গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

আবু রাশেদ পলাশ

 আত্মাবাস                          

বি.এ. পরীক্ষা দিয়ে বাড়ী যাচ্ছে মালেক  নন্দাইলগামী বাসটা যখন কেন্দুয়া বাজারে এসে দাঁড়ায় দিনের সূর্যটা তখন পশ্চিমে লুটোপুটি খাচ্ছে  মাগরিবের আযান হলে অন্ধকার হতে দেরী হয়না  যারা গাঁয়ের ছেলে অথবা যাদের জীবনে গ্রাম দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তারা জানে রাত কত নিষ্ঠুর হাঁটাপথে  তাই কালক্ষেপণ না করে বাস হতে নেমেই গুণাই নদীর পথ ধরে হাঁটতে থাকে মালেক  সন্ধ্যায় নদীঘাটে নৌকা শোভা পায়  দিনভর যারা দিনমজুরীর কাজ করে গৃহস্থের জমিতে, সন্ধ্যায় তারাই মাঝি হয়ে নদী পার করে অন্যদের  মৃত গুণাই নদীতে মাঝিরা স্থায়ী কর্মের সন্ধান করতে পারেনা কখনও  এখান থেকে দু চার পয়সা উপার্জন হলে তা সংসারে বাড়তি আয়ের বন্দোবস্ত করে মাত্র 
যাহোক রাতের অন্ধকার যখন ক্রমেই ঘনতর হচ্ছে তখন একটি নৌকা জোগাড় আবশ্যক মালেকের জন্য ।নদীর ঘাটে এসে পরিচিত মাঝি খুঁজে সে  দৃষ্টিগোচর হলে আশ্বস্ত হয়  মাঝি জেলে পাড়ার করম আলী ।ঐ পাড়ার মুগা মালেকের বন্ধু মানুষ  ছোটবেলা একই স্কুলে পড়েছে ওরা  করম আলী ওরই বাপ ।মালেকের পরিচিত জন্মের পর থেকেই  ডানপাশের চোখটা নষ্ট হওয়ায় ছোট থেকেই ওকে একটা কাল চশমা পড়তে দেখেছে মালেক  ওটা এখনও আছে  সময় গড়িয়েছে, সাথে চোখে দৃষ্টিও কমেছে তার ।কিন্তু পুরনো চশমাটা পরিবর্তন হয়নি আজও  ঠিক পরিবর্তনও নয়, নতুন আরেকটা কেনারই হয়তো সামর্থ্য হয়নি তার  ডাঁটগুলো ভেঙে গেছে কবেই  এখন ওটা চোখে আঁটতে দুপাশে সুতো বেঁধে নিয়েছে করম 
নৌকা চলে গুণাই নদীর শ্রান্ত জলে  সহসা কথা হয়না দুজনে  হয়তো করম চিনতে পারেনি মালেককেঅথবা গাঁয়ে ফেরার দীর্ঘ বিরতিতে হয়তো ভুলে গেছে সে  মালেকও যেচে কথা বলতে যায়না  নৌকারগলুইয়ে চুপচাপ বসে থাকে সে  ভাড়া মিটিয়ে নামার সময় করম বলে-
-কেডাগো চেনা ঠেহে মালুম অয় ? মালেক বলে-
-মালেকগো কাহা ইয়ার আলীর পূত 
-আন্ধারে একলা যে, কালীতলা কাটাই যাইও 
-কেগো কাহা , বাঁধ দেও যে ?
-সত্য হুননাই মালুম অয় ? ভূদেব ফেরত আইছে হুনি 
-ভূদেব মুচী, হাচানি কাহা ?
