গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১২

সাদিক সাকলায়েন


বৃষ্টিআগন্তুক আর ক’টা সিগারেট


     গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। এতোটা রাস্তা হেঁটে গেলে নির্ঘাত কাকভেজা হয়ে বাসায় বাসায় ঢুকতে হবে। আর আমার যা ঠাণ্ডার সমস্যা এতে দুদিন আর বিছানা থেকে উঠতে হবে না। দ্রুত পায়ে হেঁটে একটা বন্ধ দোকানের সামনে টিনের চাল বাড়ানো ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। দোকানটার জরাজীর্ণ অবস্থা। এপথে নিয়মিত যাওয়া আসা করি কিন্তু কোনোদিন খুলতে দেখিনি। রাস্তার ওপাশের বাড়িটা একসময় প্রাইভেট ক্লিনিক ছিলো। এখন শুধু সাইনবোর্ডটা আছে। ডাক্তারও নেই, রোগীও নেই। সন্ধ্যা প্রায় শেষের দিকে। একটা ভেজা রিকশাওলা গামছার একপ্রান্ত মুখে ধরে অন্যপ্রান্ত ডান হাত দিয়ে চিপতে চিপতে যাত্রী নিয়ে চলে গেলো। আশেপাশে আর কোনো মানুষ চোখে পড়ছে না। আমি আনমনে রাস্তার পাশের গাছগুলোর ওপর বৃষ্টি পড়ার দৃশ্য দেখছি। পাঁচ-সাত মিনিট হবে- কি, বৃষ্টি খুব ভালো লাগে? নীরবতার মধ্যে হঠাৎ করে মানুষের গম্ভীর কণ্ঠ শুনে চমকে গেলাম। অপ্রস্তুত হয়ে কোনো কথা বললাম না, শুধু লোকটার আপাদমস্তক দেখে নিলাম। পঁয়তাল্লিশের মতো বয়স হবে, মাথার চুল অর্ধেক পা আর ঠোঁটের ওপর পুরু সাদাকালো গোঁফ। পোশাকেআষাকে ভদ্রলোকই মনে হচ্ছে। ততক্ষণে লোকটা নিজের ঠোঁটে একটা সিগারেট চাপিয়ে আমার দিকে পাইনের প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়েছেন। আমি একটু ইতস্তত বোধ করলাম, উনি বললেন অভ্যাস থাকলে নিতে পারো, সমস্যা নেই। আমি একটা সিগারেট বের করে মুখে লাগালাম। উনি জ্বলন্ত লাইটার দিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ ঘটালেন। ভালোই হলো, একটা সঙ্গী পাওয়া গেলো আর সাথে একটু সুখটানের ব্যাবস্থাও। - বৃষ্টি খুব ভালো লাগে, তাই না? উনি আবার একথা জিজ্ঞেস করলেন। এই প্রথম আমি মুখ খুললাম। বললাম, বৃষ্টি কার না ভালো লাগে! উনি বললেন, খুব ভালো লাগে? আমি বললাম, মোটামুটি, একটু আগে ভালো লাগছিলো না কিন্তু এখানে দাঁড়ানর পর ভালোই লাগছিলো গাছের ওপর, রাস্তার ওপর বৃষ্টি পড়তে দেখে। উনি বললেন, জীবনে কবার বৃষ্টি দেখেছো? –অদ্ভুত প্রশ্ন! এটা কেউ বলতে পারে নাকি? এটা তো কোনো বিশেষ ঘটনা নয়, হিসেব করার, মনে রাখার মতো কোনো বিষয়ও নয় এটা। লোকটা বললো, ঠিক, মানুষের জীবনে কতোগুলো আনন্দও, কতোগুলো দুঃখ আছে যেগুলো যখনতখন পাওয়া যায় বলে মানুষ মনে রাখে না, কিন্তু কারো জীবনের তীব্র আনন্দ, তীব্র দুঃখে মানুষ সবচেয়ে বেশি আলোড়িত হয়, অথচ এ ছোটোছোটো আনন্দ আর দুঃখগুলোকে যদি এক করা যায় তাহলে ওগুলোর চেয়ে ছোটোগুলোর যোগফল অনেক বেশি, অনেক ভারী। কথাটা ভালো লাগলো। লোকটাকে পরিচয় জিজ্ঞেস করবো তার আগেই তিনি বললেন- ঐ ক্লিনিকটা বন্ধ কেনো জানো? আমি বললাম, না, তবে একটু আগে ভাবছিলাম। উনি বললেন তাহলে তোমাকে একটা গল্প বলি, শোনো-

