হাতের
গামছায় রক্ত মুছে সাগরেদ জাহাঙ্গীরকে ডাকে রুস্তম । অই মাঙ্গির পুত, ল গোস্তগুলো টাঙ্গায় দে। ছুটে আসে জাহাঙ্গীর ।
বাঁকানো শিকে মাংস গেঁথে নিতে নিতে বলে, শুনলাম ওস্তাদে নাকি ইন্ডিয়া যাইতেছেন
গ্যা ? কেডা কইছে কোন হারামীর পুতে তোরে
এই কথা হুনাইছে ? মহল্লার শওকত বুলছে--- কথাটি বলতে গিয়েও গিলে ফেলে জাহাঙ্গীর
। ওস্তাদের মেজাজ জাহান্নাম লাগতাছে । এখন এই কথা তুললে কেয়ামত হয়ে যাবে। কিন্তু শওকতের
খবর ত ফলস হতে পারেনা। ওস্তাদের শালা লাগে সম্পর্কে শওকত। ঘর লাগোয়া ঘর দুজনার।
ওস্তাদের বিবির লগে হেভি খাতির। মোহররমের
অনুষ্ঠানে এক সাথে দুই পরিবার জলসার আয়োজন
করে। সেখানে কাওয়ালির মূল গায়েন শওকত। আজকাল জাহাঙ্গীরকে ওরা দলে নেয় ধুয়া ধরার জন্যে। ওস্তাদে চাইপ্যে যাইতে
চাইতেছে। মাগার কিল্লাই ?
মোবাইলে গান ছেড়ে দেয় রুস্তম। মন ভাল না । তার
মেয়ে রোশনি এইবার বিবিএ পাশ করে ইন্টার্ন
করছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে। মহল্লার সব মেয়েদের চেয়ে সেরা মেয়ে তার। চব্বিশ বছর
বয়েস। কি সুন্দর ফরফর করে ইংরেজি বলে। বিয়েও ঠিক। বাঙ্গালী পোলা। সেও ব্যাংকার।
মেয়ের রুমে বঙ্গবন্ধুর ছবির পাশে এক
দাঁড়িওয়ালা বুড়ো মানুষের ছবি। সে নাকি বিশ্বকবি। তার লেখা গান শোনে মেয়ে। কবিতা
পড়ে। রুস্তমকেও সেই গান শোনায়। এই গান শুনলে রুস্তমের মন নরম হয়ে যায়। গরু খাসির
গলায় ছুরি চালিয়ে জবাই করতে মন উঠে না। মনে কয় এই সব ছাইড়া ফুলের দোকান দিই কিম্বা
আতর গোলাপ কাফনের কাপড়ের দোকান খুইলা বইস্যা পড়ি। তখন কি বোঝে জাহাঙ্গীর পোলাডা কে
জানে! রুস্তমকে সরাইয়া নিজেই জবাই করা গরু খাসি দস্ত করতে লেগে যায়। তয় কথাটি
মিথ্যা নয়। আশফাক চাচাকে দেখতে তার দিল্লী যাইবার কথা চলতাছে।
বিহারের ভাগলপুর থেকে রুস্তমের দাদাজান জব্বার পহেলা এই বাংলায় চলে আসে। । অভাব যখন ঘরের ভিটি বেচতে
বাধ্য করল তখন রুস্তমের দাদাজান আরও কয়েকজনের সাথে ধুনকারের কাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
কলকাতার রাস্তায়, অলি গলি চষে “লেপ তোশক বালিশ বানাই করে করে” শেষে থিতু হয় এই পুব বাংলার ঢাকায়। দাদাজান ছিল জোয়ান পুরুষ।
তার ঘরে নতুন বউ । মন টিকে না এই জলা জঙ্গল নদীনালার দেশে। থেকে থেকেই নয়া
বিবিজানের মুখ ভেসে ওঠে। ভার বাড়ে শরীরের।
তার সাথে কাম ক্ষুধা রাতজাগা। আয়
বাড়তে অনেকে পরিবার নিয়ে এসেছে। রুস্তমের দাদাজানও এক শীতে মা বউকে আনতে রওনা হয়
ভাগলপুর ।সাথে নেয় পুব বাংলার তাঁতের শাড়ি। হাতে বোনা রঙিন গামছা। আম্মিজান কিছুতেই রাজী হয়না দেশ ছাড়তে। তিনি
ভাইয়ের বাড়ির রান্নাঘরের বারান্দায় মাচা বেঁধে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন। কিন্তু
