আমার সেই অর্থে কোনও নিজের বলে সামগ্রী নেই । আমি যেন এক পথের
পাশের ঝোপ ।যাকে কেটে ফেলাও চলে , আবার
রেখে দিলেও ক্ষতি নেই । বাড়িতে দিন দিন ক্ষোভ বাড়ছে । যত দোষ নন্দ ঘোষের
মত আমিই যেন সব কিছুর জন্য দায়ী ।আমার আর এই জীবন ভালো লাগে না ।
মনে হয় সব কিছু ছেড়ে চলে যাই দূরে কোথাও । কিন্তু যাবটা কোথায় ? আমার নাম বসন্ত দত্ত , বাবার নাম সুব্রত - তবে
তিনি আর নেই । তিনি আজ থেকে প্রায় বছর পঁচিশ আগে গত হয়েছেন ।
সেদিনটার কথা আমি কক্ষনো ভুলবো না । নয় নয় করে আজ আমার বয়স হয়ে গেল পঞ্চাশ বছর ।
জীবনে তো কম কিছু দেখলাম
না ? বাবা এমনই এক শ্রাবণ মাসের
আঁধার কালো দিনে হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ করে চলে গেলেন পরলোকে । থুড়ি , মাফ করবেন আমাকে । তিনি ইহলোক বা পরলোকে বিশ্বাস করতেন
না । তবে যাবার আগে তিনি
আমাকে বেশ কিছু উপদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন ।সেই উপদেশগুলির কোনটাই আমি
আজ অবধি মানি নাই। কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছে তাঁর উপদেশ মানলে আমার জীবনে লাভ বই
ক্ষতি হত না । জীবনের
অর্ধেকের বেশি সময় তো পার করে ফেললাম । মনে মনে ঠিক করলাম , বাকি জীবনটা পিতৃদেবের উপদেশ মেনে চলবো ।
এতদিন হয়ে গেল , বাবা ঠিক কি কি উপদেশ দিয়েছিলেন সব তো মনে নেই ? ভাবতে লাগলাম , এখন
বাবার দেওয়া কোন উপদেশটা আমার পক্ষে লাগসই হবে ? বাড়িতে বউ,ছেলে, বউমা,মা-
সকলেই
আমাকে গঞ্জনা দেয় । আমার যে কোন দোষ নেই , তা কিন্তু নয় । কি করব বলুন ? ওটাই যে আমার স্বভাব । তাহলে প্রথমেই বলে নি আমার দোষের
কথা । আমার দোষ হল , আমি কাউকেই মুখের ওপর না
বলতে পারি না । গৃহের কর্তা হিসাবে প্রতিবেশীরা আমার কাছেই আসে , এটা- ওটা চাইতে । আমি অবলীলায় তা দিয়ে দিই । সেগুলি পরে
আর ফেরত পাওয়া না গেলে আমার বিপদ বাড়ে । আমার এক মামাতো
ভাই হটাত একদিন এসে হাজার ত্রিশ টাকা ধার চাইল । মামার ছেলে বলে
কথা , তাকে কি ফিরিয়ে দেওয়া যায় ? আবার ধরুন সদ্য পিতৃহারা পাড়ার একটি বেকার যুবক আমাকে
এসে বলল, '
দাদা আমি
একটা ম্যানি মার্কেটিং কোম্পানিতে যোগ দিয়েছি , একটা কেশ করুন !' কি আর
করা যায় ? মুখ এড়াতে না পেরে একটা এক লক্ষ টাকার কেশ করলাম । এখন
সেই কোম্পানি আর নেই , টাকাটা জলে গেল।
