গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

অসিত বরণ চট্টোপাধ্যায়

রুখা মাটিতে সোঁদা গন্ধ

 (গত সংখ্যার পর - শেষাংশ)

বিবর্ণ পলাশ। রুখা মাটি। ক্রীতদাসের আনা গোনা। মন খারাপের ধু্সর ইতিহাস। চোদ্দ বছরের বালক রফিক এসেছে সুদুর মুর্শিদাবাদের ফরাক্কা চর থেকে। বাড়িতে চারটে ছোট ভাই আর এক দিদি। বাবার সঙ্গে মজুর খাটতে এসে এই বয়সে বিড়ি খাওয়া বেশ ভালই রপ্ত করেছে। একদিন কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করে ফেললাম,
-এই পড়াশোনার বয়সে মজুর খাটতে এলি কেন?
-পড়াশুনা করবু তো খাবু কি বাবু।তাছাড়া আব্বুর কর্জ মেটাবু ক্যামনে?
-তোর বাবার কর্জ তুই মেটাবি কেন?
-ঠেকদারের সেটাই তো কড়ার বাবু।
-তার মানে
তার মানেটা যা বোঝালো তাতে আমি শিউরে উঠলাম। ও যা বলল তার মর্মার্থ হল, পেটের জ্বালায় আর সংসার চালানোর তাগিদে প্রায়শ চরবাসীদের লেবার সাপ্লায়ারের কাছ থেকে কর্জ নিতে হয়। একবার ঋণের জালে জড়ালে একজীবনে সে ঋণ থেকে মুক্ত হওয়া কঠিন। গরিবরা গরিবই থেকে যায়। এক কঠিন শর্তে ওরা লেবার সাপ্লায়ারের বন্ডেড লেবার হয়ে যায়। মাসে একশ পঁচাত্তর টাকা মজুরী, চারদিন ছুটি। দৈনিক খাবারের বরাদ্দ চাল আলু, নুন, কাঁচালংকা আর বিড়ি। মাসের কাজ শেষে মজুরী
  পৌঁছে যায় বাড়ীতে। ওদিকে পাঁচ ছয় জনের সংসার দশ বারোদিন ভালই চলে তারপর আবার ঋণ। অভাবী মানুষের চিন্তার রাশ থাকে অভাবের হাতে। চক্রবৃদ্ধিহারে ঋনের পারদ চড়তেই থাকে। 'মেন্টাল ব্যান্ডউইডথ' হয়ে যায়। ঋণ আর শোধ হয়না। তাছাড়া চর এলাকায় কোন কাজ কর্মও নেই। যে সময়ের কথা বলছি সে সময় একশ দিনের কাজ বা সরকারী  অনুদান ছিল না। বেঁচে থাকার তাগিদে ওদের এই ব্যাবস্থা মেনে নিতে হত। বাড়ীর পুরুষ সদস্য বাইরে কাজ করতে গেলে সবচেয়ে ক্ষতি হত বাড়ীর মেয়েদের। লেবার সাপ্লায়ারের বাড়ীর কাজ, কৃষির কাজ তো করতেই হত,তাছাড়া মালিকের শয্যাসঙ্গিনীও হতে হয়। কিশোরীরাও বাদ যায় না। কিন্তু ভাগ্যের দোহাই দিয়ে সব মেনে নেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। অভাব অনটন নিয়ে সর্বক্ষন জাগলিং করতে হয়। পারতো না শুধু একটা স্পার্টাকাসের জন্ম দিতে।
তাই দুরদেশে আসা রফিক কামাল, ইয়াসিন,গিয়াসুদ্দিন জামালুদ্দিন, রহিম শেখ ওরা গান গাইত,
" আল্লাহের আমি বড় বেটা
   নসিব আমার মজুর খাটা....