রুস্তমকে ইজাজত দেয় বউ নিয়ে যেতে। নতুন বউ রেশমার বাক্সো বোঁচকা গুছিয়ে দিয়ে বলেন, যাও মেরে
লাল। এই আমার জন্মভূমি। এখানেই আমার মউত লেখা।
রেশমার
ভারী পছন্দ হয় এই দেশ। এখানে মাটিতে বীজ
ফেললেই গাছ হয়। আকাশ ঝেঁপে জল নামে। সবুজ মরকতে মোড়া চারপাশ। বিহারের মত রুখু সুকু
শক্ত পাথর মাটি পেরিয়ে মাইলের পর মেইল হেঁটে জল আনতে হয় না । বড় দিলদার বাঙ্গাল মানুষগুলো । বাঙ্গালদের
সাথে ভাব ভালবাসায় দিব্যি মানিয়ে নিয়েছিল
বিহারের মেয়ে রেশমা। কিন্তু কিছুদিন পরেই দেশ ভাগ হয়ে গেল। রুস্তমের দাদাজান ছুটে
গেল বিহার। আম্মিজান চলেন, এটি এখন হিন্দুর দেশ। মুসলমানদের জন্যে পাকিস্তান
রাষ্ট্র হয়েছে। তাছাড়া বাঙ্গালদেশ বড় সুন্দর। দেশোয়াল ভাই বেরাদরে আমরা এক মুলুক
করে নিয়েছি সেখানে। কিন্তু আম্মিজান আসেনি। নাতিদের জন্যে রুপার তাবিজ দিয়ে বলেছিল
আমার বেটারা ভাল থাকুক। অই দেশের জন্যে আমার হাজার সালাম আমার বেটাদের মুখে আহার
দেওয়ার জন্যে। বেটা অই দেশই এখন তোমার আম্মি।
ততদিনে জব্বারের একটি লেপ
তোষক বানানোর দোকান হয়েছে। দুই ছেলে আব্বাস আর আশফাক মহল্লার ছেলেদের সাথে ইশকুলে যায়। ইশকুল থেকে ফিরে মিছিল করে । বড়
ভাইদের সাথে পোষ্টার লাগিয়ে ঘরে ফিরে। খালি পায়ে
প্রভাতভেরি করে । গান গায় “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো--। মহল্লার সর্দার রুস্তম আব্বাসের দাদাজানকে ডেকে
বলে, ভাইহো ছেলে সামালকে। আমরা বাঙ্গাল নেহি হে। নাহি হোংগা। হুকুমতে গুস্সা
দেখানা ঠিক নেহি হোগা। ছেলেরা শুনলে ত।
শেষ পর্যন্ত পুলিশ আসে। কিছুদিনের জন্যে দুই
ছেলেকে বিহার পাঠিয়ে তবে ঝামেলা থেকে রেহাই মেলে। বড় ছেলে আশফাক বিহারেই থেকে গেল।
কিন্তু ছোট ছেলে রুস্তমের বাপজি আব্বাস
সাচ্চা দিলে এই দেশকে ভালবাসত । সত্তরের ইলেকশনের আগে ফিরে এসে জান লড়িয়ে দিল শেখের জন্যে। বেরাদারদের
অনেকের মুখ কালি হল। সর্দার বুদ্ধি দিল, শাদি করাও। বাঙ্গালি লোগকো পেয়ার করনা ছুট যায়েগি। আব্বাসের
বিবি হয়ে ঘরে এলো সর্দারের আপন বোনের মেয়ে এতিম শিরিনবানু। ইশকুলে নাটক করে,
রবীন্দ্র নজরুলের গান গায় কবিতা আবৃত্তি করে। বাঙাল মেয়েদের মত শাড়ি পিন্ধে যখন
তখন গেয়ে ওঠে “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।”
সেই
সময় পুর্ব বাংলার পরিস্থিতি বিবেচনা করে অনেকেই ছেলেমেয়ে পরিবার বিহার পাঠিয়ে
দিচ্ছিল। কেবল পাকিস্তানী পতাকা উড়িয়ে দিয়ে রওনক সাদি আর তার সাগরেদরা বেজায়
পাকিস্তানী হয়ে পাকিস্তানের পক্ষে শেখের বিপক্ষে ছিল। রওনক সাবধান করে আব্বাসকে।
বড়ভাই আশফাকের বন্ধু ছিল ইশকুলে। আব্বাস তর্ক করে, ভাইজান আমরা কেন পাকিস্তানী হব।
