গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

মনোজিৎকুমার দাস

      শুভ পূণ্যাহ                                                                                     
সেন এস্টেটের জমিদারবাবু স্বয়ং এবার কলকাতা থেকে শুভ পূণ্যাহ অনুষ্ঠানে আসবেন বলে হারাণ নায়েব খুবই ব্যস্ত এবং সেই সাথে শংকিতও। নায়েবমশাই মনে মনে ভাবেন, জলবর্ষার মধ্যে পূণ্যাহে আমাদের প্রজারা ঠিকমত আসবে তো!  বোশেখের এক তারিখে নতুন সালের পূণ্যাহ করার নিয়ম।  জমিদারবাবুর জন্যে শ্রাবণ মাসের শেষে তা করতে হচ্ছে। পাশের ধলহরাচন্দ্রের নিস্তারিনী ঠাকুরানীর জমিদারিতে পূণ্যাহ নিয়ম মাফিক বোশেখের এক তারিখেই হয়েছে। গড়াই গাঙের ওপারের সাওরাইলের জমিদার গিরিশ রায় বাবুদের জমিদারিতেও ওই তারিখেই পূণ্যাহ হয়েছে। কলিমুদ্দিন পেয়াদার আসতে দেখে নায়েবমশাই এর চিন্তায় ছেদ পড়ে।

কলিমুদ্দিন পেয়াদা বলে- নড়ালের জমিদারীর জন্যি আমাগেরে জমিদারী তো লাটে উঠবিনি, নায়েববাবু। হারাণ  নায়েব পেয়াদার কথা শুনে একটু রাগের সাথেই বললেন- কেন?
-  আফনি শোনেনি, নড়ালের জমিদারবাবু করন্ডি, আমলসার ও রামচন্দ্র এই তিন মৌজার খাজনা মাপ করে নিষ্কর করে দিছেন।
- খাজনা মাপ, নিষ্কর! কেন ? কলিমুদ্দিনের কথা শুনে নায়েববাবু অবাক হয়ে বললেন।                                                                                                       কলিমুদ্দিন পেয়াদা বলল- নড়াল ইস্টিটির  জমিদার বাবুর কিত্তি শুনলি পারে তাজ্জব হতি হয়। 
প্রহ্লাদ নায়েব মারা যাওয়ার পরে জমিদার ভুবন সেন তার কলকাতার পোস্তগোলার গোমস্তা রাঢ় দেশের হারাণ পোদ্দারকে নায়েব করে পাঠান তার পূর্ববাংলার জমিদারীতে। বণিক গোত্রের ভুবন সেনের জমিদারী এস্টেট একটাই মাত্র। ব্রিটিশ আমলে জমিদারী এস্টেটের মালিক হওয়া ছিল মান সম্মানের ব্যাপার। তাই ভুবন সেন সে আমলের লাখপতি হয়েও সখের বসে ছোট একটা জমিদারী এস্টেটের বন্দোবস্ত নেন।

কলিমুদ্দিন নতুন নায়েবের কাজে সন্তুষ্ঠ নয়। সে মনে মনে ভাবে- ছিল কলকাতার পোস্তগোলার ভূষিমালের আড়তের গোমস্তা হারাণ হয়ে আইছে সেন ইস্টিটির নায়েব! তেজারতি করতি হলিও তো অন্য আড়তে খোঁজপাতি রাখতি হয়, এ ব্যাটা তো দেখতিছি তাও জানে না। এ ইলাকার বড় জমিদার নড়াল ইস্টিট, তাগেরে সাথে পাল্লা দিয়ে এহানে জমিদারী করা চারটিখনি কতা না। হারাণ তো মুইকে কতাই কয়তিই দ্যায় না। পেয়াদাকে নীরব থেকে দেখে হারাণ নায়েব বললেন- বল দেখি কলিম,  নড়াইল এস্টেটের জমিদারে গল্প।   