প্রসঙ্গ পাল্টে রফিককে জিজ্ঞেস করলাম,
-আজ ভোজ কেমন খেলি।
-ভাল খাইলাম বাবু। অনেকটা মাংস খেয়েসি। মাঝে মধ্যে এমনি ভোজ পাইলে মন্দ লয় বাবু। আপ্নে মাঝে মাঝে বইলে দিবেন তো। তা আমদের দফাদার আর মুন্সীটা বহুত হারামী লোক আসে। এখানকার ঠিকাদারের চামচা। নিজেরা বাবুদের ক্যাম্পে যেয়ে মাছটা মাংসটা খেয়ে আসে আর আমাদের বেলায় ভাত আলুচোখা আর কাঁচালংকা।
কিছু ফালতু গল্প করে ফিল্ড হোষ্টেলে পৌঁছালাম সন্ধ্যা নাগাদ। রাত নটা নাগাদ মুন্সী হাবিব এসে বলল,
-বাবু জৈনুলের অবস্থা খুব খারাপ। পেট ভেঙে গেছে। কুড়ি পঁচিশবার দাস্ত হয়েছে,বার পাঁচেক বমি করেছে।
আমি বললাম
 
-ডাক্তার নিয়ে যেতে হবে তো।
বলেই মোটর বাইকে করে গেলাম পাশের গ্রামের প্রাথমিক হাসপাতালে। গিয়ে ডাক্তার বাবুকে বলতেই সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমার মোটরবাইকে চড়ে বসলেন। আট নম্বর ধাওড়ায় গিয়ে দেখি এক বিচিত্র কান্ড। জৈনুলের মাথা ন্যাড়া করে ওর মাথায় একজন বাটিতে করে জল ঢালছে,অন্য একজন ঝাঁটার মুড়ো নিয়ে খুব ঝাড়ফুঁক করছে। ডাক্তার সুহৃদ বাবু দেখে রেগে কাঁই।
 
-এটা কি হচ্ছে? মানুষটা ডিহাইড্রেট হয়ে গেছে আর মাথায় জল ঢালা হচ্ছে? কোলাপ্স তো মনে হচ্ছে হয়েই গেছে।
ডাক্তার বাবু নাড়ী ধরে বললেন " হি ইজ নো মোর।
আচমকা পরিবেশটা থমথমে হয়ে গেল। ডাক্তারবাবু চলে গেলেন। ঠিকাদারের ম্যানেজার, দফাদার আর মুন্সিকে নিয়ে বৈঠকে সাব্যস্ত হলো ডেড বডির সৎকার হবে ভেটি গ্রামের কবরে। রাত তিনটে নাগাদ জৈনুলকে কবরস্থ করে ক্যাম্পে ফিরে এসে স্নান করলাম। ভোরের ট্রেনে লোক পাঠিয়ে দেওয়া হলো বাড়িতে খবরটা দেওয়ার জন্য। সঙ্গে কিছু টাকা।
টাকা নাকি মানুষের শোক ভুলিয়ে দেয়।
প্রোজেক্টে ঢালাই এর কাজ শুরু হলো যথারীতি। মানুষ মরতেই পারে তা বলে উন্নয়নের কাজ তো বন্ধ থাকতে পারে না!
দিবারাত্র কাজ চলতে লাগলো। বিশাল র‍্যাফট ফাউন্ডেশন। বর্ষার আসার আগেই চল্লিশ ফিট নীচের কাজ শেষ করতে হবে। গা লাগোয়া পাহাড় গৌরাঙ্গী। যে কোন সময় ধস নামতে পারে।একদিকে বাঁধে মাটি ফেলার কাজ শুরু অন্যদিকে স্পীলওয়ে কনস্ট্রাকশনের কাজ। দিনের বেলার কাজে কোন অসুবিধা হতো না কিন্তু রাতের কাজে ঝামেলা অনেক বেশী। প্রথমত দ্বিস্তরীয় রডের উপরে নড়বড়ে কাঠের পাটাতনে চলাচলের অসুবিধা, দ্বিতীয়ত জেনারেটরের অপ্রতুল আলোয় প্রায়শ দুর্ঘটনা ঘটত। তৃতীয়ত নারী শ্রমিক নদীতে শৌচকার্য করতে গেলে কিছু সুযোগসন্ধানীর খপ্পরে পড়া যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবু নির্মান কাজ এগিয়ে যাচ্ছিল কাজের নিয়মেই।
হঠাৎ একদিন কানাঘুষো শুনতে  পেলাম বংশী মাহাতোর কিশোরী কন্যা সুরবালা প্রেগন্যান্ট হয়েছে। প্রথমে খুব একটা আমল দিই নি। কিন্তু পরিস্থিতি  একদিন জটিল হয়ে পড়ল। দাঙ্গার মত পরিস্থিতি। খবর নিয়ে জানলাম এই পরিস্থিতির মূল নায়ক এক্রামুল নামে এক ১৭/১৮ বছরের সদ্যযুবক শ্রমিকের।
