হীরা চন্দ্র
রামপুর বাজারটা খুবই ছোট । সেখানে হাতে গোনা কয়েকটা দোকান মাত্র আর হালকা খাবারের জন্য একমাত্র নিকুঞ্জ দা’র মিষ্টির দোকানটাই ভরসা । সকাল তখন সাড়ে ন’টা প্রায় । নিকুঞ্জ দা’র মিষ্টির দোকানে টিফিন সারার পর, চায়ের জন্য অপেক্ষা করছিল অমিত । পাশের গ্রামের প্রহ্লাদ’কে রাস্তা ধরে হাটতে দেখে, নজরে পড়ল অমিতের ৷ প্রহ্লাদ তাঁর ছোটবেলার বন্ধু । দু,জনেই মাধ্যমিক পর্যন্ত একসাথেই পড়াশুনা করেছিল । অমিত ‘প্রহ্লাদ...প্রহ্লাদ...’ বলে ডাকতেই অবাক চোখে অমিতের দিকে ফিরে তাকাল ৷ কাছে এগিয়ে আসা মাত্রই জিঞ্জেস করল_ ‘ কি রে অমিত, কেমন আছিস ? কতদিন বাদে তোর সাথে দেখা, কী করছিস এখন’ ?
‘আরে থাম! আগে বস তারপর সব বলছি ৷ পল্লব’কে বসতে বলে, নিকুঞ্জ দাকে দুটো চা দিতে বললো । দোকানের একমাত্র স্টাফ বছর পনেরোর কালু দুটো কাঁচের গ্লাসে করে গরম চা টেবিলের উপর রেখে চলে গেল ৷ চা খেতে খেতে অমিত আর পল্লবের গল্প জমে উঠল ৷ সদ্য ‘স্কুল সার্ভিস’ পরীক্ষার মাধ্যমে অমিতের চাকরী পাওয়াতে উচ্ছসিত পল্লব, বলে উঠল_ ‘ যাক, তুই তো পারলি মাষ্টার হতে, আমাকে তো মাঠেই পড়ে থাকতে হল, ক্ষেত-গৃহস্থি নিয়ে...’ ৷
‘ঠিক আছে প্রহ্লাদ, আজ তাহলে উঠি ৷ আমাকে আবার স্কুলের জন্য রওনা দিতে হবে’ ।
‘ যাচ্চলে! গল্পের তালে তালে, তোর স্কুলের নামটাই জানা হল না’ । ‘বেশি দুর না, এখান থেকে মাত্র কুড়ি কিলোমিটার, সোনাপুর হাই স্কুলে’ ।
মিষ্টির দোকানের বিল মিটিয়ে দিয়ে দু’জনই দোকানের বাইরে বেরিয়ে এল ৷ রাস্তার পাশেই মুস্তাকের পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান ৷ প্রতিদিন নিয়ম করে সিগারেট টানার অভ্যাস অমিতের ৷ প্রহ্লাকে জিঞ্জেস করল ‘সিগারেট টানিস’ ? ‘নাহ্ ... সেরকম অভ্যাস নেই, তবে তুই যখন বলছিস... চলবে’ ৷
পানের দোকানের সামনে সুতোয় বাঁধা ঝুলতে থাকা গ্যাস লাইটারে দু’জনেই সিগারেট ধরাল । এরই মধ্যে বাজারে খুব চিৎকার-চেঁচামেচিঁ শোনা গেল সাথে কয়েকটা কুকুরও তাল মিলিয়েছে ৷ হঠাৎ দেখল একটা লোক, কয়েকটা কুকুরকে সমানে ধাওয়া করছে লাঠি নিয়ে ৷ সেই লোকটার পেছনে আরও চার-পাঁচটা কুকুর ও কয়েকটা ছোট ছোট ছেলে দৌড়াচ্ছে ৷ এমনটা নাকি অনেকক্ষণ ধরেই চলছে । গরমের মধ্যে মোটা জিন্সের জামা, কালো নোংরা প্যান্ট, মাথায় কালো কাপড় দিয়ে পেঁচানো পাগড়ির মত, দু’টো ঝোলা একটা বড় ব্যাগ লাঠির মধ্যে গোঁজা, ঘাড়ে নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে ক্লান্ত মনে হল লোকটাকে । হাঁফাতে হাঁফাতে সে পানের দোকানের সামনে এসে দাড়াল ৷ বোঝাই যাচ্ছে , ঘাড়ের ব্যাগগুলো খুব ভারী ৷ ইশারায় লোকটা একটা বিড়ি চাইল মুস্তাকের কাছে । বিড়ি পেয়েই লোকটা সেখান থেকে চলে গেল ৷ অমিত মুস্তাকের কাছে জানতে চাইল লোকটার সম্পর্কে । মুস্তাকের কথায় লোকটা নাকি কয়েকদিন থেকেই ঘোরাঘুরি করছে কিন্তু তার সম্পর্কে কেউ বিশেষ কিছু জানে না । সবার কাছেই লোকটা নাকি একটা পাগল । সময় মত বাসটা সামনে এসে দাড়তেই, প্রহ্লাদকে ‘আবার দেখা হবে’ বলে উঠে পড়ল গাড়িতে ৷
শুক্রবারে সাড়ে বারোটায় টিফিন হয়ে যায় স্কুলে । এই দেড় ঘন্টা সময় যেন সহজে কাটতে চায়না । স্কুলের টিচার্রস রুমে সব মাস্টার মশাই’রা নিজ নিজ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনায় ব্যাস্ত । কমন রুমটার একপাশে একা বসে ‘দেশ’ পত্রিকা নিয়ে ঘাটাঘাটা করছিল অমিত । স্কুলের আরেক মাস্টার মশায় গৌর বাবু অমিতকে একা বসে থাকতে দেখে ‘হ্যলো... মিঃ অমিত সেন, একা একা কী করছ ?’_ ‘এইতো! একটু পত্রিকাটা দেখছি...।’
