শীতের
সকালে একা একা মৃতা পঁচাত্তর বছর বয়সের
স্ত্রীর হাত ধরে বসে রইলেন সুমিতশেখর। সুহাসিনীর মৃত্যুকালে তাঁর
চার ছেলেমেয়ের কেউই পাশে ছিল না। তখন শীতকাল। সুহাসিনী ঘরের বাইরে বাঁধানো চাতালে
বেতের চেয়ারে বসে সকালের চা খাচ্ছিলেন। একদিকে সুমিতশেখর, তিনিও
বসে ছিলেন। সুমিতশেখর
তাঁর স্বামী, যথারীতি সকালের পূজা-পাঠ শেষে পায়ে
মোটা মোজা, মাথায় টুপি,গায়ে পাঞ্জাবীর উপরে
একপ্রস্থ গরম জামাকাপড়, তাঁর উপরে শাল মুড়ি দিয়ে
সুহাসিনীর পাশে বসে চা খেতে খেতে কথা বলছিলেন। বেশির ভাগ কথাবার্তাই সাংসারিক,
মধ্যে ছেলেমেয়েদের কথাও হচ্ছিল। গত কয়েকদিন ধরেই সুহাসিনী কথায়
কথায় ছেলেমেয়েদের কথা তুলছিলেন। ক্রমাগত একই কথা বারবার বলায় বিদ্রুপের সুরে সুমিতশেখর বলে উঠলেন—ভারি তো ছেলেমেয়েদের কথা ভাব, কই, এতবার করে যে ওদের বললে এখানে আসার জন্য, একজনও
এলো? তুমি শুধু ওদের নিয়ে চিন্তা কর, ওরা করে না, বুঝলে?’
সুহাসিনী
এই কথায় দুঃখ পান। আজও পেলেন। ছেলেমেয়েরা থাকে কত দূরে। ঘর-সংসার,
নিজেদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, স্বামীদের
আপিস-কাছারি সব ফেলে মেয়েরা,
বৌমারা কি করে এতদুরে এসে বসে থাকবে? এত দুরে আসতে গেলে তো আর
এক/দুদিনে র জন্য আসা যাবে না, হাতে কয়েকদিনের সময় নিয়ে
তবে আসা । তিনি নিজে কি তা জানেন না? তাহলে শুধু শুধু
সুহাসিনীকে কষ্ট দেওয়া কেন! বেশ
তো ছিলেন ছেলেদের কাছে। বড় শহরে থাকা, খাওয়া,
আরামের তো কোন অসুবিধে ছিল না! ছোট ছেলের কাছে যখন বিদেশে ছিলেন,
ছেলে-বৌমা, নাতনি কত করে বলেছিল ওখানে
থাকার জন্য। কিন্তু সুমিতশেখরের সেই এক কথা---বিদেশের মাটিতে মরব কি রে, আমার কি নিজের দেশ নেই ?’ যদি ওরা আরো
বেশিদিনের জন্য আটকে রাখে, তাড়াতাড়ি তিনমাসের মাথায় চলে
এলেন কলকাতায় বড় ছেলের বাড়িতে। তা সেখানেও তো দিব্যি ছিলেন! হেসে-খেলে, শরীর চর্চা করে, বাজারে ঘুরে ঘুরে মাছ,
শাক-সব্জি কিনে, নাতির সঙ্গে পার্কে
খেলা করে তাঁর তো দিন মন্দ কাটছিল না! কিন্তু কি যে হল, আবার পালিয়ে এলেন। মানুষটার
বোধ হয় এক জায়গায় বেশিদিন মন টেঁকে না।
সব ছেড়ে ফিরে এলেন সেই বাপের ভিটেয়। ছেলেমেয়েরা তাঁদের চাকরি জীবন,
সংসারজীবন ফেলে রেখে
এখানে এসে থাকতে পারে ? তাঁর নিজের
চাকরি জীবনে তিনি এসে কদিন ছিলেন বাপ-মায়ের কাছে!
সুমিতশেখর
এসব যে বোঝেন না তা নয়, তবু বলা চাই, আর এইজন্যই সুহাসিনী মনে মনে কষ্ট পান। সারা জীবন বড় বড় শহরে, ঠাটে-বাটে থাকার পর সুহাসিনীর কি কষ্ট হয়না, এই
আধা শহরে এসে থাকতে? কি আছে এখানে, দুটো ভাল করে কথা বলার মত লোক পাওয়া যায় না! কিন্তু সুহাসিনী হলেন সেই ধরণের স্ত্রী, যিনি স্বামীর
কথায় কোনদিন অবাধ্য হবেন না, স্বামীর কথাই শেষ কথা,
যত কষ্টই হোক না
কেন, মানিয়ে নেবেন। তবে আর শুধু ছেলেমেয়েদের কথা
বারবার তুলে তাঁকে কষ্ট দেওয়া কেন?
সুহাস
কি ছেলেমেয়েদের কথায় তাঁর উপর রাগ করে চলে
গেলেন! ছেলেমেয়েদের সম্বন্ধে বিরক্তি প্রকাশ কি তাঁকে খুব বেশী আঘাত দিল?