নায়েবের কথা শুনে পেয়দা মুখ খুলল—আপনে জানেন না তো করন্দি, আমলসার, মাগরোর বিল, উদাস থিকে যত পূব দিকির গাঁও সব নড়াল ইস্টিটির জমিদারী। শাবন মাস পড়তিই গড়োই আর হানু গাঙের জলে য্যানো সুমুদ্র হয়ে যায়। বিল বাওড়ের জলে মাছ আর মাছ। সোনাখলি, সোনাইবিবির খালে বড় বড় বাঁশের চটার বাঁধ , গাঁওয়ে চাষীরা তাদের বাঁধালে লগে টোঙ বানায়ে তাতে পাহাড়ায় থাহে রাতিব্যালা যাতে কেউ মাছ চুরি না করে।                                                                                                                        সেদিনডাতে নড়াল ইস্টিটির জমিদারী বড়বাবু ও বড় গিন্নিমা দুজন পাইক নিয়ে পাবনা অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমে যাতিছিলেন নাও চড়ে সোজা বিল বাওড় দিয়ে। নাওয়ে তিনজন মাঝি। নাও আটকে গ্যাল সোনাইখালির পটল মন্ডলের মাছ মারার বাঁধালে। লগি ঠেলে মাঝি বাঁধালের লগে আসে চেঁচিয়ে বলল—বাঁধাল তোল, জমিদারের নাও। কিন্তু টোঙের মধ্যি থিকে কোন জবাব না আসায় তিনজন মাঝি এক সাথে কড়াগলায় বলল—জমিদারের নাও বাঁধালের বাঁশ ও চরাট তুলে যাতি দাও, নইলে--------                                                         ঘুম জড়ানো গলায় টোঙের মাঝ থিকে একজন বলে উঠল- জমিদার! জমিদার ! কতজনেই জমিদার কওলায়, নড়ালের জমিদার ছাড়া আর কোন জমিদার আছে নাকি। নড়ালের জমিদার ছাড়া আমরা কারোকেই জমিদার বলে মানি না। মাঝিরা তাদের কথার জবাব দেওয়ার আগে নাওয়ে ছইয়ের মধ্যি থিকে বড়বাবু মাঝিদের বললেন- নাও ফেরাও গ্রামের দিকে। তারপর কলিমুদ্দিন যা বলল তা থেকে হারাণ নায়েব বুঝলেন:ভোর হয়ে আসছিল । বড়বাবুর কথা মতো মাঝিরা নাও পাশের গ্রামের দিকে ফেরাতেই বড়বাবু বুঝতে পারলেন সামনের গ্রামের বিলের ধারেই তো তাদের এককালের নায়েব সদাশিব সরকারের গ্রাম করন্ডি। বড়বাবুর নাও সদাশিবের বাড়ির ঘাটে থামল। সদাশিব নড়াইলের জমিদার বাবু নাওকে চিনতেন। তিনি নাওয়ের কাছে এসে বড়বাবু ও বড়গিন্নিমাকে দেখতে পেয়ে হতবাক।
বড় বাবু ও বড়গিন্নি মাকে নাও থেকে বাড়ির ভিতরে দিয়ে যত্নআত্তি করার পর বড়বাবু সদাশিব নায়েবকে বললেন- খালের বাঁধালের কারণে মাঝিরা নাও ফিরিয়ে তোমার এখানে আসা। ভালই হয়েছে, বাঁধালে বাধা না পেলে তোমার এখানে আসাই হতো না। তার বাড়িতে বড়বাবু ও বড়গন্নিমার পদধূলি পড়ায় সদাশিব বেজায় খুশি, কিন্তু  মাঝিদের কথায় পটলরা জমিদার বাবুর নাও যাওয়ার ব্যবস্থা না করে বড়ই অন্যায় করেছে। বড়বাবু সদাশিবকে বললেন- তোমাদের গ্রামটা খুব সুন্দর! তবে লোকজন মনে হয় একটু বেয়াড়া। বড়বাবুর কথা শুনে বুঝতে সদাশিব বুঝতে পারলেন বড়বাবু কেন এ কথা বলছেন। বড়বাবু কী যেন চিন্তা করে বললেন- আমি সব প্রজাদের সাথে কথা বলব আজ সন্ধ্যেয় তোমার কাচারীতে। হাওড়ের যেখানে বাঁধাল আছে তাদের অবশ্যই এখানে আসার ব্যবস্থা করবে। ওদের সাথে কথা বলার জন্য আমাদের আজকের রাতটা তোমার এখানেই থেকে যেতে হল।                                     
কলিমুদ্দিন পরিশেষে যা বলল তা থেকে হারাণ নায়েব বুঝলেন পটল মন্ডলদের কথা খুশি হয়ে নাড়াইলে জমিদারবাবু তার স্টেটের অধীন তিনটি মৌজার নিষ্কর করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ সময় হারাণ নায়েব ভাবলেন, ভুবন সেন আসার আর সময় পেলেন না!