কিন্তু পরিস্থিতি যেদিকে দ্রুত মোড় নিতে লাগলো তাতে নিজেই বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। এ পরিস্থিতি অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে না পারলে সমুহ বিপদ ভেবে সান্তুড়ি থানায় খবর পাঠালাম। থানার ও সি বিরজুলাল সিং বিশাল বাহিনী এনে মোতায়েন করলেন পাহাড়গোড়ায়। এক্রামুলকে থানায় ধরে নিয়ে গেলেন। অস্থায়ী ক্যাম্পে পুলিশ মোতায়েন হওয়াতে কিছুটা স্বস্তি পেলাম ঠিকই কিন্তু সাময়িক। দাঙ্গা পরিস্থিতির উন্নতি হল বটে কিন্তু ঝামেলা বাড়লো বই কমলো না।
পুলিশ  তার স্বভাব অনুযায়ী ঠিকাদারের উপর শোষণ শুরু করলো। খাওয়া দাওয়ার খরচ তো মেটাতে হতই তার সঙ্গে তোলাবাজি। অন্যদিকে দুস্কৃতীর দল,ওরা পুলিশের উপস্থিতি ঠিকভাবে নিতে পারেনি তারাও চাপ দিতে শুরু করলো পুলিশ  ক্যাম্প উঠিয়ে দেওয়ার জন্য। দ্বিমুখী চাপের কাছে মাথা নোয়ানো কষ্টকর হলেও কিছু উপায়ন্তর ছিল না। এক সময় মনে হচ্ছিল প্রোজেক্ট বন্ধ করে দেওয়া সমীচীন।
এইসব নানা চিন্তায় চিন্তিত হয়ে শরণাপন্ন হলাম তদানীন্তন জেলা সভাধিপতির সঙ্গে। সব ব্যাপার খুলে বললাম। এটাও বললাম তিনি সাহায্য না করলে উন্নয়নের কাজ বন্ধ করে দিতে হবে। তিনি সবকিছু শুনেটুনে বললেন," আমি পনের জনের টিম করে দিচ্ছি, ওরা পরিস্থিতি সামাল দিয়ে দেবে।" ভাবলাম এবার হয়ত পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে।
কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। আগে ভাবিনি রাজনীতীর লোকেরা পুলিশের চেয়েও ভয়ংকর। ত্রিমুখী সহযোগিতায় (?) উন্নয়নের কাজ স্তব্ধ হওয়ার যোগাড়। অপর দিকে দিল্লীর জলসম্পদ ভবন থেকে সঠিক সময়ে কাজ শেষ করার কড়া বার্তা।
রাজনীতির লোকেরা নুতন উৎপাত শুরু করলো। চাকুরীর দাবীতে চিৎকার শুরু হতেই প্রমাদ গনলাম। সবাইকে তো মুখের কথায় চাকুরী দেওয়া সম্ভব না। অগত্যা আবারও সভাধিপতির সঙ্গে বৈঠক। বললাম "দয়া করে পুলিশ ও আপনার লোক উঠিয়ে নিন,দুস্কৃতীদের ধরার বন্দোবস্ত করুন।" উনি সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে বললেন "ঠিক আছে আমি দেখছি।"
মাসখানেক পর দেখলাম পুলিশ ক্যাম্প উঠে গেলো। উত্তাল রাজনীতি  প্রশমিত হলো। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে দুস্কৃতীরা যেমন ছিল তেমনি থেকে গেলো। যদিও তাতে উন্নয়ন বাধাপ্রাপ্ত হয়নি।
এর পর পরই শুরু হলো মৃত্যু মিছিল।  একদিন ভোরবেলায় পলাশ গাছে ঝুলন্ত প্রেগন্যান্ট সুরবালার দেহ আবিস্কৃত হল। রুখামাটি কেমন যেন থম মেরে গেল। বংশীর চোখের জলে ভিজে গেল রুখামাটি। পুলিশ সুরবালার দেহ নিয়ে গেল ময়নাতদন্তের জন্য।
