ধরনের ফুলগাছ ও ফলগাছের ছায়ায় ফাল্গুনের শেষে রোদের তাপ তেমন প্রভাব
ফেলতে পারেনি।
রোহন দূর থেকে দাঁড়িয়ে প্রভাতের শিক্ষণ
প্রক্রিয়ার পদ্ধতি দেখতে থাকে। মুক্ত শিক্ষার আসল রূপটা তার চোখে উদ্ভাসিত হয়। মনে
পড়ে শান্তনিকেতনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের কথা।
রোহন
একজন সাহিত্যিক। এছাড়া সে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে। ফেসবুকে রোহনের সঙ্গে
পরিচয় হওয়ার পর সে প্রভাতকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে দূর আসানসোল থেকে এসেছে।
প্রভাত
ধারাপাত শেষ করে কিছু গল্প বলতে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করল দূরে রোহন দাঁড়িয়ে। একমুখ হাসি
নিয়ে সে বলল,
"আরে, আসুন আসুন! ঐখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?"
"না, এমনি। তোমার শিক্ষাদানটা
দেখছিলাম।"
"আপনার মতো কি আর শিক্ষা দিতে পারি!" প্রভাতের কথায় একটা বেকারত্বের
হতাশার সুর কিলবিল করে ওঠে।
"না না! তুমি ভীষণ ভালো শিক্ষক। তোমার এই মুক্ত
শিক্ষা দেখে আমার মনও মুক্ত হল। আমরা সবাই যদি তোমার মতো করে শিক্ষাটাকে নিয়ে ভাবতে
পারতাম...."
রোহন তার হৃদয়ের
কথাটা বলে দিল। রোহনেরও মনে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি অনীহা ছিল। অনীহা ছিল বর্তমান
শিক্ষকদের নীতিহীন শিক্ষাদানের প্রতি। কেবল পিঞ্জরে বন্দী করে পাখিকে কিছু বুলি শেখানো
যায়, মুক্তি শেখানো যায় না। দীর্ঘদিন
বন্দী পাখিকে যখন খোলা আকাশে ছাড়া হয়, সে তখন ওড়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
তাছাড়া
দরিদ্র শিশুরা তো অবহেলিত হয়। তাই সেইরকম কিছু ছেলের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে প্রভাত
যে মানবধর্মের নিদর্শন রাখছে, তাতে তাকে বাহবা জানাতেই হয়।
রোহন
ও প্রভাতের মধ্যে নানারকম কথা হয়। প্রভাতের সাহিত্য রচনা নিয়েও কথা হয়। রোহন প্রভাতের
হাতে দশ হাজার টাকা তুলে দেয় 'কিশলয় মুক্তি মার্গ'-এর জন্য।
রোহন
চলে গেলে প্রভাত আবারও পাঠদান শুরু করে। প্রভাতের সঙ্গে ছেলেমেয়েরাও ছড়া বলতে শুরু
করে-
"সকালে
উঠিয়া আমি মনে মনে বলি......"
ছেলেমেয়েদের ছুটি হয়ে যাওয়ার পর প্রভাত
আম গাছটার নীচে খাতা পেন নিয়ে বসে পরল। প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য তার সকালের চিন্তা
এখন অনেকটা কেটে গেছে। রোহনের সাহায্যের হাত তাকে সাময়িক প্রশান্তি দিয়েছে। সে কবিতা
লিখতে শুরু করল। উপরে আম গাছে পাখিরা কিচিরমিচির করে খেলায় মত্ত। তার নীচে আম বকুল
ঝরে ঝরে পরতে লাগল।
"তুই
ভাত খাবি না?",
ঝর্ণা এগিয়ে
আসে।
"না, খিদে নেই গো!"
"তা
খাবি কেন?
ঐ কবিতাই গেল!" এই বলে ঝর্ণা চলে যায়।
এই
ঝর্ণা প্রভাতের প্রতিষ্ঠানের একজন সাহায্যদাত্রী। বাড়ির কাজ শেষ করে এসে সে 'কিশলয় মুক্তি মার্গ'-এর শিশুদের জন্য রান্না
করে দেয় এবং খাবার বিতড়নও করে। এর জন্য সে কোনো পারিশ্রমিক নেয় না। প্রভাত প্রথম দিকে
তাকে কিছু পারিশ্রমিক দিতে গেলে সে বলে, "আমার ছেলে তো তোর সান্নিধ্যে থেকে পড়াশোনা করছে। এর চেয়ে
বড় পাওনা কি আর হতে পারে! তাছাড়া তোর এই কাজে আমিও যুক্ত থাকতে পেরেছি, এটাই তো আমার জীবনের অলংকার!"