-নিয্যস । মিছা কইতে ডর অয় ।
করম আলীর কথা বিশ্বাস হয়না মালেকের  গুণাই নদী পার হয়ে ওদের বাড়ী যেতে হাঁটতে হয় বেশ খানিক সময়  বর্ষাকালে যখন বন্যার পানিতে গ্রাম ভাসে, তারপর নদীর জল এসে ওদের দহলিজ ছোঁয়, তখন কেন্দুয়া বাঁজার হতে বাড়ী অবধি নৌকায় আসা যায়  পৌষ-মাঘ মাসে নদী শুকিয়ে মরা গাঙের রূপ নেয়,তখন বাড়ীর পথটাও দীর্ঘতর হয় আগের চেয়ে 
যাই হোক গুণাই মাঝির সাথে কথা সেরে গাঁয়ের পথ ধরে হাঁটতে থাকে মালেক  হয়তো প্রথম পা ফেলতেই একটা সুনসান নীরবতা অনুভব করে সে  রতের অন্ধকারটাও ঝেঁকে বসেছে ইতোমধ্যেই  আগে কিন্তু এমন ছিলনা  শেষবার যখন গ্রাম ছেড়েছিল মালেক তখনও দেখেছে রাতের শেষ অবধি হাঁটুরে দল যাতায়াত করে এ পথ ধরেই  কারও কারও হাতে হ্যারিকেনের অর্ধনিভন্ত আগুণ থাকতো  আজ নেই ।সবাই কি ভয় পেয়েছে ভূদেবের ফিরে আসার খবরে ? ভূদেব কি সত্যি ফিরে এসেছে ? কিভাবে ফিরে এল সে সশরীরে নাকি অশরীরী কোন আত্মা হয়ে ?
মুহূর্তে একটা অজানা আশঙ্কা এসে ভর করে মালেকের মধ্যে  তারপর ওর বিদ্যার সামান্য অহংকারটুকুও ম্লান হয়ে যায় যেন  একরকম জীবন বাঁচানোর তাগিদেই পা টিপে টিপে একসময় বাড়ীর উঠোনে এসে দাঁড়ায় সে  মরিয়ম বিবি হাতে একটা পিদিম নিয়ে ছেলের জন্য অপেক্ষা করে বারান্দায়  দৃষ্টিগোচর হলে সে বলে-
-বাজান আইলি ?
-হুম 
-ডরাইছস মালুম অয় ?
মায়ের কথার জবাব দেয়না মালেক  দিতে ইচ্ছেও করেনা তার  ঘরে এসে বিছানা নেয় সে  পরদিন মুগার ডাকে ঘুম ভাঙে ওর  করম আলীর কাছে ওর আসার খবর শুনে প্রিয়বন্ধুকে দেখতে এসেছে সে  পরক্ষণে ছাইয়ের গাঁদি থেকে একটা পোড়া কাঠের কয়লা তুলে মাজন করতে করতে নদীর ঘাটে এসে দাঁড়ায় দুজন ।মালেক বলে-
-ভূদেব ফেরত আইছে হুনি, কতা হাঁচা ?
