বি.এ. পরীক্ষা দিয়ে বাড়ী
যাচ্ছে মালেক । নন্দাইলগামী বাসটা যখন
কেন্দুয়া বাজারে এসে দাঁড়ায় দিনের সূর্যটা তখন পশ্চিমে লুটোপুটি খাচ্ছে । মাগরিবের আযান হলে
অন্ধকার হতে দেরী হয়না । যারা গাঁয়ের ছেলে অথবা যাদের জীবনে গ্রাম দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তারা
জানে রাত কত নিষ্ঠুর হাঁটাপথে । তাই কালক্ষেপণ না করে বাস হতে নেমেই গুণাই নদীর পথ ধরে হাঁটতে থাকে
মালেক । সন্ধ্যায় নদীঘাটে নৌকা
শোভা পায় । দিনভর যারা দিনমজুরীর
কাজ করে গৃহস্থের জমিতে, সন্ধ্যায় তারাই মাঝি
হয়ে নদী পার করে অন্যদের । মৃত গুণাই নদীতে মাঝিরা স্থায়ী কর্মের সন্ধান করতে পারেনা কখনও । এখান থেকে দু চার পয়সা
উপার্জন হলে তা সংসারে বাড়তি আয়ের বন্দোবস্ত করে মাত্র ।
যাহোক রাতের অন্ধকার যখন ক্রমেই
ঘনতর হচ্ছে তখন একটি নৌকা জোগাড় আবশ্যক মালেকের জন্য ।নদীর ঘাটে এসে পরিচিত মাঝি
খুঁজে সে । দৃষ্টিগোচর হলে আশ্বস্ত
হয় । মাঝি জেলে পাড়ার করম
আলী ।ঐ পাড়ার মুগা মালেকের
বন্ধু মানুষ । ছোটবেলা একই স্কুলে
পড়েছে ওরা । করম আলী ওরই বাপ ।মালেকের পরিচিত জন্মের
পর থেকেই । ডানপাশের চোখটা নষ্ট
হওয়ায় ছোট থেকেই ওকে একটা কাল চশমা পড়তে দেখেছে মালেক । ওটা এখনও আছে । সময় গড়িয়েছে, সাথে চোখে দৃষ্টিও কমেছে তার ।কিন্তু পুরনো চশমাটা
পরিবর্তন হয়নি আজও । ঠিক পরিবর্তনও নয়, নতুন আরেকটা কেনারই হয়তো সামর্থ্য হয়নি তার । ডাঁটগুলো ভেঙে গেছে
কবেই । এখন ওটা চোখে আঁটতে দু’পাশে সুতো বেঁধে
নিয়েছে করম ।
নৌকা
চলে গুণাই নদীর শ্রান্ত জলে । সহসা কথা হয়না দু’জনে । হয়তো করম চিনতে পারেনি মালেককেঅথবা গাঁয়ে ফেরার দীর্ঘ বিরতিতে হয়তো ভুলে গেছে সে । মালেকও যেচে কথা বলতে যায়না । নৌকারগলুইয়ে চুপচাপ বসে থাকে সে । ভাড়া মিটিয়ে নামার সময় করম বলে-
-কেডাগো চেনা ঠেহে মালুম অয় ? মালেক বলে-
-মালেকগো কাহা ইয়ার আলীর পূত ।
-আন্ধারে একলা যে, কালীতলা কাটাই যাইও ।
-কেগো কাহা , বাঁধ দেও যে ?
-সত্য হুননাই মালুম অয় ? ভূদেব ফেরত আইছে হুনি ।
-ভূদেব মুচী, হাচানি কাহা ?
