গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই, ২০১৪

অদিতি ভট্টাচার্য্য

বৃত্ত

গতকালই শুনেছিলাম অনুসূয়াদি নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আজ সন্ধ্যেবেলা ফিরতি পথে তাই ভাবলাম যাই একটু খবর নিয়ে আসি। গিয়ে দেখলাম আরো দু তিনজন আছেন। বুঝলাম অনুসূয়াদির শারীরিক অসুস্থতার খবর পেয়েই সবার আগমন।

        আমাকে দেখে অল্প হেসে বললেন, “তোমার কানেও পৌঁছে গেছে খবরটা? বিখ্যাত মানুষ হয়ে গেছি দেখছি!”
        আমিও হেসে বললাম, “তা হলে তো ভালোই। কেমন আছেন এখন? কী হয়েছিল?”
        “তেমন কিছুই না। রোদ লেগে শরীরর খারাপ হয়েছিল। বাজার থেকে রিকশা পেলাম না। হেঁটে হেঁটেই ব্যাংকে গেলাম। বেলাও হয়ে গেছিল, রোদটাও খুব চড়া ছিল।”

        “রোদ্দুরে ঘোরাঘুরি করবেন না। দরকারে তো বেরোতেই হয়, রিকশা নেবেন। রোদটা না লাগানোই ভালো, সাবধানে থাকবেন,” বললাম আমি।

        আমার কথাটা একদম লুফে নিয়ে উপস্থিত এক ভদ্রমহিলা বললেন, “সেই কথাই তো বলছি তখন থেকে। বয়স হয়ে গেছে, একা থাকেন, দেখার কেউ নেই, সাবধানে থাকবেন।”

        এতক্ষণ অনুসূয়াদি সবার উপদেশ চুপচাপ শুনছিলেন, এবার উত্তর দিলেন, বোধহয় এই একা থাকার কথা উঠল বলেই, “একা তো আজ নয়, অনেককালই থাকি। তার জন্যে কিছু নয়। হঠাৎ একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, ঠিক হয়ে যাবে। এসব তো থাকবেই, শরীর থাকলে শরীর মাঝেমধ্যে বেগড়বাঁইও করবে।”

        অনুসূয়াদিকে দেখছি বছর কয়েক আগে থেকে, যবে থেকে আমাদের পাড়ার বাসিন্দা হয়েছেন তবে থেকে। ওনার এক ছাত্রী থাকত কাছেই, সে অনুসূয়াদি বলত, দেখাদেখি আমরা সবাই। কলেজে পড়াতেন, রিটায়ারমেন্টের পর কলকাতার হট্টগোলে নাকি আর থাকতে ভালো লাগছিল না, তাই এই মফস্বল শহরে বসবাসের সিদ্ধান্ত। নিজের ব্যক্তিত্ব এবং পরিশীলিত আচার ব্যবহারের জন্যে নতুন পাড়াতেও অনুসূয়াদি খুব তাড়াতাড়ি সবার নজরে পড়ে গেছিলেন। মিশুকেও যথেষ্ট, তাই আলাপ পরিচয় হতে দেরী হয় নি। দরকারে অদরকারে বার কয়েক আমিও গেছি ওনার বাড়িতে, আলাপচারিতা নেহাতই কেজো কথায় বা দিনকাল, বাজারদর, আবহাওয়া, দেশের পরিস্থিতি ইত্যাদিতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে, এর গণ্ডী পেরিয়ে ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রবেশ করে নি কখনো।

        কিন্তু কিছু মানুষ বোধহয় আছেন যাঁরা যতই হট্টগোল থেকে বাঁচার আর একটু নিরিবিলিতে থাকার যতই প্রয়াস করুন, পূর্ব জীবনের ঘটনাবলী তাঁদের পিছু ছাড়ে না। বরং সঙ্গে আরো অনেক ডালপালা জুড়ে পরচর্চার বেশ ভালো মতো রসদ হয়ে স্থায়ীভাবেই সঙ্গে লেগে থাকে। অনুসূয়াদির ক্ষেত্রেও তাই হল। একে তো একা কোনো ভদ্রমহিলা নতুন কোথাও এসে বসবাস শুরু করলে আশেপাশের মানুষজনের কৌতূহলটা একটু বেশীই হয়, এ যুগেও, তার ওপর আবার বিগত দিনের এ রকম খোরাক থাকলে তো কথাই নেই। কানাঘুষো তাই প্রায়ই কানে আসত। কিছু কিছু শুনে মনে হত হতেও পারে, কিছু বিশ্বাস করতে মন চাইত না।