এই মুলুক ত আগে এক ছিল। সেই ব্রিটিশ জমানা থেকে। বাংলা
বিহার উড়িষ্যা বার্মা । এই দেশ আমাদেরও আপনা দেশ। আমাদের নুন দিয়েছে। অন্ন জল আশ্রয়
দিয়েছে। আমরা কেন পাকিস্তানীদের পক্ষে যাব ? আব্বাসের আম্মিজানও ছেলের যুক্তি মেনে নেয়। সত্যি ত।
বিহারে তারা না খেয়ে ছিল । এক মুঠো ছাতু ভাগ করে খেতে হয়েছে কতদিন । তার শাশুড়ি তো
সারা বছর রোজা করত যাতে না খেয়ে থাকতে না
হয়। এই দেশ মায়ের মত আশ্রয় দিয়েছে তাদের। নতুন
বউ শিরিনবানুও স্বামীর সাথে একমত। স্বামীর
হাত ধরে টগবগিয়ে রেসকোর্স ময়দানে চলে আসে বংগবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ শুনতে ।
অন্তসত্বা শিরিনবানু একবার শুনেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মুখস্থ করে ফেলেছিল। চোখ
দৃঢ় করে হাতের আঙ্গুল উঁচিয়ে বঙ্গবন্ধুর মত বলত , এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার
সংগ্রাম। জয় বাংলা।” বাঙ্গালী না হয়েও
স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের জন্য উন্মুখ অধীর হয়েছিল ওরা।
একাত্তরের
জুন মাস। খুব গোপনে আব্বাস কাজ করছে। কঠিন
পাহারা চারপাশে। বেরাদরদের সাথে দুরত্ব এতদূর বেড়ে গেছে যে কোন মূহুর্তে বিপদ হয়ে
যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধেও যেতে পারছে না। চারপাশে শত্রুপুরী। রওনক ভাইজানের ঘরে এক
পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন আসে যখন তখন। রওনকের আত্মীয়। দেশভাগের সময় করাচী চলে গেছিল। সারাক্ষণ
কাঁটা হয়ে থাকে বাপজি, আম্মি আর শিরিণবানু। জুনের একুশ তারিখ কাসটমারের চালান
রশিদে সংকেত আসে বুড়িগঙ্গা নদিতে অস্ত্র আর সৈন্য বোঝাই একটি লঞ্চ ডুবিয়ে দিতে হবে।
অপারেশন সাকসেসফুল করতেই হবে। গ্রুপ টু, বি রেডি। জয় বাংলা। সেই বিকেলে বাজারের থলি হাতে বেরিয়ে যায় আব্বাস। যাওয়ার
আগে আম্মিকে সালাম করে শিরিনবানুর বুকের ভেতর
কেঁপে ওঠে। এই প্রথম সে ভয় পায়। ভরা পোয়াতি শিরিনের জল এসেছে পায়ে। হাঁটতে কষ্ট তবু
আব্বাসের হাত জড়িয়ে নেমে আসে উঠোনে । শিরিনের পেটে চুমু খায় আব্বাস। নিচুস্বরে
বলে, আমার বিটিয়া হবে। জোরসে বল বিটিয়া, জয় বাংলা। গলি পেরিয়ে হাঁটতে শুরু করে।
একই সময় রাস্তার অন্য পাশের এক ময়লা মুখ ফেরিওয়ালা হেঁকে ওঠে, শো ওও ও
ও ন পাপড়ি !
সাতদিনের মাথায় জব্বারের লেপ তোষকের দোকানে
মিলিটারী নামে। সাথে মহল্লার রওনক। শিরিনবাণুর কোলে তখন চারদিনের ছেলে। পাগলের মত
ছুটে আসে রেশমা বানু। তার সামনেই দোকানে আগুন দেয় রওনক। জব্বার
আর আব্বাসকে তুলে নিয়ে যায় মিলিটারিরা। পায়ে ধরা থেকে জীপের সামনে আত্মাহুতি দিতে
উদ্যত রেশমা বাণুকে ধরে রাখে প্রতিবেশীরা। পাকিস্তানী মিলিটারিরা জানতে চায়,কৌন ?