-নিয্যস । মিছা কইতে ডর অয় ।
করম আলীর কথা বিশ্বাস হয়না মালেকের । গুণাই নদী পার হয়ে ওদের
বাড়ী যেতে হাঁটতে হয় বেশ খানিক সময় । বর্ষাকালে যখন বন্যার পানিতে গ্রাম ভাসে, তারপর নদীর জল এসে ওদের দহলিজ ছোঁয়, তখন কেন্দুয়া বাঁজার হতে বাড়ী অবধি নৌকায় আসা যায় । পৌষ-মাঘ মাসে নদী
শুকিয়ে মরা গাঙের রূপ নেয়,তখন বাড়ীর পথটাও দীর্ঘতর হয়
আগের চেয়ে ।
যাই হোক গুণাই মাঝির সাথে কথা সেরে
গাঁয়ের পথ ধরে হাঁটতে থাকে মালেক । হয়তো প্রথম পা ফেলতেই একটা সুনসান নীরবতা অনুভব করে সে । রতের অন্ধকারটাও ঝেঁকে
বসেছে ইতোমধ্যেই । আগে কিন্তু এমন ছিলনা । শেষবার যখন গ্রাম
ছেড়েছিল মালেক তখনও দেখেছে রাতের শেষ অবধি হাঁটুরে দল যাতায়াত করে এ পথ ধরেই । কারও কারও হাতে
হ্যারিকেনের অর্ধনিভন্ত আগুণ থাকতো । আজ নেই ।সবাই কি ভয় পেয়েছে ভূদেবের ফিরে আসার খবরে ? ভূদেব কি সত্যি ফিরে এসেছে ? কিভাবে ফিরে এল সে সশরীরে নাকি অশরীরী কোন আত্মা হয়ে ?
মুহূর্তে একটা অজানা আশঙ্কা এসে ভর
করে মালেকের মধ্যে । তারপর ওর বিদ্যার সামান্য অহংকারটুকুও ম্লান হয়ে যায় যেন । একরকম জীবন বাঁচানোর
তাগিদেই পা টিপে টিপে একসময় বাড়ীর উঠোনে এসে দাঁড়ায় সে । মরিয়ম বিবি হাতে একটা
পিদিম নিয়ে ছেলের জন্য অপেক্ষা করে বারান্দায় । দৃষ্টিগোচর হলে সে বলে-
-বাজান আইলি ?
-হুম ।
-ডরাইছস মালুম অয় ?
মায়ের কথার জবাব দেয়না মালেক । দিতে ইচ্ছেও করেনা তার । ঘরে এসে বিছানা নেয় সে । পরদিন মুগার ডাকে ঘুম
ভাঙে ওর । করম আলীর কাছে ওর আসার
খবর শুনে প্রিয়বন্ধুকে দেখতে এসেছে সে । পরক্ষণে ছাইয়ের গাঁদি থেকে একটা পোড়া কাঠের কয়লা তুলে মাজন করতে
করতে নদীর ঘাটে এসে দাঁড়ায় দুজন ।মালেক বলে-
-ভূদেব ফেরত আইছে হুনি, কতা হাঁচা ?