        যা নিয়ে লোকের এত কৌতূহল, কানাকানি, আলোচনা – সেই সব ঘটনাই, বলা ভালো অনুসূয়াদির জীবনের ওই উথালপাথাল সময়টা একদিন হঠাৎ বই-এর পাতার মতো খুলে গেল আমার সামনে। জানতে পেরেছিলাম অনেক কিছুই, নেহাতই আকস্মিক ঘটনা সেটা। আমার এক মাসি বেড়াতে এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। তাঁকে নিয়ে বেরিয়েছিলাম, ফেরার পথে বাড়ির কাছাকাছি একদম অনুসূয়াদির মুখোমুখি। অনুসূয়াদি কি একটু অস্বস্তিতে পড়েছিলেন? কে জানে! পড়লেও সেটা চোখে পড়ে নি আমার। বরং মাসির গোল গোল চোখের দৃষ্টি আর মুখের অবাক ভাব নজর এড়ায় নি আমার।
        “আপনি এখানে? কবে থেকে?” মাসির প্রশ্ন।

        “এই তো প্রায় বছর তিনেক হল,” বলে চলে গেছিলেন অনুসূয়াদি, আর দাঁড়ান নি।
        তাঁর চলে যাওয়া দেখে মাসি জিজ্ঞেস করলেন, “এ আবার এখানে এসে জুটেছে বুঝি? কবে থেকে? বলিস নি তো?”
        “তুমি কি করে চিনলে ওনাকে?” আমার পালটা প্রশ্ন।
        “আমাদের কমপ্লেক্সেই তো থাকত। চল বাড়ি চল। সব বলছি।”
        বাড়িতে এসে মাসি বেশ জমিয়ে বসে সব বলতে শুরু করলেন। আশেপাশের দুচারজন প্রতিবেশীও জুটে গেলেন।
        “এক পাড়ায় থাকতে হলে প্রতিবেশীদের খবর, কে কেমন সব জানা উচিত,” মাসির মন্তব্য।
        অন্যরাও একমত। অতএব মহা উৎসাহে মাসি বলতে লাগলেন।

        জানা গেল মাসিদের কমপ্লেক্সেরই বি ব্লকের তিনতলায় একটা ফ্ল্যাটে থাকতেন অনুসূয়াদি আর তাঁর স্বামী। অনুসূয়াদির স্বামী কোনো এক প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করতেন। কলকাতাতেই। তখন অনুসূয়াদির নতুন বিয়ে হয়েছে। বছর চার পাঁচ পরে হঠাৎই সবার নজরে আসে কিছুদিন ধরে অনুসূয়াদির স্বামীকে দেখা যাচ্ছে না, উনি আর ফ্ল্যাটে থাকছেন না। আসল খবর পেতেও বেশী দেরী হল না। অনুসূয়াদির স্বামী আবার বিয়ে করেছেন এবং দ্বিতীয় পত্নীর সঙ্গেই আছেন। অনুসূয়াদির কোনো সন্তান হয় নি, তাই একাই ওই ফ্ল্যাটে রয়েছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার উনি কোনো আইনি সাহায্য নেন নি বা এই সম্পর্ক থেকে বেরোবারও কোনো চেষ্টা নাকি করেন নি। যতটকু দেখেছি তাঁকে, তাতে তাঁর পক্ষে অস্বাভাবিকই বটে

        “মনে নিশ্চয়ই আশা ছিল যে স্বামী একদিন ওর কাছেই ফিরে আসবে, তাই কিছু করে নি। তবে বেশভূষা দেখে বোঝা যেত না বিবাহিত না নয়,” মাসির মন্তব্য।
        “কিন্তু আমরা তো জানি যে উনি উইডো,” একজন বললেন।
        “তা তো বলতে পারব না ভাই, ওর স্বামীর বা তার দ্বিতীয় স্ত্রীর কোনো খবরই জানি না,” মাসি বললেন, “অনেক বছর পরে দেখলাম। বয়স হয়ে গেছে তাই, নাহলে সেই একই রকমই আছে। আমি তো দিব্বি চিনতে পারলাম।”

