গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই, ২০১৪

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়


ধারাবাহিক গদ্য

জেনানা ওয়ার্ডের গল্প

(১) জেলখানার জেনানা ওয়ার্ডের মেয়ে কয়েদীদের লেখাপড়া শেখাতে গিয়ে প্রথম দেখেছিলাম নুসরত বানুকে। এ তার আসল নাম নয়, আমিই পালটে দিয়েছি। এখন আর জেলখানাও বলে না, বলে সংশোধনাগার। একটি মফস্বল শহরের জেলা সংশোধনাগারে মেয়েদের ওয়ার্ডের লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব বর্তালো আমাদের গুটিকয়েকের ওপরে। দায়িত্ব কেউ তুলে দেয়নি। আমরা নিজেরাই কয়েকজন মিলে কিছু একটা করার তাগিদে সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম। তারপর যা হয়...এখানে চিঠি-চাপাটি, ওখানে চিঠি-চাপাটি, এখানে অনুমতি, ওখানে অনুমতি এমনি হাজার কাঠখড় পুড়িয়ে, হাজার নিয়ম পার হয়ে অবশেষে মিলল আমাদের জেলের ভিতরে যাবার ছাড়পত্র। তারপর থেকে এটা আমাদের রোজকার জীবনে একটা রুটিন হয়ে গেল বলা যায়।

জেলা শহরের সংশোধনাগার। বিরাট তার এলাকা, হাজার রকম তার নিয়ম-কানুন। কতগুলো গেট পার হয়ে যে ভিতরে যেতে হয় ! এক এক করে গেট খোলে, আর আমরা সেই রাস্তা টুকু পার হয়ে আরও এক গেটের সামনে এসে দাঁড়াই। মেন গেটে জমা দিতে হয় মোবাইল, হাতের সব কিছু। সই করে ঢোকা, সই করে বাইরে আসা। পরিচয় পত্র দেখানো এমনি সব নানান নিয়মের বেড়াজাল। নয় নয় করেও আছেন বেশ কিছু পুরুষ ও মহিলা বন্দী। রোজই তাদের বাড়া-কমা চলে। নতুন কেউ এসে পড়েন, আবার অন্যরা কেউ চলে যান অন্য কোন সংশোধনাগারে বদলি হয়ে কিংবা ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে যান। যাবজ্জীবন দন্ডে যারা অভিযুক্ত, তারা এখন আর জেলা সংশোধনাগারে থাকেন না। তাদের জন্য নির্দিষ্ট আলিপুর সেন্ট্রাল জেল। কতরকমের মানুষ, কতরকমের চরিত্র যে দেখলাম ভাবলে অবাক লাগে। পুরুষ বন্দীদের দেখি শুধু বিকেলে খেলার মাঠে, আমরা যখন সেইসময় মেয়েদের ওয়ার্ড থেকে ফিরে আসি, তখন। সেই সময় বিকেলে মাঠে খেলার সময়। সারা মাঠ জুড়ে তখন খেলার আসর। কোথাও ভলি বল, কোথাও ফুটবল, কোথাও ক্রিকেট। মেয়ে বন্দিনীরা নিজেদের এলাকার বাইরে আসতে পারেন না। কিন্তু রাস্তার দুধারে ভিড় করে অনেক পুরুষ বন্দী যারা নিজেরা খেলেন না কিন্তু অন্যদের খেলা দেখেন সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমাদের দেখলে রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ান, পার হবার জায়গা করে দেন। দেখলে কে বলবে এরা অপরাধী! চোর, ডাকাত, খুনী আরও কত রকমের জঘন্য অপরাধ!

মেয়েদের ওয়ার্ড ছোট। জনা পঞ্চাশেক থাকার মত। কিন্তু দোতলা বাড়িটিতে মনে হয় আরো থাকার মত জায়গা অনায়াসেই জুটবে। তাদের আর চাই না, কিন্তু প্রয়োজনে থাকার মত জায়গা আছে। চারিদিকে উঁচু পাঁচিলের ভিতরেই আলাদা করে আরো উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বিরাট গেটে বিরাট তালা ঝোলানো থাকে সবসময়। ভিতরে-বাইরে পুলিশ মোতায়েন থাকে। ভিতরে মেয়ে রক্ষী, বাইরে পুরুষ রক্ষী। বাইরের ঘন্টি বাজলে ভিতর থেকে গেটের মধ্যে অল্প ফাঁক করা জায়গা দিয়ে দেখে নেয়, তারপর দরজা খোলে। আবার ভিতর থেকে বাইরে আসার সময়েও ভিতর থেকে ঘন্টি বাজলে ভিতরের তালা খোলার পর বাইরের তালা খোলে, গেট ফাঁক হয় অল্প করে, আমরা একে একে বেরিয়ে আসি ভিতর থেকে। তার আগে লাইন দিয়ে গুনতি করে মেয়েদের ভিতর বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে গ্রিলের বড় গেটে তালা পড়ে। এমনি আরো কত কি নিয়ম! অবাক হই ভেবে--এত রকমের বিস্ময় জমা হয়ে ছিল আমাদের জন্য!

মফস্বল জেলা শহরের সংশোধনাগারের বেশির ভাগ মহিলা কয়েদীরাই আসেন আশে-পাশের গ্রাম গঞ্জ থেকে যার অধিকাংশই বধূ-হত্যা, পণ দেওয়া-নেওয়া এসব মামলার আসামী হিসাবে। শহরের বার-রেস্টুরেন্টের ড্যান্সিং গার্ল রাও আসেন যখন পুলিশের কড়া নজরদারি চলে। পতিতাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত মেয়েরাও আছেন, সংখ্যায় তারাও কিছু কম নয়। দু/চার জন বাংলাদেশী মহিলা বা স্বল্পবয়স্কা মেয়েও আছেন যারা কাঁটাতার পেরিয়ে এপারে খদ্দেরের সঙ্গে ওঠা বসা করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। বিহার-ইউপি তে নানান মেলায় নাচাগানা করতে গিয়ে ট্রেনে ধরা পড়েছেন এখানের কাছাকাছি কোন ষ্টেশনে, অগত্যা এই সংশোধনাগারে স্থান হয়েছে, এমন নাচনেওয়ালীও দু/একজনেকে দেখেছি। নুসরত বানুও এই মেয়ে কয়েদীদের একজন। না, লুকিয়ে ট্রেনে ফেরার পথে ধরা পড়ে এখানে আসার মত কেস তার নয়। বাড়িতে অভাব, বাবার মদের ঠেকে রাতদিন পড়ে থাকা। সংসারে ভাতের প্রয়োজনে বাবাই তার মেয়েকে নামিয়েছে এই রাস্তায়। নুসুরতের প্রথম হাতেখড়িও বাবার সাহায্যে বাবার ইয়ার-বন্ধুদের দ্বারাই। চলছিল এভাবেই প্রায় বছর দুয়েক। তারপরে একদিন খদ্দেরের আবদারে কোন এক সন্ধ্যার অন্ধকারে খোলা মাঠে বসেছিল তারা কয়েকজন। পুলিশ তাড়া করলে সকলেই পালাতে পারলেও নুসরত বানু পালাতে সক্ষম হয়নি। পুলিশের হাতে ধরা পরার পর থেকে তার স্থান জেলা শহরের এই সংশোধনাগার।