-নিয্যস । হগগল কই হুন ।
তারপর মুগার কথায় যে সত্য প্রকাশ
হয় তার সারমর্ম এই, বহুকাল পূর্বে মুসলমান
পাড়ায় যে ভূদেব বসবাস করত সে আবার ফিরে এসেছে সত্যি । ফিরে এসেছে অশরীরী আত্মা হয়ে । এসেই পার্শ্ববর্তী বারুইল গ্রামের কছিখাঁর মেয়ে হেনার উপর ভর করেছে
সে । প্রথমে সবাই ভেবেছিল
জীনের আঁচর ।পরে যখন পীরগঞ্জের
নুহাই মুনশি দাওয়া দিতে মুখোমুখি হল সেদিন ভূদেব স্বয়ং কথা বলেছে ওর সাথে । হেনার মুখ দিয়ে গড়গড়
করে সব সত্যি প্রকাশ করেছে সে । তারপরইতো আশ্বস্ত হল সবাই । এটা ভূত, জীন কখনও হিন্দু হয়না ।
ভূদেব ফিরে আসার পর থেকে একটা
থমথমে ভাব বিরাজ করে গাঁয়ের সর্বত্র । জীবন সায়াহ্নে এসেও যে মানুষটার মাথাই টুপী উঠেনি কোনদিন, এখন নামাজের ওয়াক্ত হলে সেই মসজিদে প্রথম মুসল্লি হয়ে
উপস্থিত থাকে । দরগাতলায় পীরের মাজারে
দিনান্তে শিরনী দেয় কতজন! গাঁয়ের উড়নচণ্ডী
ছেলেগুলো একসময় যারা মেথরপাড়ার ভাতপচা মদ খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতো, এখন তারাই মাজারে খাদেমের কাজ করে । রাত গভীর হওয়া পর্যন্ত
মুসলমান মেয়েদের মুখে আল্লাহ আল্লাহ রব শুনা যায় ।
ভূদেবের প্রথম গাঁয়ে আসার
মুহূর্তটা মনে পড়ে মালেকের । ধান কাঁটার মৌসুম শেষ হয়েছে মাত্র ।ফসলহীন জমিগুলোতে সীমাহীন রিক্ততা । নবান্ন উৎসব শুরু হয়নি
তখনও । এমনই এক সময় ভূদেবের
আগমন । এসে কালীতলায় নজুখাঁর
অনাবাদী জমিটায় একটা ছোট ডেরা তুলেছিল সে । নজুখাঁ অবশ্য রাজী ছিলনা এতে । সে বলেছিল-
-হিঁদুর ছাও মালুম অয় ? অধর্ম চলবার নয়, বিদায় ল হারামির পুৎ । ভূদেব বলেছিল-
-তিনকুলে কেউ নাইগো কাহা । থাকুন দেন, মুচীর কাম করুম বাঁজারে । অবশেষে নুহাই মুনশির মধ্যস্থতায় ভূদেবের থাকার ব্যবস্থা হয় গাঁয়ে ।
কেন্দুয়া কিন্তু মুসলমানদের গ্রাম । হিন্দু চিহ্নের
ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই এখানে । বয়স্করা বলে স্বাধীনতার পর এ গাঁয়ে হিন্দু দেখেনি কেউ । স্বাধীনতা উত্তরসূরিদের
কাছে হিন্দু জীবন রূপকথার ন্যায় । গাঁয়ের ছেলেরা তাই ভূদেব এলে কদিন ওকে ঘিরে জটলা করে । তারপর একে একে তারাও
ব্যস্ত হয় যার যার মত।
এখানে এসে বাজারে মুচীর কাজ করে
ভূদেব । তাতে উপার্জন সামান্যই । যেহেতু সংসারে আপন বলে
আর কেউ নেই, সেহেতু রান্নাবান্নায়
সামান্য অসুবিধা বোধ হয় হয়তো কিন্তু ওকে উপোষ থাকতে হয়না কোনদিন। মাঝেমাঝে একাকীত্ববোধ
হয় খুব । গাঁয়ের উড়নচণ্ডী হাভাতে