          আমার এক বন্ধু ছিলো। আলতাফ। কলেজে একসাথে পড়তাম। খুব রসিক ছিলো। কথায় কথায় মানুষকে হাসাতো কিন্তু নিজে কখনো হাসতো না। ইন্টারমিডিয়েটের পর যে যেখানে চলে গিয়েছিলাম। তো অনেক বছর পর একদিন কষ্ট করে ওর ফোন নাম্বারটা জোগাড় করলাম। সেদিন সন্ধ্যায় কথা হলো ওর সাথে। অনেক কথার পর জিজ্ঞেস করলাম, কিরে কি করছিলিস? আলতাফ মনেহয় শুয়ে ছিলো। উঠে বসতে বসতে বললো, টিভি দেখছিলাম। আমি বললাম, কোন চ্যানেল, কিসের অনুষ্ঠান? আলতাফ বললো, চ্যানেলও না, অনুষ্ঠানও না। -তাহলে ? আলতাফ গম্ভীর হয়ে বললো ইলেক্ট্রিসিটি নেই, টিভি দেখার ইচ্ছে হলো তাই মোমবাতি জ্বালিয়ে টিভিস্ক্রিনে মোমের শিখার কম্পন দেখছি কয়েক সেকেন্ড চুপথেকে আমি দৃশটা কল্পনা করে হো হো করে হেসে উঠলাম। তারপর আরও কিছু কথা হলো। ওর ব্যাপারে অনেককিছু জিজ্ঞেস করলাম। শুনলাম বিয়ে করেছে, একটা মেয়েও আছে, স্কুলে যায়। কিন্তু স্বভাববশত সে আমাকে আমার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। আমিও আর কথা বাড়ালাম না। সেদিনের পর অনেকদিন আমার আর কথা হয়নি ওর সাথে।

          আমি তখন এই ক্লিনিকটার মালিক। অনেক ভেবেচিন্তে নাম ঠিক করেছিলাম সেবাশুধু ব্যাবসাই নয় মানুষের সেবাও হবে এখানে। ক্লিনিকটা ভালোই চলতো। আমি নিজে প্রতিদিন এর দেখাশোনা করতাম। তো একবার একটা ট্যুরে গেলাম দেশের বাইরে। ফিরে এসে শুনলাম একটা ঘটনা। - ওহ সিগারেট শেষ হয়ে গেছে, নাও আরেকটা জ্বালাও। আমি একটা সিগারেট ধরালাম, উনিও, তারপর আবার বলা শুরু করলেন-

          একটা লোক তার মেয়েকে আমার এই ক্লিনিকে ভর্তি করিয়েছিলো। মেয়েটার হার্টে সমস্যা। অপারেশন করাতে হবে কিন্তু তার জন্য ব্যয় হবে কয়েক লাখ টাকা। লোকটার এতো টাকা দেবার মতো সামর্থ্য ছিলো না। আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলো ছাড়ের জন্য, কিন্তু আমি দেশে না থাকায় সম্ভব হয়নি। মেয়ের কষ্ট দেখে, মেয়ের জীবন বাঁচানোর জন্যে কোনো উপায় না দেখে লোকটা তার একটা কিডনি বিক্রি করে দেয়। এরপর অপারেশনে তার মেয়ে সুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু রিলিজের দিন আরও কিছু টাকা বাকি পড়ে যায়। নিরুপায় লোকটা ক্লিনিকেরই এক কর্মচারীর কাছে তার মুঠোফোন বিক্রি করে বাকি টাকা শোধ করে মেয়েকে নিয়ে যায়। পরে খোঁজ নিয়ে দেখি এই লোক আর কেউ নয়, আমার বন্ধু আলতাফ। খুব আঘাত পেলাম। এরপর আলতাফকে অনেক খুঁজেছি ওর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্যে, কিন্তু ওর ফোন তো বন্ধ। আলতাফকে পেলাম না। একটা অপরাধবোধে ভুগতে ভুগতে শেষ পর্যন্ত ক্লিনিকটা বন্ধই করে দিলাম।

          কথাগুলো বলে তিনি উদাস হয়ে সিগারেট টানছিলেন আর মুখভর্তি ধোঁয়া ছাড়ছিলেন। আমি চুপ করে কিছু ভাবছিলাম। এমন সময় একটা প্রাইভেট কার এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালো। লোকটা আমাকে বললো- ভালো থেকো, চলি। বলেই তিনি গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। ততক্ষণে চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। বৃষ্টিও ধরে এসেছে। আমি বাড়ির পথে হাটা শুরু করলাম। হাতের সিগারেটটাতে শেষ টান দিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে দিলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমার মাথায় তখন কতোগুলো দৃশ্য, কতোগুলো কথা ঘুরপাক করছিলো আমার অনেক ছোটো ছোটো কষ্টের কথা মনে পড়লো। যে কষ্টটাকে অনেক বড়ো কষ্ট দেখে সিগারেট ধরেছিলাম, ছোটো কষ্টগুলোর সম্মিলনের কাছে ওটা সামান্য হয়ে দাঁড়ালো। আমি জীবনে কতোগুলো সিগারেট টেনেছি? জানি না। এসবের কথা কেউ মনে রাখে না।