কবিতা লেখা শেষ করে টিনের ঘর বন্ধ করে
সে শহর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে তার বাড়ির পথে রওনা দিল।
প্রভাতের
এই সাধনা দিনের পর দিন প্রকাশ্যে আসতে লাগল। অনেকে তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল।
সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচয় থাকায় অনেক সাহিত্যিক সাহায্যার্থে এগিয়ে এল। এছাড়া দু-তিনটে সাহিত্য প্রকাশন, বিশেষ করে 'রঙধনু' প্রকাশন তাকে সাহায্য করে।
ক্রমে পরিচিতির ফলে স্থানীয় অঞ্চলের অনেকে আর্থিক সাহয্য করে। চারপাশ থেকে এত সাহায্যে
এবং প্রভাতের অদম্য সাহসিকতায় এই প্রতিষ্ঠানের আয়তন ও শিশু-শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়ে
যায়। শহরের পার্শ্ববর্তী গ্রামের দরিদ্র ঘরের অনেক শিশু সেখানে শিক্ষাগ্রহণের জন্য
আসতে শুরু করে।
শিক্ষার্থীদের পড়ানো এবং দেখাশোনা করা
একা প্রভাতের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। সে তার গ্রামের
দুই
বন্ধু নিবিড় ও আবীরকে পাশে পায়। এরা দুজনেই বি.এ. পাশ করে বেকার ছিল। প্রভাতের সামাজিক
কর্মের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। তাই প্রভাত একবার বলতেই তারা রাজী হয়ে যায়।
ধীরে ধীরে প্রভাতের এই সেবামূলক কর্ম
স্থানীয় অঞ্চল ছাড়িয়ে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পরল। বিভিন্ন জায়গায় প্রভাতকে ডেকে সম্বর্ধনা ও পুরস্কার
দেওয়া হল। বিভিন্ন সংস্থা তাকে সাহহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। ভোটের সময় স্থানীয় বিধায়ক
গোকুল সর্দার
'কিশলয় মুক্তি
মার্গ'-এর বিল্ডিং করে দেবে বলে
ঘোষণা করল। প্রভাত প্রথমে অসম্মত থাকলেও পরে ঝর্ণার কথায় এবং শিশুগুলোর কথা ভেবে সে
সাহায্য নিতে সম্মত হল। তার সম্মত হওয়ার আর একটা কারণ হল অনাথ শিশুদের বাসস্থানের সুবিধা
দেওয়া। কয়েক মাসের মধ্যে 'কিশলয় মুক্তি মার্গ' টিনের ঘর থেকে পাকা ঘরে পরিণত হল। কিন্তু ভোটের সময় গোকুল সর্দার প্রতিটা
প্রচারে 'কিশলয় মুক্তি মার্গ'-এর নাম তুলে ধরাটাকে প্রভাত
মেনে নিতে পারেনি। তার প্রতিষ্ঠান নিয়ে এই রাজনীতি করাটা তাকে আঘাত দিয়েছিল। সেদিন
থেকে সে মানসিকভাবে ঠিক করেছিল আর কোনোদিন এইরূপ সাহায্য সে নেবে না।
কিন্তু
তার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনিচ্ছাকৃত রাজনীতি জড়িয়ে যাওয়ায় আস্তে আস্তে অনেক জায়গা থেকে
সাহায্য আসা বন্ধ হয়ে গেল। ফলে 'কিশলয় মুক্তি মার্গ' আর্থিক সংকটের মধ্যে পরল।
তীব্র আর্থিক সংকটের মধ্যে পরে যখন
প্রভাত কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না, তখন 'রংধনু' প্রকাশনের কর্ণধার সৌমিত্র রায় প্রভাতকে একটা প্রস্তাব দিল, "আমি আপনাকে সবরকমভাবে সাহায্য
করব। তবে আমাকে এই 'কিশলয় মুক্তি মার্গ'-এর অংশীদার করে নিতে হবে!"
"সে
তো আপনি আমাদের পাশেই আছেন!"
"না, কথায় নয়। যদি খাতায় কলমে
হয়!"
