অন্তু এখন যেখানে থাকে সেটি পুরনো
কংক্রিটের তৈরি একতলা ঘর । পরিত্যক্ত,অপরিচ্ছন্ন আর আপাদমস্তক শেওলা ধরা । চারপাশে শাল-কড়ইয়ের
সুবিস্তৃত অরণ্য ।আশেপাশে জনবসতির চিহ্ন দেখা অমাবস্যায় চাঁদ দেখার মত দুরূহ এখানে
। একাকি জীবনে এখানে মাঝেমাঝেই কিছু অপরিচিত মুখশ্রী চোখে ভাসে ওর । কে জানে কত বছর আগে
এখানে কারো পদচিহ্ন পড়েছিল । অথবা কোন রমণী তার ভেতরে লালিত স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে
গেছে এখানে । এখন কোথায় সে ?
ভাবনাগুলো মস্তিষ্কে কেমন জটলা পাকায় আজকাল । এ জায়গাটা
আগে চেনা ছিলনা অন্তুর ।সহকর্মী সুমন সম্প্রতি এর সন্ধান দিয়েছে তাকে । তারপর এখানে এসে
বসতি গড়েছে সে । ভেতরে জংলা কেটে পরিষ্কার করেছে । স্যাঁতস্যাঁতে মেজেতে একটা চৌকি পেতে নিয়েছে ইতোমধ্যেই । চৌকির
ব্যবস্থা করেছে সুমন,
সাথে কয়েক বোতল কার্বলিক এসিড । সাপের ভয় আছে জঙ্গলে । তার চেয়েও
ভয়ংকর বুনো শেয়াল । রাতে এখানে শেয়াল ডাকে । গভীর রাতে দরজার পাশে শেয়ালের কণ্ঠ
শুনলে পিলে চমকে উঠে অন্তুর । তবুও জায়গাটা নিরাপদ ওর
জন্য কারণ জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সে । বিশাল জনসমুদ্রে অস্তিত্বহীন ঠেকলে
মানুষ ফেরারি হয় । নিজ সত্ত্বাকেও বিশ্বাস করতে পারেনা তারা । অন্তুর অবস্থাও এখন
তদ্রূপ । আয়নার সামনে দাঁড়ালে যে সত্ত্বা চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় তার থেকেও
পালিয়ে বেড়াতে ইচ্ছে করে ওর ।
আজকাল রাতে ঘুম হয়না অন্তুর ।
চোখগুলো কেমন জ্বালা করে যেন । বিছানায় শুয়ে থাকলে পীঠে ব্যাথা অনুভব করে সে । পরক্ষনে অন্ধকারেই দেয়ালে হেলান
দিয়ে বিড়িতে আগুন ধরায় নেশাচরী । ভেতরে ভ্যাঁপসা গন্ধ নাকে লাগেনা ওর । অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে । পিদিমে আগুন দিলে ঘরের ভেতরটা চোখে পড়ে সহসায় । দেয়ালে মাকড়সা বাসা
করেছে, জাল বুনেছে কোনায় কোনায় ।
সুমনের সাথে অন্তুর পরিচয়
কাকাতালিয়ভাবে । গ্রামের কলেজে এইচ এস
সি দিয়ে শহরে এসেছিল সে । প্রথমদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়ে কতগুলো সমস্যার
মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে । সাথে মার্কসীট না আনায় ভর্তি হতে পাচ্ছিলনা অন্তু । বিশ্ববিদ্যালয়
ট্রান্সপোর্টের সামনে এসে দেখে শিক্ষার্থীদের বিশাল জটলা । লম্বা,কাল আর দানব
সদৃশ একজন বক্তৃতা দিচ্ছে । ছাত্র-ছাত্রীদের কি সব অধিকার আদায়ের কথা বলে সে ।
এখান থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়না সেগুলো । পাশে বসে সুমন আড্ডা দেয় বন্ধুদের সাথে। ওর সাথে সহসা কথা বলার সাহস
পায়না অন্তু । দৃষ্টিগোচর হলে সুমনই এসে পরিচিত হয় ওর সাথে ।
-কি ভাই,নতুন মনে হচ্ছে
সমস্যা কোন ?
