গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

সাঈদা মিমি

মায়ের শাড়ি

মায়ের শাড়িতে একটা আলাদা ঘ্রাণ থাকে, একেক সময় একেক রকম দুপুরে মা যখন মাটির উনানে জ্বালানি দিতে দিতে বাকি রান্নার জোগাড়যন্ত করেন, তখন তার শাড়িতে আঁশটে ধোঁয়ার গন্ধ :ইশ মা, তোমার সাথে মাছের গন্ধ! :তাতো বলবিই, খাওয়া শেষ হলে শোনা যাবে, ফাস্টোকেলাস! স্নানের পর মা পরেন মাড়ভাঙ্গা মিলের কাপড়, একটু সুরমা চোখে, খানিকটা পাউডার কি ঘ্রাণ! একেই বুঝি মায়ের সুবাস বলে!! বিকেলেও মা তকতকে, রাতের কাজ সারতে সারতে আবার ঘেমো হয়ে যান বড় হতে হতে দেখেছি, রাতে মা স্নান করে, একপ্যাঁচের শাড়ি পরেনl নীল নয়তো আকাশি অথবা ঘষটে সাদা, আদি অকৃতিম মিলের মোটা সুতার কাপড়

মাত্র পনের বছর বয়সে মায়ের বিয়ে হয় দাদাজান বলতেন, সাগর সেঁচে মুক্তা এনেছি দাদিজান মোটেই সেরকম ভাবতেন না তার এম পাশ করা সুদর্শন ছেলের জন্য গরীব ঘরের এইট পাশ মেয়েটাকে এনেছেন, যেনো মায়ের পরম ভাগ্য! বিয়ের সব ঝামেলা শেষ হওয়ার পর তিনি মা কে বললেন, তোমার গয়নাগুলি দাও, বৌ আমার সিন্দুকে নিরাপদ থাকবে মা দিয়ে দিলেন, এমনকি দামী শাড়িগুলিও মায়ের হাতে রইলো একগোছা ব্রঞ্জে ঢালাই দেয়া চুড়ি, নাকফুল, আর কানে বকুলফুল ডিজাইনের রুবি পাথর বসানো একজোড়া টব দাদী শাড়িওয়ালাকে খবর পাঠালেন, আটজোড়া মিলের কাপড় রাখা হলো চারজোড়া মায়ের, চারজোড়া মেজ কাকিমার রান্নাঘরের কাজে ব্যাস্ত থাকবে বৌরা, বেশি দামি শাড়ি সহজেই নষ্ট হয়ে যাবে সেই রাতে দাদাজানের সাথে ঝগড়া হয়ে গেলো দাদির- :কাজটা ভালো করছো না, রহিমা! বাড়ির বৌ, কাজের ঝি নয় তোমাকেও আমি গরীব ঘর থেকে এনেছিলাম, আমি কিংবা আমার মা কোনোদিন কষ্ট দিয়েছি তোমাকে? এই কথার পর সারাঘরে কেয়ামত হয়ে গেলো

বাবা এবং মেজকাকার বয়সের পার্থক্য দেড়বছর দাদাজান দুইবার ঝামেলা না করে এদের বিয়ে একদিনেই করিয়ে দিয়েছেন কথা আসলে সেটা নয়, কথা হলো, মেজকাকিমা ধনী ঘরের মেয়ে সুন্দরী এবং অহংকারী, তাছাড়া তার ব্যাক্তিত্ব সাংঘাতিক দাদিজানের এহেন আচরণ উনি মেনে নিতেই পারলেন না প্রথমে কাকা কে বললেন, আলাদা হতে কাকা এবং বাবা কেউ তাদের মায়ের স্বিদ্ধান্তের উপর কথা বলেন না সুতরাং, উনি রাজি হলেন না অতঃপর নিজের বাবা মা এবং দুই ভাই কে ডেকে আনলেন আমার ঘাড়ত্যাঁড়া দাদি মোটেই মচকাবেন না; প্রধানমন্ত্রী গোল্ডামেয়ার কাকিমা তার বাবার বাসায় চলে গেলেন গেলেন মানে পুরোপুরিই, কাকা কে তালাক দিয়ে বাবার বয়স তখন বাইশ, সেজোকা' সাত, ছোটকা' জন্মাননি আমার গরীব ঘর থেকে আসা মা সবকিছুই মেনে নিলেন দ্বিতীয় জীবনশুরুর প্রারম্ভেই তার মেরুদণ্ড মোমের বানিয়ে দেয়া হলো