সৌমিত্রের
চোখে তখন ভবিষ্যতের একটা রূপকল্প।
প্রভাত
কোনো কথা বলে না। নীরব হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে না এই পরিস্থিতিতে তার ঠিক কী করা উচিত।
যে স্বপ্ন নিয়ে সে একাকী এই প্রতিষ্ঠানটা শুরু করেছিল এবং এতদূর পর্যন্ত সে পৌঁছেছে, তাকে সে কীভাবে অন্যের অংশীদারিত্বে
দেয়! অথচ আর্থিক সংস্থান না হলেও
তো অনাথ শিশুদের খরচ নির্বাহ করা কঠিন কাজ।
নিবিড় ও আবীরের কাছে যুক্তি নিলে তারা
বলে,
"এই মূহূর্তে
এটা ছাড়া আর তো কোনো করণীয় কিছু দেখতে পাচ্ছি না!" প্রভাতেরও মনে হয় এটা ছাড়া আর কোনো
গতি নেই। তাছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গোকুল সর্দার যেভাবে রাজনীতিকে জড়িয়ে দিয়েছিল, তার থেকে বেশি কোনো ক্ষতি
করতে পারবে না। অংশীদারিত্বটা কিছুটা কেবল দিতে হবে। এতে বরং লাভই হবে। সৌমিত্রের সাহায্য
বরাবর পেলে প্রতিষ্ঠানেরই লাভ।
সৌমিত্রের সাহায্যে 'কিশলয় মুক্তি মার্গ'-এর আর কোনো সংকট রইল না।
তবে এই 'কিশলয় মুক্তি মার্গ'কে নিয়ে কোনো আলোচনার সময়
প্রভাতের সঙ্গে সৌমিত্রের নামও উঠে আসতে লাগল, যা প্রভাতের মনকে নাড়া দেয়।
একদিন
রাত্রির দিকে প্রভাত যখন লেখার মধ্যে ব্যস্ত, তখন হঠাত্ই কিংশুক নামে এক পুরানো বন্ধু ফোন
করে জানতে চাইল, "তুই কলকাতাতেও কিশলয় মুক্তি মার্গ গড়ে তুললি!"
"আমি?" প্রকাশ আকাশ থেকে পরল।
"হ্যাঁ, উত্তর কলকাতা ও দক্ষিণ কলকাতার
দুটো জায়গায় এই নামে দুটো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আজ উদ্বোধন হল। সেখানে সৌমিত্রবাবু ছিলেন।
তিনি জানালেন এই দুটি প্রতিষ্ঠান তোর আরামবাগের প্রতিষ্ঠানের অংশ। তোর অনুরোধে নাকি
গড়ে উঠেছে। আর তুই বলছিস জানিস না!"
প্রভাত খবর নিয়ে জানল সৌমিত্র রায় নিজে
এই দুটো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। তবে দুটোই বৈতনিক বিদ্যালয়। এই কথা নিবিড় এবং
অবীর দুজনেই জানত।
প্রভাত
প্রথমে সৌমিত্রকে ফোন করে, "এটা কী শুনলাম! এটা কি ঠিক হল?"
"না।
মানে!"
প্রথমে আমতা
আমতা করলেও তারপর নিজের অধিকার তুলে ধরল, "তাছাড়া আমিও তো কিশলয় মুক্তি মার্গের অংশীদার। এটা করার
অধিকার আমার আছে।"
"তা
বলে বেতন নিয়ে!...."