যাক , এসব ভেবে আর লাভ নেই । বাবা চলে যাবার আগের দিন রাতে
আমাকে বলেছিলেন ধূমপান না করতে । ওই উপদেশটা আমার পক্ষে এ জীবনে আর মানা সম্ভব নয়
। দ্বিতীয় আর একটি
উপদেশের কথা মনে পড়েছে আমার । সেটাও তো মানা হয় নি । পিতৃদেব
বলেছিলেন কোনও আত্মীয়কে টাকা ধার না দিতে , তাতে
সম্পর্ক খারাপ হয় । ঠিক তাই হয়েছে । আমি কিছু না বললেও , মা সেই
মামাতো ভাই এবং মামার সাথে ঝগড়া করে এসেছেন । এখন আর কথা নেই । আমি
ভাবলাম , 'ইস , বাবার
কথা যদি মানতাম , তাহলে আজ আমার এই দশা হত না
'। বাবার যে তৃতীয় উপদেশটার কথা
আমার মনে পড়ল , সেটা
আমি করতে পারি । পিতৃদেবের কোন কথাই তো এতদিন মেনে চলি নি । এই মধ্য বয়সে একবার না
হয় একটা উপদেশ মেনে দেখি ! বাবা বলেছিলেন , 'সংসার ভীষণ কঠিন
জায়গা , এখানে মাথা গরম করে কোন লাভ
নেই । যখন খুব রাগ হবে , তখন দূরে সরে যাবি।'
আমি আর দেরি করলাম
না । মোবাইল ফোনটা টেবিলে রেখে হাঁটা দিলাম স্টেশনের দিকে । এখন সকাল সাতটা । আমার
আর কোন দিকে মন নেই । আমি নিজেই জানি না আমার গন্তব্য কোথায় ?
স্টেশনে এসে একটু দ্বিধায় পরলাম , কোন দিকে যাব আমি ? আমার
বাড়ি বর্ধমান । ট্রেন যাচ্ছে একদিকে হাওড়া অন্যদিকে আসানসোল । আর একটা লাইন যাচ্ছে
শিলিগুড়ির দিকে । পাহাড় আমার ভীষণ
প্রিয় । তাই চেপে বসলাম শিলিগুড়িগামি এক সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেস
ট্রেনে । টিকিট কাটা হয় নি । ভাবলাম টি টি তে ধরবে । কিন্তু কেউ কিছু বলল না ।
ট্রেন একের পর এক স্টেশন পার হয়ে ছুটছে । আমার
এবার মনে হল , এই
মধ্য বয়সে এই রকম পাগলামি না করলেই ভালো হত ? আমার
এই অঙ্গাতবাসের কথা শুনলে লোকে কি না কি বলবে ? আজ
হাজি সাহেব আমাকে না দেখতে পেয়ে হয়ত এতক্ষণে
ফোন করেছে । ফোনটা বেজেই যাবে । সকলেই কাজে ব্যস্ত । কেউ ওদিকে
খেয়াল করবে না । বউমা চা দিতে এসে হয়ত আমাকে না দেখতে পেয়ে ফোনে চেষ্টা করবে । কিন্তু ফোনটা তো টেবিলেই
পরে আছে ।
তখন ভাববে ভুল করে ফোনটা নিয়ে যাই নি । ট্রেন যখন মালদা এলো , তখন দেখলাম সকলেই প্রায় নেমে গেল । খুব খিদেও পেয়েছিল ।
আমিও নামলাম । সামনেই রেলের ভোজনালয় । পেট পুরে মাছ ভাত
খেলাম । ফিরে আসার পথে দেখা হয়ে গেল আমার এক সহকর্মীর সঙ্গে । 'কাকু এদিকে কোথায় ? বেড়াতে
যাচ্ছেন নাকি ?'
আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম ।
সেরেছে । ছেলেটির নাম রতন শুক্লা । এদিকেই বারি।
প্রথম চাকরি বর্ধমানে । তখন আমার বাড়ি ভাড়া থাকত । বউমা ছাড়া বাড়ির
সকলকে চেনে । আমি আমতা আমতা করে বললাম , 'এই
একটু উইক এন্ড ট্যুর '। রতন ছাড়বার পাত্র নয় , বলল , ' কাকিমা
,দাদা,
ভাই - ওরা যাচ্ছে তো ?' আমি
বললাম , ' না, আমি
একাই যাচ্ছি ।'
ঠিক এসময় ট্রেনের সিগন্যাল হয়ে গেল
, তাই রক্ষা
পেটে ভাত পরার পর
কখন ঘুমিয়ে গেছিলাম খেয়াল ছিল না । ঘুম ভাঙ্গল অনেক মানুষের হৈ চৈ শুনে । দেখলাম
ট্রেন দাঁড়িয়ে এন জি পি স্টেশনে । আমি চটপট নেমে পরলাম । এখানেও আমাদের একটি
অফিস আছে । পাছে কেউ দেখেফ্যালে তাই তাড়াতাড়ি স্টেশন থেকে বের হয়ে
হাতের কাছে যা পেলাম তাই ধরে তেনজিং নোড়কে বাস টার্মিনার্সে চলে এলাম । এ টি এম
থেকে হাজার দশেক টাকা তুললাম ।
বলা যায় না , কোথায়
কি দরকারে লাগে ? একটা র্টেকার পাহাড়ে উঠছিল
। একটাই সিট খালি ছিল । চেপে বসলাম তাতে ।
পাহাড়ের পথে প্রবেশ করতেই মনটা খুশিতে ভরে গেল । নিজেকে মনে হল
মুক্ত বিহঙ্গ । আমার আর কোন দায় নেই , দায়িত্ব নেই ।
একটি জায়গায় এসে
গাড়ির ইঞ্জিন খারাপ হয়ে গেল । ড্রাইভার বলল ,'কখন
ঠিক হবে ,কিছু বলা যাবে না।' গাড়িতে
চাপার সাথে সাথেই ভাড়া নিয়ে ছিল । আমি আর টাকা ফেরত না চেয়ে চলতে শুরু
করলাম । রাত নামতে আর বেশি দেরি নেই । সকাল থেকে স্নান হয় নি ।
এবার কোথাও আশ্রয় নেওয়া দরকার । শরীর এতো ধকল সইতে পারবে না। তাই দূরে একটা জনবসতি
দেখে এগিয়ে গেলাম । যা
অনুমান করেছিলাম ঠিক সেরকম না হলেও, কাছাকাছি । একটি হোটেল জাতীয় কাঠের ঘর । ভিতরে একজন মহিলা রয়েছেন ।
আমি ভবিষ্যতের কথা ভেবে বললাম ,' রাতে
থাকার ব্যবস্থা হবে ?' মহিলা
কিছুক্ষন কি যেন ভাবল, তারপর
একটি জানালার কাছে গিয়ে কাকে যেন নিজের ভাষায় কিছু জিঞ্জাসা করল, তারপর পরিষ্কার বাংলায় বলল, হবে । আমি আসস্থ হলাম ।
মহিলাটি বেশ কাজের
। ঘরে ওর স্বামী আছে । তাকে কাজে সাহাজ্য করে খুব। আমি দেখলাম আমাকে বেশ শীত করছে
। আমার অবস্থা দেখে ভদ্রলোক একটি চাদর দিলেল । একেবারে আনকোরা
নতুন চাদর । ভিতরে নিয়ে গিয়ে আমাকে ঘর দেখালেন । একটি ঘর থেকে
কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া দেখা যাচ্ছে ।সে ঘরটির ভাড়া তিনশ টাকা , অন্য ঘরের ভাড়া দুশ টাকা । আমি আর দ্বিধা করলাম না , বললাম
,'ভালো
ঘরটিই আমি নেব ।' স্নানের জন্য গরম জল রেডি
করে ভদ্রমহিলা আমাকে ডাক দিলেন । উনি বললেন , পাশে
স্নান ঘর ,
সব ঠিক করে রাখা আছে । দরকার হলে
ডাকবেন ! আপনার জন্য এখন
চ্যাও বানিয়ে দিচ্ছি !' আমি
ঘাড় নাড়লাম । এদের আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ । রাতে আর বিশেষ কিছু খাইনি । দুটো রুটি
সবজি খেয়ে শুয়ে পরেছিলাম । ঘুম ভাঙ্গল ঝলমল করা আলো দেখে ।
আমি জানি না
বাড়িতে আমার মা,
বউ, ছেলে কিংবা বউ মা কি করছে ? আমার
জীবনে এমন সকাল যেন বহুদিন আসেনি ।