 কলকাতা থেকে ভুবন  সেন তাঁর জমিদারি সেরেস্তার নায়েব হারাণকে লিখেছেন - শ্রাবণের শেষ দিকে জমিদারী কাচারিতে আসিতেছি জানিপুরের ঘাটে বোট রেডি রাখিবে খোকসা রেলস্টশনে কলিমুদ্দিনকে ঘোড়াগাড়ি নিয়া যেন প্রস্তুত থাকে কত তারিখে গোয়ালন্দ মেলে আসিবো তা পরের চিঠিতে জানাইতেচ্ছি                                                                                                                 এইটুকু পড়ে নায়েব মশাইয়ের যেন মাথাটা ঘুরে যাবার অবস্থা ! দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কলিমুদ্দিন  পেয়াদার দিকে একবার তাকিয়ে আবার জমিদার বাবুর চিঠির বাকি অংশে চোখ রাখলেন
ভুবন সেনের হাতের লেখা যেন ছাপার অক্ষরের মতো - হারাণ , তুমি হয়তো  ভবিয়া অবাক হইবে এ সময়ে কলকাতার বালিগঞ্জ ছাড়িয়া আমার মতো ফুলবাবু জলজঙ্গলে ঘেরা জমিদারির তদারক করিতে বাঙাল দেশে যাইতে মনস্থ করিতেছি কেন শুভপূণ্যাহ অনুষ্ঠানে আমার ছেলে ভরত সেনের যাওয়ার কথা ছিল। ওর পরীক্ষা থাকায় বোশেখে যাইতে পারিল না  বলিয়া তারিখ পিছানো হইলেও  ভরত এখন না যাওয়ার জন্য টালবাহানা করিতেছে। আমার এখনও যাওয়া ইচ্ছে ছিল না । তবে শোন , সাওরাইলের গিরিশবাবু  ঘোড়ার রেস আমাকে এক হাত দেখানোর পর ... তিনি আমাকে বললেন -' ঘোড়ার রেসে হারজিত আছে মন খারাপ করিবেন না আমি বর্ষার সময় আমার জমিদারিতে ফিরে যাব বর্ষা শুরু হলে তো রেসকোর্সে ঘোড়দৌড় বন্ধ হয়ে যাবে আসুন না ভুবনবাবু বাঙাল দেশের বর্ষা দেখে আসবেন আর আপনার জমিদারীতে এ বছরে পূণ্যাহ হয়নি। ভরত নাকি যাবে না।  গড়াই নদীর ইলিশ তো ওরা খাওয়ানি , আর সাংলে জালে গড়াই নদীতে ইলিশ ধরার কী যে আনন্দ ! শ্রাবণের শেষ দিকে জমিদারি দেখতে যাওয়ার কথা জানিয়ে নায়েবকে চিঠি দিন আমিও থাকবো আসুন গড়াই নদীতে ইলিশ ধরা যাব '
তাই আমি বর্ষাকালে আসিতেছি ইলিশ ধরা যাইবে, আর শুভপূণ্যাহটা জমকাল ভাবেই করা যাইবে। আর হানু গাঙের ওপারে আমাদের অনেক পতিত জমি আছে। কিছু জমিতে ঘরবাড়ি উঠিয়াছে নাকি , ভরতের কাছে শুনিলাম। ওখানে আমি ভুবনডাঙা নামে একটি গ্রামের পত্তনি দেব বলিয়া মন:স্থ করিয়াছি। প্রজাদের খাজনাও বাড়াইতে হইবে।  
জমিদার ভুবন সেনের চিঠির এই টুকু পড়ে হারাণ নায়েব বিড়বিড় করে বললেন - এ দেখছি বড়  ল্যাটা !                                                                                                                                  কলিমুদ্দিন নায়েব বাবুর কথা ভাল ভাবে বুঝতে না  পেরে তাকে জিজ্ঞেস করল - জমিদার বাবুর কি লিহেছেন , খারাপ কিছু !                                                                                                                             - জমিদার আসছেন এ মাসের শেষ দিকে..... বিরক্ত সহকার হারাণ নায়েব কলিমুদ্দিনের কথার জবাব দিয়ে চিঠির বাকিটুকু পড়তে লাগলেন- হারণ কলকাতা হইতে বাঈজীদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা গিরিশ বাবুই করিবেন, তোমাকে তা নিয়ে ভাবিতে হইবে বে । তুমি শুধুমাত্র প্রজাদের  জানাইয়া দিবে যে পূণ্যাহের পরে রাতে বাঈজীদের গান বাজনা হইবে।