-হুম,মার্কসীট আনিনি
ভর্তি নিচ্ছেনা তাই ।
-ও আচ্ছা, আস আমার সাথে ।
সেদিন সুমনের সহায়তায়
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় অন্তু । সুমন ছাত্র রাজনীতি করে । লম্বা দানব সদৃশ যে
মানুষটা অবিশ্রাম বক্তৃতা দেয়, ওর নাম রনি । বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সব থেকে
পরিচিত মুখ । সুমন ওরই অনুসারী ।অতপর সুমনের মাধ্যমেই রনির সাথে পরিচিত হয় অন্তু ।
পরিচয় পর্ব শেষ হলে অন্তুকে নিয়ে মঞ্চে উঠে রনি তারপর আবার মুখে কথার তুবড়ি ছুটে
ওর-
-বন্ধুরা এর নাম অন্তু । ভর্তি হতে
এসে হয়রানির শিকার । আজ থেকে অন্তুও আমাদের সহকর্মী । পরক্ষনে শ্লোগান দেয় সবাই- “ভর্তি নিয়ে বাণিজ্য, মানিনা
মানবনা । প্রশাসনের কাল হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও” ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর
সবসময় সুমনের সহযোগিতা পেয়েছে অন্তু । সুমনের মাধ্যমেই ছাত্র রাজনীতিতে আগমন ওর ।
তারপর সহকর্মী হয়ে উঠা । এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেও পরিচিত মুখ । অবনীর কথা মনে আছে ? অর্থনীতি
বিভাগের অবনী-দোহারা গড়নের সুশ্রী মেয়েটা । বন্ধুরা টুনি বলে ডাকে ওকে ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কালচারাল প্রোগ্রামে ওর সরব উপস্থিতি চোখে পড়ার মত । এক
অনুষ্ঠানে অন্তুর সাথে পরিচয় হয় ওর । সেদিন শাড়ি পড়েছিল সে ।হাতে কাচের চুড়ি আর
মাথায় বেলি ফুলের ঝুঁটি । মঞ্চে উঠার আগে অন্তুকে দেখে বলেছিল-
-দেখতো আমার সাজটা ঠিক আছে কি ?
-হুম । সেদিন আর কথা হয়নি ওদের ।
তারপর একদিন ডিপার্টমেন্ট থেকে ফেরার পথে পেছনে একটা মেয়ে মানুষের কণ্ঠ শুনে অন্তু
। তাকিয়ে দেখে অবনী । অবনী বলে-
-তোমাকে বলছি । কি নাম যেন তোমার,সিনিয়র ?
-হুম, অন্তু ।
-আপনি বলতে পারবনা, ওটা আমার হয়না
। আমি অবনী । চল বসি এখানে ।
এরপর মাঝেমাঝেই অবনী আর অন্তুর
দেখা হয় ক্যাম্পাসে । দেখা হলে বসে আড্ডা দেয় ওরা । কোনদিন সন্ধ্যার শেষ অবধি ।
নারী দেহে সম্মোহনী ক্ষমতা থাকে ।ওটা বিধাতা প্রদত্ত । রাতে বিছানায় শুয়ে ওগুছালো ভাবনায়
পড়ে অন্তু । তারপর ভেতরে ভেতরে শিহরণ হয় ওর ।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিরোধী
পক্ষের মধ্যে জহিরের দাপট তুঙ্গে । ওকে কে না চেনে ? বিকেলে দলের ছেলেদের নিয়ে
ক্যাম্পাস পদক্ষিন করে সে । ট্রান্সপোর্টে গেলে টঙের মামারা ঘন লিকারে চা করে
খাওয়ায় ।এরই মধ্যে একদিন
ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রনির সাথে বিরোধ হয় ওর । ব্যাপারটা হয়তো
এখানেই শেষ হতে পারত কিন্তু হয়নি । এটা নিয়ে বেশ বড় কলহ হয় পরে । প্রথমে হাতাহাতি তারপর
রক্তারক্তির ঘটনা ঘটে ক্যাম্পাসে । সেদিন অন্তুর হাতে রিভলবার আসে সুমনের মাধ্যমে । অন্তু বলে-
-রিভলবার চালাতে পারিনাতো সুমন ভাই
?