ঠিক তার তিনদিন পর দুপুর বেলায়  ডিনামাইট দিয়ে পাথর ব্লাস্টিং হচ্ছিল দ্বিতীয় এক স্ট্রাকচার ফাউন্ডেশন এ। নিয়মমাফিক ধাওড়া বা শ্রমিকদের বাসস্থান ব্লাস্টিং রেঞ্জ ছ সাতশ ফিট দুরেই করা হয়। ঠিক এমনি এক দুরবর্তী ধাওড়ায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল আইনুল। ব্লাস্টিং এর পাথর পড়বি পড় এক্কেবারে ধাওড়ার চালা ভেদ করে উপুড় হয়ে শোয়া আইনুলের কোমরে। জোড়া কিডনি গেল থেঁতলে। সঙ্গে সঙ্গে ট্রাকে করে জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। কিন্তু বাঁচানো গেল না।
কাজ যতই শেষের দিকে আসে ততই আহত নিহতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। পিয়ার্সের কাজ চলছিল।চল্লিশফুট উঁচু পাথরের খাড়া দেওয়াল। লম্বা প্রায় দেড়শ ফুট। মাথায় পাথর নিয়ে বা সিমেন্ট মোর্টার নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এপাশ থেকে ওপাশ যাতায়াত। প্রায়শই কাঁচা গাঁথনির উপর যাতায়াত করতে হত শ্রমিকদের। পর্যবেক্ষনের জন্য আমরা নিরাপদ দুরত্ব থেকেই কাজ সারতাম। একদিন ঠিক ছুটি হওয়ার আগের মুহুর্তে এক মেয়ে শ্রমিক মাথায় সিমেন্ট মোর্টার সুদ্ধ পা হড়কে পড়ল একেবারে চল্লিশফুট নীচে কনক্রিট মেঝের উপর। তৎক্ষনাৎ মৃত্যু হলো মেয়েটার। ঘটনার আকস্মিকতায় সব শ্রমিক কেমন যেন ঘাবড়ে গেল। আমার পা থর থর করে কাঁপতে শুরু করল। কোনোমতে মই বেয়ে নিচে নেমে এলাম। বেশ মনে আছে ওর নামটা। গঙ্গা। খুবই ভাল ও প্রাণবন্ত মেয়ে ছিল। সারারাত ঘুম হয়নি সেদিন। বার বার ওর থেঁতলানো দেহটাই মনে পড়ছিল বারবার। জীবনে এই প্রথমবার মৃত্যুকে ভয় পেলাম।
তারপর বেশ কয়েকমাস কেটে গেলো। নির্মানের কাজ প্রায় শেষের দিকে। ব্রীজের কাজ শুরু হওয়ার আগে একটা লিন্টেন বিম করা বাকি। তার প্রাথমিক কাজের প্রস্তুতি প্রায় সারা। তিনফুট থিকনেসের আর সি সি বিম। টু টিয়ার পঁচিশ মিলি ডায়া রড বিছানোর কাজ শেষ। ঢালাইয়ের কাজ শুরু হল একদিন। আমি সবাইকে সতর্ক করে দিলাম যে এত উঁচু যায়গার স্বল্প পরিসরের ছোটো কাস্টিং এ বেশী শ্রমিকের দরকার নেই। কে কোথায় থাকবে তাও বলে দিলাম। পুরুষ শ্রমিক বলতে সহকারী  মিস্ত্রি সহ প্রধান রাজমিস্ত্রি। মই বেয়ে কংক্রীট নিয়ে উঠবে মাত্র তিনজন।বাকীরা থাকবে নিচে যোগাড় দেওয়ার জন্য। সহকারী মিস্ত্রি কড়াই ধরে কংক্রিট ঢালবে তাছাড়া প্রয়োজনে ভাইব্রেটার মেশিন চালাবে। এইভাবে ম্যানিং করে দিয়ে ঢালাইয়ের কাজ শুরু করতে বললাম। ঢালাইয়ের কাজ সুন্দর ভাবেই চলছিল। আধঘন্টা চলার পরই দেখি সুন্দরী নাম্নী ফাজিল মেয়েটা উপরে উঠে গিয়ে কড়াই তুলে রাজমিস্ত্রিকে যোগাড় দিচ্ছে। আসলে উঠে আসার কারণটা অন্য। সবাই জানে রাজমিস্ত্রি রাজু যেখানেই থাকবে সেখানেই সুন্দরী থাকবে, আবার সুন্দরী পাশে না থাকলে রাজু ঠিকমত কাজ করবে না। অতএব ওকে বারণও করা যাবে না। অগত্যা আমাকেই নেমে যেতে হলো। কেননা ওয়ার্কিং স্পেস এতই কম যে সেখানে চারজন থাকা প্রায় অসম্ভব। যাইহোক পাশের পিয়ার্সের উপরে উঠে কুড়ি ফুট দুর থেকেই কাজের তদারকি শুরু করলাম।