কলিমুদ্দিনের কথা শুনে হারাণ নায়েব বিরক্তির সুরে বললেন- তোমার খোশমেজাজ দেখে আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছে। বানের জলে প্রজাদের মাঠের ফসল ধৌত হয়েছে এবার , কোথা থেকে  তারা নজরানা দেবে। তারপর হানুগাঙের ওপারে ভুবনডাঙা নামে একটি গ্রামের পত্তনি দেবেন, প্রজাদের খাজনাও বাড়ানোর কথা তিনি লিখেছেন ! আমাদের জমিদারবাবু  সাওরাইলের জমিদার গিরিশ রায়ের এবার গড়াই নদীতে ইলিশ শিকারও করবেন, আর বাঈজীদের আনার দায়িত্বও তিনিই নাকি নিয়েছেন। 
 -কী কন !নায়েব বাবু অজ পাড়াগায়ে কলকাতার বাঈজীর নাচগান হবি বড়ই আনন্দিরই কতা। তাহলি তো সহলকে আগে আগে জানাতি হবি। কিন্তুক আমাগেরে জমিদার বাবু গিরিশবাবুর ল্যাজ ধরিছেন, না জানি গিরিশবাবু আমাগেরে জমিদারবাবুকে নাকানিচুবোনি না খাওয়ান! নতুন গাওয়ের পত্তনি , ভাল কতা । পাশের তিনডা মৌজা নড়ালে জমিদার নিষ্কর করে দিছেন, আর আমাগের জমিদারবাবু খাজনা বাড়াতি চাইতিছেন! কতাডো ভাল লাগতিছে না। এডাও গিরিশবাবুর ------
কলিমুদিদনের কথা থামিয়ে দিয়ে নায়েববাবু তাকে বললেন- শুভপূণ্যাহের চিঠিগুলি ঠিকঠাক বিলি করার ব্যবস্থা করগে। রামলাল সদ্দারকে লগিয়ে দাও পুকুর পাড়ের কূয়াটা চাটাই ঘিরে ফেলে একটা পায়খানা বানাতে। কলকাতার বাঈজীগেরে জন্য কী করব বুঝতে পারছি না। কোনটা থুয়ে কোনটা করব ,তা  মাথায় আসছে না।                                              
হারাণ নায়েবের কথা শুনে কলিমুদিদন পেয়াদা বলল- এত ভাবতিছেন ক্যানে?                            - কেন ভাবিতেছি তা বুঝতে পারলে তো তুমিই নায়েব হতে। হারাণ রেগে বলে উঠলেন।
কলিমুদ্দিন ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে খোকসা রেলস্টেশনে গোয়ালনন্দ মেইল আসার অপেক্ষায় ছিল স্টেশনে ট্রেন ভিড়তে সে দূর থেকেই দেখতে পেল ফাস্ট ক্লাশ কামরার জানালা ভুবন সেন জমিদারের মুখটা কলিমুদ্দিনের চোখে পড়ল। প্রহ্লাদবাবু নায়েবের সাথে সে ভুবন বাবুর বাড়ি বেশ কয়েকবার গিয়েছিল। কলিমুদ্দিন ভেবেছিল, গিরিশ বাবুও বাঈজীদের সাথে করে আনবেনে। পরে তার মনে পড়ল শুভপূণ্যের তো কয়েকদিন বাকী আছে। এত আগে কী বাঈজীরা কলকাতা ছেড়ে আসতি পরে। জমিদারবাবুকে নিয়ে নাও গড়াই নদী থেকে সুন্দরপুরকে বায়ে হানুগাড়ে পড়ল। কলিমুদ্দিন ভাবল- অল্প সুমাইয়ে মধ্যি কাচারী বাড়ির ঘাটে পৌছাবেনে। হারণ নায়েবমশাই নতুন মানুষ ! জমিদারবাবুকে ঘাট থিকে আদর জানায়ে কাচারিবাড়িতি নিয়ে যাবার জন্যি প্রেজ্জারদের ঘাটে হাজির করিছেন কিনা কে জানে!