-সাথে রাখ,শিখিয়ে দেব ।
প্রথমদিন রিভলবার হাতে নিলে কেমন
অস্বস্তি হয় অন্তুর । পরক্ষনে বলে –
-এটা বরং তোমার কাছেই রাখ ভাই,আমার কেমন
অস্বস্তি হয় ।
কথা শুনে ধমক দেয় সুমন-অবুঝের মত
কথা বলিসনা অন্তু । তোর সেফটি তোকেই দিতে হবে ।
এ ঘটনার পর কিছুদিন পালিয়ে থাকতে
হয় সবাইকে । লুকিয়ে গ্রামে চলে যায় অন্তু । সেখানে ওর মা থাকে, বাবা পরবাসী । ছেলে বাড়ি ফিরলে
আহ্লাদিত হয় হাসিনা বানু । রাতে সুখ-দুঃখের গল্প করে দুজন । হাসিনা বানু বলে-এবার
পলিটিক্স ছেড়ে দে অন্তু,
ওসব করে কি হবে বলতো ?
সহসা হাসিনা বানুর কথার জবাব দেয়না
অন্তু । পীড়াপীড়ি করলে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দেয় সে । এদিকে কদিন ধরে মনে
মনে অন্তুকে খুঁজে অবনী । ক্যাম্পাসে কোথাও দেখা পাওয়া যায়না ওর । সুমনের সাথে
দেখা হলে ওর বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারটা অবগত হয় সে । এরপর ক্যাম্পাসে ফিরে আবার ছাত্র
রাজনীতিতে সক্রিয় হয় অন্তু । অবনীর সাথে দেখা হলে মান-অভিমানের একপালা গান হয়
দুজনের মধ্যে ।
অবনীর সাথে অন্তুর প্রেমময় সম্পর্ক
হঠাৎ করেই । এইতো গেল ফাল্গুনে মনের
আদান-প্রদান করল দুজন । এখন ওরা আত্মার আত্মীয় । আজকাল অবনীর ছোট ছোট ছেলেমানুষি
গুলোও সয়ে গেছে অন্তুর । অবনীর সারাদিন চকলেট চিবানোর অভ্যাস । একটাকা ধরের সস্তা চকলেট । ও
চকলেট চিবালে বিরক্ত হয় অন্তু । তারপর বলে-
-কি খাও ওসব, ছেড়ে দাওনা ?
-ভালতো, তুমিও একটা নাও
।
পরক্ষনে অভিমান করে থাকতে পারেনা
অন্তু । সেও একটা চকলেট মুখে নিয়ে চিবাতে থাকে । আহ! কি সুখময় সম্পর্ক ওদের ।
একেকজন যেন মধুভরা রক্তজবা । এ ক্যাম্পাসের কে না ওদের চেনে ? বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রতিটি দূর্বাঘাসও ওদের প্রেমের সাক্ষী । সেখানে অবনীর কোমল পায়ের স্পর্শ আছে যে
। কলাভবনের দক্ষিণে শিমুলতলা, সেখানে ছোট একটা বাঁশের টং
। অবনীর পছন্দের জায়গা এটা । কত বিকেল দুজনে এখানে কাটিয়েছে ! কত সুখময় মুহূর্তের
সাক্ষী এ টং ! পশ্চিম আকাশে রক্তাভ সূর্যটা লাল হয়ে একসময় মিলিয়ে যায়,ধরণীর বুকে
অন্ধকার নামে তখন । শিমুলতলায় ঝিঝি পোকার আনাগোনা বাড়ে ক্রমশ । কিন্তু প্রজাপতি
সদৃশ মানুষদুটোর কথা ফুরায়না সহসা । অন্তু বলে-
-রাতযে অনেক হল অবু চল উঠি । অবনী
বলে-
-যদি না যায় আজ, আমার সাথে
থাকবা এখানে ?