সুহাসিনী চিরদিনই বড় বেশী সন্তানভক্ত। এমন মা বুঝি কোটিকে গুটিকও
মেলেনা। সুমিতশেখরের ছেলেমেয়েদের নিয়ে অত আহ্লাদেপনা নেই। তাঁদের মানুষ করেছ,
লেখাপড়া শিখিয়েছ,ব্যস! এবার ছেড়ে দাও।
সুহাসিনীর মত কে মাছ ভালবাসে, কে ছোট মাছ খায় না, কার রসগোল্লা পছন্দ, কে কারিপাতা দেওয়া ডাল
মুখে তোলে না,এসব মনে থাকে না,অত
আদিখ্যেতা ভালও বাসেন না। তাই কি ছেলেমেয়েরা তাঁকে একটু এড়িয়ে চলে? নাতি-নাতনীরাও সুহাসের ভক্ত বেশী। তিনি নিজেই বা কি কম! সুহাসের মুখের
দিকে চেয়ে রইলেন সুমিতশেখর।
কতক্ষণ
কেটে গেছে সুমিতশেখর নিজেও জানেন না। বড় ফটকটার গায়ে কেউ যেন জোরে জোরে
ধাক্কা দিচ্ছে। শব্দ শুনে সম্বিৎ ফিরল সুমিতশেখরের,কিন্তু
সুহাসকে ছেড়ে কি করে এখন উঠবেন বুঝতে পারছিলেন না। শব্দটা কি অনেকক্ষন হচ্ছে! বাড়ির ফটকটা খানিক দূরে।
বাঁধানো চাতাল পেরিয়ে কিছুটা ঘাসের লন মত আছে। সুহাসের আবদারেই এটা করতে হয়েছিল।
গাঁ-গঞ্জে থাকি বলে কি গাছপালা, ঘরদোর সব অগোছালো
করে রাখতে হবে নাকি! ঘরদোর সাজানোয় খুব শখ ছিল সুহাসের। খুব মামুলী জিনিস দিয়েও এত
সুন্দর করে সাজিয়ে রাখত, মন জুড়িয়ে যেত দেখলে। শব্দটা আরো
জোর হচ্ছে। কেউ
কি ডাকছে? সুহাসের হাতটা আরো জোরে চেপে ধরলেন সুমিতশেখর।
(২)
ধপ
করে একটা আওয়াজ আর বাড়িতে কাজ করে যে দেহাতী মেয়েটা, যুগিয়া, তার ছোট ছেলেটা লাফ দিয়ে পড়ল এপারে। সুমিতশেখর
যেন কিছু দেখেও দেখলেন না। যুগিয়ার ছেলে, যার নাম কিনা
টংলু, সেখান থেকেই হাঁক দিল----দাদা, হেই দাদা...হাঁকছি কখন থেক্যে, শুনতে নাই পাও?
মা দাঁড়ায় আছে বাহারে..চাবি খুল...’
সুমিতশেখরের
দিকে ছুটে এল টংলু। কি বুঝল কে জানে,
একছুটে ঘরে ঢুকে একটা ছোট্ট বেতের ঝুড়ির ভিতর থেকে বাইরের ফটকের
চাবি নিয়ে তালা খুলল। আর তারপরই শোনা গেল তার চীৎকার--- ও মা,আস্যো আস্যো...দিদির কি হইছে দ্যাখ, কে কুথাকে
আছো গ,আস্যো আস্যো...ইদিকে আস্যো গ...’
যুগিয়াই
ছুটে এলো সকলের আগে। সকালের বাসী কাজ করার জন্যই সে এসেছে। এসে দ্যাখে এই কান্ড!
টংলুকে পাঠাল আশাপাশে বাড়িতে খবর দিতে।
তারপরের
ঘটনা দ্রুত ঘটে যেতে লাগল। একেবারে যেন ঘড়ির কাঁটা ধরে। আশেপাশে বাড়ির লোকজনেরা এলেন,সুহাসকে ঘরের ভিতর খাটে
শোয়ানো হল। ছেলেমেয়েদের খবর দেওয়া হল। বিকেল নাগাদ বড় ছেলে, বৌমা, নাতি আর ছোট মেয়ের দলবল এসে হাজির হল।
সুমিতশেখরের জন্য শোবার, বিশ্রাম করার ব্যবস্থা করা
হয়েছিল, কিন্তু সুহাসের পাশে বসে একটি হাত ধরেই তিনি বসে
রইলেন আগের মতই। সুমিতশেখর কি কিছু বুঝতে চাইছেন, কোন
প্রশ্ন আছে তাঁর সুহাসের কাছে, নাকি তিনি ক্ষমাভিক্ষা
করছেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে দুঃখ দিয়েছেন বলে, কটু কথা বলেছেন
বলে? সুমিতশেখর যেন সেটাই জানতে চান।
সুহাসকে
নিয়ে যাবার সময় মেয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। একবার তাঁকে অন্য ঘরে নিয়ে যাবার
চেষ্টা করল। সুমিতশেখরের মুঠি
আরো দৃঢ হল। যুগিয়া পায়ের কাছে কাঁদতে লাগল ---মা ঠাকরুণ নাই বাবা, যাত্যে দাও উনাকে...।‘
শেষে
টংলু এসে হাত ধরল সুমিতশেখরের---দাদা, আমি
যাব্যো, তুমি চল আমার সঙ্গে।‘ সুমিতশেখর
কিছু বুঝি বলতে চান। যুগিয়া বলে উঠল---চল বাবা, আমরা
যাব্যো।‘
শববাহকদের
সঙ্গে যেতে কষ্ট হবে ভেবে মেয়ে জামাই তাঁকে গাড়ীতে তুলে নিতে চাইলেন। সুমিতশেখর
কোন কথা না বলে টংলুর একটা হাত ধরে উঠে দাঁড়ালেন।
পড়ন্ত
বিকেলের আলোয় সুহাসের পাশে পাশে শ্মশানযাত্রীদের সঙ্গে হাঁটতে লাগলেন সুমিতশেখর।
একহাতে ধরা রইল টংলু আর পিছনে তাঁকে সাবধানে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল যুগিয়া।
শেষজীবনের সঙ্গী তো এরাই!
ঢালের
কাছে এসে শক্ত করে টংলুর হাত ধরলেন সুমিতশেখর।