        বুঝলাম মাসির ইঙ্গিত কোনদিকে। বিবাহিতা মহিলার সব চিহ্ন তো অনুসূয়াদি আগেই ত্যাগ করেছেন, তাই স্বামী থাকা বা থাকার কোনো ফারাক তাঁকে দেখে বোঝা যায় না। অনুসূয়াদি তাই একই রকম রয়ে গেছেন। লোকের চোখে আশ্চর্য ঠেকবে বইকি! কারণ লোকে তো বাহ্যিক পরিবর্তনটাই দেখে, মনের গহীনে কী হচ্ছে সে খবর আর কে রাখে বা রাখার চেষ্টা করে। আমি শুধু একটা কথাই বুঝতে পারলাম না তাঁর মতো একজন স্বাবলম্বী, অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ স্বাধীন মানুষ একজন পুরুষের প্রথম স্ত্রী হওয়ার পিকিউলিয়ার স্ট্যাটাস বয়ে কেন এতদিন কাটালেন এবং তার পর বৈধব্যও মেনে নিলেন। অনেক আগেই তো তিনি এই সম্পর্ক থেকে মুক্ত হতে পারতেন। তাঁর আপনজনও কী কেউ তাঁকে এসব বলেন নি? নাকি তিনি মনের কোনে সত্যিই কোনো আশা লালনপালন করছিলেন? কয়েকদিন এসব কথাই মনের মধ্যে ঘুরপাক খেল, তারপর আবার ভুলেও গেলাম। ব্যস্ত, দ্রুত জীবনের আরো নানান ব্যাপার এসে এদের হটিয়ে মনের দখল নিল।

        এর পরপরই অনুসূয়াদির অসুস্থতার খবর পেলাম। অনুসূয়াদির কথাই ঠিক। গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, দিন কয়েকের মধ্যেই ঠিক হয়ে গেলেন। প্রতিবেশীদের আলোচনাও থিতোল এক সময়। সময় তার নিজস্ব নিয়মে বয়ে যেতে লাগল।

        এক রবিবার সকালে দেখলাম অনুসূয়াদির বাড়ির সামনে একটা ট্যাক্সি থামল। যে নামল তাকে দেখে দারুণ চমকালাম। দোকান থেকে ফিরছিলাম, রাস্তার ওপারে ও, মুখ দিয়ে বেরিয়েই গেল, “প্রতীক তুই!” বেশ জোরেই। আমরা এক কলেজে পড়েছি, প্রতীক আমার এক বছরের জুনিয়র।
        প্রতীক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, হাসল, বলল, “শ্রেয়াদি তুমি! তুমিও এখানে থাকো? কেমন আছো?”
        “ভালো আছি। কতকাল বাদে দেখা। তাও আবার এখানেই এরকম হঠাৎ করে।”
        “হ্যাঁ অনেককাল বাদে। মার কাছে এসেছি। তিন বছর পরে দেশে এলাম, তাও মাত্র কয়েকদিনের জন্যে। একটা কনফারেন্সে এসেছিলাম,” প্রতীক বলেই যায়।

        কিন্তু আমার কানে আর কিছু ঢোকে না, প্রথম কথাটা ঢুকতে দিলে তো! মার কাছে? প্রতীকের মা কে? অনুসূয়াদি? কী করে সম্ভব?

        ততক্ষণে অনুসূয়াদিও বেরিয়ে এসেছেন। বোধহয় আমাদের কথোপকথনও শুনেছেন, অন্তত ওনার মুখ দেখে তো তাই মনে হল, চোখদুটোতে যেন কৌতুকের আভাস। আমি আর দাঁড়ালাম না, “এখন যাই, পরে কথা হবে, আমাদের বাড়িতে যাস,” বলে চলে এলাম।

        নিজের হাজারটা কাজের মধ্যেও ওই কথাটাই মনে রয়ে গেল, প্রতীকের মা অনুসূয়াদি! সম্ভব অসম্ভব সব কিছু ভাবতে ভাবতে বোধহয় পাগলই হয়ে যেতাম যাদি না প্রতীকের সঙ্গে আবার দেখা হত। প্রতীকই এল আমাদের বাড়িতে।

        নিজের কথা বলছিল। বিদেশেই সেটল করেছে, ওখানেই এক দক্ষিণ ভারতীয় মেয়ের সঙ্গে আলাপ, তাকেই বিয়ে করেছে।

        এইসব বলার পর একটু চুপ করে থেকে বলল, “মা বলছিল তুমি খুব অবাক হয়েছ আমাকে এখানে দেখে।”  
     
        অস্বীকার করলাম না, বললাম, “হ্যাঁ তা একটু হয়েছি বটে।”

        মনে পড়ছিল অনেক কিছুই, প্রতীক বলেছিল ওর বাবা নেই, শুধু এইটুকুই, বাড়ির কথা, মা বাবার কথা উঠলে কী রকম যেন এড়িয়ে যেত। আমরাও তখন কলেজ পড়ুয়া অল্প বয়সী ছেলেমেয়ে, এসব নিয়ে মাথা ঘামাতাম না।

