ছেলেবেলা থেকে বাজারে এবং বাজারের আশেপাশে
তাকে দেখে আসছি। বাঁশী হাতে, কখনও উলঙ্গ, কখনও হ্যাফপ্যান্ট্ পরে। কদম্ ছাঁট চুল। সবাই তাকে ভজা নামেই চেনে।
গোটা শহরটাতে,
ভজাকে চেনে
না, এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে
না।
শোনা যায় ভজা যেদিন যে দোকানে যায়, সেই দোকানে সেদিন, বিক্রির পরিমান অস্বাভাবিক
বেড়ে যায়। ফলে সব দোকানদারই চায়, একবার তার দোকানে ভজার পায়ের ধুলো পড়ুক। কিন্তু অন্যের ইচ্ছায় ভজার
কিছু যায় আসে না। ভজার চলাফেরা সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় নিয়ন্ত্রিত হয়।
ভজা আর কেউ নয়, একটা বদ্ধ পাগল। তাকে ভালমন্দ
খাবার খাইয়ে সব দোকানদার, বাজারের সব বিক্রেতা, গনেশের আরাধনা করে। সিঙ্গারা, কচুরী, জিলিপী, মিষ্টি— ভজা বেশ ভালই আছে।
এরমধ্যে কে আবার ভজার কৃপাদৃষ্টি পেতে, তাকে একটা বাচ্ছাদের ছোট
ঢোল উপহার দিয়েছে। বাঁশী ছেড়ে ভজা দু’টো মোটা কাঠি দিয়ে, সারাদিন ঢোল্ পিটিয়ে বাজারের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ঘুরে বেড়াতে
লাগলো। পায়ে খরম্, মাথায় লাল রঙের স্পঞ্জের টুপি, গলায় ঢোল্। ঢোল্ ভজার প্রিয় বাদ্যযন্ত্র
ভেবে, আরও বেশী লাভের আশায়, কে আবার বড় একটা ঢাক্, ভজাকে
উপহার দিয়ে বসলো। পূজামন্ডপে ঢাকী যে ঢাক্ বাজায়, একবারে নতুন একটা সেই ঢাক্। প্রতিযোগিতার
বাজারে এটুকু না করলে চলবে কেন? বিজ্ঞাপনের জন্য তো মানুষ কত খরচ করে। এ তো সামান্য একটা ঢাক্।
বড়, প্রমান সাইজের ঢাক্ পেয়ে ভজা মহা খুশি।
সারাদিন দোকান বাজারের আশেপাশে ঢাক্ পিটে চলেছে। খুশি দোকানদারও, লক্ষ্মী তার দোকানে আসলো
বলে।
এইভাবে বেশ চলছিল, হঠাৎ কোথা থেকে দ্বিতীয়
এক পাগলের আগমন। সবাই তার নাম দিয়ে ফেললো “ভোলা”। ভোলা কিন্তু ভজার বাজার নষ্ট করতে
পারলো না। তবে ভজার সান্নিধ্যে থাকায়, ভোলার খাবারের অভাব হ’ল না। এটা প্রমানিত হ’ল যে, ভজা ভোলার থেকে শতগুণে পয়া।
ভজা আর ভোলাকে
নিয়ে বাজার-দোকানের বিক্রেতাদের দিন বেশ
ভালই কাটছিল। এরমধ্যে ভজা একদিন
ঢাকের ফিতে গলায়
ঝুলিয়ে ঢাক্ পেটাতে পেটাতে, রাস্তার ধারে গভীর পুকুরটার পাড়ে গিয়ে
উপস্থিত হ’ল। পিছল পুকুরপাড়ে ঢাক্ পেটাতে গিয়ে সে পুকুরে পড়ে গেল। ঢাকের ফিতে গলায়
ঝোলানো থাকায়, সে জল খেলেও ডুবলো না। ঐ ঢাক তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা
করলো। ভোলা সেই দৃশ্য পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে স্বচক্ষে দেখলো।
খবর শুনে বাজার দোকানের বিক্রেতারা
দোকান বাজার ফেলে, পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভজাকে ডাঙ্গায় তুলে আনলো। সকলে মিলে তার সেবা
করে তাকে সুস্থ করে তুললো। একজন আবার বড় এক গ্লাশ গরম দুধও তাকে খেতে দিল।
কোন দোকানদার বেশী পূণ্য অর্জন করলো, কে লক্ষ্মীর আশীর্বাদ পেল
জানিনা, তবে সকলে ঢাক্ উপহার দাতাকে
ধন্যবাদ জানিয়ে একবাক্যে স্বীকার করলো— “রাখে হরি মারে কে”?
সত্যি কথা। ভজা হরির অবতার। কাজেই হরি
তো তাকে রক্ষা করবেনই।
আবার আগের মতোই দিন কাটতে লাগলো। ভজার
সাথে ভোলার অন্তরঙ্গতা ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। ক্রমে ভোলা ভজারই অংশ বলে লোকে বিশ্বাস করতে
শুরু করেছে। কচুরী, সিঙ্গারা, জিলিপীর ভাগ ভোলাও পেতে শুরু করেছে। ভজার ঢাক্ ভোলার গলায় মাঝে মধ্যেই
দেখা যাচ্ছে। এমন সময় ঘটলো দ্বিতীয় অঘটনটা।
ভোলার ঢাক্ পেটানোর ঠেলায় ভজার ঢাকের
চামড়ায় একটা ফুটো দেখা দিল। সেই ঢাক ভজার গলায় ঝোলানো। দু’জনে সেই পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে। ঢাক্ বাজাতে
বাজাতে ভজা ঢাক্ গলায় আবার পুকুরে পড়ে গেল। ভোলা পাড়ে দাঁড়িয়ে। এবার কিন্তু ঢাকের ফুটো
দিয়ে জল ঢুকে, পাথরের মতো ভাড় তার গলায় চেপে বসলো। ভজা হাজার চেষ্টা করেও পাড়ে ফিরে
আসতে পারলো না। যে ঢাক্ গতবার তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল, এবার সেই ঢাকই তাকে অতল
জলে ডুবিয়ে নিয়ে গেল। ভোলা এবারও পাড়ে দাঁড়িয়ে ঘটনাটা দেখলো।
দোকানদাররা যখন খবর পেয়ে পুকুর পাড়ে
এসে পৌঁছলো,
তখন ভজা অনেক
দুরে চলে গেছে। ভজার নিথর দেহ যখন জল থেকে তোলা হ’ল, তখন পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে, সকলকে কাঁদিয়ে, সে অন্য লোকে চলে গেছে।
এবার কিন্তু সকলে ঢাক্ উপহার দাতাকে
অভিশাপ দিতে দিতে একটা কথাই বললো— “মারে হরি রাখে কে”? ভোলাই সেদিনের হরি ছিল কী না বা ভজার শুন্যস্থান ভোলা পুরণ করতে পেরেছিল
কী না জানিনা।