আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের থেকে দীনবন্ধুবাবুর জীবনটা অনেক সুখে, অনেক শান্তিতেই কাটছিল। বি.এ.
পাশ করেই বেশ ভাল একটা চাকরী পেয়ে যাওয়ায়, জীবনটা আরও মসৃণ গতি পেয়েছিল। স্ত্রী
রমলা ও ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। কিন্তু যত গোলমাল দেখা দিল রাঘবের মৃত্যুতে।
রাঘব তার বন্ধু ভৈরব এর ছোট ভাই। তার থেকে
বয়সে অন্তত বছর সাতেক এর ছোট। হঠাৎ বুকে যন্ত্রণা শুরু,
ডাক্তার আসার আগেই সব শেষ। ডাক্তার এসে নাড়ী টিপে জানায়— “সরি সব শেষ,
ম্যাসিভ্ হার্ট অ্যাটাক”।
খবরটা শোনার পর থেকে দীনবন্ধুবাবুর মনে একটাই
চিন্তা, তার
থেকে সাত বছরের ছোট একটা লোকের যদি এরকম হার্ট অ্যাটাক হয়,
তাহলে তার তো যে কোনদিন এ রোগ হতে পারে। তার কিছু হলে সংসারটা
তো ভেসে যাবে। এই চিন্তায় তিনি ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শেষে ডাক্তার এসে বিভিন্ন রকম
পরীক্ষা করে জানালেন, দীনবন্ধুবাবু
সম্পূর্ণ সুস্থ। তার শরীরে কোন রোগ নেই। তবে ক্রমাগত এই ভাবে চিন্তা করলে, সত্যিই হার্টের ক্ষতি হতে পারে। সব রকম
টেনশন, উত্তেজনা, দুঃখ থেকে দুরে থাকতে হবে। মনে আরও আনন্দ, ফুর্তি আনতে হবে। প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে, কড়কড়ে চারশ’
টাকা ভিজিট নিয়ে,
দীনবন্ধুবাবুর মনে টেনশন এর বীজ বপন করে, তিনি চলে গেলেন।
ছেলে শ্যামাচরণ প্রেসক্রিপশন খুলে দেখলো তাতে
দুটো মাত্র নির্দেশ লেখা আছে। এক, স্টপ টেনশন, আর দুই, একটা মাল্টি ভিটামিন টনিক।
বাড়ির সবার অনুরোধে দীনবন্ধুবাবু, ডাক্তারের
নির্দেশ মতো দু’বেলা
টনিক খেতে শুরু করলেন, এবং যাতে কোন রকম টেনশন না হয়,
উত্তেজনা না হয়,
তার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। কী ভাবে টেনশন কমানো যায়, তা নিয়ে এক নতুন টেনশন শুরু হ’ল।
বাজারে জিনিসপত্রের দাম যে ভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে
বাড়ছে, তাতে
তার চিন্তা বাড়তে পারে, টেনশন হতে পারে ভেবে, তার বাজারে যাওয়া বন্ধ করা হ’ল। রাস্তার পাশে ছোট্ট সুন্দর বাড়ি। বাড়ির সামনে সামান্য একটু জমি।
জমিটাতে কিছু গাছপালা লাগিয়ে একটা বাগান। সকালে উঠে চা খেয়ে একটু বাগানের পরিচর্যা
করা, তারপর স্নান সেরে, খেয়ে দেয়ে অফিস যাওয়া, আর অফিস থেকে ফিরে চা জলখাবার খেয়ে, টিভি নিয়ে তার সময় কাটতে লাগলো।
সকালে একটাই বাস,
এবং সেই বাসেই তিনি এতদিন অফিস যেতেন। কিন্তু বাসটা ভাঙ্গাচোরা
রাস্তা দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে যায়। রোজই তার মনে হ’ত, বাসটা
না উল্টে যায়। এতদিন ঠিকই ছিল, কিন্তু এখন আর ঐ বাসে যাওয়ার সাহস তার হ’ল না। অগত্যা রিক্সায় অফিস যেতে গিয়ে,
দেরী হয়ে যাওয়ার ভয়ে রোজ তার টেনশনের পারদ চড়তে শুরু করলো।
কাজকর্মও আর আগের মতো নির্ভয়ে দক্ষতার সাথে করতে পারেন না।
একদিন অফিস যাওয়ার সময় তিনি লক্ষ্য করলেন বাগানের
বাতাবি লেবু গাছটায়, ছোটছোট বেশ কয়েকটা লেবু হয়েছে। গাছটা একবারে রাস্তার পাশে বেড়ার
ধারে হওয়ায়, যে
ডালটা বেড়ার বাইরে রাস্তার দিকে বেড়িয়ে আছে,
সেই ডালে অনেক বেশী লেবু হয়েছে। রিক্সা করে অফিস যাওয়ার
