গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই, ২০১৪

মুস্তাইন সুজাত


ক্ষুধা


এক

ক্ষুধা যেন চাগার দিয়া উঠে নছরআলির । পেটে খেলে তবে না পিঠে সয় !
রাক্ষইস্যা ক্ষুধা তার । অল্পে মেটে না এই ক্ষুধা । ভুখা পেট, কতদিন যে আয়েশ পুরে খায় না ? ভাবতে গেলেই চোখে জল আসে । আফসোসের জল ।
ইউনিয়ন পরিষদের চওড়া বারান্দা ।একটা পিলারে পিছমোড়া দিয়ে বাঁধা নছর আলি। হাত পাঁচেকদূরত্বে কাঠের নড়বড়ে টুলে বসে আছেহাড় জিরজিরে ময়ব চৌকিদার । ঝাঁঝালো রোদ আর অস্থির গরমে চারদিক কাতর । গাছের পাতা নেতানো আর স্থিরনৈঃশব্দতা । চৌকিদারের গায়ের গেঞ্জিটা পুরনো হতে হতেহালকা হলদে রঙ ধরেছে ।ঘামে ভিজে গিয়েলেপটে আছে চামড়ায় । তার পাঁজরের হাড় ২০০হাত দূরে থেকেও ঠিক ঠিক গুনে ফেলা যায় । নছর আলিকে পাহারা দেবার জন্য বসিয়ে রাখা হয়েছে তাকে । একটু পরপর চৌকিদার আর নছর আলি পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে আর চোরাদৃষ্টি বিনিময় হচ্ছে তাদের মধ্যে । যে পিলারের সাথে নছর আলি বাঁধা আছে ওটা কংক্রিট ঢালাই দেয়া, ১০ বাই ১০ । হাতে চিকন দড়ির বাঁধ ।কয়েক গাছি সুতা একসাথে করে দড়ি পাকিয়ে নেয়া হয়েছে । একটু টান খেলেই ছিঁড়ে যাবে । দড়িরবাঁধ ছিঁড়ে দৌড় দিলে ময়বচৌকিদারের ক্ষমতা নেই ঠেকানোর। কিন্তু নছর আলির সে ইচ্ছা হয়না । বরং তার ক্ষুধা পায়, প্রচণ্ড ক্ষুধা এবং সে ভাত খেতে চায় ।

দুই
এই অঞ্চলে হাতেনাতে চোর ধরা পরলে ভয়ঙ্কররকমএক শাস্তি দেয়া হয় ।প্রতি হাত থেকে মধ্যমা এবং কনিষ্ঠা আঙুল বেছে নিয়ে নখের গোঁড়ায় সুঁই ঢুকানো হয় । আর এতে সাধারণ সুঁই ব্যবহৃত হয়না; অতি চিকন, সোনামুখি সুঁই লাগে । এই বিধান কখন কে যে শুরু করেছিল কেউ বলতে পারে না ।তবে চলে আসছে ।একাজের জন্য এলাকার সবচেয়ে সাহসী মানুষ খবির খাঁকে ডেকে আনা হয় আর আঙুলে পুরার কাজটা অতি সাবধানে সারেনতিনি । সুঁই ফুটানোর তীব্র ব্যথায় অপরাধী কুঁচকে যায়, খবির খাঁ দমে না ।
অবশ্য নছর আলিকে শেষ পর্যন্ত এর কিছুই করা হয় না । কেন হয় না ? এর কোন সুনির্ধারিত কারনও খুঁজে পাওয়া যায় না । 


তিন

মণ্ডল বাড়িতেসিঁদ কাটতে গিয়ে গত রাতে ধরা পড়েনছর আলি । শাস্তির এন্তেজামও হচ্ছিল নিয়ম মোতাবেক । কিন্তু চৌকিদার মারফৎ খবর পেয়েই চেয়ারম্যাননছর আলিকে নিয়ে আসে ইউপিতে, নিজের করায়ত্তে । এই প্রথম তরুণ চেয়ারম্যান প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় । অনেকেচেয়ারম্যানকেসাধুবাদ জানায়; কেউ কেউ গতানুগতিক প্রথার বিরোধিতা করায় চেয়ারম্যানকে শাপান্ত করে ।