-নিয্যস । হগগল কই হুন ।
তারপর মুগার কথায় যে সত্য প্রকাশ হয় তার সারমর্ম এই, বহুকাল পূর্বে মুসলমান পাড়ায় যে ভূদেব বসবাস করত সে আবার ফিরে এসেছে সত্যি  ফিরে এসেছে অশরীরী আত্মা হয়ে  এসেই পার্শ্ববর্তী বারুইল গ্রামের কছিখাঁর মেয়ে হেনার উপর ভর করেছে সে  প্রথমে সবাই ভেবেছিল জীনের আঁচর ।পরে যখন পীরগঞ্জের নুহাই মুনশি দাওয়া দিতে মুখোমুখি হল সেদিন ভূদেব স্বয়ং কথা বলেছে ওর সাথে  হেনার মুখ দিয়ে গড়গড় করে সব সত্যি প্রকাশ করেছে সে  তারপরইতো আশ্বস্ত হল সবাই  এটা ভূত, জীন কখনও হিন্দু হয়না 
ভূদেব ফিরে আসার পর থেকে একটা থমথমে ভাব বিরাজ করে গাঁয়ের সর্বত্র  জীবন সায়াহ্নে এসেও যে মানুষটার মাথাই টুপী উঠেনি কোনদিন, এখন নামাজের ওয়াক্ত হলে সেই মসজিদে প্রথম মুসল্লি হয়ে উপস্থিত থাকে  দরগাতলায় পীরের মাজারে দিনান্তে শিরনী দেয় কতজন! গাঁয়ের উড়নচণ্ডী ছেলেগুলো একসময় যারা মেথরপাড়ার ভাতপচা মদ খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতো, এখন তারাই মাজারে খাদেমের কাজ করে  রাত গভীর হওয়া পর্যন্ত মুসলমান মেয়েদের মুখে আল্লাহ আল্লাহ রব শুনা যায়   
ভূদেবের প্রথম গাঁয়ে আসার মুহূর্তটা মনে পড়ে মালেকের  ধান কাঁটার মৌসুম শেষ হয়েছে মাত্র ।ফসলহীন জমিগুলোতে সীমাহীন রিক্ততা  নবান্ন উৎসব শুরু হয়নি তখনও  এমনই এক সময় ভূদেবের আগমন  এসে কালীতলায় নজুখাঁর অনাবাদী জমিটায় একটা ছোট ডেরা তুলেছিল সে  নজুখাঁ অবশ্য রাজী ছিলনা এতে  সে বলেছিল-
-হিঁদুর ছাও মালুম অয় ? অধর্ম চলবার নয়, বিদায় ল হারামির পুৎ  ভূদেব বলেছিল-
-তিনকুলে কেউ নাইগো কাহা  থাকুন দেন, মুচীর কাম করুম বাঁজারে  অবশেষে নুহাই মুনশির মধ্যস্থতায় ভূদেবের থাকার ব্যবস্থা হয় গাঁয়ে 
কেন্দুয়া কিন্তু মুসলমানদের গ্রাম  হিন্দু চিহ্নের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই এখানে  বয়স্করা বলে স্বাধীনতার পর এ গাঁয়ে হিন্দু দেখেনি কেউ  স্বাধীনতা উত্তরসূরিদের কাছে হিন্দু জীবন রূপকথার ন্যায়  গাঁয়ের ছেলেরা তাই ভূদেব এলে কদিন ওকে ঘিরে জটলা করে  তারপর একে একে তারাও ব্যস্ত হয় যার যার মত।  