কিছুক্ষন বেশ কাজ চলল। বিপদটা হল ভাইব্রেটার চালানোতে।কেউই সম্ভবত বুঝতে পারিনি এমন ঘটনা ঘটে যাবে। ভাইব্রেটারের ঘুর্নায়মান চাকা মুহুর্তে সুন্দরীর শাড়ী ছিঁড়ে ওকে বিবস্ত্রা করে ফেলল।ভাগ্যিস নিচে না পড়ে ছফুট চওড়া পিয়ার্সের উপরে পড়ল। ওদিকে ছেঁড়া কাপড় ঘুরতে ঘুরতে শুকনো সিমেন্ট গুঁড়োয়
  পুরু ধোঁয়াসায় কিছুই দেখা যায় না। ফলে স্টার্টার সুইচ অফ করা যাচ্ছে না। সে এক বিশ্রী কান্ড। দেড় দুমিনিটের মধ্যে মেশিন আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেল। রাজু এসে  তার মাথার গামছা দিয়ে নিম্নাঙ্গ ঢেকে লজ্জা নিবারণ করল। আমরা প্রায় সকলেই মুখ ফিরিয়ে নিলাম অন্যদিকে। সহকারী মিস্ত্রি রেংটু নেমে গেলো। অন্য এক মেয়ে শ্রমিক উপরে উঠে এসে ধরাধরি করে সুন্দরীকে নিচে নামালো। ওর মাথায় অল্প স্বল্প চোট আঘাত লেগেছিল,কিন্তু ভাগ্য ভাল আরও বড় বিপদ হয়নি। সুন্দরী মাথা নিচু করে বাড়ী চলে গেল। তার পরদিন থেকে আর সুন্দরীকে দেখা যায়নি। তারপর থেকে রাজু কেমন যেন মাথা নিচু করে মনমরা হয়ে কাজ করতো।



ভোলা পুলিশের গুলিতে মারা গেল ঠিকই। কিন্তু থেকে গেল বীরু। বীরুও দাদার চেয়ে কম যায় না। দাদার ভাল গুন সে কোনটাই পায়নি। বরং বদগুনের চুড়ামনি হওয়ার কারনে দাদার সঙ্গীসাথীরাও ওর থেকে দুরত্ব তৈরী করতে শুরু করল। উল্টোদিকে বীরু রাজ্যপাট হারাবার ভয়ে আরও মরিয়া হয়ে উঠলো। তোলাবাজীর বহর বাড়তে লাগলো। নানান অত্যাচারে ক্যাম্পবাসীরাও অতিষ্ঠ হয়ে পড়ল। ওর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিজয় বাউরী কাউন্টার এটাকে মারা যাওয়ার খবর শুনে দ্বিগুণ উৎসাহে সাম্রাজ্য বিস্তারে মনযোগ দিল। ঠিক এ সময় ওর সংগে যোগ দিল তার প্রাক্তন প্রতিদ্বন্দ্বী  সন্তোষ। লম্বা,মারহাট্টা শরীর। বেশ কয়েক বছর আগে এই সন্তোষের দুটো পা ভেঙ্গে দিয়েছিল ভোলা ও বীরুর দল। স্থানীয় সবাই একটু অবাকই হয়ে গিয়েছিল ওদের এই অসম মিলন দেখে। একদিন ভোরবেলায় পাথর সাপ্লায়ার দিনেশ শান্তিকারীর ক্ষত বিক্ষত দেহ পাওয়া গেল নদীচড়ায়। শুনলাম বীরুর মনমতো তোলা দিতে অস্বীকার করায় তার এই করুণ পরিস্থিতি। পুলিশ রেইড করল সমস্ত ক্যাম্প, এবং সম্ভাব্য স্থানগুলো। কোথাও পেল না অথচ বাকী সবাই দেখতে পাচ্ছিল হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে বীরু সন্তোষেরা তিন নং মাটি খাদানে মাটি খুঁড়ছে। আসলে পুলিশ ওদের চিনতই না। আর বাকী যারা চিনত তারা কখনই মুখ খোলেনি ভয়ে।