চার

‘চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা যদি না পরে ধরা’ কথাটা বেজায় সত্য যেমন জানে সবাই, নছর আলিও জানে ।
চুরিবিদ্যার হাতেখড়ি দশ বছর বয়সে এবং মুলত নছর আলিসিঁদেল চোর । এই ষাট বছর বয়সেও টনটনে হাতের কাম । দীর্ঘ চুরির জীবনে মাত্র একবার ধরা পড়েছিল । অবশ্য ধরা পড়ার কারণও ছিল একটা । চুরি করতে গিয়ে বাড়ির রান্না ঘরে ঢুকে যখন মাংস-পোলাওয়ের গন্ধ পায়, তার ক্ষুধাটা চাড়া দিয়ে উঠে । খাওয়া শেষে অন্ধকার ভেদ করে মাটির সাংকিটা রাখতেগিয়েইঘটে যত বিপত্তি । সাথীরা চলে এলেও নছর আলি বের হতে পারেনিসেদিন ।ঠিক আটকে যায় ।ক্ষুধাচক্রে আটকে যায় ।
এরপর আর কোনদিন কেউ তাকে আটকাতে পারেনি ।এই শেষ বেলা, জীবনের একেবারে শেষ সময়ে এসে গতরাত ধরা খেল । তাও কি ধরতে পারতো কেউ ? বয়স্ক চোখের অভিশপ্ত ছানিটা ধরিয়ে দিল তাকে । কখনো আধ পেটা, কখনো ভুখা পেটা; মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলছে এভাবেই । ক্ষুধার তাড়নায় গত রাতে গিয়েছিল মণ্ডল বাড়িতে । রমজান মণ্ডলের মেয়ের বিয়ে ছিল গেলহপ্তাহে । রোস্ট-কোরমা, পোলাও-জর্দা, মাংস-দৈ এ সারাটা গ্রাম যেন গন্ধে মৌ মৌ করছে এখনো । তিন গ্রাম পর থেকে নছর আলির নাকে গন্ধ লাগে আর সাথে সাথে ক্ষুধাটা চাগাড় দিয়ে উঠে । অবশ্য গন্ধটা যায়বিয়ে বাড়িতে দাওয়াতি মেহমানদের কথার পিঠে সওয়ার হয়ে । সেই গন্ধে পেটটা তার মোচর খায় আর জিভ জলে ভরে ।

সবই ঠিক ছিল । রান্না ঘর দিয়েইঢুকেছিল । চোখের সামেন কিছুই পায়নি । চারদিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । অথচ ভেতরে আসতেই একটা সুস্বাদু গন্ধ নাকে ঠেকে । এগিয়ে যায় গন্ধটা নিশানা করে । ছানি পড়া চোখে ঘরের দেয়ালের পাশে রাখা ফ্রিজটা আবছা দেখতে পায় । ডালাটা খুলতে গেলেই ক্যাঁচ করে শব্দ হয় আর ভেতরের আলোটা ঠিক চোখে এসে পরে । ঘরটা চকিতেফর্সা হয় । নছর আলি ভয়ে কয়েকপা পেছাতেই কার যেন পায়ে পা লাগে । ঘুম পাতলা কাজের মহিলা তড়াক করে উঠে পড়ে আরগায়ের জোড়ে চিৎকার তুলে,
চোর চোর । ঘরের মাইজ্জে চোর হামাইসে ।

পাঁচ

বেলা দ্বিপ্রহর । একটু আগে নছর আলির হাতের বাঁধ খুলে দেয়া হয়েছে । চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে ভাত-মাংস রান্না করে পাঠানো হয়েছে । চোখ চক চক করছে এবং সে এখন খাবে । অদূরে কাঠের বেঞ্চিটার উপর বসে আছে ময়ব চৌকিদার । নছর আলি তাকে ইশারায় ডাকে। ময়ব চৌকিদার নড়েনা কিংবা নড়তে চায় না । ভাবে, কি না কি করে বসে আবার, চোরের মতিগতি ? এদিকে তার পেটেও অসহ্য ক্ষুধা । সকাল থেকে না খাওয়া চৌকিদারের ক্ষুধার জ্বালা আর কেউ না বুঝলেও নছর আলি ঠিক ঠিক বুঝতে পারে । চতুর্থ ডাকে চৌকিদার এগিয়ে আসে এবং এদিক সেদিক তাকিয়ে বসে পড়ে নছর আলির সাথে । নছর আলি চৌকিদারের পাতে খাবার তুলে দেয় । ওরা তৃপ্তি ভরে ভাত মাখায় ।মাংসের ঘন ঝুল আর ইরি ধানের ভাত লেপটালেপটি হয় পাতে । নলা মুখে পুরেই কাঁচা মরিচে একটা কামড় বসায় নছর আলি আর আয়েশে চোখ বুজে । আর তৎক্ষণাৎচোখর সামনে ভেসে উঠে গত হওয়া স্ত্রীর অনাহারী মুখটা । চোখ খুলতেই এক ফোঁটা অশ্রু টপ করে পড়েমাটিতে ।

আপাতত নিজের পাতে মন দেয় নছর আলি । গোগ্রাসে ভাতের দলা মুখে পুরতে থাকে একের পর এক । জীবন কেবল যার ক্ষুধাচক্রে বাঁধা তার আবার কিসের অতীত, কিসের ভবিতব্য !