অবনীর কথা শুনে হাসে অন্তু । তারপর
দীর্ঘক্ষণ কোন অজানা মোহের মধ্যে পড়ে থাকে দুজন । এ মোহের ঘোর কাটেনা সহসা । অন্যদিকে অবনীর সাথে সম্পর্ক হওয়ার পর
থেকে সংগঠনের কাজে মন নেই অন্তুর । ব্যাপারটা বিচলিত করে রনিকে । একদিন রাতে এ নিয়ে কথা হয় দুজনের
মধ্যে । রনি বলে-
-সারাদিন কই থাকিস বলতো, দেখিনা যে ?
অবনীর ব্যাপারটা পাশ কাটানোর
চেষ্টা করে অন্তু । ও বলে-আছি ভাই আপনাদের সাথেই ।
-মেয়ে মানুষের পাল্লায় পড়ছিস
শুনলাম । কেন এসব ফালতু ব্যাপারে জরাস ? কাজে মন দে
-ঠিক আছে ।
অন্তুর কথায় খুশি হতে পারেনা রনি ।
ওর সংক্ষিপ্ত করে বলা ঠিক আছে কথাটা যে আদৌ ঠিক নেই এটা রনির চেয়ে ভাল কে জানে ।
সংগঠনে বেশ চৌকশ সে, নিজের অবস্থান বিসর্জন দিতে অকৃপণ । সেদিন সুমনের সাথেও কথা হয় ওর ।
রনি বলে-
-অন্তুকে আমার চাই,অবনী কে- খোঁজ
নে ?
এরপর হঠাৎ একদিন অবনীর সাথে
সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি হয় অন্তুর । দীর্ঘদিন কথা হয়না ওদের মধ্যে । ঐ দিন গুলোতে
বিধ্বস্ত থাকে দুজনই । অবশেষে একদিন সুমনের মাধ্যমেই নতুন করে সম্পর্ক তৈরি হয় ওদের ।
সুমন বলে-
-ছেলেমানুষি ছাড় দুজনই, একটু স্থিত হও
সম্পর্কে ।
তারপর আবার প্রজাপতির আনাগোনা বাড়ে
ক্যাম্পাসের সর্বত্র । শিমুলতলার টং প্রাণ পায় আবার । এখানে বসে আগামীদিনের স্বপ্ন
বুনে দুজন । অবনী আর অন্তুর সম্পর্কটা হয়তো এমনই হতে পারতো সবসময় । কিন্তু হয়নি। হঠাৎ একদিন অস্ত্রসমেত
পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায় অন্তু । পত্রিকায় নাম আসে ওর । ক্যাম্পাসে কানাঘুষা করে
সবাই । এক এক করে দিন যায়,
সহসা ছাড়া পায়না সে । তারপর রনির সহায়তায় যেদিন বেড়িয়ে আসে অন্তু,
ততদিনে অবনী বদলে গেছে বেশ । অন্তু এলে সহসা ভরসা করতে পারেনা
অবনী । ছাত্র রাজনীতির নামে অন্তু যা করে বেড়ায় স্থানীয়দের ভাষায় সেটা ক্যাডার
রাজনীতি । এর ভবিষ্যৎ কি ? একাকি বিছানায় শুয়ে অশ্রু
বিসর্জন দেয় চপলমতি মেয়েটা । কিন্তু সম্পর্কের টানাপড়েন গুছাতে পারেনা সহসা ।
একদিন শিমুলতলায় জোড়াশালিকের
পদচারনা দেখা যায় হঠাৎ । শালিকের কূজন শুনা যায়না সহসা । বিকেলের শেষ সময়টা টঙে বসে থাকে অন্তু-অবনী,কথা বলেনা কেউ ।অকস্মাৎ অন্তু বলে-
-চকলেট খাবা অবু, একটা দেই ?