নাও কাচারীর ঘাট লাগার পর কলিমুদ্দিন পেয়াদা চোখে আঁধার দেখল। প্রজারা দূরের কথা নায়েব, মহুরী কেউ ঘাটে নেই। কলিমুদ্দিন ভাবল-  হারাণ নায়েবের তো দেখতিছি জ্ঞানবুদ্ধি নেই।
নায়েব প্রজাদের নিয়ে গাঙের ঘাটে হাজির না থাকায় ভুবন সেন মনে কিছু নিলেন না। কারণ তিনি নিজেই তার আড়তের গোমস্তা ছিলেন। তার জ্ঞান গম্মি সম্বন্ধে জমিদার বাবু জানানা আছে। গান বাজনায় তার আগ্রহ বেশি। তাই সে শুভপূণ্যাহে কলকাতার বাঈজীরা আসছে যেনে হারাণ বেজায় খুশি হয়েছিল, তার সাথে বাঈজীদের না দেখে নায়েবের মনটা খারাপ হয়ে উঠল।
পূণ্যাহের দিন এসে গেল। পূণ্যাহ নিয়ে হারাণ নায়েবের কোন অভিজ্ঞতা নেই। যদু বংশী কাচারীর স্থায়ী মহুরী, সহদেব গোসাই সহকারী মহুরী । যদু বংশী বেশদিন কলকাতার আর.জি. কর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছেন অসুস্থ হয়ে।
কলিমুদ্দিন পেয়াদা নায়েব মশাইকে বলল- সহদেব গোসাইকে পূণ্যাহের পুজোর দায়িত্ব দেন। তিনিই পূণ্যের সব আয়োজন করতি পারবিনে। পূণ্যের টাহা পয়সা জমা দেওয়ার পর তাদেরকে বাতাসা ও কাগজের মালা  দিতি হয় তা কি আপনি জানেন? পেয়দার কথা শুনে নায়েব বললেন- পূণ্যাহের কোন কিছুই আমি জানি না। সহদেববাবুকেই সব দায়িত্ব দেব। সহদেব গোসাই পূণ্যাহের সব দায়দায়িত্ব নিয়ে পূণ্যাহের আয়োজন করলেন।  
কলিমুদ্দিন বলল নায়েববাবুকে বলল- শাবণ মাস হলিও দুই এক দিনের মধ্যি বৃষ্টি হবি নানে বলে আকাশ দেহে মনে হতিছে না, বাবু? ।কাল শুভপূণ্যে , দিন আর রাতডা ভাল গেলি পারেই হয়। নায়েববাবু কী যেন ভাবছিলেন। তিনি তার কথায় কান না দিয়ে অস্ফুট স্বরে বললেন- গিরিশবাবু ভালয় কাল দুপুরের মধ্যে এলেই হয়। তা না হলে তো কেলেঙ্কারীর এক শেষ হবে। বাঈজীদের আসার সময়ে কথা জমিদারবাবুকে জিজ্ঞাসাও করতে পারছি না।  
কলিমুদ্দিন কথাই সত্যি হল। আলোঝলমলে সকালটা দেখে কলিমুদ্দিন বেজায় খুশি। কাচারীর সামনে স্টেজ করার কাজ চলছে দুদিন ধরে। কলকাতার বাঈজীদের নাচগান বলে কথা! পূজাঅর্চনার পর পূণ্যাহ সাড়ম্বরে শুধু হল। দলে দলে প্রজারা আসছে কাদাজল ভেঙে, নয় তো নাওয়ে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার পথে। বাঈজীদের সাথে নিয়ে গিরিশবাবুর আসার নামটি নেই।                                                                          
জমিদার ভুবন বাবুকে চিন্তিত দেখে কলিমুদ্দিন সাহস করেই তার  সামনে হাজির হল।। কলিমুদ্দিন কোন কথা বলার আগেই জমিদার বাবু তাকে জিজ্ঞেস করলেন- পোস্ট অফিসে একটু খোঁজ নিতে পারলে ভাল হতো, কলিম।                                                                                       - পোস্টোঘরে কিসির কাজ বাবু? পিয়ন একরাম তো বিকেলের দিকি এ পথে বাড়িতি ফেরে, চিঠি থাকলি পারে তো ঠিক মতোই ---।                                                         কলিমুদ্দিন কথা শেষ না হতে একরাম পিয়নকে তাদের ওদিওকই আসতে দেখা গেল।                      