        “কী যে বলি, কোথা থেকে বলি……….
        “থাক না ওসব। বলতে অসুবিধে হলে কোনো দরকার নেই। আমার অত কৌতূহল নেই,” আমি প্রতীককে থামিয়ে দিলাম।

        “না না তা নয়। আর তোমার কৌতূহল না থাকলেও অন্যদেরও যে থাকবে না তার তো কোনো মানে নেই। বরং বেশীই থাকবে। আগেও তো দেখেছি। কাজেই বলাই ভালো। অন্তত মার জন্যে,” প্রতীক বলে, থেমে যায়, আবার বলতে শুরু করে, “আমার জীবনও আর পাঁচটা বাচ্ছার মতোই শুরু হয়েছিল। বাবা মার আদরে, ভালোবাসায়। ভালো স্কুলে পড়তাম। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। গরমের ছুটিতে সেবারও আমরা বেড়াতে যাচ্ছিলাম। সিমলাতে। আমি, বাবা, মা। কিন্তু সিমলাতে আর পৌঁছতে পারি নি। আমার বাবা মা গেল অন্য কোথাও আর আমার জীবনটা ওলটপালট হয়ে গেল। ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট। অনেক লোক মারা গেল, অনেকে আহত হল, আমি আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে গেলাম শরীরে মামুলী দুচারটে ক্ষতর দাগ আর মনে এক সাংঘাতিক ট্রমা নিয়ে। বছর সাতেক বয়স তখন আমার। মামার বাড়ির লোকেরা আমাকে নিয়ে গেল। বাবার বাড়ির দিক থেকে কেউ এল না। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না, আমি অন্তত কাউকে কখনো দেখি নি। তখনই নানান কথা কানে আসত। শুনতে মোটেও ভালো লাগত না সেসব, ভালো বুঝতামও না সব।

        যাই হোক মামার বাড়ির অবস্থা যথেষ্ট ভালো ছিল। ‘একটা ছেলে থাকবে, থাক, দুটো খেয়ে পরে বাঁচুক। কিছু হলে তো দোষ মামা বাড়িরই হবে। থাক, পড়াশোনা করলে করুক। ফুলগাছের বাগানে তো ওই একই আলো, বাতাস, সার, জল পেয়ে দু চারটে আগাছাও বড়ো হয়। থাক সেরকম,’ এই ছিল মামা মামীদের মানসিকতা। সত্যিই আগাছার মতো বাড়ছিলাম, বিনা আদরে, যত্নে। নামের সঙ্গে অনাথ শব্দটা আটকে গেছিল স্থায়ী ভাবেই। যে স্কুলে পড়তাম সেখানে হস্টেলেও ছিল। শুরু হল হস্টেলে থাকা।  আমার মতো আরো অনেকে ছিল সেখানে। ছুটিছাটায় মামার বাড়ি আসতাম।

        স্কুল থেকেই একবার এক্সকারশনে যাওয়া হল। ভাইজাগ। যাওয়ার দিন থেকেই শরীরটা ভালো ছিল না, কিন্তু বেড়ানোর উৎসাহে গা করি নি। ফল ফলল পরে। বোরা কেভসে নামতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। মাথা ফাটল, গায়ে ধুম জ্বর তখন। জ্ঞান হারাতে হারাতে দেখেছিলাম এক ভদ্রমহিলাকে, আমাকে তোলার চেষ্টা করতে। উনিও নামছিলেন কেভ দেখতে, আমাদের পাশেই ছিলেন। এরপর আর আমার কিছু মনে নেই। বন্ধুদের কাছে শুনেছি জ্বরের ঘোরে খালি মা মা করতাম, ভদ্রমহিলাও নাকি নিয়ম করে আসতেন, ঠায় বসে থাকতেন।

        জানি না এরপর কী করে যেন ওনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। মামার বাড়িতে যখন সবাই জানল, মামী ঠোঁট উলটে বলল, ‘এতো হবে জানা কথাই। এর জন্যেই তো বর আরেকটা বিয়ে করলেও কিছু করে নি। আশায় আশায় ছিল। এখন তো আর কেউ নেই, ছেলেটাকে হাত করবে।’ তখন আরো একটু বড়ো হয়েছি, বুঝেছিলাম সবই। নিজের ওপরই ঘেন্না করত নিজের বাবার কীর্তির কথা ভেবে।”
আমি চুপ। প্রতীকের কথা আর মাসির কথা জোড়া লাগালে যেন বৃত্তটা সম্পূর্ণ হচ্ছে।