-না, একটা অনুরোধ করব রাখবা ?
-হুম,বল ।
-পলিটিক্স ছেড়ে দাও তুমি । এ
সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি,
ভেবেছ কখনো ?
-পলিটিক্স ছাড়লে টিকতে পারবনা যে ?
-বেশতো, আমাকেই ছেড়ে
দাও তাহলে ।
তারপর আর কথা বাড়ায়না অবনী । নিজ
গন্তব্য লক্ষ করে জোড়া পায়ের চিহ্ন আঁকে মাটিতে । অবনী চলে গেলে অনেকগুলো ভাবনা
এসে দোল খায় অন্তুর মধ্যে । এক অর্থে অবনীই ঠিক । ও যে ভালবাসার কাঙাল । ক্যাডার
রাজনীতি করে অবনীদের মনে জায়গা পাওয়া যায়না । আশা করাও অন্যায় । কিন্তু অবনীবিহীন
অন্তু-যখন উন্মাতাল গ্রীষ্মে একপশলা বৃষ্টির প্রতীক্ষা সেখানে মায়াময়ী হাতের
স্পর্শ দিবে কে ? পরক্ষনে রনিকে একটা কথা জানিয়ে দেয় অন্তু-
-আমি আর পলিটিক্স করবোনা ভাই ।
অন্তুর কথায় বিচলিত হয়না রনি ।
মুখশ্রী দেখে মনে হয় এমন কথা শুনার জন্য প্রস্তুত ছিল সে । তারপর সেও বলে
দেয়-বেশতো, ভাল না লাগলে ছেড়ে দে পলিটিক্স ।
রাতে রনির কাছে সব শুনে ভাবনায় পড়ে
সুমন । রাজনীতির যে বাঁকে আবদ্ধ অন্তু, সেখান থেকে বেড়িয়ে আসা যে অতটাও সহজ নয়-এ
সত্যিটা বুঝাতে চেষ্টা করে সে । সুমন বলে-
-পাগলামী করিসনা অন্তু । সংগঠন
ছেড়ে দিলে জহির বাঁচতে দিবেনা তোকে ।
বিরোধী পক্ষের মেহেদী অবনীদের
ডিপার্টমেন্টে পড়ে । অবনীর দুবছর সিনিয়র সে । ডিপার্টমেন্টে ওকে দেখলে চোখ বড় বড়
করে তাকিয়ে থাকে ছেলেটা । অন্তুর সাথে সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি হলে অবনীকে
কুপ্রস্তাব দেয় সে । এ নিয়ে একদিন অন্তুর সাথে বেশ কলহ হয় তার । এরপর অন্তু ধরে
মারে ওকে । মেহেদীও শাসায়-
-ছাড়বনা কাউকে, প্রতিশোধ নিব
দেখিস । এরপর ব্যাপারটা জহির পর্যন্ত গড়ায় ।
একদিন সন্ধ্যায় ফেরার পথে অবনীর সাথে
দেখা হয় সুমনের । তারপর বসে গল্প করে ওরা । অবনী বলে-অন্তুকে এবার ছেড়ে দেন সুমন
ভাই । পড়াশোনা করুক ।
-তুমিও পাগল হইছ অবনী । সংগঠন
ছাড়লে টিকতে পারবেনা ও ।
-তবুও চেষ্টা করতে দেন একবার ।
কথা বাড়ায়না সুমন । তারপর সত্যি
একদিন সংগঠন ছেড়ে দেয় অন্তু । ও সংগঠন ছেড়ে দিলে সম্পর্কে আবার স্বস্তি আসে ওদের ।
এরপর আবার শিমুলতলায় পাশাপাশি বসে থাকতে দেখা যায় দুজনকে । আশপাশের দূর্বাঘাসে
পদচিহ্ন পড়ে ওদের ।
এরপরের ঘটনা মর্মান্তিক । একদিন
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি কথা শুনা যায় মুখে মুখে । অর্থনীতি বিভাগের অবনী