সে এগিয়ে এসে বলল- জমিদার বাবুর টেলিগ্রাম ! জমিদার বাবু সই করে টেলিগ্রামটা একরামের হাত থেকে নিয়ে সেটা খুলে পড়ে তো হতবাক। জমিদারের মুখে কোন কথা নেই। কলিমুদ্দিনের সাহস হচ্ছে না টেলিগ্রামের কী লেখা তা জানবার। জমিদারবাবুই এক সময় নিজেই মুখ খুললেন- খবর খুব খারাপ কলিম, গিরিশবাবু অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে, তিনি বাঈজীদেরকে নিয়ে আসতে পারছেন না ।                                                                  -সব্বনাশে খবর বাবু, সন্ধ্যের আগেই লোক আসতি থাকবেনে। বাঈজীরা না আলিপারে কী হবিনি আপনিতো বুঝতি পারতিছেন না। নায়েব বাবুও নতুন লোক, আপনারা পালায়ে বাচতি পারেন। কিন্তুক আমাগেরে কী হবেনে? নাচগান না হলিপারে স্ট্যাজডা লোকে পুড়ায়ে দিবেনে।                                                                                             জমিদার বাবু চিন্তিত কন্ঠে বললেন- তোমার নায়েব আর সহদেববাবুকে ডাক, কলিম। সহদেব গোসাই কাছেই ছিলেন , নায়েববাবু জমিদারবাবু’র দিকেই আসছিলেন। জমিদার বাবু ভাবলেন – হারাণ নায়েবের দ্বারা কোন কাজ হবে না। সহদেব বাবু স্থানীয় মানুষ , তার কাছ থেকে একটা পরামর্শ পাওয়া যেতে পারে। নায়েববাবু ও সহদেব গোসাইকে টেলিগ্রামের খবরটা জমিদার বাবু জানালে সহদেব গোসাই রেগে গিয়ে বললেন- জমিদারবাবু , আমার ক্ষমা করবেন আমার কথা মন্দ হলে সাওরাইলের জমিদার আপনার বন্ধু! কেমন বন্ধু ! ঘোড়ার রেসে’র বন্ধু আর এক গ্লাসের-----                                      গোসাইয়ের কথা থামিয়ে দিয়ে হারাণ নায়েব বললেন—আহ! কী যা তা বলছেন, গোসাইজী।
জমিদার ভুবন সেনের ফরসা মুখটা লাল হয়ে গেলেও কিছু না বলে সহদেব গোসাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এদিকে, নায়েব বাবু  মনে মনে ভাবলেন,  আমাদের জমিদার ভুবন সেনের এক গ্লাসের দোস্ত গিরিশ রায় ঘোড়ার রেসে হারানোর পর এবার সেন জমিদার এস্টেটেও হারিয়ে দিলেন প্লান করে। সহদেব গোসাই অনেক্ষণ ধরে ভাবার পর তার মনে হল মধুশ্রী অপেরার রিহার্সেল তো এবার চলছে রাজাপুরের রাজবাড়িতে, নায়ক অমলকান্তি আর নায়িকা তার স্ত্রী মধুশ্রী । আজ রাতেই তো বঙ্গে বর্গি  বইয়ের ফাইনাল রিয়ার্সেল। অমলকান্তি আমার মামাতো ভাই , তাকে এই স্টেজে ফাইনাল রিয়ার্সেল করার কথা বললে খুশি মনে তা সে গ্রহণ করবে। সহদেব গোসাই কলিমুদ্দিনকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন – রাত কয়টায় অনুষ্ঠান আরম্ভের কথা? জবাবে সে বলল- রাত দশটায়।                                                                                 - ঠিক আছে,                                                                                                          তার সাথে কথা শেষ করে সহদেব গোসাই জমিদারের রুমে গিয়ে বললেন- জমিদারবাবু , চিন্তা করবেন না । আজ রাতে গান এখানে হবে বাঈজীদের থেকেও বড় নাচনেওয়ালিদের নাচগানে।                                                                                                       সহদেব গোসাই কলিমুদ্দিন পেয়দাকে সাথে নিয়ে  নৌকায় রাজাপুরের রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। রাত আটটার দিকে মধুশ্রী অপেরার পুরোদল নিয়ে তারা কাচারী বাড়িতে ফিরে এল।                                                                                              