পত্রিকায় একতা গল্প পড়তে পড়তে সকালের সেই ‘ক্ষ্যাপা’ লোকটার কথা মনে পড়ে গেল । লোকটাকে ছেলেরা পাগল বলে । কেন, জন্ম থেকেতো কেউ পাগল হয়না ! কত কারণেই তো মানুষের মানিসিক ভারসাম্য হারিয়ে যায় ! ভাবছিল অমিত লোক্তার নাম কি ? তার অতীত কি ? অমিত জানে সে কিছুই করতে পারবেনা , তবু ভাবে । লোকটার মধ্যে তার ছেঁড়া অপিস্কার পোশাকের মধ্যে মুখে একটা ঔজ্বল্য দেখেছে অমিত । অমিত নিশ্চিত লোকটা রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো শিজড় হীন ভ্যাগাবন্ড নয় । লোকটার রহস্যময় ব্যাগ গুলো সম্পর্কে একটা কৌতুহল জন্মাল অমিতের মনের মধ্যে । এর পর কোনও দিন লোকটার সঙ্গে যদি দেখা হয় তাহলে সেই রহস্যময় ব্যাগ গুলোর কথা জিঞ্জেস করবে আর তাড় অতীত জানবার চেষ্টা করবে । এই সব ভাবনার মধ্যেই ক্লাসের ঘন্টা বেজে উঠল । অমিত পত্রিকাটা নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে ক্লাস নাইনের ঘরে ঢুকে পড়ল ।
আরো প্রায় বছর খানেক কেটে গেছে । মাঝে মাঝেই লোকটাকে বাজারে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে অমিত অথচ লোকটার সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা হয় নি । সেই আগের মতই চেহারা, একই রকম পোশাক শুধু পরিবর্তন বলতে কালো পাগড়ির বদলে নীল রঙের ময়লা একটা টুপি । টুপিটার সামনের দিকে হাত দিয়ে কোনরকমে সেলাই করা একটা স্টীকার, সেখানে বড় বড় অক্ষরে ‘কাস্টম’ লেখা ।
মুস্তাকের দোকানে অনেকবার মুখোমুখি হয়েছে অমিত, কয়েকবার পয়সা দেবারও চেষ্টা করেছিল কিন্তু কখনই নেয় নি । লোকটার চাহিদায় শুধুমাত্র একটা বিড়ি এবং সেটা পেলেই সে খুশি । কয়েকদিন থেকেই মুস্তাক একটা আবেদন পত্র লিখে দেবার জন্য অমিত’কে অনুরোধ করছিল । পড়াশুনো না জানা মুস্তাকের সেই আবেদন পত্র লিখবার জন্য অমিত স্কুল থেকে ফেরার পথে দোকানের বেঞ্চে বসে একটা সাদা কাগজে আবেদন পত্র লিখছিল । লোকটা বোধয় একটা বিড়ির আশায় পাশে এসে দাড়ালো । অমিত খেয়াল করলো লোকটা অমিতের লেখাটা দেখছিল – লেখার অক্করগুলোর ওপরে তার চোখ । নজরে পড়তেই অমিত জিজ্ঞেস করল ‘আপনি লিখতে পারেন ?’ লোকটা মাথা নাড়াল, কোন শব্দ না করেই অমিতের কাছ থেকে কলমটা চেয়ে নিল । অমিত আশেপাশে কোনও সাদা কাগজ না পেয়ে নিজের ব্যাগ থেকে ডাইরিটা বের করে, শেষ পৃষ্টায় লিখবার জন্য এগিয়ে দিল লোকটার সামনে । কাছাকাছি থাকা কয়েকজন ভীড় জমাল দোকানের সামনে , যেন কি মজার ব্যাপার , পাগল বলে ক্ষ্যাপানো লোকটা লিখছে । বিস্ময় তাদের চোখে মুখে । মুস্তাকের দোকানে বিড়ি চাওয়া লোকটা স্পস্ট গোটা গোটা অক্ষরে অমিতের ডায়রির পাতাতে ইংরাজিতে নিজের নামতা লিখলো হীরা চন্দ্র রায় , কেষ্টপুর । এবার বিস্ময়ের পালা অমিতের । কেষ্টপুর তো তার বাল্যের গ্রাম । ওখানেই অমিত ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে । অমিত স্মৃতি হাতড়াতে থাকে । অনেকদিন গ্রাম ছেড়েছে অমিত, তা প্রায় ৩০ বছর হবে । লোকটার মুখে একটা হাসির রেখা । মুস্তাককে দরখাস্তটা দিয়ে ঘরের দিকে হাঁটা লাগলো অমিত । তখনো তার ভাবনার মধ্যে লোকটা । হীরা চন্দ্র রায় । অমিত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় , এবার গরমের ছুটিতে তার পুরানো গ্রাম কেষ্টপুরে যাবে , হীরা চন্দ্র রায়ের অতীত সন্ধান করবে ।
----