মারা গেছে । গতরাতে কে বা কারা শ্বাসরোধে হত্যা করেছে তাকে । সকালে কেউ একজন
ডিপার্টমেন্টের পেছনে ওর লাশ দেখে প্রশাসনে খবর দেয় । ঐদিনই অবনী হত্যা মামলা হয়
থানায় ।ফেঁসে যায় অন্তু,জহির,মেহেদী সহ অনেকেই । অবনী হত্যাকাণ্ডের পর
বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বাভাবিক শ্রী হারায় । শিক্ষার্থীদের জটলা চোখে পড়েনা সহসা ।
সন্ধ্যার পর নীরবতা নামে সর্বত্র ।
অবনীর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এসেছে ।
আচ্ছা লাশকাটা ঘরে মৃত মানুষের কান্না শুনেছ কেউ অথবা কোন মেয়েলি কণ্ঠের আর্তনাদ ? যে দেহে
ভালবাসা পরিপুষ্ট হয় তার ব্যাবচ্ছেদে অন্তরাত্মার আস্ফলন কেমন হয় ? অন্তুর খুব জানতে ইচ্ছে করে ভালবাসাপূর্ণ ঐ দেহগুলো বোবাকান্না করে কি ?
হাতের বিড়িটা শেষ হয়ে এলে দেয়ালে চেপে ধরে আগুন নেভায় সে । মাকড়সার দিকে দৃষ্টি
গেলে চোখ আটকে থাকে সেখানে । নিরীহ মশাসদৃশ পতঙ্গগুলো ওর জালে আটকা পড়লে ভোগ্যপণ্য
হয় ।
কদিন থেকে ব্যস্ত রনি, সাথে সুমনও ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন কমিটি দেওয়া হবে ছাত্র রাজনীতিতে । প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে
জহির । মনে মনে ওকে সরিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করে রনি গ্রুপের নেতারা । ক্যাম্পাসে পরিস্থিতি
স্বাভাবিক হলে আবার আগমন ঘটে
অন্তুর । ও এলে খুশি হয় রনি । রনি বলে –
-অশ্রুকে আগুনে পরিনত কর অন্তু, অবনী হত্যার
প্রতিশোধ নেব আমরা ।
ফেরত দেওয়া রিভলবারটা হাতে তুলে
দিলে টগবগে দেহে খুন চাপে অন্তুর । জহিরকে ছাড়বেনা সে । বেড়িয়ে আসার সময় রনির ঘরে
কানাঘুষা শুনা যায় । সুমন আর রনি কথা বলছে কোন ব্যাপারে । রনি বলে-
-অবনী শেষ, এবার জহিরকে
সরিয়ে দে সুমন ।
পরক্ষনে সত্যিটা বুঝতে পারে অন্তু
। অবনী হত্যার পরিকল্পনাকারী আসলে সুমন আর রনিই । অস্ত্রসমেত একদিন পুলিশের হাতে
রনিই ধরিয়ে দিয়েছিল তাকে । মুহূর্তে যাতনা তৈরি হয় নিজের মধ্যে । হাতের রিভলবারটা
কার্তুজে পূর্ণ,ওটা তাক করতে ইচ্ছে করে সুমনদের দিকে । হাতে শক্তি পায়না সে । আয়নায়
নিজ মুখশ্রী দৃষ্টিগোচর হলে নিজেকে একটা মশাসদৃশ পতঙ্গ ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না তার
। বুঝতে পারে মাকড়সার জালে আটকে গেছে সে । পরক্ষনে সুমন তাড়া দিলে সামনের দিকে পা
বাড়ায় অন্তু-ফেরারি জীবনে আবার ফেরারি হওয়ার জন্য ।