এখানে এসে বাজারে মুচীর কাজ করে ভূদেব  তাতে উপার্জন সামান্যই  যেহেতু সংসারে আপন বলে আর কেউ নেই, সেহেতু রান্নাবান্নায় সামান্য অসুবিধা বোধ হয় হয়তো কিন্তু ওকে উপোষ থাকতে হয়না কোনদিন। মাঝেমাঝে একাকীত্ববোধ হয় খুব  গাঁয়ের উড়নচণ্ডী হাভাতে ছেলেগুলোও হিন্দু বলতে ছি!ছি! করে ওকে নিয়ে  সৃষ্টি থেকে পরধর্ম চর্চায় যে কালী জমেছে মানুষের মনে তা কি এত সহজে দূর হয় ? মুসলমান পাড়ার পথ দিয়ে রীতিমত আসা যাওয়ার বারণ ওর  অথচ ভূদেবকে কোন দিন শক্ত করে ধর্ম পালন করতেও দেখেনি কেউ  ওর ঘরে পূজা অর্চনার কোন সরঞ্জাম শোভা পায়না  বেশভূষাতেও নয় 
যাহোক তবুও ভূদেবের একাকি সংসার দৃষ্টি এড়ায়না গেঁয়োদের  কয়েক হাজার মানুষের মধ্যে এক দুইজন থাকে যারা ওর সাথে মিশতে আগ্রহবোধ করে  রাতে এসে একা একা বিছানায় শুয়ে থাকে ভূদেব  ইচ্ছে হলে নিজের সাথেই কথা বলে সে  কে জানে, মনে মনে হয়তো সেও একটা অচেনা মেয়ে মানুষের মুখশ্রী আঁকে  সাথে একটা ঘর আর একটুকরো জমি 
জ্যৈষ্ঠের গরম কমতে শুরু করেছে ইতোমধ্যেই  এমনই একদিন বাজার থেকে আসার পথে ভূদেবের সাথে দেখা মালেকের  ডাক দিতেই নিতান্ত অপরাধীর মত সামনে এসে দাঁড়ায় সে  তারপর বলে-
-কিছুনি কবা দাদা ? মালেক বলে-
-নিয্যস । শুক্কুরবার আমরার বাড়ী নেমন্তন নেও ।
মালেকের প্রস্তাবটা নিতান্তই অপ্রত্যাশিত ভূদেবের কাছে । এ পাড়ায় ভাল করে কথাই বলেনা কেউ ওর সাথে, তার উপর মুসলমান বাড়ীতে নেমন্তন্ন । একটা অজানা আশংকা এসে ঠাই নেয় ভূদেবের মধ্যে । সে বলে-
-ক্ষেমা দেও দাদা । মাও তোমার গোস্বা অইব ।
কথা ঠিক । মরিয়ম বিবিকেও ভূদেবের ব্যাপারে কোনদিন আন্তরিক হতে দেখেনি মালেক । কিন্তু তবুও ছেলে প্রস্তাব দিলে ভূদেবের ব্যাপারে সেদিন আপত্তি করেনা সে । কে জানে, হয়তো মালেককে খুশী করতেই মার এ প্রস্তাব মেনে নেওয়া । যাহোক যথারীতি শুক্রবার গাঁয়ে একটি সাদা চাদর জড়িয়ে নেমন্তন্ন খেতে উপস্থিত হয় ভূদেব । ওকে দেখে আশ্চর্য হয় সবাই । এখনও ততটা শীত পড়েনি যে দিনে গাঁয়ে চাদর জড়াতে হবে । পরমুহূর্তে প্রকাশ হয় সত্যিটা,আসলে দাওয়াত খেতে আসার মত বিশেষ কোন কাপড় নেই ভূদেবের । অনাবৃত দেহ ডাকতে তাই এ কৌশল অবলম্বন। মালেকদের বাড়ীতে এসে কারো সাথে কথা বলার সাহস হয়না ভূদেবের । মরিয়ম বিবি বলে-
-আমারে শরমাওনি বাপ,ঘেন্না কই আমার নাই ?
তবুও সহজ হতে পারেনা ভূদেব । লজ্জা পেলে হয়তো চোখের পাতা পড়ে ঘনঘন  হাতে আনা হালি দুই কলা মালেককে দিয়ে বলে-
-হগগল তোমার জন্যি দাদা । খাইয়ো কলাম 
মালেকদের বাড়ী থেকে সেদিন রাত করে বাড়ী ফিরে ভূদেব । এরপর বাজারে এলে প্রায়ই কথা হয় দুজনে ।কুশলাদি জানা হয়  ফেরার পথে সস্তাদরের কিছু সদাই হাতে দিয়ে ভূদেব বলে-
-লও কাউরে কইয়োনা কলাম 