পথে তিনি একটা ব্যাপারে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন—
রাস্তার দিকের লেবুগুলো চুরি হয়ে যাবে না তো? যা সব বাঁদর ছেলে মেয়ে। অফিসে কাজে মন
বসাতে পারলেন না। সারাদিন চিন্তায় চিন্তায় থেকে,
অফিস থেকে ফিরেই আবার লেবু গাছটা ভাল করে দেখলেন। রাস্তার
ওপর বেড়ার বাইরে দশটা লেবু হয়েছে।
সন্ধ্যায় টিভির সামনে বসে তার প্রিয় সিরিয়ালে
মন বসাতে পারলেন না। কী ভাবে লেবুগুলো চোরের হাত থেকে বাঁচানো যায়, ভাবতে ভাবতে সিরিয়ালটা
দেখলেন। শেষে এই ভেবে শান্তি পেলেন যে, লেবুগুলো এখনও খুবই ছোট। বড় হয়ে খাওয়ার উপযুক্ত
হতে এখনও অনেক দেরী, ততদিনে
কিছু একটা ব্যবস্থা করা যাবে।
কী ব্যবস্থা করা যায় ভাবতে ভাবতে রাতে কখন
ঘুমিয়ে পড়লেন। সকালে উঠেই লেবুগুলো আবার গুণে দেখলেন,
হ্যাঁ দশটাই আছে। এই ভাবে রোজ তিনি অফিস যাওয়ার সময় একবার
গুণে দেখেন, আবার
অফিস থেকে ফিরে ঘরে ঢোকার সময় আর একবার গুণে দেখেন বটে,
কিন্তু কোন পাকাপাকি ব্যবস্থার কথা ভেবে উঠতে পারলেন না।
শেষে লেবুগুলো যখন সামান্য বড় হ’ল, তখন
তার মনে হ’ল, এই লেবুগুলোই তার টেনশনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা ডাক্তারের মতে তার পক্ষে বিপজ্জনক।
কাজেই এই নিয়মিত টেনশন থেকে বাঁচতে গেলে, লেবুগুলো ছিঁড়ে ফেলাই শ্রেয়। কারণ ভবিষ্যতে যখন লেবুগুলো সত্যিই চুরি
হয়ে যাবে, তখন
সেই অপেক্ষাকৃত বড় আঘাত, তিনি সহ্য করতে পারবেন না।
পরদিন সকালে গুণে গুণে দশটা লেবুই, গাছ থেকে ছিঁড়ে ফেললেন। ছোট ছোট বাতাবি
লেবু, খাওয়াও
যাবে না, তাই
ফেলে দিলেন। কিন্তু ফেলে দেওয়ার পর একটু মনোকষ্ট হলেও,
পরে তার নিজেকে বেশ টেনশন ফ্রী ও হাল্কা মনে হ’ল।
রোজ সকালে বাগান পরিচর্যার সময় তিনি লক্ষ্য
করেন, লেবুগুলো
কেমন আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে, তারপর এক সময় বেশ বড় বড় লেবুগুলো কী রকম হলুদ রঙের হয়ে যাচ্ছে।
একদিন অফিস থেকে ফিরে, বাগানের গেট খুলে বাড়িতে ঢুকবার মুখে
বাঁ পাশে দৃষ্টি যেতে তিনি লক্ষ্য করলেন, রাস্তার দিকের ডালে একটা বেশ বড় হলুদ রঙের লেবু। ছোট থাকা কালীন যখন
তিনি অন্য লেবুগুলো ছিঁড়ে ফেলেন, এটা বোধহয় তখন পাতার আড়ালে ছিল।
মনমরা হয়ে গেট বন্ধ করে বাড়িতে ঢুকে তিনি চেয়ারে
গা এলিয়ে দিলেন। স্ত্রীর প্রশ্নে আক্ষেপ করে স্ত্রীকে সব কথা খুলে বলে, বললেন কেন যে লেবুগুলো ছিঁড়ে ফেললাম।
যে লেবুটা দেখতে পাইনি, সেটা কী সুন্দর বড় হয়েছে। চোরে ছুঁয়েও দেখে নি। তার মানে অন্য দশটাও
একই রকম বড় হ’ত, চুরিও হ’ত না। আজ লেবুগুলো থাকলে কত ভাল হ’ত। আক্ষেপ করতে করতে একসময় তার গলা ধরে এল,
চোখ দুটো চিকচিক্ করতে লাগলো। স্ত্রী রমলা তাকে শান্ত করার
চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাকে শান্ত করবে কে?
কান্না মেশানো গলায় তিনি বললেন, ঐ সাইজের এক একটা লেবুর কত দাম, হায়!
হায়! এ আমি কী করলাম?
এই ভাবে কিছুক্ষণ হা হুতাশ করার পর, তিনি বুক চেপে ধরে মেঝেতে শুয়ে পড়লেন।
ছেলে ছুটলো ডাক্তার ডাকতে। সেই ডাক্তার আবার এলেন। নাড়ী টিপে ধরে বললেন— “সরি সব শেষ,
ম্যাসিভ্ হার্ট অ্যাটাক”। চারশ’ টাকা গুণে নিয়ে তিনি চলে গেলেন।