প্রভাতের প্রশ্ন এড়িয়ে সৌমিত্র ফোন রেখে দিল। প্রভাতের
বুঝতে বাকি রইল না সৌমিত্রের আসল অভিসন্ধী। প্রভাতের স্বপ্নের মধ্যে সৌমিত্র একটা বড়
কাঁটা। তবু প্রভাতের কিছু করার নেই। প্রভাতের গড়া 'কিশলয় মুক্তি মার্গ'-এর নাম নিয়ে সৌমিত্রের শিক্ষা-ব্যবসা প্রভাতকে মানসিকভাবে
বিধ্বস্ত করল। কেন যে সেদিন সৌমিত্রের সাহায্য নিতে গেল। ছোটো থাকাই ভালো ছিল। ছোটো
স্বপ্ন ফলতে ফলতে বৃহত্ আয়তন হয়ে গেলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তখন ছোটো স্বপ্নটা অবহেলিত
হয়ে যায়। মহত্
কাজটা ক্ষুদ্র
পরিসরেই হয়তো ঠিক ছিল।
কিছুদিন বাদ 'কিশলয় মুক্তি মার্গ'-এর পঠন পাঠন ও অনাথদের রক্ষণাবেক্ষণ
নিয়ে একটা আলোচনা সভা ডাকা হয়। সমস্ত শিক্ষকদের পাশাপাশি সৌমিত্র সেই আলোচনা সভায় যোগদান
করে। পাঠ্যসূচি ও পঠন পাঠন নিয়ে আলোচনায় সৌমিত্র এবং প্রভাতের মধ্যে মতভেদ হলে প্রায়
অধিকাংশ শিক্ষকেরা সৌমিত্রের পাশে দাঁড়ায়। ফলে বিরোধিতা সত্ত্বেও শহুরে শিক্ষার পাঠ্যসূচির
মতো এখানেও পাঠ্যসূচি করা হয়। যাতে মুক্ত শিক্ষা পুরোপুরি লঙ্ঘিত হয় শিশুদের উপর তথ্যের
রাশি রাশি ভার চেপে বসে।
এই
ঘটনার পর প্রভাত মুচড়ে পরে। সে তার বন্ধু নিবিড় এবং অবীরকেও পাশে পেল না। 'কিশলয় মুক্তি মার্গ'-এর মুক্ত পথ আজ তার কাছে
রুদ্ধ। সে একা নিজে সব সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ফলে দরিদ্র শিশুদের নীতিশিক্ষে এবং
মুক্তি পথ দেখানোর জন্য যে পথ নির্মাণ করে তার ভবিষ্যত নিয়ে প্রভাত চিন্তিত হয়। এছাড়া
ভবিষ্যতে কি আর এই প্রতিষ্ঠান অনাথদের জায়গা দেবে? আলোচনায় তো সৌমিত্র তুলেছিল বেতনের
কথা। চিন্তিত অবস্থায় প্রভাত একাকী আম গাছটার নীচে বসে সাতপাঁচ ভাবে।
প্রভাতকে চিন্তিত দেখে ঝর্ণা বলে, "কি রে! কি হয়েছে?"
"না
গো। কিছু না!"
একটু চাপা
স্বভাবের সে। মনের কথা চট করে প্রকাশ করতে চায় না। যদিও প্রভাত জানে এই ঝর্ণাদিদিই
তার মনটাকে বোঝে, তাকে ভালোবাসে।
"কিছু
না? মিথ্যা কথা!" ঝর্ণা বুঝতে পারে কিছু একটা
হয়েছে।
কিছু
বলবে না ভেবেও ঝর্ণা দিদির ভালোবাসাকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। সে আবেগ বিহ্বল হয়ে পরে, "কিশলয় মুক্তি মার্গ আর মুক্ত
নেই গো। এখানে হৃদয়ের টান ফুরিয়েছে!" প্রভাতের চোখ চিকচিক করে ওঠে। পরমূহূর্তে সে নিজেকে সামলে
নেয়।
ঝর্ণা
কিন্তু তার এই কথায় বুঝে যায় কিছু একটা হয়েছে। কি হয়েছে সেটা বুঝতে পারে না। তাই সে
উত্কণ্ঠার সঙ্গে বলে, "মানে?"
সেই সময় প্রভাতের ফোনে রিং বেজে ওঠে- 'বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহার....' রোহনের ফোন। প্রভাত ফোনটা
ধরে রোহনের সঙ্গে কথা বলতে থাকে। কথায় কথায় রোহন বলে, "আমি কাজ ছেড়ে দিয়ে এখন শহরে তোমার মতো
দুটো প্রতিষ্ঠান গড়েছি, দরিদ্র শিশুদের জন্য। তবে একজন ভালো আদর্শ শিক্ষক চাই। ঠিক তোমার মতো
কেউ। তোমার তেমন কেউ জানাশোনা থাকলে বলো।"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ! জানা থাকলে অবশ্যই বলব।"
ঝর্ণা
দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে থাকা প্রভাতের চোখের দিকে তাকাল। কদিনে প্রভাতের চোখমুখ থেকে
যে দীপ্তি হারিয়েছিল, এখন তার চোখে আবার যেন পুরানো দিনের দীপ্তি ফিরে এল।