এহেন হরিহর আত্মা দুইবন্ধু মিলে সারা তল্লাটকে তটস্থ করে রেখেছিল। এক ঠিকেদার তিনটে নুতন ট্রাক নামিয়েছিলেন দ্রুত কাজ করার উদ্দেশ্য নিয়ে। তা হঠাৎ বীরু একদিন ঐ নুতন গাড়ীর চালক দর্শন সিং কে নামিয়ে দিয়ে নিজে স্টিয়ারিং ধরে দর্শনকে বললো, "তুমহারা মালিককো বোল দো এ গাড়ী আজ সে মেরা হ্যায়। কুছদিন বাদ হাম এ গাড়ী লেকর আসানসোল যায়েগা।" দর্শন হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো। ও জানতো এর প্রতিবাদ করলে কি ফল হবে। তাই সে নম্র ভাবেই বলল, "ঠিক হ্যায় বাবু হম মালিককো বোল দুংগা।"এ কথা সন্ধ্যেবেলায় ঠিকাদারের ম্যানেজারের কানে যেতেই পরিবেশটা  থমথমে হয়ে গেলো। কেননা তোলাবাজির এত বড় বহর এর আগে দেখা যায়নি।
উপায়ন্তর না পেয়ে ম্যানেজার পুনিরাম বাঁড়ুজ্জ্যে শলা পরামর্শ  করার উদ্দেশ্যে সন্তোষকে ডেকে পাঠিয়ে সমস্ত ঘটনা বললেন। নিরুত্তাপ সন্তোষ একটিই মাত্র কথা বলল,"আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন।"
সেদিন বৈশাখী পূর্নিমা। ব্রীজের প্রথম স্প্যানে ঢালাইয়ের কাজ চলছে। দুপুর বেলায় ঠিকাদারের ক্যাম্পে খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম করছি খাটিয়ায়। উপুড় হয়ে ছিলাম। হঠাৎ শুনি সাহেবকে হাঁক পাড়ছে বীরু। 
-সাহেব খাবার নিয়ে আয়।"
 সাহেব ক্যাম্পের রাঁধুনি। খাবার নিয়ে আসতেই ওকে জিজ্ঞেস করল 
-এটা কে শুয়ে আছে র‍্যা?
  সাহেব উত্তর দিল,"ইঞ্জিনিয়ার সাব।" 
বীরুর সংক্ষিপ্ত
  জবাব, -"ওহ"।
আমি উপুড় হয়ে ঘুমের ভান করে ওদের গল্প শুনছিলাম। শুনলাম কোন এক ভুতাই বাউরী মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে যায়গা দখলের জন্য। ওকে নিকেশ করতে না পারলে সমুহ বিপদ। পরে রাত্রিবেলা তা নিয়ে দুজনে মিলে গৌরাঙ্গী জঙ্গলের বহড়া তলায় বিস্তারিত আলোচনা হবে। বলেই ওরা উঠে গেলো। আমি তার কিছুক্ষন পরে উঠে ব্রীজ ঢালাইয়ের কাজ দেখতে গেলাম।
কাজ শেষে ফিল্ড হষ্টেলে ফিরে গেলাম সন্ধ্যে নাগাদ। একদিকে পলাশের মাতামাতি, অন্যদিকে প্রচন্ড দাবদাহ। রাত একটু বাড়তেই ঠান্ডাজলে স্নান করে মাঠে খাটিয়া নিয়ে বসলাম। আয়েশ করে সিগারেট খাচ্ছিলাম।
আমার অধস্তন কর্মচারীরাও একে একে এসে আমার চারপাশে বসলো। প্রতিদিনের মত সেদিনও নানান গল্প গুজব ঠ্যটা ইয়ার্কি হচ্ছিল। জ্যোৎস্নাময় রাত। গরম কিছুটা কমতেই বড় স্নিগ্ধ মনে হচ্ছিল সে রাত। তখন রাত এগারোটা। এই হাসি ঠাট্টার মাঝে মেনগেটের দিকে তাকাতেই হাড় হিম হয়ে গেল। দেখি স্পোর্টসপ্যান্ট পরা খালি গায়ে বিজন বাউরী। হাতে তার বিশাল টাঙ্গি। এ অঞ্চলে যাকে বলে ফার্সা। পুর্নিমার আলোয় রুপোর মত চকচক করছে।নৈশপ্রহরী লালচাঁদ মাহালী বলে উঠলো,
-কে ওখানে?
-আমি বিজন। গেটটা একটু খোল তো মাহালি।আমি খুলে দিতে বললাম। গেটে ঢুকেই বিজন বললো,
-চ্যাটার্জী বাবু আছেন?
বললাম,-আছি।
চমকে উঠলাম ওকে দেখে। ভয়ে কোন কথা বলতে পারছিলাম না।
-আপনার কাছে একটু বসব স্যার?
ভয়ে ভয়ে বললাম,
-বসো
-স্যার একটা কথা বলবো?
 
-বলো
-স্যার একটা সিগারেট দেবেন?