রওনক পরিচয় দিতেই ছুঁড়ে ফেলে, হঠ যা বেঈমানের আম্মা।” জীপ থেকে চেঁচিয়ে ওঠে
আব্বাস, রওনক দেখ লেংগে।
এরমধ্যে
হাত চিঠি আসে । বড় ছেলে আশফাক লিখেছে দিল্লী চলে আসতে। সর্দার চুপিচুপি আসে। শিরিণবাণুকে
করাচিওয়ালা মিলিটারী ক্যাপ্টেন নিকাহ্ র প্রস্তাব দিয়েছে। জ্বলে ওঠে শিরিণবাণু।
ততদিনে মহল্লার অনেকেই বুঝতে পারছিল পাগল হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা । এবার দেখল উন্মাদিনী
শিরীনকে। ঘর থেকে বটি নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল রওনকের দিকে। আর সেই মূহুর্তে সমস্ত প্রেম
ভুলে “বেঈমানের বিবি বলে” শিরিনকে নিষ্ঠুরের মত রাইফেলের বাট দিয়ে পিটাতে শুরু করে রওনকের পাকিস্তানী আত্মীয় ক্যাপ্টেন।
রেশমাবাণু ঠেকাতে গেলে তাকেও “বেঈমানের মা” বলে আহত করে ফেলে রেখে যায়।
শিরিনবানু এখন সম্পুর্ণ উন্মাদ। ছেলেটা পড়ে থাকে
ঘরে। জোর করে শিশুটিকে বুকের দুধ খাওয়ায় রেশমা বানু। শিরিন বাচ্চাটিকে একবারের
জন্যেও তাকিয়ে দেখে না। সারাদিন কাগজ ছেড়ে আর বিড় বিড় করে ঘর উঠোন ঘুরে বেড়ায়। পেটের
দায় বড় দায়। রেশমা বানু কাজ করে সর্দারের বাড়িতে । সর্দারের বিবি বাচ্চাটিকে
রুস্তম রুস্তম নামে ডাকে। খাওয়ায়। একদিন ঘোর সন্ধ্যায় শিরিনবানু খালি ঘরে আগুন
লাগিয়ে দেয়। কেউ কেউ এগিয়ে আসে বাঁচাতে । কেউ কেউ দূর থেকে বেঈমানের বিবি পুড়ে
মরছে দেখে ভয়ে সরে যায়।
দেশ
স্বাধীন হলে সেই শোন পাপড়িওয়ালা দেখা করতে
আসে। কিছু সাহায্য পেয়ে ছাপড়া তুলে নেয় রেশমা বানু। তারপর কেউ আর কোন খোঁজ নেয় না।
সর্দার সবকিছু বিক্রি করে চলে যায় দিল্লী। আশফাক মিয়া বহুবার নিতে এসেছে। রেশমা
বাণুর কেবল ই মনে হয়েছে তার স্বামী ছেলে ফিরে আসবে। তিনি রুস্তমকে নিয়ে বুকে আশা বেঁধে জেগে থাকেন।
রুস্তম বেড়ে উঠেছে রাস্তায়। নাম সই ছাড়া
কিছুই পড়াশুনা জানে না। অনেক টুটা ফাটা কাজ করে একটি মাংসের দোকান দিতে পেরেছে। সেই
দোকান এখন বড় হয়েছে। স্বচ্ছল হয়ে বিয়ে করেছে । তার মেয়ে কি করে যেন লেখাপড়া শিখে
মহল্লার চানতারা হয়ে ঊঠেছে। পুরানো যারা আছে তারা অনেকেই বলে ওর দাদী শিরিণবাণুও
নাকি এমন চৌকস বুদ্ধিমতী ছিল।
আশফাক চাচা প্রায় ই আসে। বরাবর কম কথার
মানুষ তিনি। রেশমা বানু মারা যাওয়ার পরে কথা কমে গেছে একেবারে। তিনি এসে কেবল ঘুরে
বেড়ান। মনে হয় কি যেন খুঁজে বেড়ান। খুঁজে খুঁজে পুরানো লোকদের বের করেন। সেন্ট
গ্রেগরী ইশকুলে গিয়ে বসে থাকেন। ইশকুলের দেওয়ালে ছায়া ফেলে অনেকক্ষণ ধরে সেই ছায়া
দেখেন। মাঝে মাঝে রুস্তমের মাংসের দোকানে বসে ছুরির ধার পরখ করেন। এবারও এসেছিলেন রোশনির
আর ওর বরের কবিতা আবৃত্তি অনুষ্ঠান দেখতে। ভোরে চলে গেলেন। রুস্তমের হাতের উপর হাত
রেখে বলে গেলেন, একটি কাজ বকেয়া ছিল। করে গেলাম। একবার দিল্লী এসো বেটা। কথা আছে।
বেলা
বাড়তেই চীৎকার ভেসে আসে। শওকতের বুড়ো বাপজী রওনককে কে বা কারা জবাই করে রেখে গেছে।
রুস্তম ছুটে যায়। ওর বুকের ভেতর তিরতির করে এক সুখের কাঁপন বাজে। চোখ ভিজে ওঠে
খুশিতে। এখন আর কেউ তাকে বলবে না বেঈমানের
বেটা।