ছেলেগুলোও হিন্দু বলতে ছি!ছি! করে ওকে নিয়ে । সৃষ্টি থেকে পরধর্ম চর্চায় যে কালী জমেছে মানুষের মনে তা কি এত
সহজে দূর হয় ? মুসলমান পাড়ার পথ দিয়ে রীতিমত আসা যাওয়ার বারণ ওর । অথচ ভূদেবকে কোন দিন
শক্ত করে ধর্ম পালন করতেও দেখেনি কেউ । ওর ঘরে পূজা অর্চনার কোন সরঞ্জাম শোভা পায়না । বেশভূষাতেও নয় ।
যাহোক তবুও ভূদেবের একাকি সংসার দৃষ্টি
এড়ায়না গেঁয়োদের । কয়েক হাজার মানুষের
মধ্যে এক দুইজন থাকে যারা ওর সাথে মিশতে আগ্রহবোধ করে । রাতে এসে একা একা
বিছানায় শুয়ে থাকে ভূদেব । ইচ্ছে হলে নিজের সাথেই কথা বলে সে । কে জানে, মনে মনে হয়তো সেও একটা
অচেনা মেয়ে মানুষের মুখশ্রী আঁকে । সাথে একটা ঘর আর একটুকরো জমি ।
জ্যৈষ্ঠের গরম কমতে শুরু করেছে
ইতোমধ্যেই । এমনই একদিন বাজার থেকে
আসার পথে ভূদেবের সাথে দেখা মালেকের । ডাক দিতেই নিতান্ত অপরাধীর মত সামনে এসে দাঁড়ায় সে । তারপর বলে-
-কিছুনি কবা দাদা ? মালেক বলে-
-নিয্যস । শুক্কুরবার আমরার বাড়ী নেমন্তন নেও ।
মালেকের প্রস্তাবটা নিতান্তই
অপ্রত্যাশিত ভূদেবের কাছে । এ পাড়ায় ভাল করে কথাই বলেনা কেউ ওর সাথে, তার উপর
মুসলমান বাড়ীতে নেমন্তন্ন । একটা অজানা আশংকা এসে ঠাই নেয় ভূদেবের মধ্যে । সে বলে-
-ক্ষেমা দেও দাদা । মাও তোমার
গোস্বা অইব ।
কথা ঠিক । মরিয়ম বিবিকেও ভূদেবের
ব্যাপারে কোনদিন আন্তরিক হতে দেখেনি মালেক । কিন্তু তবুও ছেলে প্রস্তাব দিলে
ভূদেবের ব্যাপারে সেদিন আপত্তি করেনা সে । কে জানে, হয়তো মালেককে খুশী করতেই মা’র এ প্রস্তাব মেনে নেওয়া । যাহোক যথারীতি শুক্রবার গাঁয়ে একটি সাদা
চাদর জড়িয়ে নেমন্তন্ন খেতে উপস্থিত হয় ভূদেব । ওকে দেখে আশ্চর্য হয় সবাই । এখনও
ততটা শীত পড়েনি যে দিনে গাঁয়ে চাদর জড়াতে হবে । পরমুহূর্তে প্রকাশ হয় সত্যিটা,আসলে দাওয়াত খেতে আসার মত বিশেষ কোন কাপড় নেই ভূদেবের । অনাবৃত দেহ
ডাকতে তাই এ কৌশল অবলম্বন। মালেকদের বাড়ীতে এসে কারো সাথে কথা বলার সাহস হয়না ভূদেবের । মরিয়ম
বিবি বলে-
-আমারে শরমাওনি বাপ,ঘেন্না কই আমার
নাই ?
তবুও সহজ হতে পারেনা ভূদেব । লজ্জা
পেলে হয়তো চোখের পাতা পড়ে ঘনঘন । হাতে আনা হালি দুই কলা মালেককে দিয়ে বলে-
-হগগল তোমার জন্যি দাদা । খাইয়ো
কলাম ।
মালেকদের বাড়ী থেকে সেদিন রাত করে
বাড়ী ফিরে ভূদেব । এরপর বাজারে এলে প্রায়ই কথা হয় দুজনে ।কুশলাদি জানা হয় । ফেরার পথে সস্তাদরের
কিছু সদাই হাতে দিয়ে ভূদেব বলে-
-লও কাউরে কইয়োনা কলাম ।