মা এসব কখনও বলেননি আমাদের পরচর্চা উনি ঘৃণা করতেন, কথা বলতেন কম অন্তত বিয়ের কয়কমাস পর যে মানুষটা জেনে গিয়েছিলেন, তার স্বামী এক চতুর ভ্রমর এবং এটাই তার নিয়তি; তিনি আরও নিশ্চুপ হয়ে গেলেন মায়ের যখন সতের, বড়দি জন্মালো এর দিন পনের আগে ছোটকা' জন্মেছেন সেই সময়ে, বৌ শ্বাশুড়ির কাছাকাছি সময়ে সন্তান জন্মানো বড় কোনো বিষয় ছিলো না সেই ঘটনার দেড়বছর পরে আমার প্রিয়দর্শিনী দাদি তার পুরোনো প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেলো সেই অপমান আর লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে দাদাজান পুরো পরিবার নিয়ে অচেনা এক মফস্বলে পাড়ি জমালেন বড়দি' পর মেজদি', তারপর বড়দা', মেজদা; সেজদা; তারপর আমি দাদাজান তখন চলাফেরা করতে পারেন না অসম্ভব ফর্সা, ভেঙ্গে চলা আয়ুর একজন মানুষ... ঐটুকুই আমার স্মৃতি শুনেছি, মেজকা' কোন এক মাজারে পড়ে থাকেন; সেখানকার খাদেম সেজকা', ছোটকা' বিয়ে করে বৌ নিয়ে আলাদা বাবা কলেজের শিক্ষক দাদাজান তার শেষজীবন, আসলে বাকি জীবন আমাদের সঙ্গেই কাটিয়ে গেলেন আমাদের ঘরে দাদিজানের প্রসঙ্গ তোলা বারণ ছিলো

আমরা যখন পরিবারের বৃত্ত ভেঙে নিজেদের পরিবার গড়েছি, মাকে সবসময় নতুন শাড়ি কিনে দিতাম; সুতির নরম কাপড় মাকে পরতে দেখিনি কখনও, পরলেও, কিছুক্ষণ পর খুলে ভাজ করে রেখে দিতেন আমাদের খুব রাগ হতো, এটা কি হচ্ছে মা? মা হেসে বলতেন, আমার ছেলের বৌরা আর তোরা ভাগ করে নিবি, আমি মরে যাওয়ার পর মা খুব যত্ন নিয়ে খেতেন, একটু ভর্তা, শাক, মাছ, মাংস একেবারেই না জোর করে গাইয়ের দুধ নিয়মিত করা হয়েছিলো তার জন্য মা পড়তে ভালোবাসতেন একটু অবসর মিললেই পড়তেন, গল্প থেকে ধর্মের বই বাবা মারা যাওয়ার পর মা কেঁদেছিলেন, একা হয়ে যাওয়ার দুঃখের চাইতেও বেশি ছিলো অভিমানের ধারাপাত হ্যাঁ, আমরা প্রত্যেকটা ভাইবোন মায়ের প্রতি বাবার অন্যায় অবজ্ঞা দেখেছিl সম্ভবত, একারণে আমরা মায়ের ছিলাম মনে প্রাণে

সেবার মসলিনের আদলে যে শাড়িটা মা কে পরাতে আমরা হেনস্থা হচ্ছি, তার নাতনির বিয়ে উপলক্ষে, মা কিছুতেই পরছেন না বড়দা' একটু খেপেছেন, মা, কত মেহমান আসবে, অন্তত এই শাড়িটা পরেন, আর সোনার বালাদুটো! কি একটা সুতির শাড়ি পরে আছেন এই প্রথম, আমার জীবনে দেখা এই প্রথম, আমার বৃদ্ধ মা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন! ওরে বাপ, সারা বয়সকালে পরেছি মিলের মোটা শাড়ি, ব্রোঞ্জের বালা শ্বাশুরি নিয়ম করে দিয়ে গিয়েছিলেন, আমার স্বামী সেই নিয়মের পালন করেছে আজ এই বয়সে, কবরে যাবার কাছাকাছি সময়ে, এই শাড়ি, বালা দিয়ে আমি কি করবো!! আমার কম কথা বলা মা, অল্প কথায় যে সত্যটা বলে দিলেন, তার নির্মমতা উপলব্ধি করার জন্য কিংবা মায়ের চোখের দিকে তাকানোর সাহস হয়নি বলেই, হয়তো আমরা, আমাদের আজন্ম নিঃসঙ্গ মাকে কষ্ট মুছে দেয়া কান্নার সূযোগ দিয়ে, নীরবে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম