গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১৪ জুলাই, ২০১৫

আবু রাশেদ পলাশ

মাকড়সা
                 
অন্তু এখন যেখানে থাকে সেটি পুরনো কংক্রিটের তৈরি একতলা ঘর । পরিত্যক্ত,অপরিচ্ছন্ন আর আপাদমস্তক শেওলা ধরা  চারপাশে শাল-কড়ইয়ের সুবিস্তৃত অরণ্য ।আশেপাশে জনবসতির চিহ্ন দেখা অমাবস্যায় চাঁদ দেখার মত দুরূহ এখানে । একাকি জীবনে এখানে মাঝেমাঝেই কিছু অপরিচিত মুখশ্রী  চোখে ভাসে ওর  কে জানে কত বছর আগে এখানে কারো পদচিহ্ন পড়েছিল । অথবা কোন রমণী তার ভেতরে লালিত স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে গেছে এখানে । এখন কোথায় সে ? ভাবনাগুলো মস্তিষ্কে  কেমন জটলা পাকায় আজকাল । এ জায়গাটা আগে চেনা ছিলনা অন্তুর ।সহকর্মী সুমন সম্প্রতি এর সন্ধান দিয়েছে তাকে । তারপর এখানে এসে বসতি গড়েছে সে । ভেতরে জংলা কেটে পরিষ্কার করেছে  স্যাঁতস্যাঁতে মেজেতে একটা চৌকি পেতে নিয়েছে ইতোমধ্যেই । চৌকির ব্যবস্থা করেছে সুমন, সাথে কয়েক বোতল কার্বলিক এসিড । সাপের ভয় আছে জঙ্গলে । তার চেয়েও ভয়ংকর বুনো শেয়াল । রাতে এখানে শেয়াল ডাকে । গভীর রাতে দরজার পাশে শেয়ালের কণ্ঠ শুনলে  পিলে চমকে উঠে অন্তুর  তবুও জায়গাটা নিরাপদ ওর জন্য কারণ জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সে । বিশাল জনসমুদ্রে অস্তিত্বহীন ঠেকলে মানুষ ফেরারি হয় । নিজ সত্ত্বাকেও বিশ্বাস করতে পারেনা তারা । অন্তুর অবস্থাও এখন তদ্রূপ । আয়নার সামনে দাঁড়ালে যে সত্ত্বা চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় তার থেকেও পালিয়ে বেড়াতে ইচ্ছে করে ওর ।       

আজকাল রাতে ঘুম হয়না অন্তুর । চোখগুলো কেমন জ্বালা করে যেন  বিছানায় শুয়ে থাকলে পীঠে ব্যাথা অনুভব করে সে ।  পরক্ষনে অন্ধকারেই দেয়ালে হেলান দিয়ে বিড়িতে আগুন ধরায় নেশাচরী  ভেতরে ভ্যাঁপসা গন্ধ নাকে লাগেনা ওর  অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে  পিদিমে আগুন দিলে ঘরের ভেতরটা চোখে পড়ে সহসায় । দেয়ালে মাকড়সা বাসা করেছে, জাল বুনেছে কোনায় কোনায় 
সুমনের সাথে অন্তুর পরিচয় কাকাতালিয়ভাবে   গ্রামের কলেজে এইচ এস সি দিয়ে শহরে এসেছিল সে । প্রথমদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়ে কতগুলো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে । সাথে মার্কসীট না আনায় ভর্তি হতে পাচ্ছিলনা অন্তু  বিশ্ববিদ্যালয় ট্রান্সপোর্টের সামনে এসে দেখে শিক্ষার্থীদের  বিশাল জটলা । লম্বা,কাল আর দানব সদৃশ একজন বক্তৃতা দিচ্ছে । ছাত্র-ছাত্রীদের কি সব অধিকার আদায়ের কথা বলে সে । এখান থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়না সেগুলো । পাশে বসে সুমন আড্ডা দেয় বন্ধুদের সাথে। ওর সাথে সহসা কথা বলার সাহস পায়না অন্তু । দৃষ্টিগোচর হলে সুমনই এসে পরিচিত হয় ওর সাথে ।
-কি ভাই,নতুন মনে হচ্ছে সমস্যা কোন ?
-হুম,মার্কসীট আনিনি ভর্তি নিচ্ছেনা তাই ।
-ও আচ্ছা, আস আমার সাথে ।

সেদিন সুমনের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় অন্তু । সুমন ছাত্র রাজনীতি করে । লম্বা দানব সদৃশ যে মানুষটা অবিশ্রাম বক্তৃতা দেয়, ওর নাম রনি । বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সব থেকে পরিচিত মুখ । সুমন ওরই অনুসারী ।অতপর সুমনের মাধ্যমেই রনির সাথে পরিচিত হয় অন্তু । পরিচয় পর্ব শেষ হলে অন্তুকে নিয়ে মঞ্চে উঠে রনি তারপর আবার মুখে কথার তুবড়ি ছুটে ওর-
-বন্ধুরা এর নাম অন্তু । ভর্তি হতে এসে হয়রানির শিকার । আজ থেকে অন্তুও আমাদের সহকর্মী  পরক্ষনে শ্লোগান দেয় সবাই- ভর্তি নিয়ে বাণিজ্য, মানিনা মানবনা । প্রশাসনের কাল হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও  

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর সবসময় সুমনের সহযোগিতা পেয়েছে অন্তু । সুমনের মাধ্যমেই ছাত্র রাজনীতিতে আগমন ওর । তারপর সহকর্মী হয়ে উঠা  এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেও পরিচিত মুখ । অবনীর কথা মনে আছে ? অর্থনীতি বিভাগের অবনী-দোহারা গড়নের সুশ্রী মেয়েটা । বন্ধুরা টুনি বলে ডাকে ওকে । বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কালচারাল প্রোগ্রামে ওর সরব উপস্থিতি চোখে পড়ার মত । এক অনুষ্ঠানে অন্তুর সাথে পরিচয় হয় ওর । সেদিন শাড়ি পড়েছিল সে ।হাতে কাচের চুড়ি আর মাথায় বেলি ফুলের ঝুঁটি । মঞ্চে উঠার আগে অন্তুকে দেখে বলেছিল-
-দেখতো আমার সাজটা ঠিক আছে কি ?
-হুম । সেদিন আর কথা হয়নি ওদের । তারপর একদিন ডিপার্টমেন্ট থেকে ফেরার পথে পেছনে একটা মেয়ে মানুষের কণ্ঠ শুনে অন্তু । তাকিয়ে দেখে অবনী । অবনী বলে-
-তোমাকে বলছি । কি নাম যেন তোমার,সিনিয়র ?
-হুম, অন্তু ।
-আপনি বলতে পারবনা, ওটা আমার হয়না । আমি অবনী । চল বসি এখানে ।

এরপর মাঝেমাঝেই অবনী আর অন্তুর দেখা হয় ক্যাম্পাসে । দেখা হলে বসে আড্ডা দেয় ওরা । কোনদিন সন্ধ্যার শেষ অবধি । নারী দেহে সম্মোহনী ক্ষমতা থাকে ।ওটা বিধাতা প্রদত্ত ।  রাতে বিছানায় শুয়ে ওগুছালো ভাবনায় পড়ে অন্তু । তারপর ভেতরে ভেতরে শিহরণ হয় ওর ।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিরোধী পক্ষের মধ্যে জহিরের দাপট তুঙ্গে । ওকে কে না চেনে ? বিকেলে দলের ছেলেদের নিয়ে ক্যাম্পাস পদক্ষিন করে সে । ট্রান্সপোর্টে গেলে টঙের মামারা ঘন লিকারে চা করে খাওয়ায় ।এরই মধ্যে একদিন ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রনির সাথে বিরোধ হয় ওর । ব্যাপারটা হয়তো এখানেই শেষ হতে পারত কিন্তু হয়নি । এটা নিয়ে বেশ বড় কলহ হয় পরে  প্রথমে হাতাহাতি তারপর রক্তারক্তির ঘটনা ঘটে ক্যাম্পাসে  সেদিন অন্তুর হাতে রিভলবার আসে সুমনের মাধ্যমে । অন্তু বলে-
-রিভলবার চালাতে পারিনাতো সুমন ভাই ?
-সাথে রাখ,শিখিয়ে দেব ।
প্রথমদিন রিভলবার হাতে নিলে কেমন অস্বস্তি হয় অন্তুর । পরক্ষনে বলে
-এটা বরং তোমার কাছেই রাখ ভাই,আমার কেমন অস্বস্তি হয় ।
কথা শুনে ধমক দেয় সুমন-অবুঝের মত কথা বলিসনা অন্তু । তোর সেফটি তোকেই দিতে হবে ।

এ ঘটনার পর কিছুদিন পালিয়ে থাকতে হয় সবাইকে । লুকিয়ে গ্রামে চলে যায় অন্তু । সেখানে ওর মা থাকে, বাবা পরবাসী  ছেলে বাড়ি ফিরলে আহ্লাদিত হয় হাসিনা বানু । রাতে সুখ-দুঃখের গল্প করে দুজন । হাসিনা বানু বলে-এবার পলিটিক্স ছেড়ে দে অন্তু, ওসব করে কি হবে বলতো ?  
সহসা হাসিনা বানুর কথার জবাব দেয়না অন্তু । পীড়াপীড়ি করলে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দেয় সে । এদিকে কদিন ধরে মনে মনে অন্তুকে খুঁজে অবনী । ক্যাম্পাসে কোথাও দেখা পাওয়া যায়না ওর । সুমনের সাথে দেখা হলে ওর বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারটা অবগত হয় সে । এরপর ক্যাম্পাসে ফিরে আবার ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হয় অন্তু । অবনীর সাথে দেখা হলে মান-অভিমানের একপালা গান হয় দুজনের মধ্যে ।   

অবনীর সাথে অন্তুর প্রেমময় সম্পর্ক হঠাৎ করেই ।  এইতো গেল ফাল্গুনে মনের আদান-প্রদান করল দুজন । এখন ওরা আত্মার আত্মীয় । আজকাল অবনীর ছোট ছোট ছেলেমানুষি গুলোও সয়ে গেছে অন্তুর  অবনীর সারাদিন চকলেট চিবানোর অভ্যাস । একটাকা ধরের সস্তা চকলেট । ও চকলেট চিবালে বিরক্ত হয় অন্তু । তারপর বলে-
-কি খাও ওসব, ছেড়ে দাওনা ?
-ভালতো, তুমিও একটা নাও ।
পরক্ষনে অভিমান করে থাকতে পারেনা অন্তু । সেও একটা চকলেট মুখে নিয়ে চিবাতে থাকে । আহ! কি সুখময় সম্পর্ক ওদের । একেকজন যেন মধুভরা রক্তজবা । এ ক্যাম্পাসের কে না ওদের চেনে ? বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি দূর্বাঘাসও ওদের প্রেমের সাক্ষী । সেখানে অবনীর কোমল পায়ের স্পর্শ আছে যে । কলাভবনের দক্ষিণে শিমুলতলা, সেখানে ছোট একটা বাঁশের টং । অবনীর পছন্দের জায়গা এটা । কত বিকেল দুজনে এখানে কাটিয়েছে ! কত সুখময় মুহূর্তের সাক্ষী এ টং !  পশ্চিম আকাশে রক্তাভ সূর্যটা লাল হয়ে একসময় মিলিয়ে যায়,ধরণীর বুকে অন্ধকার নামে তখন । শিমুলতলায় ঝিঝি পোকার আনাগোনা বাড়ে ক্রমশ । কিন্তু প্রজাপতি সদৃশ মানুষদুটোর কথা ফুরায়না সহসা । অন্তু বলে-
-রাতযে অনেক হল অবু চল উঠি । অবনী বলে-  
-যদি না যায় আজ, আমার সাথে থাকবা এখানে ?
অবনীর কথা শুনে হাসে অন্তু । তারপর দীর্ঘক্ষণ কোন অজানা মোহের মধ্যে পড়ে থাকে দুজন  এ মোহের ঘোর কাটেনা সহসা । অন্যদিকে অবনীর সাথে সম্পর্ক হওয়ার পর থেকে সংগঠনের কাজে মন নেই অন্তুর  ব্যাপারটা বিচলিত করে রনিকে । একদিন রাতে এ নিয়ে কথা হয় দুজনের মধ্যে । রনি বলে-
-সারাদিন কই থাকিস বলতো, দেখিনা যে ?
অবনীর ব্যাপারটা পাশ কাটানোর চেষ্টা করে অন্তু । ও বলে-আছি ভাই আপনাদের সাথেই 
-মেয়ে মানুষের পাল্লায় পড়ছিস শুনলাম । কেন এসব ফালতু ব্যাপারে জরাস ? কাজে মন দে
-ঠিক আছে ।
অন্তুর কথায় খুশি হতে পারেনা রনি । ওর সংক্ষিপ্ত করে বলা ঠিক আছে কথাটা যে আদৌ ঠিক নেই এটা রনির চেয়ে ভাল কে জানে । সংগঠনে বেশ চৌকশ সে, নিজের অবস্থান বিসর্জন দিতে অকৃপণ । সেদিন সুমনের সাথেও কথা হয় ওর । রনি বলে-
-অন্তুকে আমার চাই,অবনী কে- খোঁজ নে ?  
এরপর হঠাৎ একদিন অবনীর সাথে সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি হয় অন্তুর । দীর্ঘদিন কথা হয়না ওদের মধ্যে । ঐ দিন গুলোতে বিধ্বস্ত থাকে দুজনই  অবশেষে একদিন সুমনের মাধ্যমেই নতুন করে সম্পর্ক তৈরি হয় ওদের । সুমন বলে-
-ছেলেমানুষি ছাড় দুজনই, একটু স্থিত হও সম্পর্কে ।

তারপর আবার প্রজাপতির আনাগোনা বাড়ে ক্যাম্পাসের সর্বত্র । শিমুলতলার টং প্রাণ পায় আবার । এখানে বসে আগামীদিনের স্বপ্ন বুনে দুজন । অবনী আর অন্তুর সম্পর্কটা হয়তো এমনই হতে পারতো সবসময় । কিন্তু হয়নি। হঠাৎ একদিন অস্ত্রসমেত পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায় অন্তু । পত্রিকায় নাম আসে ওর । ক্যাম্পাসে কানাঘুষা করে সবাই । এক এক করে দিন যায়, সহসা ছাড়া পায়না সে । তারপর রনির সহায়তায় যেদিন বেড়িয়ে আসে অন্তু, ততদিনে অবনী বদলে গেছে বেশ । অন্তু এলে সহসা ভরসা করতে পারেনা অবনী । ছাত্র রাজনীতির নামে অন্তু যা করে বেড়ায় স্থানীয়দের ভাষায় সেটা ক্যাডার রাজনীতি । এর ভবিষ্যৎ কি ? একাকি বিছানায় শুয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয় চপলমতি মেয়েটা  কিন্তু সম্পর্কের টানাপড়েন গুছাতে পারেনা সহসা  
একদিন শিমুলতলায় জোড়াশালিকের পদচারনা দেখা যায় হঠাৎ  শালিকের কূজন শুনা যায়না সহসা  বিকেলের শেষ সময়টা টঙে বসে থাকে অন্তু-অবনী,কথা বলেনা কেউ ।অকস্মাৎ অন্তু বলে-
-চকলেট খাবা অবু, একটা দেই ?
-না, একটা অনুরোধ করব রাখবা ?
-হুম,বল ।
-পলিটিক্স ছেড়ে দাও তুমি । এ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি, ভেবেছ কখনো ?
-পলিটিক্স ছাড়লে টিকতে পারবনা যে ?
-বেশতো, আমাকেই ছেড়ে দাও তাহলে ।

তারপর আর কথা বাড়ায়না অবনী । নিজ গন্তব্য লক্ষ করে জোড়া পায়ের চিহ্ন আঁকে মাটিতে । অবনী চলে গেলে অনেকগুলো ভাবনা এসে দোল খায় অন্তুর মধ্যে । এক অর্থে অবনীই ঠিক । ও যে ভালবাসার কাঙাল । ক্যাডার রাজনীতি করে অবনীদের মনে জায়গা পাওয়া যায়না । আশা করাও অন্যায় । কিন্তু অবনীবিহীন অন্তু-যখন উন্মাতাল গ্রীষ্মে একপশলা বৃষ্টির প্রতীক্ষা সেখানে মায়াময়ী হাতের স্পর্শ দিবে কে ? পরক্ষনে রনিকে একটা কথা জানিয়ে দেয় অন্তু-
-আমি আর পলিটিক্স করবোনা ভাই ।

অন্তুর কথায় বিচলিত হয়না রনি । মুখশ্রী দেখে মনে হয় এমন কথা শুনার জন্য প্রস্তুত ছিল সে । তারপর সেও বলে দেয়-বেশতো, ভাল না লাগলে ছেড়ে দে পলিটিক্স ।
রাতে রনির কাছে সব শুনে ভাবনায় পড়ে সুমন । রাজনীতির যে বাঁকে আবদ্ধ অন্তু, সেখান থেকে বেড়িয়ে আসা যে অতটাও সহজ নয়-এ সত্যিটা বুঝাতে চেষ্টা করে সে । সুমন বলে-
-পাগলামী করিসনা অন্তু । সংগঠন ছেড়ে দিলে জহির বাঁচতে দিবেনা তোকে ।

বিরোধী পক্ষের মেহেদী অবনীদের ডিপার্টমেন্টে পড়ে । অবনীর দুবছর সিনিয়র সে । ডিপার্টমেন্টে ওকে দেখলে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে ছেলেটা । অন্তুর সাথে সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি হলে অবনীকে কুপ্রস্তাব দেয় সে । এ নিয়ে একদিন অন্তুর সাথে বেশ কলহ হয় তার । এরপর অন্তু ধরে মারে ওকে । মেহেদীও শাসায়-
-ছাড়বনা কাউকে, প্রতিশোধ নিব দেখিস । এরপর ব্যাপারটা জহির পর্যন্ত গড়ায় ।
একদিন সন্ধ্যায় ফেরার পথে অবনীর সাথে দেখা হয় সুমনের । তারপর বসে গল্প করে ওরা । অবনী বলে-অন্তুকে এবার ছেড়ে দেন সুমন ভাই । পড়াশোনা করুক ।
-তুমিও পাগল হইছ অবনী । সংগঠন ছাড়লে টিকতে পারবেনা ও ।
-তবুও চেষ্টা করতে দেন একবার ।

কথা বাড়ায়না সুমন । তারপর সত্যি একদিন সংগঠন ছেড়ে দেয় অন্তু । ও সংগঠন ছেড়ে দিলে সম্পর্কে আবার স্বস্তি আসে ওদের । এরপর আবার শিমুলতলায় পাশাপাশি বসে থাকতে দেখা যায় দুজনকে । আশপাশের দূর্বাঘাসে পদচিহ্ন পড়ে ওদের ।

এরপরের ঘটনা মর্মান্তিক । একদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি কথা শুনা যায় মুখে মুখে । অর্থনীতি বিভাগের অবনী মারা গেছে । গতরাতে কে বা কারা শ্বাসরোধে হত্যা করেছে তাকে । সকালে কেউ একজন ডিপার্টমেন্টের পেছনে ওর লাশ দেখে প্রশাসনে খবর দেয় । ঐদিনই অবনী হত্যা মামলা হয় থানায় ।ফেঁসে যায় অন্তু,জহির,মেহেদী সহ অনেকেই । অবনী হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বাভাবিক শ্রী হারায় । শিক্ষার্থীদের জটলা চোখে পড়েনা সহসা । সন্ধ্যার পর নীরবতা নামে সর্বত্র ।

অবনীর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এসেছে । আচ্ছা লাশকাটা ঘরে মৃত মানুষের কান্না শুনেছ কেউ অথবা কোন মেয়েলি কণ্ঠের আর্তনাদ ? যে দেহে ভালবাসা পরিপুষ্ট হয় তার ব্যাবচ্ছেদে অন্তরাত্মার আস্ফলন কেমন হয় ? অন্তুর খুব জানতে ইচ্ছে করে ভালবাসাপূর্ণ ঐ দেহগুলো বোবাকান্না করে কি ? হাতের বিড়িটা শেষ হয়ে এলে দেয়ালে চেপে ধরে আগুন নেভায় সে  মাকড়সার দিকে দৃষ্টি গেলে চোখ আটকে থাকে সেখানে । নিরীহ মশাসদৃশ পতঙ্গগুলো ওর জালে আটকা পড়লে ভোগ্যপণ্য হয় ।
কদিন থেকে ব্যস্ত রনি, সাথে সুমনও । বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন কমিটি দেওয়া হবে ছাত্র রাজনীতিতে । প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে জহির । মনে মনে ওকে সরিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করে রনি গ্রুপের নেতারা  ক্যাম্পাসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার আগমন ঘটে অন্তুর । ও এলে খুশি হয় রনি । রনি বলে
-অশ্রুকে আগুনে পরিনত কর অন্তু, অবনী হত্যার প্রতিশোধ নেব আমরা ।

ফেরত দেওয়া রিভলবারটা হাতে তুলে দিলে টগবগে দেহে খুন চাপে অন্তুর । জহিরকে ছাড়বেনা সে । বেড়িয়ে আসার সময় রনির ঘরে কানাঘুষা শুনা যায় । সুমন আর রনি কথা বলছে কোন ব্যাপারে । রনি বলে-
-অবনী শেষ, এবার জহিরকে সরিয়ে দে সুমন 

পরক্ষনে সত্যিটা বুঝতে পারে অন্তু । অবনী হত্যার পরিকল্পনাকারী আসলে সুমন আর রনিই । অস্ত্রসমেত একদিন পুলিশের হাতে রনিই ধরিয়ে দিয়েছিল তাকে । মুহূর্তে যাতনা তৈরি হয় নিজের মধ্যে  হাতের রিভলবারটা কার্তুজে পূর্ণ,ওটা তাক করতে ইচ্ছে করে সুমনদের দিকে । হাতে শক্তি পায়না সে । আয়নায় নিজ মুখশ্রী দৃষ্টিগোচর হলে নিজেকে একটা মশাসদৃশ পতঙ্গ ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না তার । বুঝতে পারে মাকড়সার জালে আটকে গেছে সে । পরক্ষনে সুমন তাড়া দিলে সামনের দিকে পা বাড়ায় অন্তু-ফেরারি জীবনে আবার ফেরারি হওয়ার জন্য ।