মধুশ্রী অপেরার বঙ্গে বর্গি   নামের যাত্রা শুরু হল রাত সাড়ে দশটায়। নাচগান অভিনয়ে লোকজন মন্ত্রমুগ্ধ । যাত্রা শেষ হওয়ার আগেই জমিদার ভুবন সেন সহদেব গোসাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন- বাবা সহদেব, তুমি আমার মান সম্মান রক্ষা করেছো। গিরিশের কথায় বিশ্বাস করে আমি প্রথম বারের মতো শুভপূন্যাহ করতে এসে ডুবতে বসেছিলাম। তুমি আমাকে আর আমার জমিদারীকে বাঁচালে। আমি বই শেষ হওয়ার পরই স্টেজেই সবাইকে পুরস্কৃত করবো। আর আমি কলকাতায় যাওয়ার আগে তোমাকে পুরস্কার দিয়ে যাব। সত্যি সত্যি বই শেষ হওয়ার পর নায়ক নায়িকা সহ সবাইকে জমিদার বাবু স্টেজেই পুরস্কার দিলেন। আর ঘোষণা করলেন- হানুগাঙের ওপারের ভুবনডাঙা নামে নতুন মৌজার নিষ্কর পত্তনি দিলাম, আর কোন প্রজার জমির খাজনা বাড়ানো হবে না বলেও ঘোষণা দিলাম।                                                                         সেন এস্টেটের জমিদার ভুবন সেনের জয়জয়কার সবার মুখে ছড়িয়ে পড়ল।
জমিদার ভুবন সেনের কলকাতা ফেরার দিন এসে গেল। কলকাতায় ফিরে যাওয়ার আগের রাতে সহদেব গোসাই, কলিমুদ্দিন ও হারাণকে নিয়ে কাচারীতে বসলেন দু’একটা কথা বলার জন্য। প্রথমে হারাণ নায়েবের উদ্দেশ্যে বললেন- তুমি পোস্তগোলার ভুষিমালের আড়ত থেকে এখানে নায়েব করে পাঠিয়ে আমি মস্ত বড় ভুল করেছি। তোমার জায়গা এখানে নয়। তুমি না থাকায় পোস্তগোলার কারবার লাটে উঠেছে। তোমাকে আমি আবার কলকাতায় ফিরিয়ে নেব। জমিদারবাবুর কথা শুনে হারাণ নায়েব মনে খুশি হলেন। তিনিও চাচ্ছিলেন কলকাতায় ফিরে যেতে। জমিদার ভুবন সেন আবার মুখ খুললেন- কলিমুদ্দিন , তুমি খুবই কাজের লোক। তোমার মাইনে মাসে পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দিলাম। সহকারী মহুরী সহদব গোসাই তোমাকে তো কলকাতায় ফিরে যাওয়ার আগে একটা পুরস্কার দিতে চেয়ে ছিলাম, তাই ন?                                                                                                                          – আমি তো পুরস্কারের প্রত্যাশী নই জমিদারবাবু। উত্তরে সহদেব গোসাই বললেন। জমিদারবাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন- হারাণের পরিবর্তে আমি তোমাকে আমার এস্টেটের নায়েবের দায়িত্ব দিচ্ছি। তুমি না থাকলে আমার শুভ পূণ্যাহ অশুভ পূণ্যাহ হয়ে যেত। আমি কলকাতায় ফিরে তোমার নিয়োগপত্র পাঠিয়ে দেব।                                                      সহদেব গোসাই কখনোই কল্পনা করেননি জমিদারবাবু তাকে এমন পুরস্কার দেবেন। তিনিও জমিদারের এ ঘোষণায় খুশি না হয়ে পারলেন না