ভূদেব কার কথা বলে সহজে অনুমান করতে পারেনা মালেক  প্রথমত, নিজের বলে কেউ নেই তার দ্বিতীয়ত, লোকানোর মানুষ  যাহোক এভাবেই দিনে দিনে একটা অসম বন্ধুত্ব তৈরি হয় দুজনে  এক এক করে দিন যায়  তারপর মালেকের মাধ্যমেই ওদের দলে পাড়ার উড়নচণ্ডী ছেলেগুলোও এসে জুটে এক সময়  বয়স বাড়ার সাথে সাথে পাড়ায় ছেলেগুলো বিড়ির নেশায় আকৃষ্ট হয়  তারপর মেথরপাড়ার ভাতপচা মদ  ভূদেবের হাতে কাজ না থাকলে ওর ঘরে এসে জোয়ার জমায় ছেলেরা  প্রাপ্ত টাকা ভাগাভাগি নিয়ে কলহ করে  সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটে দ্রুত  এরপর আবার কোন অজুহাত পেলে সম্পর্ক তৈরিতে সময় নেয়না  এরও মাস ছয় পরের কথা, একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে বড় রাস্তার মোড়ে মালেকের সাথে ভূদেবের দেখা  চোখাচোখি হলে হাঁক দেয় ভূদেব-
-মালেকনি খাড়া কতা কই 
-শিগগির ক, হাতত কাম মেলা 
-আজ রাইতে যামু, ভারুইল যাত্রা পালা 
-যাত্রানি, মা জানলে গোস্বা অইব 
-পলায় যামু  কাউরে কওন বারণ 
সেদিন রাতে পালিয়ে ভূদেবের সাথে ভারুইল বাজারে যাত্রা দেখতে যায় মালেক  যাত্রা শেষে ওরা যখন বাড়ী ফেরে মসজিদে ফজরের আযান হয় তখন  সেদিন হয়তো বুঝতে পারেনা কেউ  কিন্তু ব্যাপারটা বেশীদিন গোপন থাকেনা কারো কাছে  কি এক কারণে পাশের বাড়ীর সবুরের সাথে কলহ হলে একদিন সবার কাছে সত্যিটা প্রকাশ করে দেয় সে  ইয়ার আলী পুত্রের এমন কর্মে নাখোশ হয় খুব  বাপের রক্তচক্ষুকে ভয় করে মালেক  এ নিয়ে একদিন কড়া শাসনের মুখোমুখি হতে হয় তাকে  এর কদিন পর একদিন ভূদেব এলে শাসায় ইয়ার আলী 
-হারামিরপু ডরাইস  গেরাম ছাড়া করুম কই 
ইয়ার আলীর চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস হয়না ভূদেবের । বেরিয়ে এসে গাঁয়ের পথ ধরে সে । তারপর দীর্ঘদিন ওর সাথে দেখা হয়না মালেকের । কদিন পর গেঁয়োরা বলাবলি করে ভূদেব নিরুদ্দেশ হয়েছে কোথাও । ওর ঘরের আসবাবপত্র সব ঠিক আছে, কেবল তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা গাঁয়ে । সমবয়সী যে ছেলেগুলোর সাথে সখ্যতা হয়েছিল ভূদেবের তারাও খবর জানাতে অপারগ ।
ভূদেব নিরুদ্দেশ হওয়ার পর কিছুদিন ওর ঘরের জিনিসগুলো সুরক্ষিত ছিল তদ্রূপ । হয়তো ওর ফিরে আসার জন্য মনে মনে অপেক্ষা করছিল সবাই । মাস দুই পার হওয়ার পরও যখন কেউ সন্ধান দিতে পারলনা, তখন সবাই ধরেই নিল ভূদেব আর গাঁয়ে ফিরবেনা কোনদিন । এরপর একদিন সুযোগ বুঝে ওর ঘরের জিনিসপত্রগুলো ভাগবাটোয়ারা করে নেয় লুটেরা । তারপর সেখানে আশ্রয় হয় পাড়ার হাড়হাভাতে ছেলেগুলোর । দিনভর গাঁজার নেশায় বিভোর হয় সবাই, রাতে ভাতপচা মদ খেয়ে অচেতন হয়ে পড়ে থাকে একেকজন ।   