ভূদেব কার কথা বলে সহজে অনুমান
করতে পারেনা মালেক । প্রথমত, নিজের বলে কেউ নেই তার
দ্বিতীয়ত, লোকানোর মানুষ । যাহোক এভাবেই দিনে দিনে
একটা অসম বন্ধুত্ব তৈরি হয় দুজনে । এক এক করে দিন যায় । তারপর মালেকের মাধ্যমেই ওদের দলে পাড়ার উড়নচণ্ডী ছেলেগুলোও এসে
জুটে এক সময় । বয়স বাড়ার সাথে সাথে
পাড়ায় ছেলেগুলো বিড়ির নেশায় আকৃষ্ট হয় । তারপর মেথরপাড়ার ভাতপচা মদ । ভূদেবের হাতে কাজ না থাকলে ওর ঘরে এসে জোয়ার জমায় ছেলেরা । প্রাপ্ত টাকা ভাগাভাগি
নিয়ে কলহ করে । সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটে
দ্রুত । এরপর আবার কোন অজুহাত
পেলে সম্পর্ক তৈরিতে সময় নেয়না । এরও মাস ছয় পরের কথা, একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে বড় রাস্তার মোড়ে মালেকের সাথে ভূদেবের
দেখা । চোখাচোখি হলে হাঁক দেয়
ভূদেব-
-মালেকনি খাড়া কতা কই ।
-শিগগির ক, হাতত কাম মেলা ।
-আজ রাইতে যামু, ভারুইল যাত্রা পালা ।
-যাত্রানি, মা জানলে গোস্বা অইব ।
-পলায় যামু । কাউরে কওন বারণ ।
সেদিন রাতে পালিয়ে ভূদেবের সাথে
ভারুইল বাজারে যাত্রা দেখতে যায় মালেক । যাত্রা শেষে ওরা যখন বাড়ী ফেরে মসজিদে ফজরের আযান হয় তখন । সেদিন হয়তো বুঝতে
পারেনা কেউ । কিন্তু ব্যাপারটা
বেশীদিন গোপন থাকেনা কারো কাছে । কি এক কারণে পাশের বাড়ীর সবুরের সাথে কলহ হলে একদিন সবার কাছে
সত্যিটা প্রকাশ করে দেয় সে । ইয়ার আলী পুত্রের এমন কর্মে নাখোশ হয় খুব । বাপের রক্তচক্ষুকে ভয়
করে মালেক । এ নিয়ে একদিন কড়া
শাসনের মুখোমুখি হতে হয় তাকে । এর কদিন পর একদিন ভূদেব এলে শাসায় ইয়ার আলী ।
-হারামিরপু ডরাইস । গেরাম ছাড়া করুম কই ।
ইয়ার আলীর চোখে চোখ রেখে কথা বলার
সাহস হয়না ভূদেবের । বেরিয়ে এসে গাঁয়ের পথ ধরে সে । তারপর দীর্ঘদিন ওর সাথে দেখা
হয়না মালেকের । কদিন পর গেঁয়োরা বলাবলি করে ভূদেব নিরুদ্দেশ হয়েছে কোথাও । ওর ঘরের
আসবাবপত্র সব ঠিক আছে,
কেবল তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা গাঁয়ে । সমবয়সী যে ছেলেগুলোর সাথে
সখ্যতা হয়েছিল ভূদেবের তারাও খবর জানাতে অপারগ ।
ভূদেব নিরুদ্দেশ হওয়ার পর কিছুদিন
ওর ঘরের জিনিসগুলো সুরক্ষিত ছিল তদ্রূপ । হয়তো ওর ফিরে আসার জন্য মনে মনে অপেক্ষা
করছিল সবাই । মাস দুই পার হওয়ার পরও যখন কেউ সন্ধান দিতে পারলনা, তখন সবাই ধরেই
নিল ভূদেব আর গাঁয়ে ফিরবেনা কোনদিন । এরপর একদিন সুযোগ বুঝে ওর ঘরের জিনিসপত্রগুলো