প্রতীক বলেই যাচ্ছে, “আমার কিন্তু মার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়তেই লাগল। মামার বাড়ি থেকে আপত্তি করে নি, তারা তো আগাছার দলেই ফেলেছিল প্রথম থেকেই। আজ যদি কিছু হয়ে থাকি সে মার জন্যেই। সব কৃতিত্ব মারই। কম কথা শুনেছে আমার জন্যে? মা বলে কবে ডাকতে শুরু করেছিলাম আজ আর মনে নেই। কিন্তু এটা মনে আছে মা বলে নি, আমি নিজে থেকেই বলেছি। সে নিয়েও কত কথা। মা কারুর মুখাপেক্ষী ছিল না, কোনো দিনই না, কিন্তু লোকে মার সমালোচনা করতে পিছপা হত না। একটা ছেলে বড়ো হবার জন্যে যে মেন্টাল, ইমোশানাল সাপোর্ট দরকার তা মা দিয়েছে আমাকে। ওই ভাইজাগেই আমাদের প্রথম দেখা, ওখানেই মা আমার পরিচয় জেনেছিল। জি আর ই দেওয়া, বাইরে যাওয়া – সব তো মার জন্যেই, মার কথাতেই। আগাছার কাছে ইনিও যদি মা না হন তাহলে আর কে হবে?”

সত্যি কথাই বলেছে প্রতীক। মার কাজই তো করেছেন অনুসূয়াদি।
“অদ্ভুত ব্যাপার কী জানো?” প্রতীক আবার বলে, “আমাকে দেখতে পুরো আমার  বাবার মতো। অবিকল। একবার মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমাকে তুমি সহ্য করো কী করে? পুরোনো কথা মনে পরে না?’ মা হেসেছিল, বলেছিল, ‘পড়ে। তোকে যার মতো হুবহু দেখতে তার মুখও মনে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে জ্বরে বেহুঁশ তোর সেই মুখটাও মনে পড়ে। তার তো আমার কাছে আর কিছু পাওয়ার ছিল না, কিন্তু সেই ছোট্ট ছেলেটার ছিল। যত্ন, আদর, ভালোবাসা – কিছুই সে পাচ্ছিল না। তাই তোর বাইরেটা নিয়ে আর মাথা ঘামাই নি। আরেকজনের শাস্তি তুই পাবি কেন?’
প্রায় রোজ ফোন করি, কিন্তু বলে নি যে শরীর খারাপ হয়েছিল। এসে জানতে পারলাম।”
শুনে সত্যিই অবাক লাগে। মানসিক জোর বটে অনুসূয়াদির। এত কিছু সত্ত্বেও প্রতীককে ভালোবেসেছেন নিজের সন্তানের মতো।
দিন দু তিনেক পরে অনুসূয়াদির বাড়ির সামনে দিয়ে আসতে আসতে দেখি বারান্দায় মা ছেলেতে বেশ কথা কাটাকাটি হচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়ে অনুসূয়াদি ডাকলেন। কী ব্যাপার? না, প্রতীক এবারে অনুসূয়াদিকে নিয়ে যেতে চায় একেবারে মাস ছয়েকের জন্যে। কিন্তু অনুসূয়াদি কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না।

“দেখো কিছুতেই যেতে চাইছে না। বাড়ি, কাজ – এসবের বাহানা দিচ্ছে। আগের বার গেছিল, তিন মাসও পুরো থাকল না, চলে এল। বলছি এবার চলো, একসঙ্গে ঘুরব, বেড়াব।”
“ঠিকই তো বলছে। অনুসূয়াদি, যান ঘুরে আসুন,” আমি বলি।

“একা রামে রক্ষে নেই, সুগ্রীব দোসর!’ অনুসূয়াদি হেসে ওঠেন, “তুমিও এক সুর ধরলে। এবার তো তাহলে আমার আর ছাড়ান নেই।”

প্রতীকের মুখে এবার হাসি ফোটে। অনুসূয়াদি প্রতীকের দিকে তাকান, মায়ের মতোই স্নেহ ভালোবাসা মিশ্রিত দৃষ্টিরসে তাকে সিঞ্চিত করেন। অনুসূয়াদির এই রূপ এই প্রথম দেখলাম। মুগ্ধ দর্শকের মতো তাই সেদিকে তাকিয়েই রইলাম।