-নাও।
আকন্ঠ মদ খেয়েছে। কি করতে এসেছে তাও বুঝতে পারছি না।
  কোনদিন যে আমার সামনে বসে না, সিগারেট চায় না, তার হঠাৎ এমন আচরণে আরো বেশী ভয় পেয়ে গেলাম।
আমার সহকর্মীরা নির্বাক।
  খালি একটু সাবধানী হয়ে আমাকে ঘিরে রাখলো। আমি ভয়ে ভয়ে ইয়ার্কি  করলাম,
-আজ এই বৈশাখী পূর্নিমায়
  ব্রাহ্মন বধ করবে নাকি। হাতে এত বড় অস্ত্র?
একহাত জিভ কেটে টাঙ্গিটা মাটিতে রেখে দিয়ে সাষ্টাঙ্গ প্রনাম করে বলল,
-কি যে বলেন স্যার। আপনাকে কিছু করলে নরকে যাব স্যার।
-তা হঠাৎ এত রাত্রে অস্ত্র হাতে এখানে এলে কেন ভাই?
-সেইটাই তো বলতে এসেছি স্যার।
-কি বলতে এসেছ বলো।
-স্যার আপনারা এবার ফিল্ড হষ্টেলে ঢুকে যান। আর মাহালীকে বলে দেন যেন আজ রাতে টর্চ না জ্বালায়।
  ভুলেও যেন গৌরাঙ্গীর দিকে তাক করে টর্চ না জ্বালায়।
-কেন?
-আজ রাতে বীরুকে তুলে নেব। আমি এবার আসছি স্যার।
বিজন চলে গেল। হতভম্ব হয়ে পরস্পরের দিকে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষন। তারপর ঢুকে পড়লাম নিজের নিজের রুমে। সেদিন আর খাওয়া হয়নি কিছুই। ইলেকট্রিক  ছিল না তখন। গুমোট গরম। বমি বমি ভাব। পেটে মনে হলো এসিড হয়ে গেছে। ঘুম হচ্ছিল না। প্রতিটা মুহুর্তে মনে হচ্ছিল এই বুঝি আর্ত কন্ঠস্বর ভেসে আসছে। একটা লোক নিশ্চিত মারা যাবে জেনেও কিছু  করতে না পারার কি যন্ত্রনা তা ভুক্তভোগী ছাড়া বোঝা সম্ভব নয়।

পরদিন সকালবেলায় খালাসি বিমল ফৌজদার এসে জানালো গতকাল রাতে বীরু চারকে নৃশংস ভাবে খুন করে পুঁতে দিয়েছে ড্যামের রিভার ক্লোজিং এর কাছে।
চমকে উঠলাম। ও কোত্থেকে বিস্তারিত খবরটা নিয়ে এসেছে। তারপর খুনের বিবরণ বর্ননা করতে শুরু করল,
-গৌরাঙ্গীর বহড়াতলার ঝোপে আগে থেকেই একজন লুকিয়েছিল। সন্তোষ বীরুকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বহড়াতলায় দুজনে বসে ভুতাইকে কিভাবে খুন করে সরিয়ে দেওয়া যায় তার প্ল্যানিং করছিল। বীরু ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি এটা একটা ফাঁদ। ঠিক সেই সময় আচমকা ঝোপে লুকিয়ে থাকা দুগাই পেছনদিক থেকে জাপটে ধরে বীরুকে। পিছমোড়া করে বেঁধে দেয় দুহাত। সঙ্গে সঙ্গে ঝোপ থেকে
  বেরিয়ে আসে আরও কয়েকজন। সন্তোষ ওর মাথা দু হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে জিভটা টেনে গেঁথে দেয় একটা ছুরি। চিৎকার করার শক্তি হারিয়ে ফেলে বীরু।
তারপর যে ছ সাতজন ছিল তারা চুলের মুঠি ধরে কিল চড় ঘুষি মারতে শুরু করে। বীরু যত সন্তোষের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে যায় ততই কিল চড়ের বহর বাড়ে। সন্তোষ বলে তার পা দুটো যেদিন ভেঙে দেওয়া হয় সেদিনটা খেয়াল পড়ে?