আষাঢ় মাসে বন্যা হয় কেন্দুয়া । উত্তর হতে পাহাড়ি ঢল নামলে গুণাই নদীর পানি এসে গৃহস্থের বাড়ীর উঠোন ছোঁয় । ঘরগুলো যেন নৌকার ন্যায় ভেসে থাকে পানিতে । কদিন ধরে অসুস্থ মালেক । সেদিন ফেরার পথে বৃষ্টিতে ভিজে গাঁয়ে জ্বর হয়েছে ওর । দিন দুই প্রায় অচেতন ছিল সে । আজ সকালে ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে ওর, এখন গাঁয়ে বল নেই একটুও । ওকে উঠে বসতে দেখে হাঁক দেয় মরিয়ম বিবি-
-হ, উঠ্যা ব বাপ খাওন দেই ।  
-মেঘ আর থামেনাই মালুম অয় ।
-বয়স্যা মাসের মেঘ, অত তাড়াতাড়ি যায়নি ।
কথা সত্যি । বর্ষা কালে বৃষ্টির ধারা থামেনা সহসা । যাহোক এমনই একদিন ভেজা কাঁকের ন্যায় আবার গাঁয়ে ফিরে আসে ভূদেব । ওকে দেখে অবাক হয় সবাই । সে যে আবার গাঁয়ে ফিরবে ভাবতে পারেনি কেউ । কিন্তু ফিরেছে ভূদেব,একা নয় । সঙ্গে নতুন বউ তার । সদ্য বিবাহিত । পায়ে আলতার রঙটাও মুছেনি এখনও ।
বিকেলে পাড়ার দোকানে গেঁয়োদের আড্ডা হয় । তখন খোশগল্পে মাতে সবাই । ভূদেবকে নিয়েও কথা বলে কেউ কেউ ।
-ভূদেব বিয়া করছে হুনছনি কাহা ?
-হ, বউ কই চাঁদরূপ ।
হ্যাঁ,ভাগ্যগুণে সুন্দর বউ পেয়েছে ভূদেব । এরপর এক এক করে দিন গেলে পাড়ার অন্য মেয়েদেরও আনাগোনা বাড়ে ভদেবের বাড়ীতে । জহুরের বউ বেহুলা বিকেলে পাড়াঘুরার ছল করে ভূদেবের বাড়ী গেলে ওকে পাশে বসিয়ে খোশগল্পে মাতে দুর্গা । বেহুলা বলে-
-কি চাঁদরূপগো বু তোমার । দেকি দিলে সুখ পাই ।
-সত্য ? চেপা মাছের বেনুন রানছি, যাওন কালে নিও কলাম ।
ঘরে নতুন বউ এলে উঠতি বয়সী ছেলেদের আনাগোনা বাড়ে ভূদেবের বাড়ীর চারদিকে । দুর্গাকে দেখলে ক্ষুধার্ত চোখগুলো আস্ত গিলে খেতে চায় যেন  দুর্গা কিন্তু মেয়ে ভাল  প্রয়োজন ব্যতিত খুব বেশি বাইরে পাওয়া যায়না তাকে  পাড়ার অন্য মেয়েরা যখন পাড়া ঘুরে তখন সে বড়ঘরের বারান্দায় বসে কাঁথা সেলাই। কেউ বেড়ানোর জন্য জোরাজুরি করলে সুকৌশলে এড়িয়ে যায় সে 
-নাগো বু, তোমরার ভাই জানলে গোস্বা অইব 

এর দিন দশেক পর একদিন বাজার থেকে ফেরার পথে মালেকের সাথে দেখা ভূদেবের  ওর বিয়ের খবর মালেক শুনেছে পাড়ার ছেলেদের কাছে  বউ দেখা হয়নি এখনও  ভূদেব জোরাজুরি করলে একরকম অনেচ্ছা সত্ত্বেও সেদিন ওর বাড়ী যেতে হয় মালেককে  উদ্দেশ্য বন্ধুর বউ দেখা