ভাগবাটোয়ারা করে নেয় লুটেরা । তারপর সেখানে আশ্রয় হয় পাড়ার হাড়হাভাতে ছেলেগুলোর ।
দিনভর গাঁজার নেশায় বিভোর হয় সবাই, রাতে ভাতপচা মদ খেয়ে
অচেতন হয়ে পড়ে থাকে একেকজন ।
আষাঢ় মাসে বন্যা হয় কেন্দুয়া ।
উত্তর হতে পাহাড়ি ঢল নামলে গুণাই নদীর পানি এসে গৃহস্থের বাড়ীর উঠোন ছোঁয় । ঘরগুলো
যেন নৌকার ন্যায় ভেসে থাকে পানিতে । কদিন ধরে অসুস্থ মালেক । সেদিন ফেরার পথে
বৃষ্টিতে ভিজে গাঁয়ে জ্বর হয়েছে ওর । দিন দুই প্রায় অচেতন ছিল সে । আজ সকালে ঘাম
দিয়ে জ্বর ছেড়েছে ওর,
এখন গাঁয়ে বল নেই একটুও । ওকে উঠে বসতে দেখে হাঁক দেয় মরিয়ম
বিবি-
-হ, উঠ্যা ব বাপ খাওন দেই ।
-মেঘ আর থামেনাই মালুম অয় ।
-বয়স্যা মাসের মেঘ, অত তাড়াতাড়ি
যায়নি ।
কথা সত্যি । বর্ষা কালে বৃষ্টির
ধারা থামেনা সহসা । যাহোক এমনই একদিন ভেজা কাঁকের ন্যায় আবার গাঁয়ে ফিরে আসে ভূদেব
। ওকে দেখে অবাক হয় সবাই । সে যে আবার গাঁয়ে ফিরবে ভাবতে পারেনি কেউ । কিন্তু ফিরেছে
ভূদেব,একা নয় । সঙ্গে নতুন বউ তার । সদ্য বিবাহিত । পায়ে আলতার রঙটাও মুছেনি
এখনও ।
বিকেলে পাড়ার দোকানে গেঁয়োদের
আড্ডা হয় । তখন খোশগল্পে মাতে সবাই । ভূদেবকে নিয়েও কথা বলে কেউ কেউ ।
-ভূদেব বিয়া করছে হুনছনি কাহা ?
-হ, বউ কই চাঁদরূপ ।
হ্যাঁ,ভাগ্যগুণে সুন্দর
বউ পেয়েছে ভূদেব । এরপর এক এক করে দিন গেলে পাড়ার অন্য মেয়েদেরও আনাগোনা বাড়ে
ভদেবের বাড়ীতে । জহুরের বউ বেহুলা বিকেলে পাড়াঘুরার ছল করে ভূদেবের বাড়ী গেলে ওকে
পাশে বসিয়ে খোশগল্পে মাতে দুর্গা । বেহুলা বলে-
-কি চাঁদরূপগো বু তোমার । দেকি
দিলে সুখ পাই ।
-সত্য ? চেপা মাছের
বেনুন রানছি, যাওন কালে নিও কলাম ।
ঘরে নতুন বউ এলে উঠতি বয়সী ছেলেদের
আনাগোনা বাড়ে ভূদেবের বাড়ীর চারদিকে । দুর্গাকে দেখলে ক্ষুধার্ত চোখগুলো আস্ত গিলে
খেতে চায় যেন । দুর্গা কিন্তু মেয়ে ভাল । প্রয়োজন ব্যতিত খুব
বেশি বাইরে পাওয়া যায়না তাকে । পাড়ার অন্য মেয়েরা যখন পাড়া ঘুরে তখন সে বড়ঘরের বারান্দায় বসে
কাঁথা সেলাই। কেউ বেড়ানোর জন্য
জোরাজুরি করলে সুকৌশলে এড়িয়ে যায় সে ।
-নাগো বু, তোমরার ভাই জানলে গোস্বা অইব ।
এর দিন দশেক পর একদিন বাজার থেকে
ফেরার পথে মালেকের সাথে দেখা ভূদেবের । ওর বিয়ের খবর মালেক শুনেছে পাড়ার ছেলেদের কাছে । বউ দেখা হয়নি এখনও । ভূদেব জোরাজুরি করলে
একরকম অনেচ্ছা সত্ত্বেও সেদিন ওর বাড়ী যেতে হয় মালেককে । উদ্দেশ্য বন্ধুর বউ
দেখা ।