তার পর তার হাত পা
  ব্রীজ  থেকে খুলে আনা শালবল্লীতে বেঁধে টেঙে নিয়ে যায় একটা কালভার্টের কাছে। সেখানে গিয়ে বাঁধন খুলে দিতেই বীরু আবারও পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করে। সন্তোষ ওর সাকরেদদের হুকুম করে ওর হাত দুটো কেটে দিতে। বলা মাত্র কাজ। বিজন তার টাঙ্গির কোপে দুটো হাত বিচ্ছিন্ন করে দেয় দেহ থেকে। পা দুটো ছটপট করে  মাটিতে। বীরু গোঁগাতে থাকে। সন্তোষ আবারও হুকুম জারি করে পায়ের ধড়ফড়ানি বন্ধ করে দিতে। যথারীতি পাদুটোও বিচ্ছিন্ন হয় দেহ থেকে। নেতিয়ে পড়ে বীরু। এরপর সন্তোষ নিজের হাতে টাঙ্গি ধরে বিচ্ছিন্ন করে দেয় মুন্ডুটা। 
রক্তে ভিজে যায় রুখা মাটি। কটু সোঁদা গন্ধে ভরে যায় বাতাস। ধেই ধেই করে পৈশাচিক উল্লাসে নাচতে থাকে মৃতদেহের উপর ওরা সাতজন। তারপর সঙ্গে নিয়ে আসা খালি সিমেন্টের বস্তায় পুরে ফেলে দেহ এবং বিচ্ছিন্ন দেহাংশগুলো। আবারও শালবল্লায় বেঁধে নাচতে নাচতে নিয়ে যায় ড্যামে। কয়েকজন মুর্শিদাবাদ শ্রমিকদের জাগিয়ে তুলে ঘুম থেকে আর বলে,“এখনই বাঁধের উপরে মাটি খুঁড়তে হবে। বেচারারা ভয়ে মাটি খুঁড়তে বাধ্য হয়। খোঁড়া গর্তে বীরুর দেহাংশ আর নিজেদের পরিধেয় সমস্ত কাপড় আর টুকরো শালবল্লী, রেখে উপর থেকে মাটি ঢাকা দিয়ে দেয়। ওরা জানত সকাল হলেই ২০/৩০টা ট্রাক মাটি ফেলে দেবে ওখানে। আর কোন চিহ্নই পাওয়া যাবে না
গল্পটা শুনে গা টা ঘুলিয়ে উঠল। তবু জিজ্ঞেস করলাম,
-ওরা এখন কোথায়?
-ওরা আকন্ঠ মদ গিলে মাটি খাদানে গান গাইছে।
-পরিবেশ?
-থমথমে। সবাই সব জানে। কিন্তু কেউ কিচ্ছু বলছে না।
-রিভার ক্লোজিং এরিয়া?
 
-ওখানে মাটি পড়ছে যথারীতি।
  গর্ত করার কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।
-ওখানে যাওয়া যাবে?
-যাবে না কেন? প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া কেউ কিছু ভয়ে বলতে পারবে না। আমি তো ওদেরই একজনের কাছ থেকে ঘটনার পূর্ন বিবরণ শুনলাম
পুলিশ কিছু খুঁজে পাবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া পুলিশে খবর দেবে কে?
কিছুক্ষন চুপচাপ থাকলাম। পরে বললাম, 
-সাড়ে দশটায় একটা ছোট স্ট্রাকচারের লে আউট দিতে যাবো।
গিয়ে দেখলাম সব নর্মাল। কাজ চলছে রীতিমত।
আরও মাস দেড়েক কাজ চলল। স্পীলওয়ের কাজ শেষ। মাটির কাজও প্রায় শেষ। মুর্শিদাবাদের শ্রামিকরা বাড়ী চলে গেল। স্থানীয় কিছু শ্রমিক ফিনিশিং এর কাজ করছিল। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আমার বদলীর আদেশ এল। এবার যেতে হবে ঝাড়্গ্রাম।
বকেয়া সমস্ত পেপার ওয়ার্ক শেষ করলাম রাতদিন জেগে। বিছানা বেডিং বাঁধলাম। নিজেই উইলিশ ডাব্লু বি জে ১০২১ হলুদ জীপের স্টিয়ারিং ধরলাম। পাশে ড্রাইভার।
এক সময় সবাইকে বিদায় জানিয়ে গাড়ী স্টার্ট করলাম। মনে পড়ল প্রথম দিনের ঘটনা। দুটো বছরের নানান স্মৃতিরা ভীড় জমালো আমার স্মৃতির মনিকোঠায়।
জানি এই রুখা ফুটিফাটা মাটি একদিন নদীবাঁধের জলে সিক্ত হবে। কটু নয় মিষ্টি সোঁদা গন্ধে ভরে যাবে আকাশ বাতাস। অহল্যা মাটি হবে শ্যামল। সোনালি ফসলে ভরে যাবে চারিদিক। পলাশ নয় গর্ভবতী ধানের মিষ্টি সুবাস নিয়ে আসবে আগামীর বারতা।
                 ( শেষ )